স্বেচ্ছা নির্বাসন
এমন এলোমেলো স্বেচ্ছার এই নির্বাসনে
কেউ নেই, কোথাও পড়ে নেই স্পর্শ, মায়া
সময়ের বাঁকে বাঁকে।
এমন দুর্বিনীত ভাগ্যরেখা নিয়ে
কোথায় যাব, কতদূর?
ঈশ্বর আমাকে ছেড়ে গেছে বহুকাল।
এত বয়স পেরিয়ে এসেছি
ভাসতে ভাসতে, জলে-শ্যাওলায়,
যদি খুঁজে পাও বিকেলে-জোয়ারে
দেখবে দারুণ সাজানো গোছানো উপরিতলে
তোমাদের ভিড়ে মিশে আছি, একাকি
বড় অগোছালো, টলোমলো তার ভেতরে।
তোমরা সেখানে পৌঁছাতে পারবে না।
অদ্ভুত অচেনা বিষাক্ত সবুজ মাঠে
আর কালো মেঘের জলে
অভিশপ্ত মুখ দেখি নিজের, যেখানে
মৃতপ্রায় নিসর্গ আর রুগ্ন নদীতে জল নেই
জলের তৃষ্ণায় কাঁদে ফসলের মাঠ, শস্য
সেখানে, ত্রস্ত পায়ে বিস্তৃত দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে দেখি
কতটা পথ পাড়ি দিয়ে এলাম
অভিশাপের হাত ধরে!
নিশানা
আমাদের নিশানার মধ্যে
এগিয়ে আসছে নতুন দিন
দূর মেঘমল্লার আর
তুমুল হাওয়ায়
আমাদের পাহাড়ি নদীতে
আমাদের বাড়ির গায়ে
আলো এসে পড়েছে।
আমাদের বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছোট নৌকা
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে
জনমানবহীন, লোকালয়হীন প্রান্তরে
গাছেদের কথা, ছায়াদের কথা, আমাদের কথা
নিঃশব্দে লেখা হচ্ছে
গাঢ়, নিস্তব্ধ চাঁদের আলোয়।
আমাদের চোখ ভর্তি স্বপ্ন, মায়া—
আমাদের শরীরে গভীর মন্থন চলে
আর মহাকালের হাত ধরে
প্রদক্ষিণ চলে নিজেদের ঘিরে
সকলের অগোচরে।
আমাদের সুবিন্যস্ত প্রেম,
অনুভূতি, আসঙ্গলিপ্সায়
কোমল ঘুমে স্বপ্ন দেখতে দেখতে
আমরা পৌঁছে যাই মৈথুন দৃশ্যে।
পাণ্ডুলিপি
পাণ্ডুলিপির শরীরে হাত বোলাতে বোলাতে
যেনো খোয়াব দেখি
শতাব্দীর অভিনিবেশ নিয়ে।
দোতলা বাড়িটা ভিজছে ঝুম বৃষ্টিতে
মেঘপ্রবাহ ভেসে যাচ্ছে
জানালার কাঁচ থেকে সুদূরে
মিহি শব্দে ভেসে আসছে
গজলের সুর!
মুখ তুলে জানতে চাইলে,
কার গজল জানেন?
বললাম, কার
আপনার দুঃখের নিকটে এনে ফেলে যে
দুমড়ে মুচড়ে কামনা বাসনার চিৎকারে-
অস্ফুটে বললাম, কি জানি!
এই মৃত শহরের মানুষ ফিরে গেছে
নিজ নিজ গৃহে
অধিকাংশই ভুলে গেছে
অন্যের কথা শুনতে।
পাণ্ডুলিপির শরীর জুড়ে বিলাপ
অন্ধকার কালো প্রহেলিকায়
আশ্চর্য নীরব পাঠক!
বাইশ বছর
আমাদের পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা দেখার স্মৃতি মনে নেই
দূর বা নিকট স্মৃতি
বাইশ বছর আগের স্মৃতি
পাথরে খোদাই করেনি কেউ
আজ অক্ষর, নম্বর দূর স্মৃতির নিয়ন্ত্রণে।
আমাদের চিনতো সকলে
বিকেলে সিঁড়িতে, অথবা চিলেকোঠার ছাদে
বিনুর মায়ের বিধবা হওয়ার ঘটনা শুনতে শুনতে
চোখের জলে বুক ভেসে যেতো
মাখানো মুড়ি মিইয়ে যেতো
খাওয়ার কথা মনে থাকতো না কারো।
ছয় ইঞ্চি চওয়া আর ছয় ফুট লম্বা কাঠের বেঞ্চিটায় পা দুলিয়ে গল্পে অল্পে ফিরে আসতো
উৎসবের সমাবেশ। উচ্ছ্বল উজ্জ্বল দিন।
কোনোদিন সারা বিকাল জুড়ে বৃষ্টি নামতো
দূরে স্টেশন মাস্টারের সাইরেন শোনা যেতো বৃষ্টি ভেদ করে।
বৃষ্টি ধরে এলে—
বেঞ্চিটায় বসে রাজনীতি, অর্থনীতির তর্ক থামতো ভূতের গল্পে
মুণ্ডু কাটা শরীরটা হেঁটে যাচ্ছে উলটা পায়ে
বুক পিঠ শরীর বেয়ে রক্ত নেমে যাচ্ছে ছাদে।
বাইশ বছর পর চমক লাগে না কোনোটাতে
পৃথিবীটা যেনো খুচরো আধুলী
প্রকৃতির রঙ, বেরঙ একই
বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙ্গে
অথবা শীত শীত গন্ধ নাকে এসে লাগে
কেবল রক্ত জাগে না
আমরা জীবন হারিয়ে ফেলেছি।
রাত্রি
রাত্রে জ্বরের ঘোরে
তুমি যখন ঘুমাইয়া থাকো
বালিশে মাথা দিয়া
চাদর জড়াইয়া
আমি আইসা বসি তোমার শিয়রে
ওষুধ খাইয়া তুমি ঘুমাইয়া থাকো।
তোমার মুখের দিকে তাকাইয়া থাকি
মানুষের ঘুমন্ত মুখ শিশুর মতো দেখায়, পবিত্র!
মাথা ঝুঁকাইয়া নিকটবর্তী হইলে
দেখতে পাই তোমার মন বেদনাকাতর
যেমন দেখতে পায় তা তোমার ছায়া।
তোমারে প্রতিদিন উজ্জ্বল আর ছন্দময় যেনো দেখায়
মনে মনে তোমার জন্য লাল ঘুড়ি বানাই
কাঁঠালিচাঁপার মালা গাঁথি
ঘুমের মধ্যে বেদনায় কুঁকড়াইয়া যাও যখন
আঁচল বিছাইয়া দেই সারা গায়ে
দুই হাতে জড়াইয়া নাও তখন
তুমি তো আমারে দেখতে পাও না
আমি দেখি বেদনার দাগ মুছতেছে
ধীরে ধীরে।
এতখানি জীবনে তোমারে দেখতেছি
নির্বিকার, নিশ্চুপ
নিরালোকে একা একা হাঁইটা যাও
লোকচক্ষুর আড়ালে
তুমি কিছুতে বদলাইলা না।
ফেরদৌস আরা রুমী
ফেরদৌস আরা রুমীর জন্ম ঢাকায়। পড়শোনা করেছেন অর্থনীতিতে। বর্তমানে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ
বড় মানুষের ছোট ছোট কথা (সাক্ষাৎকারভিত্তিক গ্রন্থ)
কবিতার বই :
আমি কারো সঙ্গে কথা বলছিলাম; আম্মার বাগান; ছাতিমের গন্ধভরা বিক্ষত সন্ধ্যায়