সকাল
তোমাকে ভাবিই না আমি
আমার রান্নাবাটির ফাঁকে,
কালেভদ্রে মনে পড়ে তোমায়
আমার ফেলে আসা মফস্বলে
তুমি তো সেই থিতু হয়ে থাকা জলা।
চুপচাপ বিড়ালের মত গুটিশুটি বসে আছো।
দুনিয়া যখন ঢুকে যায় সকালের আলসে ঘুমে,
সংসার সংসার খেলতে খেলতে
আমি যেন এক মুঠো ধান হাতে নিই।
ওরা আমার উনুনে সাদা খই হয়ে ফুটতে চায়।
কখন যে কুয়াশা কেটে রোদ উঠলো
আজ সকাল শুরু হলো ঠিক পৌনে এগারোটায়।
এই নরম রোদ্দুরে কী আহ্লাদে আছি তোমাকে সম্বোধনে।
অথচ সংস্পর্শের দিক থেকে সবচেয়ে দূরে আছি।
তোমাকে দূর থেকে দেখতেই ভালো লাগে
আমার একান্ত ব্যক্তিগত দেবতা তুমি।
এই যে যোজন যোজন দূরত্বে আছি,
তার প্রতি ইঞ্চিতেই কী এক হুহু করা আদর।
আমার কেবল সম্পর্কের উর্ধ্বে উঠে
এই হুহু করা নিয়ে ভাবা লাগে।
কী আদর দাও, তুমি!
আমি একটু একটু করে সেই জলায় নামি!
দুপুর
একেকটা আলাপ
এত বেশি জাপ্টানি হয়!
মনে হয় যেন শরীরের মধ্যে শরীর হয়ে লেগে ছিল,
সাড়ে পাঁচ হাজার বছর।
মফস্বল থেকে রাজধানীতে আসা
সদ্য গোঁফ গজানো কিশোরের মতো
সে, ইতঃস্তত ঘুরে বেড়ায়।
লোকে দেখে একা।
অথচ, শহুরে ড্রেনজলের নোংরায়
বাসের ভীড়ে,
ছেঁড়া স্যান্ডেল সামলে কিশোর বাঁচায়
তার আরেক শরীরকে।
নিয়ন আলো গিলে নেয়
খাপছাড়া শহুরে সবুজ।
দুপুরের চড়া রোদে,
ফুটপাতে হাঁটতে থাকে
জবুথবু চপ্পল।
জাপ্টানি শরীরের মায়ায় নুয়ে পড়া কিশোর,
তুমি তো জানো
কতখানি অভিমানে
শিউলিগুলো
দুঃখফুল হয়ে গন্ধ ছড়ায়
এই কদাকার শহরে।
বিকাল
এই যে বসন্তের পড়ন্ত দুপুরে
স্বর্ণচাপার মৃদু গন্ধ মাখানো তেরছা রোদ
জানালা গলিয়ে এসে জমেছে ফুলতোলা বিছানায়
জমেছে আমার প্রাচীন কায়ায়।
এই রোদে হয়তো একদিন
হাঁটতে হাঁটতে ইস্টিশনের দিকে গিয়েছিলাম
তুমি বিষণ্ণ মনে, তোমার বুক খামচে ধরার গল্প বলেছিলে সেদিন
কি এক খামতি ভাবের কথা বলছিলে যেন।
তোমার বিষণ্ণতাকে মনে হয়েছিল তুঁত গাছের পাতা,
পলুপোকা হয়ে সে বিষণ্ণতা খেয়ে
বানিয়ে দিয়েছিলাম সহস্র রেশম পোশাক।
নরম রোদের সেই সে আকাশ নুয়ে ছিলো আমাদের দিকে।
শাঁ করে ট্রেন চলে যাওয়ায় হুট করেই নিঝ্ঝুম হয়ে গিয়েছিল ইস্টিশন।
তারপর—
তোমার কোমল রেশম পোশাকের গায়ে
সোনাঝরা রোদ মেতেছিলো রঙের খেলায়,
অনেক কাল আগে, ঠিক এমন এক বসন্তের বিকেলে
তুমি আমার গায়ে খুঁজেছিলে
সেই সে আদিম ঘ্রাণ
আজ যেই সোনালো ছুঁয়েছে আমার শয্যায়
এই দুপুরের পড়ন্ত বেলায়,
সেই একই আলো একদিন ছুঁয়েছিল— আমাদের মাটির দাওয়ায়।
আমাদের অপার্থিব নিমগ্নতায়।
সন্ধ্যা
সুবেহ-সাদিক থেকে সূর্যাস্ত
অসহিষ্ণু; অথচ সংযমে আছি
বেলা তো থেকে থেকে বাড়ন্ত
আমি- কী জানি, কিসে যে বাঁচি!
সেইসব তীর্যক কথার চেয়ে
নিজের তির্যক ছায়া
ঢের ভালো
বেলা বরং ডুবেই যাক
পাখিরা ফিরুক,
পথ যতই এলোমেলো।
আমায় ভীষণ করে
সেইসব দিনে ‘ধরে’
যেইসব দিনকে লোকে
‘রোজা’ বলে ডাকে
আমি কিন্তু তুমুল করে
উদযাপন করি তারে
কেননা, সংযমেও,
উৎসব আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকে।
রাত
আজকে কি হলো, জানো?
একগাদা কাজ সেরে,
ধুয়ে, খেয়ে, নেয়ে,
ভাবতে বসলাম তোমায়।
মানুষের মন, অথবা মানুষের শরীর—
এর মধ্যে ঘড়ি আছে, জানো?
এই একই সময় সে জানান দেয়
তোমার কথা।
ওহ, সেই ছবিটা,
আগেই দেখাচ্ছিলাম যেই ছবিটা,
মনে আছে?
একটা সপ্তপর্ণা।
আচ্ছা, ছাতিমের নাম কি করে সপ্তপর্ণা হলো,
সেই গল্পটা,
মনে আছে?
চারুকলার সেই ছাতিমের গল্প,
মনে আছে, তোমার?
একদিন এক দুঃখফুল ফোটা রাতে
হেঁটেছিলাম সেই রাস্তায়
একটা সপ্তপর্ণ এসে পড়ল আমার পায়ে
তুলে নিয়ে এলাম।
যত্নেই ছিল।
কিন্তু সময়ে কিসব যে হয়!
সেই সাতপাতার সেই জৌলুশ আর নেই, গো!
তবুও শুকনা স্পাইরাল সেই পাতায়
কেমন একটা আদর আছে।
কেমন একটা আরাম আছে।
আমাদের আমাদেরত্বেও
জৌলুশ তো ছিল না কোনকালে
তবুও এই সময়ে;
এই ক্লান্তিতে;
এই আচ্ছন্নে;
কেমন একটা আদর আরাম আছে,
স্পাইরাল সপ্তপর্ণ হয়ে সে কেমন করে
আঁকড়ে রাখে আমায়।
ফারজিনা মালেক স্নিগ্ধা
জন্ম ১৯৮৩ সালে জানুয়ারির দশে। জীবনের প্রথম আঠারো বছর পুরোটাই ময়মনসিংহে। স্কুল আর কলেজ। পরে, জাহাঙ্গীরনগরে অনার্স মাস্টার্স। জার্মানির হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি থেকেও মাস্টার্স করেন তিনি। পরে বাংলাদেশে বিভিন্ন এনজিও-তে কাজ করেন প্রায় সাত বছর। দুই হাজার সতেরো সালে পিএইচডি শুরু করেন অস্ট্রেলিয়ার ব্রিজবেনে। শেষ করে একই শহরে ব্লুকেয়ার নামের একটি কমুইনিটি সংস্থায় কাজ করছেন।