সময়ের ঘুম
একটা কপট যুদ্ধবিধ্বস্ত স্তূপের পাশে ঘুমিয়ে আছে সময়। শেয়ালের চিৎকারে ভেঙে যাচ্ছে বেলজিয়াম গ্লাস। যোনি থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত-আলতা পরে হেঁটে যাচ্ছে কেউ কারো বুকের ওপর দিয়ে। কাটা চিবুক স্পর্শ করে দিচ্ছে শকুন। রাত চিরে দু’টুকরা হচ্ছে আপনাতে। কুয়োতলায় প্রবল অক্সিজেনে মারা যাচ্ছে সাপ। স্বপ্নে কী দেখে মুচকি হেসে পাশ ফিরে শোয় সময়!
নাম
কোথাও মেঘ জমলে, আত্মহত্যা করে তোর দেয়া সমস্ত ডাকনাম। চলে যেতে যেতে, এঁকে দেয়া নাম নিয়ে যায় সে।
যে-নামে ডাকত তাকে হিজলের বন, সে খামে পদ্ম ঝরে যেত হাওয়ায়। একলা নদীপাড়ে এসে দাঁড়ালে দোপাটি, ঘুমিয়ে থাকাকালে পৃথিবীর সমস্ত সত্য মিথ্যে বলে মনে হয়। কুয়াশা মুছে যাচ্ছে চোখ হতে। কেবল আগাছায় ডুবে আছে গোলাপের ঝাড়। একটা শিউলি ঝরে যেতে গিয়ে কেবল ভুলে যাচ্ছে নাম।
চকোলেট
কারো না-আসা চিঠির নাম চকোলেট। চকোলেট আশলে বাগানভর্তি সফেদা, এই ফেটে যাবে, ফেটে যাবে করছে! বালিকা-ভোলানো চকোলেট উঠে গেছে মহাকাশ হতে। তোর চোখ আদি ও অকৃত্রিম চকোলেট ফল!
তোমার ভুলে না দেয়া চকোলেট এপিটাফে রেখে এসো।
দুই নদী
একটা শান্ত নদী। পা ডুবিয়ে সন্ধে নামে তাতে। মাছরাঙা মুখ দেখে সেখানে। তারপর চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। তার আরও আগে, হাঁস পা ধুয়ে যায়, এত বড়ো চোখ মেয়ে চোখ মুছে যায়। একটা শান্ত নদী। বাতাস পাতা উড়িয়ে এনে ফেলে তাতে। পাতাটা কিছুক্ষণ তিরতির করে কাঁপে। তারপর অভ্যস্ত হলে খেয়ালে ভেসে যায়। একটা শান্ত নদী। হাত দিলে স্থির থাকে। পাতা সরে পথ করে দেয়। মাছরাঙার মুখ হাতে বা পাতায় দেখা যায়। কারো মুখ টিপে হাসার শব্দ শোনা যায়। একটা শান্ত নদী! আমি তাকে দেখেছি।
একটা উত্তাল নদী। মাছরাঙার মুখ ভেঙে ভেঙে যায়। তা দেখে বড়ো চোখ মেয়ের হাসি বাতাস বয়ে নেয়। সেই চোখ ভেঙে যায় হাসির সঙ্গে সঙ্গে। একটা পাতা ঘূর্ণিতে আটকা পড়ে, যেন ফ্রক ছড়িয়ে দিয়ে ঘুরছে কেউ। হাঁসের পায়ের লাল ছড়িয়ে যাচ্ছে। বাতাসের হাহাকার বয়ে যায় অতলে। কারো হাসির শব্দ চাপা পড়ে যায়। একটা উত্তাল নদী! আমি তাকে দেখব বলে বেঁচে আছি।
ঊনমানুষের জীবন
তোমাদের বাড়ির উঠোনে, আমপাতার ফাঁক ফোঁকর গলে যে রোদে মাটি ভিজে যায়, তার ছায়ায় বসতে দিও। সোনামুখী সুঁই হারিয়ে যাওয়ার গল্প শেষ হওয়ার আগেই রাত নেমে আসলে, তুমি উঠে যেয়ো। আমি চলে যাব নদীর দিকে। কোনো দানো-টানো এখন আর থাকে না ওখানে। বরং কোনো কোনো ঘরের বউ ঝিকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে নদীর পেটে।
একটা ঊনমানুষের জীবন পার করতে করতে আমার জানা হয়ে যায় পৃথিবীর সমস্ত শ্মশান আর কবরের কথা। যেহেতু তুমি কখনো ডেকে ফেরাবে না, এবং জীবনের মানে খুব অদ্ভুতভাবে নির্লিপ্ত এখানে, একটা কেঁচোর জীবন পার করার ভাবনা ভাবা যায়। ঊনমানুষ আমি, স্মৃতি থেকে মুছে যাচ্ছে জগতের সকল কেঁচো!
তৌফিকা নাসরিন
ফেনী, ৮ জুন
পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাকোত্তোর, একই বিষয়ে এম.ফিল করার পর বর্তমানে পিএইচডি করছেন।
প্রকাশিত বই: গলে পড়ছে সবুজ আকাশ (২০২৪, চন্দ্রবিন্দু)