বিকেল অশ্রুতসুরে
কথা হলো, ‘ক্লান্ত হওয়া যাবে না’,
বেঁচে থাকার অদ্ভুত কৌশল।
আকাশের পাশাপাশি বসে,
মাটি ও মহর গোনা যায়,
কার কাছে কী দামি কেউ জানে না!
জানালার এ-পাড়ে মটরশুঁটি খেত,
কিনারায় বসে থাকে কারও শৈশব,
সুতো কেটে যাওয়া কোনও
ঘুড়ির দুঃখ, সেসব কথা অশ্রুত;
রহস্যময় সন্ধ্যার মতো!
কেউ হেঁটে গেছে অনির্ণেয় পথ—
হারিয়ে যাওয়া মুখের কথা ভেবে,
ভেসে গেছে কুয়াশারেণু যার যার
একার বাতাসে!
আকাশ-পৃথিবী থেকে কত দূরে
মানুষের পা যায়? ফাল্গুনে
আবারও এরোপ্লেন ঘোরে
মাথার ওপরে—সময় ও মৃত্যুর
দূরত্ব মাপা হয় না কোনও দিন!
কথা ছিল, ক্লান্ত হওয়া যাবে না,
লোক দেখানো শহর ছেড়ে,
মাইল মাইল রোদ—এখনো
কোথাও ফোটে মাটির বাঁশির সুরে—
জেগে থাকে ফিলিস্তিন
রঙিন কাগজ, প্লাস্টিক ঠোঁটের বাহবা নিয়ে
সেই পুরোনো রাস্তাতেই হাঁটছেন, এখনো,
জেনেও জানবেন না বলে স্থির করেছেন,
বিবিধ প্রলোভনে, আরোপিত প্রয়োজনে;
ডুবে গেলে—জন্মের উদ্দেশ্য ঝুলে থাকে
জানালার গ্রিলে কাগজের পাখির মতোন!
”যা আসে নিজেই আসে”, “নিজ থেকে আসে না কিছু”
প্রতিটি যুক্তির নেপথ্যে ক্লান্ত হয় মন।
খাবারের জন্য সাগরে ঝাঁপ দিচ্ছে ক্ষুধার্ত কেউ!
আপাত নিশ্চিন্ত ঘরে ঘুমাতে যান, পৃথিবীর
কোথাও জেগে থাকে অনিশ্চিত মানুষ ও
ফিলিস্তিন—
পাহাড় অথবা ধুলো
মানুষ হিসেবে তুমি নিষ্প্রভ;
চারপাশে হিমবাহের চলাচল।
বুকে ফণিমনসার বাগান নিয়ে
ঘুম পায়, তবু, চোখে শ্যাওলা
স্মৃতির আবরণ; মুছতে গিয়ে
স্ক্রল করছো আকাশ—অন্য
এক দুনিয়া, রহিত যোগাযোগ।
কেউ হারায় তবু হারায় না।
সব পুরোনো ও পুনরাবৃত্তি।
কোন কালে ফেলে আসা উঠানে,
কলপাড়ে, শীতল জলে ধোয়া
চোখ মনে পড়ে, যেন সবটা আকাশ
তার চোখ, তবু সে তাকায় না।
মানুষের থেকে, নিজের থেকে,
ফিরে যেতে যেতে পৌঁছে যাও
একটা নিস্তব্ধ পাহাড়ে; যে-পাহাড়
সমস্ত চিত্রকল্প হারিয়ে পরিত্যক্ত;
দাঁড়িয়ে থাকে, দূরে—
সেখানেই বুক ভরে নিশ্বাস নিও,
মন-জাগা মায়া, না-হয়; ভুলে যেও
জন্মতিথি ধরে!
এই নিঃসঙ্গ পাহাড়টা তোমার
সঙ্গী হোক! যেখানে, চারপাশে
প্রতিধ্বনিত হয়,’ ‘একটা পাহাড়
ছোটো হতে হতে তোমার হৃদয়
হয়ে গেছে!” তুমি প্রতিদিন এভাবে
বেঁচে থাকো, ফিরে আসো, মাটির
বুকে—পাথর ভেঙে ভেঙে ধুলোর
শরীর হয়ে, তারপর; মানুষের
যাত্রায় মিশে যাও অবিরত!
মানুষ হিসেবে তুমি অনেকটা এমন,
ধুলোর মতো, পাহাড়ের মতো—
রূপান্তরিত শিলা
অনেক বেশি বলার কিছু নাই।
মনে পড়ে—পড়ে না, কী আসে-যায়?
এই যে সময়, অতিক্রান্ত হয় রক্তে,
শরীরে। অন্তহীন বরফের দেশে
‘রক্ত’ উষ্ণতা হারায়।
‘সে’ আর ‘আমি’; শেষ না-হওয়া
জানা-অজানার ভেতর
আটকে আছি জন্মতিথি ধরে—
পার হই বয়স ও বোধের দরজা
কী সাবলীল আচ্ছন্নতায়!
‘সে’ সে-ই থাকে না; আমি ছুটছি
লুপের ভেতর; অর্থ-অনর্থের
সীমানা মুছে মুছে—অনেক বেশি
বলার কিছু নাই। স্মৃতি ও ভবিষ্যতের
যুগলবন্দী ফাঁদ! আমরা
ছুঁই না—কেউ কাউকে।
পাশাপাশি দুজনের স্বপ্ন যতটা আলাদা!
শরীর থেকে মন অচেনা হয়ে,
ভোর হয়ে, পাখি হয়ে উড়ে যায়—
পুরোনো ও পুনরাবৃত্তিতে ‘সময়’
একরোখা ঘোর ধরে চলা—যেন,
পৃথিবীর প্রাচীন নদীর বরফ ভেঙে;
‘সব না-থাকা’, ‘সবার না-থাকা’,
বুকের ভেতরে বয়ে; ফিরে আসে
ক্লান্ত দেশের রূপান্তরিত শিলা
বিষাদ ও বিভ্রম ছেড়ে ব্যাখ্যাতীত—
নিজের ভেতরে—নিজের ভেতরে!
এরচেয়ে আপাত কিছু নেই, বলার—
থেমে থাকা পথ
‘সবাই আছে কিন্তু কেউ নাই’
আপনার কখনো এমন মনে হয়?
ভেতরটা খুব ফাঁকা, রিক্ত, অবশ।
জ্বর এলে যেমন লাগে—
একটা কেমন ঘোর!
তাপে পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে
চেতন ও অবচেতনের মাঝখানে
কোথাও ঝুলে থেকে
স্মৃতির কাছেও যেতে ইচ্ছা করে না।
যেন, কেউ কোথাও ছিলোই না কখনো!
এরকম নির্জন। জীবন।
খুব জরুরি কিছু পরে থাকে স্থবিরতায়।
হিম বরফের দেশে আটকা পড়ে
হারিয়ে যাচ্ছে সময়।
রোদ এসে পৌঁছাবে—সে পথ
বড় দীর্ঘ মনে হয়!
শ্বেতা শতাব্দী এষ
জন্ম: ১২ অক্টোবর, ১৯৯২, জামালপুর শহরে
বাবা: জ্যোতিষ চন্দ্র এষ
মা: ছবি ভৌমিক
শিক্ষা: স্নাতকোত্তর
বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কবিতাগ্রন্থ
অনুসূর্যের গান (২০১০) জলসিঁড়ি, ঢাকা
রোদের পথে ফেরা (২০১৩) মুক্তচিন্তা, ঢাকা
বিপরীত দুরবিনে (২০১৬) ঐতিহ্য, ঢাকা
আলাহিয়ার আয়না (২০১৭) ফেস্টুন, ঢাকা
ফিরে যাচ্ছে ফুল (২০১৯) ঐহিক, কলকাতা
‘বিপরীত দুরবিনে’ বইয়ের জন্য ‘আয়েশা ফয়েজ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭’ এবং তরুণ কবি ক্যাটাগরিতে ‘আদম সম্মাননা ২০১৯’