আমাদের আনারসি চিৎকার
১.
তোমায় খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না
এই চাপানউতোর কবিস্বভাব আমার
শীর্ণকায় খাঁজকাটা শরীরের ঘণ্টাধ্বনি
যে আজানুলম্বিত শরীরপথ রচনা করছে
তাকে অবিলম্বে অতিক্রম করি
মনে মনে ওই শেষ বার তোমায় অতিরিক্ত চুম্বন করেছিলাম
ধীরে ধীরে পতন, অহম ক্ষয় ও নূতন কানের ফুটো
প্রস্তুত করেছে দৃশ্যমান সুতো
সেই সুতোয় নির্মিত হয়েছে আমার শীতপোশাক
শুধু প্রকাশ্যে উল্লম্ফন উলঙ্গ-দোষ কি আমার একার
২.
মৃত্যু এক জটিল প্রস্থান
অস্বাভাবিক অন্ধকার গুহা থেকে খানিকটা এগিয়ে
মাদুর বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে
মৃত্যু অতিবৃদ্ধ সরল তুমি
সাহচর্যকে হিংসা হয় খুব
কাদা ছোড়ার দুনিয়ায় তুমি আমায় উলঙ্গ করো
নাবিক হও
ভেজা তুলসী পাতা তুলো সহযোগে
সামান্য আতর ঢালো নাভিতে
ভোগ করো উদ্ভাসিত আকাঙ্ক্ষা
অন্ধজন তোমার শরীরে, আলোময় ঘিরে রেখেছে
এবার চোখ বন্ধ করে দাও
মৃত্যু এক সরল প্রস্থান
কিছুটা সহাস্য, স্বাভাবিক
৩.
ছোকরা
দ্যাখো আমাদের কোনো ঘর নেই
ঘরের উপর ছাদ নেই
ছাদের উপর মহাকাশ নেই
আমি আছি
নিঃশব্দে নিরালায় একা
সিগারেটের পর সিগারেট পুড়ে যাচ্ছে
বই পুড়ছে
খাতা পুড়ছে
দ্যাখো
আমাদের হাতে তৈরি সাঁকো দুলছে
ঝুলছে
মদ ঢালছি গ্লাসে
অথচ ভর্তি হচ্ছে না কিছুতেই
আমার পা থেকে নাভি
বুক থেকে মাথার দাম দিয়ে রাখলাম
তোমায়
ছোকরা
আমাদের খালি গায়ে যে কবে পূর্ণিমা আসবে
আর তুমুল উত্তেজনায় টানটান করে শোবো
এই চিঠি আজ তোমার জন্য
দ্যাখো
আমাদের তারা খসবে নতুন কোনো দেশে
ধ্বংস করবে
তারপর ঘর ছাদ মহাকাশ
নিঃশব্দে নিরালায় একা
৪.
যতটা নরম ভাবি, ততটা আলোচনায় পরিষ্কার হয় না
লুপে চলে কোহেন
হঠাৎ মোহেনজোদারোর কথা মনে পড়ে
ইতিহাসে সেই প্রথম
২৬ শতাব্দীর দীর্ঘ রচনাবলী
আমাদের পরিকল্পনায় খেলা করে হরপ্পা
সিন্ধু সিন্ধু নগরে আমাদের দেখা হবে
দেখা হওয়ার লুপে চলবে ঠোঁটের খেলা
বিস্বাদের নদী ভেসে যাবে
ট্রিগারড হব তোমার ‘বাবা’ ডাকে
৫.
একটা আনারসের সারা গায়ে চোখ
আমাদের কথা হয় এমন অজস্র পলকে
চাহনি মজবুত পথে কিছুটা তার রস
আমায় দিনেদুপুরে এসরাজ শোনাচ্ছে
মাথায় ঝাঁকড়া ফুল
একবার ফুলে চোখে এক হয়েছিল ছাদনাতলায়
তারপর বিবাহ যাপন
সেই গায়ে আনারকলি সুর আহা
চোখে মিশে যায় যৌথ-খামার
চোখেরা পলক গাইতে শুরু করে
৬.
দিদিমণি হাতে ধরে অঙ্ক শেখাতেন৷ ছোটোবেলার পাখি উড়ে যেত বীজগণিতের ফর্মুলায়। কেউ তাকে আপন করেনি। জ্যামিতির স্কেল দিয়ে হুবহু মেপে নেওয়া পাখির দৈর্ঘ্যপ্রস্থ অথবা খাঁচার পরিধি থেকে দিদিমণিকে আলতো দেখা।
চওড়া সিঁথির অবিন্যাস রেখায় মুছে যাচ্ছে দশমিক। আর সেই প্রথমবার গসাগুর সিঁড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন দিদিমণি।
৭.
একটা ল্যান্ডস্কেপ স্বপ্নের নেশা ধরিয়েছিলাম প্রথমে। হাওয়া আসতেই উড়িয়ে দিচ্ছে স্থূলকায় এফিমিনেট ঠোঁট। ধাক্কা লাগাও হে ছোকরা! হাওয়ার নিশান ওড়াও।
দাফনে মৃত্যু লেগে থাক
দাফনে পুরুলিয়া লেগে থাক
দাফনে পাপ লেগে থাক
মেয়েলি হাওয়া লেগে থাক দাফনে
৮.
একটা বেডরুম
শতবর্ষ পুরনো খাটে লাল চাদর পেতে রাখা হয়েছে
ঘরের দুপাশে চেয়ার ঘরের দৈর্ঘ্য প্রস্থ্যকে দুইভাগ করেছে
হাওয়ায় উড়ছে সদ্য ভেজা তোয়ালে
ঘরের তিনদিকে পেরেক বিদ্ধ ফটোফ্রেম
মেঝেতে লুটানো তোমার টুপি, চায়ের কাপ
একটা ঘরে যা যা থাকার সব আছে
এমনকি তোমার ছায়া
শুধু এই ঘরে অত্যাচারিত হওয়ার প্রতিটি দাগ
আমার শরীর থেকে উধাও
তারপর থেকে আমি অলৌকিকে বিশ্বাস করি
৯.
অবিমিশ্র বৃষ্টি পড়ছে পাহাড়ে
উঁচুনিচু বাঁকা পথে ঝিমি চাঁদের রং
থেকে কাঠঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ছে
মুনলাইট সোনাটা
একটি আনারস সহযোগে আমার গা এলিয়ে বসে আছে
ইন দ্য মুড ফর লাভের অবিকল ছায়া
ছলাকলায় পারদর্শী নই, তাই আশ্বিনের বারবেলায়
মনে পড়ে যাচ্ছে আমাদের আনারসি চিৎকার
কেউ দুম করে মরে যাওয়ার মতো এযাবৎ
আমার মাথার যন্ত্রণা উচ্চাঙ্গে উঠছে আর নামছে
১০.
সাগর উথলে উঠলে গহীন থেকে ঝরে কাজুবাদাম
ঘনঘোর সবুজের যমজ তল কূল চায় মান চায়
চোরাস্রোতে দেখা যায় জ্যোৎস্নার ঘরদোর
আমরা সাগরের এপারে বসে ভাবি ওপারের কথা
দুটো লোক গা ভর্তি জল নিয়ে হেঁটে যায় অতলান্তের দিকে
নামানো রুকস্যাক থেকে বেরিয়ে আসে যা-কিছু লবণ
সবই নির্জনতার কালার প্যালেট
আমরা ভাবি অথৈ স্রোত আর অভিমানের নোনা
চাঁদ তোমায় টি’ দিয়ে যায়
তারপর ঘুম
তারপর ঘুম
তারপর ঘুম
ঘুমের অতিরিক্ত নোনায় তুমি শুধু মরে যাও
পরিচিতি :
সুমন সাধু
কবি, গদ্যকার ও সাংবাদিক
বাস ভারতের কলকাতা শহরে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করে বর্তমানে ভারতের একটি বাংলা নিউজ পোর্টালের কন্টেন্ট হেড। সম্পাদিত পত্রিকা ‘আঙ্গিক’, ‘শনিবারের কড়চা’ (বঙ্গদর্শন), ‘কায়া তরুবর’। এযাবৎকাল অবধি সুমনের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘বিশ্বাস নাও করতে পারেন’, ‘গওহর জান’, ‘উড়তে চললাম কমরেড’, ‘ঘুম হও অজস্র অপরাজিতা’। প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ ‘বিলম্বিত দুপুর’।