অন্ধ
একা, অন্ধ লোকটি আজ—
নিজেরই চেহারা ভুলে
একটি আয়না হাতে, একা একা হাসছে আপাদমস্তক
টের পায়, কবেকার
আলোর স্মৃতিও তার– ক্ষীয়মান
যেন দূর কোনো এক তারার মতন, ক্রম-অপসৃয়মান
অর্থাৎ কখনো সে স্বপ্ন দেখে…
দেখে রোদ
এত উজ্জ্বল
যেন ঝলসেই যাবে বোবা চোখ
আর রোজ একা একা
পিছু নেয় রোদটির—
তারাটির কাছাকাছি একদিন পৌঁছে যেতে
দাবা
‘In Chess, whichever move you make, you must face the consequences.’
এই গাঁয়ে
অবসরে দাবা খেলে মানুষগুলো
তাদের খেলার পাশে, অনেক ক্ষতের পাশে, কাত হয়ে—
মরে থাকে মেধাবী
ঘোড়া
খেলা
শেষে তথাকথিত
সেই গ্রামব্যপী—বেখেয়ালে, ব্যস্ত হালে মানুষেরা—
খামোখাই নড়েচড়ে
ফেরে
আর
আয়রনিক্যালি তারা
আটকে যেতে থাকে গুটির শরীরে, নীরবে
তাদের ফসলী মাঠ হয়ে ওঠে দাবার ঘরের মতো, ক্রমশ
দাবার ছকের মতো
সমতল
সুতরাং
প্রায়শই হঠাৎ—
অবনীল
আকাশ হতে—ঘন
আর চিরচেনা মেঘের মতন অথচ
নেমে আসে মনুষ্যগুটি অভিমুখে, এক হাতেই
তালি দিতে দিতে, দানবিক
অচেনা একটা
হাত
বোধি
কোথাও একটি গাছ।
সবুজ পাতার ফাঁকে অসংখ্য অতিথি পাখি ধরেছে। আর পেকে পেকে ঝরতেছে আকাশের দিকে।
বিনিময়, নিযুত-লক্ষ মাইল দূর হতে আলো এসে, হাতের তালুতে এসে, ভেঙেচুড়ে বহুল অর্থময় ছড়িয়ে গেল।
কোথাও একটি গাছ, খুঁটে খুঁটে খেয়ে নেয় আলো।
মাথার উপর জল—উবে উবে মেঘ, তার—একটু হিমালয়, একটু সাগর আর একটু সিন্ধু নদ।
ভাব না ভাষা, কে
আবছা দুপুরে
চর অচরজুড়ে মেঘ না বৃষ্টি
মুষলধারে ঐ ঝরছে পাতারা
লাশের উপরে
এ রূপ মরতে
এরূপ মর্ত্যে ভাব না ভাষা কে
ডিম না মুরগি কে আগে এসেছে
এ বায়ুবর্তে—
হচ্ছে বৃষ্টি
যেনবা এমবুশ মুষলধারে ঐ
সাঁতার কষছে স্রোতের উলটো
ভাসছে লাশটি
ভাষাটা থেমেছে
কলম ও কাগজে, ভাষাটা থামলেও
একটি ভাবনা উদিত হচ্ছে—
মৃতের মগজে
ধীবর পল্লী
চন্দ্রশাসিত রাত্রি।
একটা শামুক, ধীরে, ধানগাছ বেয়ে উঠতেছে
অবিরাম—আউশের ক্ষেত। সোঁদা-মাটি-উদ্ভিদ-ঘ্রাণ। আষাঢ়ের ব্যাঙ ডাকছিল আর নরম হাওয়ায়, এই চন্দ্রালোকের তলে, ধীবরপুত্র এক বাঁশের খইচা হাতে যথেষ্ট ছায়ামূর্তির মতো—নড়ছে চড়ছে ও একটা হিজলগাছ চিরকাল নিম্নভূমির দিকে অল্প ঝুঁকে…
দূর, খালজুড়ে কচুরিপানার বুদ্বুদ
লগি, অন্তরীক্ষ ছিঁড়ে উড়ে যাবে চাঁদের পাশে
কোষানৌকায়, ক্লান্ত ধীবর—অবিকল যিশুখ্রিস্টের মতো, জলের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে
মানুষের বনে
খ.
এই গ্রাম, ভোর হতে
এখনো কিছুটা রোদ নীলাকাশ অল্প বাকি।
তবু মানুষের ঘুম ভাঙে, নিচু লয়ে ভাঙে;
এই ভাঙার শব্দে
এই ওমের শব্দে
যে শিশির ঝরতেছে সেও এক শব্দ এবং
খবরের কাগজ থেকে উঠে আসা খুন-ধর্ষণের চিৎকারেও—
জেগে উঠছে মানুষ,
বলছে পরস্পর রাত্রিকালীন স্বপ্ন।
আর জাগরণে ডুবে যেতে যেতে
ওরা ভাত খায়
নিজ হাতে
মানচিত্র এঁকে এঁকে
জগতের ভূমি ও ভূমিকা বাড়ায়।
ঘ.
বটবৃক্ষ একা, সবদিকে তাকিয়ে রয়েছে খেয়ালে
নিচে গ্রাম বিছিয়ে, আজও কারা গান গায়
হ্রস আর দীর্ঘ বাক্য বলে
নির্ভুল গঞ্জিকাবাংলা ভাষায়।
দূরে মাগরিব, প্রতি সিজদায়
ইমাম বদলে যায় আয়াতের সুরে।
আর এখানে, নাতিসন্ধ্যায়
খোদার দস্তখত নকল ক’রে—
“একটাই মুহূর্ত, তারে টেনেটুনে অনন্তকাল…”
বলছিল সাধু। অথবা ব্রহ্মচোর।
লাল চোখ। সূর্যের মতন লাল।
ওরা খণ্ডকালীন ঈশ্বর।
নতুন এক মৃত্যুপদ্ধতি
ক.
মইরা যাওয়ার মতো—কী এক নষ্ট ঋতু জগতে
ভুট্টা ক্ষেতের উপরে—বিকাল ছড়িয়ে বিস্তারিত।
যতটা দেখায় চোখ তারও বেশি এখানে আকাশ।
কেননা আকাশ আজ উড্ডীন পাখিতে ভরাট
হয়ে আছে; ওইপাশে থেমে গেছে সবটুকু আলো।
যেহেতু আকাশ, মানে সবদিকে পথ বিথারিত।
নীরদার্দ্র। মেঘ ঘোলা করে পাখি উড্ডীন আর
অসংখ্য ডানার ছাপ ফেলে অচেনায় উড়ে যাচ্ছে
এসবের নিচে আজ নিজের ভেতরে, মরে যাচ্ছি।
নিজের ভেতরে মরে—কাত হয়ে পড়ে থাকতেছি
শৈশব
উড়তেই পারছি না আর—
মেরুদণ্ড ভুলে গেছে ডানার খবর
অথচ আমার এই নশ্বর শরীরের পবিত্র অঙ্গ ছিল মায়ের আঁচল
অথচ এখন, প্রায়শই স্মৃতির ভেতরে
শৈশব থেকে আমি দৌড়ে বেরিয়ে পড়ি, ডানাভাঙা
একটি ঘুড়ির পেছনে
পায়ের তলায় ঘাস, মিছেমিছি ভাঙছে সবুজ আর
চিরায়ত রোদের তলায়
এই নশ্বর শরীরের পবিত্র অঙ্গ ছিল ঘুড়ির নাটাই।
স্মৃতির ভেতর তাই
দৌড়ে দৌড়ে আমি পৌঁছে যচ্ছি প্রায়ই পৃথিবী কিনারে, আর
সেই মায়ের আঁচল
সেই ঘুড়ির নাটাই
সমস্তসমেত আজ—
পৃথিবীকে মনে হচ্ছে
—নশ্বর নিজেরই বাকিটা শরীর
টু বিল্ড এ ফায়ার
শীতে জমে যাচ্ছে শুক্রতারা—
নিচে
কনকনে মাঘ ভেঙে, আব্বু, খোদার দিকে যাচ্ছেন
অবিরল
নাড়াজ্বলা আগ।
চারপাশে মানুষের লালচে চেহারা
নড়ছে—
“আগুন পোয়াইতে কি শ্যাষম্যাশ দোযখে যাবো?”
*
দাদা তো কবেই গেছে
সিথানে পুরাতন রেডিও ছেড়ে।
সেইঘরে দাদি আজ
পানের সুঘ্রাণ নিয়ে—
অনেক ঘুমের গভীরে
প্রিয় হাঁসেদের ডাকে ‘তৈ তৈ!’
গত আশ্বিনে—
একটা হাঁসের ছাও শেয়ালে নিয়েছে
গাঢ় ঘুমের ভেতরে, দাদি
সেই শেয়ালটাকেই খুঁজছে…
*
মাঘী চাঁদ
মাথার উপর
নিয়ে—
কোথাও অন্ধকারে একটা শেয়াল
একটি দৃশ্য হয়ে—
চিত্রনাট্য মেপে
একটি দৃশ্য যেন :
চারপাশ কুয়াশাধোয়া জোৎস্নায়
চারপাশ, জ্যোৎস্নাবৃত কুয়াশায়
অবিরল
উড়ছিল—
নাড়াজ্বলা অগ্নিকণা
তাহাদের অন্ধকারে
ওরা
পিঠ ঠেকিয়ে—
মানুষের চোখগুলি বিম্ব ফলাতে শিখছে;
প্রাণের চিহ্ন হয়ে
এইটুকু,
আপাতত,
অন্য দৃশ্য হয়ে—
“কত নাম জমলো লাশের, একটাও আমার না রে!”
*
এইটুকু
স্বার্থকতা নিয়ে—
কোথাও বাদুর ঝাপটায়।
কোথাও নামাজ শেষ
রান্না বাকি
আম্মা’র দুইহাত ভর্তি দোয়া।
আম্মা
ডানকানে
কম শুনছেন
গত ধানের বতরে
এক ধান ছিটকে
তার কানের ভেতরে—
কনকনে মাঘ।
নাড়াজ্বলা অবিরল আগ।
চারপাশে
মানুষের উষ্ণতা
অস্তিত্বের সুরে যেন
নতুন আজান বুনছে।
“…আমাদের মাথার উপর যদি ঠেকতো আরশ!”
*
আমাদের উষ্ণতা
খিদে আর খোদা বলতে—
আব্বু
ধীর পা’য় হেঁটে হেঁটে
চালতাগাছের নিচে
বাড়ি ফিরছেন…
রনক জামান
জন্ম : ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯১; মানিকগঞ্জ, ঢাকা, বাংলাদেশ। পড়াশোনা : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (রসায়ন শাস্ত্র)। কবিতার অবসরে অনুবাদও করেছেন কিছু।
ranakzaman1991@gmail.com
প্রকাশিত গ্রন্থ
কবিতা
শামুকচর্য (২০২৪)
অগ্রন্থিত ওহী (২০১৯)
ঘামগুলো সব শিশিরফোঁটা (২০১৬)
অনুবাদ
ললিতা – ভ্লাদিমির নবোকভ (২০১৬, ২০২২)
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে – সেরা ২০ ছোটগল্প (২০১৮)
আমক – স্তেফান সোয়াইগ (২০১৮)
দক্ষিণে – সালমান রুশদি (২০১৮)
ইসমাইল কাদারের কবিতা (২০১৭)