গল্পের ব্যাপ্তি মাত্র একদিনের অথচ দীর্ঘ চার দশকের বিশাল ভার বয়ে চলতে হয়েছে ‘হেলফায়ার’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলোকে। কড়া শাসন করে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া ফরিদা খানম ও তার দুই অনুগত মেয়ে লাভলী এবং বিউটিকে ঘিরে কাহিনীর বিস্তার। উপন্যাসের শুরু ও শেষ হয় লাভলীর চল্লিশতম জন্মদিনে। জীবনে ওইদিনই সে প্রথমবার ঢাকা শহরে একা বের হয়। বয়স যাই হোক—তার অনুভব, উত্তেজনা তাই একজন কিশোরীর মতো। এতোদিন আড়ালে পড়ে থাকা একটা বিশাল পৃথিবীর পর্দা যেন কেবলই সরে গেছে। লাভলী সেই খানিক উদ্বেগ, খানিক আনন্দ মেশানো জগতে পা ফেলে একরকম হারিয়ে যায়। গাউসিয়া মার্কেট দিয়ে শুরু, চাঁদনী চক, নিউ মার্কেট হয়ে সে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে রমনা পার্কে। বিশাল ঢাকা শহরের এই এতোটুকু জায়গা লাভলীর কাছে মহাসমুদ্র। সেখানে মাতাল বাতাসের সুখ যেমন আছে, ডুবে যাওয়ার ভয়ও অনিবার্য।
মূলত নারী চরিত্রকেন্দ্রিক অনবদ্য এই আখ্যানে দুইজন চমকপ্রদ পুরুষ চরিত্রের সাথে লাভলী সমান্তরাল আলাপ চালিয়ে যায় রমনা পার্কের ছায়ায় বসে। লাভলীর বিদ্রোহী হয়ে ওঠার আভাস পাওয়া যায়। অন্যদিকে ফরিদা খানমকে মনে হয় নেশায় ডুবে থাকা মানুষ। ঘোর কেটে গেলে সে প্রচণ্ড অসহায় হয়ে পড়বে— এই ভয়ে চার দশক ধরে সে তার চারপাশে নিজের হাতে তৈরি করা মোহের দেয়াল পরম যত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করে। পুরো সংসার নিয়ে সে একরকম স্বেচ্ছাবন্দী জীবনযাপন করে। ঔপন্যাস্যিকের বড় সার্থকতা আমার মনে হয় ফরিদা খানমের মতো এমন একটা চরিত্র নির্মাণে, যে একই সাথে সবচেয়ে স্বাধীন এবং চিরবন্দী। ফরিদার নেশার উৎস ছিল তার বজ্রকঠিন মা । মায়ের কাছ থেকে পাওয়া ক্ষমতা ও স্বনির্ভরতার স্বাদ তাকে বাকি জীবন মাতাল করে রাখে।
লীসা গাজীর বর্ণনায় ঢাকা শহর কোন কোন সময় চরিত্রগুলোর চাইতেও উজ্জ্বল, প্রাণবান হয়ে ওঠে। দুই হাজার সাত সালের মনিপুরিপাড়া থেকে শুরু করে ষাটের দশকের কবি জসীমউদ্দিন রোড— প্রতিটা জায়গা চরিত্রগুলোর সাথে সাথে এগিয়ে গেছে সমান তালে। শবনম নাদিয়ার অনুবাদও ঢাকার সমস্ত স্বাদ অক্ষত রাখতে পেরেছে। তাঁর ইংরেজিটা এতো বেশি এই উপন্যাসের স্থান, কাল, পাত্রের সমানুপাতিক যে মনে হয়, বাংলা থেকে ইংরেজির রূপান্তরে তেমন কিছু হারিয়ে যায় নাই। ঢাকার মানুষগুলো এক ভাষা থেকে অন্য ভাষার এই দীর্ঘ ভ্রমণের পরেও শেষমেষ ঢাকাতেই রয়ে গেছে।
কাহিনীর বিন্যাসও প্রশংসার দাবি রাখে। সকাল থেকে সন্ধ্যারাত পর্যন্ত একই ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় দুইটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। একটা ভেতর থেকে বাহিরমুখী, আরেকটা ধারা বাহির থেকে ভেতরের দিকে বয়ে চলে। রাতের একটা সময় গিয়ে এই দুই স্রোত মিলে যায়। মেঘনা ও যমুনার মিলিত ধারায় তারপর গল্প এগিয়ে যায় রক্তসমুদ্রের দিকে।
সামনে উপস্থিত চরিত্রগুলোর চেয়ে অনেক সময় অনুপস্থিত চরিত্রগুলো বেশি আকর্ষণ তৈরী করে, যেমন আব্দুল বশির, ফরিদার মা, রিয়াজ। একদিনের গল্পকে এরা পৌঁছে দেয় অতীতের বিভিন্ন সময়ে। আর গ্রীক ট্র্যাজেডির কোরাসের মতো লাভলীর মাথার মধ্যে কথা বলে চলে অজানা পুরুষ কণ্ঠস্বর। পড়তে পড়তে ফরিদাকেও মনে হয় রাজা ইডিপাস। আমরা তার ভুল, দম্ভ আর মোহের করুণ পরিণতির জন্যে অপেক্ষা করি। পার্থক্য হলো ইডিপাসের পতন হয় সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে, আর ফরিদা কোন একটা জরুরী সত্য আমরণ গোপন রাখত চায়, এমনকি নিজের কাছ থেকেও।
মুখলেস সাহেবের চরিত্র অন্য এক বাস্তবতা হাজির করে। স্ত্রী ফরিদা খানমের প্রতি তার যেন আজন্ম ঋণ। সেই ঋণ শোধ করার একমাত্র উপায় মৌনতা। যত বেশি চুপচাপ পার করে দেয়া যায় জীবনটা, ততই মঙ্গল। সে তাই মাথা ঘামায় না কোন কিছুতে। মেয়ে দুইটাও মায়ের অবাধ্য হয় না কোনদিন। প্রেম, যৌনতা, বিয়ে, সন্তান ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে থাকতে লাভলী আর বিউটি নিজেদের বয়স ভুলে যায়। ফরিদা খানমের যত্ন আর তদারকি একটা দম বন্ধ করা শান্তি টিকিয়ে রাখে সংসারে, যুগের পর যুগ। সুপ্ত অগ্নিগিরির মতো জমে উঠতে থাকে লাভলী আর বিউটির জীবন আর শরীরের চাহিদাগুলো। কাজী নজরুলের ইসলামের ‘অগ্নিগিরি’ গল্পের কথা মনে পড়ে যায় ‘হেলফায়ার’ পড়তে পড়তে। কয়েক পৃষ্ঠা পর-পর মনে হয় এই বোধহয় বিস্ফোরণ ঘটে গেল!
মাতৃতান্ত্রিক শাসনের একটা পিতৃতান্ত্রিক রূপ এঁকে দেখিয়েছেন লীসা গাজী। আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে এই ধরণের শাসকের উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। একটা সময় গিয়ে ফরিদা খানমের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাই মনে হয় ‘হেলফায়ার’ আদতে একটা রূপক গল্প। লাভলী আর বিউটি ঢাকা শহরের প্রচুর নারীর প্রতিনিধি। আর ফরিদা খানম এক ধরনের গর্বিত অন্ধত্বের প্রতীক। লাভলী তার প্রথম সন্তান। তার চল্লিশতম জন্মদিনে, যেদিন এই আখ্যানের শুরু এবং শেষ, ধীরে ধীরে ফরিদা খানমের চোখ খুলতে থাকে। ততদিনে দেরি হয়ে গেছে অনেক, চারপাশের দুনিয়া ভেঙে পড়ে যাবে যেকোন সময়। সেই কঠিন উপলব্ধি ফরিদাকে অস্থির করে তোলে।
অনেক উঁচু থেকে দেখলে দৃশ্যটা এরকম দেখাবে: একটা নির্জন ছাদ, দুপুরের নিস্তব্ধতা চারদিক থেকে ছাদটাকে চেপে ধরেছে, সেই ছাদে ততোধিক নির্জন একজন প্রৌঢ়া এলোপাথাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছেন আর মাথার উপরে দু’হাত ছুঁড়ে অন্ধের মতো ‘হুস’ ‘হুস’ করছেন। তার ঠিক… উপরেই কালো মখমলে মোড়ানো একটা কাক বৃত্তাকারে ঘুরছে আর বিরামহীন কা… কা… ডেকে চলেছে। কিছু একটা ঘটবে, ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটবে — কুল ছাপানো নদীর মতো এই অমঙ্গল চিন্তা বারবার ফরিদার মনে আছড়ে পড়ছে আর তখন তার সমস্ত রোষ গিয়ে পড়ছে কাকটার ওপর। যেন কাকটাকে তাড়াতে পারলেই তার এবং তার পরিবারের উপর থেকে সমস্ত বালা-মুসিব্বত কেটে যাবে।
(মূল বাংলা উপন্যাস থেকে)
সিনেমার গান, রসময় গুপ্তের চটিবই, ভিসিআর, কুপার’স এর পেস্ট্রি- এই সমস্ত রেফারেন্স উপন্যাসকে আরও বেশি জীবন আর সময়ঘনিষ্ঠ করে তুলছে। রিয়াজ নামের বিজ্ঞান কলেজে পড়া এক তরুণের স্মৃতি লাভলীর জীবনের একমাত্র উল্লেখযোগ্য দিক। বাদবাকি জীবন একঘেয়ে, নিরুত্তাপ। চল্লিশতম জন্মদিনে সে তাই ভাবে তাকে কিছু একটা করতে হবে মনে রাখার মতো। জীবনের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যে সে কী বিদ্রোহ করবে? যদি করে বসে— সেই বিদ্রোহ আসলে কার বিরুদ্ধে? যেন সে চাইলেই আজকে এক অনন্য যুদ্ধ শুরু করতে পারে? মায়ের সাথে নাকি নিজের সাথে নিজের লড়াই?
লাভলী সরাসরি এই প্রশ্নগুলো করে না, লীসা গাজীও তাই সহজ কোন উত্তর দেন না। তিনি উপন্যাস শেষ করতে করতে বরং পাঠককেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন— এতক্ষণ যে আগুনের গল্প পড়লেন সেই আগুনে পুড়ে অবশেষে কে ভস্ম হয়? ফরিদা খানম, বিউটি নাকি লাভলী? অতীতের নরক নেভাতে গিয়ে যে আগুন শেষমেশ জ্বলে উঠে, কতদূর তার ভবিষ্যৎ?
হেলফায়ার (২০২০)। লীসা গাজী। অনুবাদ: শবনম নাদিয়া। প্রকাশক: একা, অ্যান ইমপ্রিন্ট অভ ওয়েস্টল্যান্ড বুকস, চেন্নাই, ভারত। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: হারশাদ মারাঠি। পৃষ্ঠা: ১৯৮। মূল্য: ৩৯৯ রুপি।