নগর ঢাকায় জনৈক জীবনানন্দ ।। পিয়াস মজিদ

নগর ঢাকায় প্রতিদিন কত আজব লোকের যে দেখা মেলে তার ইয়ত্তা নেই। এই যেমন গত পরশু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোড়ে উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটছিলেন রোগামতো কালোবরণ একটা লোক। পরনে আধ-ময়লা পাঞ্জাবি, ততোধিক ময়লা ধুতি আর পায়ে বহু বছরের পুরোনো মডেলের স্যান্ডেল। হাঁটছেন ২০১২ সালের বিভক্ত ঢাকার দক্ষিণাংশের রাস্তায় কিন্তু লোকটার তাকানোর ভঙ্গি, হাঁটাচলার ঢং—সবকিছুতে কেমন যেন বিংশ শতাব্দী-বিংশ শতাব্দী গন্ধ। চিনলেন না লোকটাকে? চোখ-মুখে বেদনাধারা বয়ে চললেও লোকটার নাম আসলে জীবনানন্দ দাশ। অনেক আগে তাঁর কবিতায় লিবিয়ার জঙ্গলের কথা উল্লেখ করেছিলেন তিনি। এখন নানাপক্ষের বোমাবাজি-হত্যা-লুটপাটে আসলেই লিবিয়া এক বৃহদাকার জঙ্গলে পরিণত হয়েছে শুনে তিনি একটু সরেজমিনে দেখে আসতে চাইছিলেন। কিন্তু একটু ধাতস্থ হয়ে বুঝলেন, লিবিয়ায় নেওয়ার নাম করে দালালচক্র তাঁকে আসলে ঢাকায় নামিয়ে গেছে। 
যা হোক, জগন্নাথের মোড়ে হাঁটতে হাঁটতে, জীবনানন্দের খেয়াল হলো এই এলাকার আশপাশেই লাবণ্য দাশের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু জায়গাটা ঠিক ঠাহর করে উঠতে না পেরে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলেন। হাড়-জিরজিরে ঘোড়াটানা টমটমের দঙ্গল পেরিয়ে পাটুয়াটুলী নামে একটা জায়গায় আসতেই চোখে পড়ল বিশালকায় সুমনা ক্লিনিক। একবার ভাবলেন ঢাকায় ঢুকে ডায়াবেটিসের পাল্লায় পড়লেন কি না পরীক্ষা করে আসবেন কিন্তু পরক্ষণেই ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরের সাইনবোর্ড দেখে নিরস্ত্র হলেন। কিন্তু তালাবদ্ধ গেট ভেদ করে ভেতরে ঢোকা হলো না। যা হোক, দূর থেকে দেখেই শান্তি পাওয়া গেল—তাঁর বিবাহের স্থলটি পৃথিবী থেকে এখনো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি তবে!
না, ক্ষুধার চোটে আর কিছু ভাবতে পারছিলেন না। সামনে একটা খালি ট্যাক্সি পেয়ে উঠে পড়লেন। বললেন, ‘কোনো ভালো হোটেলে নিয়ে চলো।’ ঘণ্টার বেশি ঢাকাই যানজটে আটকে থেকে ট্যাক্সিওয়ালা তাঁকে নামিয়ে দিল প্রেসক্লাবের মোড়ে। বলল, ‘স্যার, ওই যে ধানসিঁড়ি হোটেল। মোগো বরিশালের বালো হোডেল।’ একটু এগোতেই খেয়াল করলেন আসলেই হোটেলের নাম ‘ধানসিঁড়ি রেস্তোরাঁ’ আর সামনে লেখা ‘আসেন ভাই, জীবনানন্দের বরিশালের বালাম চালের ভাত খেয়ে যান।’ এখন তিনি তাহলে ভাতের বিজ্ঞাপনেও কাজে লাগেন! ক্ষুধা তো এতেই মিটে গেল। 
উল্টো দিকে আবার হাঁটতে হাঁটতে বাংলা একাডেমীর গেটের সামনে গিয়ে একটা ব্যানার দেখে থামতে হলো। ব্যানারে লেখা ‘আমৃত্যু জীবনানন্দ গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রয়াণে আমরা শোকাহত’। হায়, হায়! মনে হচ্ছে অল্প কদিন আগেই মারা গেছেন লোকটা। বেঁচে থাকলে তো অন্তত জানা যেত তাঁর জীবনানন্দ গবেষণার কারণ ও ফলাফল। বাংলা একাডেমী ছাড়িয়ে তারপর টিএসসি মোড়ে ‘ডাস’-এ গিয়ে একটা লাচ্ছি অর্ডার দিলেন জীবনানন্দ। লাচ্ছি খেতে খেতে টিএসসির ভেতর থেকে একটা আবৃত্তি-কণ্ঠ ভেসে এল কানে: “… বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।” বনলতার নামটা অনেক দিন পরে শুনে একটু নস্টালজিক হয়ে পড়লেন। আজ কোথায় সেই বনলতা? কোথায় সেই সব হারিয়ে যাওয়া দিন?
টিএসসি থেকে একটা রিকশা নিয়ে শাহবাগ মোড়ে এসে নামলেন। 
রাস্তা পেরোলে দেখেন একরাশ ওষুধের দোকান। সামনে একটা পত্রিকার স্ট্যান্ড। একটা পত্রিকা খুলতেই দেখেন চার পাতাব্যাপী ক্রোড়পত্র। বিষয়: গদ্যশিল্পী জীবনানন্দ। এক আলোচক লিখেছেন ‘জীবনানন্দের মাল্যবান, জলপাইহাটি-র মতো উপন্যাস বাংলা গদ্যের গতি ঘুরিয়ে দিয়েছে।’ তাই নাকি? জানলে তো এভাবে ট্র্যাঙ্কবন্দী করে রাখতেন না গল্প-উপন্যাসের খাতাগুলো। হঠাৎ পত্রিকাওয়ালার কথায় হুঁশ হলো। ‘আরে ভাই, না নিলে এমন ঘাঁটাঘাঁটি করতাছেন কেন?’ পত্রিকাটা যথাস্থানে রেখে সামনে এগোতে এগোতে ঢুকলেন আজিজ সুপার মার্কেটে। একটা বইয়ের দোকানে কাচের আড়ালে সাজানো একটা বই বিশেষভাবে চোখে পড়ল—অনন্য জীবনানন্দ। বইটা দেখে একটু কৌতূহলী না হয়ে পারলেন না। 
দোকানটার ভেতরে গিয়ে দ্রুত বইটা হাতে নিয়ে দেখেন মূল লেখক ক্লিনটন বি সিলি, বাংলা অনুবাদক ফারুক মঈনউদ্দীন। ঢাউস বই। ভূমিকাটায় একটু চোখ বুলিয়ে জানা গেল মার্কিন মুলুকের এক লেখক প্রচুর ঘেঁটেঘুঁটে বইটা লিখেছেন। অজানিতে চোখের কোণে একটু জলও জমে উঠল। এই তাঁকে বেঁচে থাকতে সজনীকান্তর দল কী উপেক্ষাই না করেছে ! আর আজ তাঁকে নিয়ে দূরদেশের গবেষকেরাও গবেষণা করছেন। পাঞ্জাবির খুঁটে চোখের জল মুছে দোতলায় পা রাখলেন। বাংলার মুখ নামে একটা বইয়ের দোকানের সামনে দেখেন কয়েকজন তরুণ আড্ডা দিচ্ছে। একজন বলল, ‘চল। একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করি। নাম দিই অদ্ভুত আঁধার।’ পাশের অন্য এক তরুণ সায় দিয়ে বলল, ‘এক্কেবারে জুতসই নাম। হ্যাঁ, জীবনানন্দ একটা জিনিস বটে। এখনকার সময়টা সেই কবে কী ঠিক ধরতে পেরেছেন—অদ্ভুত আঁধার।’ 
দোতলা ছেড়ে তিনতলায় উঠতেই দেখেন সারি সারি বস্ত্রবিপণি। একটা দোকানের নাম ‘উটের গ্রীবা’ দেখে ভেতরে ঢুকলেন। কিন্তু এখানে তো উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্ধতা নেই। ভিড়ের চোটে দাঁড়ানোই দায়। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা বৈশাখের পাঞ্জাবি-ফতুয়া-শাড়ি কিনতে এসেছে বোঝা গেল। একটা শাড়ির জমিনে রুপালি রেখায় লেখা ‘হায় চিল! সোনালি ডানার চিল…’ কবিতার কিয়দংশ। হাসি পেল জীবনানন্দের। কোন দুপুরে না রাতে চিল এসেছিল তার মনে, আর কি না তা এখন ঢাকার আজিজ মার্কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
আজিজ মার্কেটের নিচে নেমে ওই লিটল ম্যাগাজিনের ছেলেগুলোকে আবার দেখতে পেলেন জীবনবাবু। শুনলেন ওরা বলছে, ‘চল চল। বেঙ্গল গ্যালারিতে যাই। আজকে ভূমেন্দ্র গুহ জীবনানন্দ নিয়ে বক্তব্য দেবেন।’ কী বলছে ওরা? সেই ভূমেন। জীবনের শেষ দিনরাতগুলো যে সেবা-শুশ্রূষা করেছে তাঁর! ভূমেন তাহলে বেঁচে আছে? শাহবাগ থেকে বাসে করে ধানমন্ডি সাতাশ নম্বর গিয়ে নামলেন। একটু এগোতেই বেঙ্গল গ্যালারি ক্যাফে। না, ভেতরে যেতে হলো না। বাইরে থেকেই ‘লাবণ্য’র কথা কানে আসতেই থমকে দাঁড়ালেন জীবনানন্দ। শোনা গেল কয়েকজন শ্রোতা ভূমেন্দ্রকে লাবণ্য বিষয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন করছেন। হায়! বেঁচে থাকতে লাবণ্য তাঁকে ভাবত একজন ব্যর্থ মানুষ। আজ যদি সে শুনত ঢাকা শহরের একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে অসফল স্বামীটির সূত্রে লাবণ্যের নামও বারবার উচ্চারিত হচ্ছে তবে কী খুশিই না হতো সে। জীবনানন্দ একবার ভাবলেন, ভূমেন্দ্র গুহের সঙ্গে দেখা করে আসবেন কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো কী দরকার হূদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর।
বেঙ্গল গ্যালারি থেকে আবার সাতাশ নম্বরের মোড়ের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করলেন এবার একটু বরিশাল গিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারলে হয়। বরিশাল। বগুড়া রোড। সর্বানন্দ ভবন। রাস্তায় একটা লোকের কাছে শুনলেন গাবতলী থেকে বরিশালের বাস ছাড়ে। ধূসর পাণ্ডুলিপি পরিবহন নামে একটা বাসে উঠে বসলেন গাবতলীর উদ্দেশে। তাঁর পাশের সিটেই একটা মেয়ে বসেছে। অনেকটা মঞ্জুশ্রীর মতো দেখতে। হঠাৎ মেয়েটার পার্স থেকে বেজে উঠল একটা গানের কলি ‘বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের যে তার নেই কো শেষ, বাংলাদেশ।’ আরে বাহ্! তাহলে তো মোবাইল ফোনের রিংটোনেও তিনি। ফোনে কথা সারতেই মেয়েটির নাম জিগ্যেস করলে উত্তর এল ‘অরুণিমা’। অরুণিমা সান্যাল নয়তো আবার! 
মেয়েটি তারপর নিজেই বলে চলল তার বিস্তারিত পরিচয়। বরিশাল বিএম কলেজের বাংলার ছাত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল এমফিলে ভর্তির ব্যাপারে। কী বিষয়ে জানতে চাইলে বলল—জীবনানন্দের নাবিকবৃত্তি। ‘এতশত বিষয় থাকতে এমন খটোমটো বিষয় কেন ঠিক করলেন?’ কিছুটা যেন উপহাসের হাসি ছুড়ে দিয়ে অরুণিমা বলল, ‘সে আপনি বুঝবেন না। জীবনানন্দ আগে ভালো করে পড়ুন। তবে বুঝবেন। কবি-টবি কিছু না। তিনি তো আসলে এক ট্র্যাজিক নাবিক। সিংহল মালয় কত সমুদ্রে কত জাহাজ বদল করলেন কিন্তু বন্দর ঠিক করে উঠতে পারলেন না। না জীবন, না প্রেম। তাই ছিটকে পড়লেন দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে। জল থেকে একেবারে রুক্ষ করুণ সবুজ ডাঙায়।’ 
জীবনানন্দ একটু নড়েচড়ে বসলেন। বলে কী মেয়েটা! এমনভাবে ধরে ফেলেছে তাঁকে। মুহুর্মুহু কৌতূহল চাপা না রাখতে পেয়ে জানতে চাইলেন অরুণিমার কাছে, ‘জীবনানন্দের এই পরিণতির কী কারণ ছিল বলুন তো?’ মেয়েটা বিজ্ঞের ভঙ্গিতে বলল—‘বিপন্ন বিস্ময় বলে একটা অসুখের নাম জানেন? মজার ব্যাপার হলো জীবনানন্দ দাশ নিজেই এই অসুখের আবিষ্কারক আবার এর শিকারও তিনি।’
আর সহ্য হচ্ছিল না জীবনানন্দের। একেবারে বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়লেন। চোখ দুটো বন্ধ করে যেন নিস্তার পেতে চাইলেন অসহ্য সত্যের হাত থেকে। কিন্তু অরুণিমা ছাড়বে কেন? মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘আপনাকেও দেখি বিপন্ন বিস্ময় রোগে পেয়েছে। উঠুন, গাবতলী তো এসে গেল।’

শেয়ার