ধুলো, ধর্ম, ধোঁয়াশা
১.
যখন ঘরে ফেরে অন্ধ, কাতর অন্ধ,
দিনের শিরস্ত্রাণ খুলে ফেলে যখন পৃথিবী
কামড়ায় অন্ধকার চোয়াল মাংসে বসিয়ে;
যখন হাওয়াই যন্ত্রে বাজে বীরত্বের অর্গান,
যাতে সেজার ফ্রাঙ্ক বলছেন, ‘বাঁচো, বেঁচে থাকো,
জীবন আছে, থেকেই যাক…’
যখন ঘরের দেওয়ালে ছটফট করে হিংস্রতম জন্তু,
অর্থাৎ আয়না; যখন আয়নার কামড়ে
লাল দাগ পড়ে অন্ধের ঘাড়ের মাংসে–
তখন দেবতারা ওই অন্ধকে হটানোর ফন্দি আঁটছেন,
যেনো ওই অন্ধই যাবতীয় সুখ আর সিংহাসনের শত্রু,
তখন ওই অন্ধই মরিচগন্ধী শত শত চাতুরীর শিকার,
কেননা সে সোনার কাঁটায় খুইয়ে ফেলেছে দু’চোখ,
এবং তার জানালা তাকে গুপ্তচরের মতো অনুসরণ করে,
যখন সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, তখনও
এবং যখন সেজার ফ্রাঙ্ক হাওয়াই উৎসবে মাতাচ্ছেন অন্ধকার,
তখনও—!
অন্ধের শত্রু দেবতারাও,
কেননা অন্ধই চোখের খাবারে ছড়িয়ে দিতে পারে বিষ,
জীবনের মতো বিষ, যে বিষ
এক অন্ধকার রাতে খামচে ধরবে দেবতাদের চোখের মণি,
এবং মানুষের মাংসের বুদ্বুদে ডুবে সোনাখোর পেটুকের মতো
কেবল গিলবে নিজেকে,
নিজের প্রতারণাময় প্রতিচ্ছবিকে,
এবং তখনও সেজার ফ্রাঙ্ক অর্গান-শীৎকারে হেঁকে বলবেন,
‘বাঁচো, বেঁচে থাকো, জীবন আছে, থেকেই যাক,
থেকেই যাক…’
২.
যখন তুমি চূড়ার খুব কাছে,
তোমার ঘাড়ে অন্ধ, মরা পাথর;
যদি জানোই, এবারও পারবে না,
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে দেখো,
‘পাথর, কেনো গড়িয়ে পড়ে যাও?
‘পাথর, অনুশোচনা জাগছে না?
এই যে এই বারো মাসের খেলা,
একঘেয়েমি; গুমরে-মরা আদর;
ঘুণ-ধরা তো ভালোবাসায়ই বাঁচে!
পাথর, আমি সাফল্যের কাছে,
‘এবার যদি উতরে যেতে পারি,
মরণপণ বিশ্বাসের ঠেলা
সামলে নিয়ে সামনে যেতে পারি,
এমন অনুশোচনা আর ভয়,
উপচে-পড়া ভালোবাসার আতর,
‘পাথর, আমি অতল পৃথিবীতে
ধার্মিকের দ্বিগুণ অপচয়ে
লেপ্টে দেবো, আয়না-মাখা চুমো!
এই নীল, নিঃস্ব, পোড়া মাটি
অচেনা আর অন্ধ রইবে না!
‘আমার চিরদিনের ঘামে ভেজা
অর্থ আর নিরর্থের খেলা
এবার ভালোবাসায় ভরে ভাঙুক!
ধ্বস্ত এই দু’কাধ জুড়ে থাকো,
পাথর, আমি চূড়ার খুব কাছে!’
৩.
(Human All Too Human)
যেসব মানুষ ফিরে আসছে, উড়ে আসছে,
ঘূর্ণাবর্তে, স্মৃতির বিমানে চেপে,
সূর্যোদয়ে, সূর্যাস্তে, প্রকাশ্যে, চুরি করে,
আমার আত্মা যাদের জন্য চিরে ফাঁক হয়ে যাচ্ছে,
যাদেরকে স্থান দেওয়ার জন্য আমিই ক্রমশ শূন্য থেকে শূন্যতর হচ্ছি,
আমাকে মেরে ফেলছি, উড়িয়ে দিচ্ছি উধাও বিমানে,
সেই মানুষেরা সবকিছু দেখে হাসছে, লোহার ফলার মতো
জুড়ে বসছে আমার ঠিক সামনে,
যে আমি বেঁচে ছিলাম ফলাহীন, নিঃসঙ্গ, নিরাসক্ত লাশের মতো…
যেসব মানুষ ইতিমধ্যেই উড়ে গেছে, উড়ে যাবে,
আমার পিতা, পিতামহী, আমার শিক্ষক, প্রিয় কোনো রমণী,
কখনো না কখনো তারাও কেড়ে নেবে অন্য কারো রাতের নিদ্রা,
কাউকে না কাউকে করে ফেলবে শূন্য, মুখ ঝেড়ে ফেলে হাতে তুলে দেবে মুখোশ–
সবার কথা ভেবেই দুঃখ লাগে,
দুঃখ লাগে নিজের জন্য,
কারণ আমি জানি না আমি কবে কার উদ্দেশে নিজেরই অজান্তে উড়ে যাবো,
আমি শিকড় মাত্র, কিছুই জানি না মাটির উপরকার গাছ, ফুল, পাতার ব্যাপারে,
আমি শিকড় মাত্র, অথচ ফুলদানি আমার আরাধ্য,
আর তাই যেসব মানুষ ফুল-পাতা হয়ে জন্মায়, দেখে সত্যিকার পৃথিবীর মুখ,
ইচ্ছা কি অনিচ্ছায়, অচেতন কি অবচেতনে,
কোনো না কোনো ফুলদানিতে ঢুকে পড়তে পারে,
ঈর্ষা করি তাদেরকেই, আর তাদের মতোই ভীষণভাবে মানুষ হতে চাই, অন্তত একবার,
একবার শুয়ে থাকতে চাই সমবেত কার্পেটে,
যারা আছে, যারা থাকবে, যারা থাকবে না, যারা নেই,
যারা আসা ও যাওয়ার অতীত,
সবাই আমার আরাধ্য;
আমার আত্মা চিরে ফাঁক হয়ে যাচ্ছে, সারা শরীর হয়ে উঠছে গহ্বর,
আমি গলে যাচ্ছি, বা ভেসে যাচ্ছি, বা কী করছি আসলে জানি না–
শুধু সংকেত থেকে সংকেতে, চিহ্ন থেকে চিহ্নের অতীতে, সময় থেকে অসময়ে,
আমি জন্ম নিচ্ছি, আমি ডুব দিচ্ছি, আর সাঁতার কাটছি অসম্ভব হাতিমির মতো,
আমাকে ক্ষমা করে দিক তারা, যাদেরকে আমি দেখিনি,
আমাকে করুণা করুক তারা, যাদেরকে আমি অস্বীকার করেছি,
আমাকে গালমন্দ করুক সবাই, যদি চায়, কিন্তু ভোলে না যেনো, যে,
আমি শুধু কোনো সংকেত নই, সংগতি নই, আর এই পৃথিবী আমারও,
আমারও আমারও আমারও….
৪.
আমার বাবা ফুলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে
বললেন, ‘হে ফুল, হে ঈশ্বর,
আমার পুত্র হও!’
ফুলটা দপ করে জ্বলে উঠলো,
ছাই হয়ে গেলো নিমেষেই;
বাবা ছাইয়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে
বললেন, ‘হে ছাই, হে চিতা,
আমার পুত্র হও!’
বাতাস উঠলে ছাই উড়ে এলো বাবার শরীরে;
আচ্ছন্ন করে নিলো তার সারা গা;
এক সময় দপ করে জ্বলে উঠলেন বাবা;;
পুড়ে ছাই হ’য়ে খসে যেতে লাগলো তার চুল, চামড়া, উরু;
ফেটে গেলো অন্ত্র,
অস্থি-মাংস-মেদ-হৃদয় সুদ্ধু বাবা হারিয়ে যেতে লাগলেন।
আগুন নিভে গেলে সেখানে পড়ে রইলো একটা ফুল।
যে ফুলটার কাছে বাবা প্রার্থনা করেছিলেন, সেই ফুল।
বাবা ফুল হয়ে গেছেন। এই ফুল তার আত্মজ। তার পুত্র।
তখনো বাতাসে প্রার্থনা ভাসছে,
‘হে ফুল, হে অদৃশ্য, হে বাতাস, হে উদাসীন,
হে নিঃসঙ্গতা, হে চিতা, হে ধুলো,
আমার পুত্র হও, আমার পুত্র হও!’
৫.
কিছুক্ষণের জন্যেও নিজেকে ভুলতে পারি না;
চোখ বুজে থাকতে পারি না;
বিশ্রামে যেতে পারি না;
দেয়ালে টিকটিকি দেখি।
বইয়ের ফাঁকে তেলাপোকার উন্মত্ত ছোটাছুটি দেখে ভাবি
এমনই একটা তেলাপোকা হতে চেয়েছিলাম আমি,
হয়েওছি শেষ পর্যন্ত।
শুয়ে শুয়ে,
যে করেই হোক, জেগে থাকি৷
কারণ একবার চোখ বুজলেই দেয়ালের ছোট্ট আয়নাটা
সুড়সুড় করে হামাগুড়ি দিয়ে আমার ভেতরে ঢুকে পড়ে;
পরে চোখ খুললেই নিজের ভেতরে নিজের বীভৎস ছবি দেখে দেখে শিউরে উঠি বারবার!
অনেক তেলাপোকার সঙ্গে
আমিও একটা তেলাপোকার মতোই শুয়ে থাকি;
ঘুমাই না।
কারণ ঘুম থেকে উঠলেই দেখবো দেয়ালে আয়না নেই;
চারপাশে তেলাপোকাও নেই।
দেখবো ওরা সব আমার ভেতরে ঢুকে আয়নার ওপর কিলবিল করছে!
এমনকি এ-ও মনে হবে যে, ওরা হাসছে,
প্রতিবার নিজের আলাদা আলাদা ছবি দেখে।
আমার ইচ্ছে হয় লাফিয়ে উঠে বেসিনে যাই
আর বমি করে দিই;
উগরে দিই এই আয়না, এই তেলাপোকার উৎসব,
আর আমার নিজের হাজার ছবি, বীভৎস ছবি, টুকরো টুকরো ছবি,
উগরে দিই…
ফিরে এসে
আবার শুয়ে শুয়ে
জেগে থাকি।
দেয়ালে টিকটিকি দেখি
আর পাহারা দিই আয়নাটাকে।
কিছুক্ষণের জন্যও ভুলে থাকতে পারি না নিজেকে;
চোখ বুজে থাকতে পারি না।
৬.
আমি তো একটা দৈত্যের মতো ভালোবেসেছি ঘাড়ের বোঝা;
পায়ের উপর পা রেখে
তাল-নারকেল গাছ উপড়ে ফেলেছি অবলীলায়,
চুমুক দিয়ে সাবাড় করেছি একটার পর একটা পুকুর;
ভালোবেসেছি ক্ষুধা আর তৃষ্ণা;
আমি তো অন্ধের মতো ভালোবেসেছি শূন্য পৃথিবী;
অন্ধ চোখের কোটরের মতো শূন্য;
মানুষ নেই, আতশবাজি নেই, মা ও ছেলের ঝগড়াঝাটি নেই;
এক নিঃসীম নীরবতা চেপে ধরেছে আমাকে,
যেনো আরেকটু হলেই পুরোপুরি মাটিতে মিশিয়ে দেবে–
আমি সেই নীরবতাকে ভালোবেসেছি;
আমি তো একটা দৈত্যের মতো ফিরে যেতে চাই ছোট্ট বোতলে,
ধোঁয়া হয়ে, অদৃশ্য হ’য়ে;
আর নিজের ক্ষুদ্র ধাঁধাকে ভালোবেসে চুপ করে থাকতে চাই অনন্তকাল;
আমাকে কেউ বোতলে ভরে ছুঁড়ে দিক সমুদ্রে,
আমি একটা চিঠির মতো ভাসবো,
অনন্তকাল না-খোলা,
অন্ধ, অদৃশ্য,
দৈত্যের মতো নিজের মধ্যে বিশাল, নিজের ধাঁধার মালিক!
৭.
বড়ো সুন্দর জেনে গেলি মানবজীবন,
রূপসী মেয়েতে মজে ঢের গান করে গেলি সূর্যাস্তের, স্বপ্নের;
কিছুই পেলি নে টের কতো ধানে কতো চাল, চালচুলো না বুঝে হাঁটলি কতো পথে!
আজ তোর সময় হয়েছে, তুই যা, আঘাটায় যা তুই, ভেসে যা!
বড়ো বিশ্বাস করে গেলি পাতায়, ঈশ্বরে, ফুলে,
পৃথিবীতে যা কিছু চমক জাগায়, আর নিরানব্বই রকম সুন্দর–
কোনোটা ভাবলি নে মিথ্যে; ভালোবাসলি নারী, শিশু, সূর্য, সঙ্গম, মধুমেলা!
আজ তোর সময় হয়েছে, তুই যা, আঘাটায় যা তুই, ভেসে যা!
বড়ো মধুময় দেখে গেলি আকাশ, পৃথিবী, সন্ধ্যা,
করলি নে কার্পণ্য, কিছু এড়ালো না তোর শূন্য, কাঁচা চোখ;
না রূপ, না মাধুরী; সবই সুন্দর, শেষে তুই পাথরেও জাগালি পাখির ঝর্ণা,
আজ তোর সময় হয়েছে, তুই যা, আঘাটায় যা তুই, ভেসে যা!
৮.
আমার সামনে দিয়ে একটা ভাঙা আয়না হেঁটে চলে গেলো;
তার পেছনে টুকরো টুকরো ছায়া;
যারা অনন্ত পথ পেরিয়েছে, কিন্তু ঢুকতে পারেনি আয়নায়;
এখন তাদের মতো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে আমার ছায়াও!
একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা আমাকে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে রাখতে চাইছে,
আমার দেহ চাপে, চাপে, কাঁটায়, কাঁটায় ভরে যাচ্ছে
ক্রমশ অদৃশ্যমান আমার মাংস, রক্তহীন প্রত্যেকটা শিরা;
বুঝতেই পারছি, আমি টুকরো টুকরো হচ্ছি;
এই পাগলা হাতি আমাকে আয়নার পেছনে না ছুটিয়ে ছাড়বে না!
আমি আমার নিজের রক্ত খেয়ে বেঁচে ছিলাম সুদীর্ঘকাল;
হাজার বছর ধরে আমি কোনো আয়না দেখিনি;
স্বচ্ছ জলের সামনে যাইনি প্রলোভন সত্ত্বেও;
আমি আমার নিজের ছায়াকে বিশ্বাস করে কাটিয়ে দিয়েছি যুগের পর যুগ;
একবারও মনে হয়নি কোনো কিছু দরকার-
আর আজ সেই ছায়া ছড়িয়ে যাচ্ছে, ফালা ফালা হয়ে, টুকরো টুকরো!
প্রচণ্ড বর্ষা আমার ভেতরে;
এখানে ওখানে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত, লাফাচ্ছে আনমনে পাগলা হাতিটা;
আর গলার ঘণ্টি বাজিয়ে মাঝেমাঝে দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে
আমাকে ছিন্ন করে, শূন্য করে চলে যেতে চাইছে অনন্ত দূরে কোথাও;
আমি বিরামহীন অপেক্ষা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি কখন সারা শরীরে ফাটল ধরবে!
আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে হাজার হাজার ভাঙা আয়না,
আর তাদের পেছনে কোটি কোটি ছায়া,
রক্তাক্ত, টুকরো টুকরো;
আমি চোখ বুজে থাকতে চাইছি দেখবো না বলে, কারণ প্রেমিকের শত্রু আয়না;
কিন্তু পারছি না; আমার চোখ যেনো পাগলা হাতিরই চোখ;
তার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা!
যে কারণে আমাকে জ্যান্ত কবরে পুঁতে রাখলেও আমি টের পাবো না কিচ্ছুটি,
আর বুঝতে পারবো না আমাকে কেউ ভালোবাসলেও;
যে কারণে আমার প্রতিটা টুকরো ছায়া পাগলা হাতির মতো নিষ্ঠুর আর শক্তিমান,
আমি এখন খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে ভাঙা আয়নার পেছনে ছুটছি;
নিজেকে দেখার নেশা, নিজের বিষাক্ত অবয়ব দেখার পাগলামি ভর করেছে আমাকে;
আমার ভেতরেরই কোনো অনাদিকালের শত্রু আমাকে জয় করে নিয়েছে,
যার কাছে আমি অসহায়, যে কারণে এই চলা তারই চলা,
এই ভাঙা আয়না তারই নেশা, আমি কেবল দেখে যাচ্ছি, আর ঘুমের ভেতরে হেঁটেই যাচ্ছি!
অরিত্র আহমেদের জন্ম ২০০০ সালে, যশোরে। বেড়ে ওঠেন যশোরের এক গ্রামেই। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগে। ভালোবাসেন দর্শন, কবিতা ও নির্জনতা।