৫.
আজ ট্রেনিং এর প্রথম দিন। সকাল সাতটা নাগাদ চুপিচুপি অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল ইন্দিরা। বাইরে ঠান্ডা হাওয়া সুপ্রভাত জানিয়ে যাচ্ছে সবাইকে। রাস্তার পাশে ছোটো ছোটো দোকানে ব্রেকফাস্ট তৈরি হচ্ছে, ইডলি, দোসা, বড়া, পোলাউ আর পোহা। প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিলে তাই খেয়ে চলে যাচ্ছে মানুষেরা। ইন্দিরা একটা দোকানে এসে বসে। ভাষাগত সমস্যা পার হয়ে একটু চেষ্টার পর সে ইডলির অর্ডারও করে ফেলতে পারে। ইন্দিরার মনে হল এখানকার স্থানীয় মানুষের মুখচোখ বাঙালি রকম নয়, সবার মধ্যেই কম বেশি রুক্ষতা আছে, হয়তো মাটিটাই রুক্ষ, তাই। বেশিরভাগ স্থানীয় মানুষই কৃষ্ণকায়, সবল, কর্মঠ। বাঙালি রক্তের সহজাত লাবণ্য এদের নেই।
ইডলি শেষ করে বাসস্টপে এসে দাঁড়ায় ইন্দিরা। রাস্তায় বেশির ভাগ বাসই সরকারি। তাতে উর্দি পরা চালক ও সহকারী। এবং অফিসটাইম হওয়া সত্ত্বেও বাসে ভীড় নেই কোলকাতার মত। ইন্দিরার মনে হয়, হয়তো কোলকাতার থেকে এখানে জীবনযাপন অনেক সহজ। বেশ ফাঁকা একটা বাসে উঠে পড়ে ইন্দিরা। আর দেখে তার সামনেই রুবাঈ দাঁড়িয়ে আছে।
“তুমি?”
রুবাঈ হাসে।
“এত সকালে যাচ্ছো যে?”
উত্তর দেওয়ার বদলে, “তুমিও তো এত সকালেই যাচ্ছো” বলে জেনারেল সীটে গিয়ে বসে রুবাঈ।
একটু অবাকই হয় ইন্দিরা, সে মহিলাদের সীটে বসে পড়ে। এত সকালে রুবাঈ কি কারণে বেরিয়েছে…
আধ ঘন্টার পর বাস থেকে নেমে ইন্দিরা আর রুবাঈ হাঁটতে শুরু করে ট্রেনিং সেন্টারের দিকে।
রাস্তার দু পাশে নির্দিষ্ট ফুট পাথ, তার পাশে চকচকে খবারের দোকান, চায়ের দোকান। আর মাঝে মাঝেই বিরাট বিরাট গোলাপি ফুলে ভরা বসন্ত রানি গাছ দাঁড়িয়ে আছে ফুট পাথে। চকচকে গাড়ি চলে যাচ্ছে চকচকে রাস্তা দিয়ে, গাড়ির মধ্যের মানুষগুলোও অদ্ভুত রকমের চকচকে, ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চকচকে মানুষেরা এই শহরে এসে বসতি গড়ে তুলে শহরটাকে আরো চকচকে করে ফেলছে, প্লাস্টিকের মত।
“নতুন ফ্ল্যাটমেটকে কেমন লাগছে?”
রাস্তায় চোখ রেখেই ইন্দিরা জবাব দেয়, “ভালোই”
“এখনো বাইরের খাবারই খাচ্ছো?”
“না, ও বানাচ্ছে, আমি সাহায্য করছি অল্পস্বল্প”
“ব্রেকফাস্টে কি বানালো আনন্দী?”
“আমি বাইরে ব্রেকফাস্ট করেছি আজকে”
“কেন?”
“ওকে ডাকতে ইচ্ছে হল না”, বলেই ইন্দিরা নিজেকে শুধরে নিল, “মানে, ইচ্ছে করেই ডাকিনি”
“কেন?”
কেন… এর যে উত্তরটা ইন্দিরার ঠোঁটে ঝুলছে সেটা বলে ফেলার মত নৈকট্য এখনো হয়নি তার রুবাঈয়ের সাথে। কোনোদিন তার অতটা কাছে রুবাঈ আসতে পারবে কি না, তাও জানা নেই। তাই জবাবটাকে দীর্ঘশ্বাস দিয়ে নিভিয়ে দেয় ইন্দিরা, বলে, “জানিনা”
“তাই? আমি বোধ হয় জানি, কেন…” কথাটা শেষ হয়না রুবাঈয়ের, উপরের দিকে তাকিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে রুবাঈ। রুবাঈয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে ইন্দিরা দেখে, প্রায় পাতা ঝরা একটা বিরাট গাছের সব থেকে উঁচু ডালে বসে আছে একটা ঈগল। ঠান্ডা হাওয়ায় তার বুকের ধবধবে সাদা পালক অল্প অল্প নড়ছে।
একটু পরে পাখিটা অন্য কোথাও উড়ে চলে যায়। ইন্দিরারা হাঁটতে শুরু করে।
ইন্দিরা বলে, “এই প্রথম আমি ঈগল দেখলাম নিজের চোখে”
“আমিও”
ইন্দিরা আর রুবাঈ চুপচাপ পথ হেঁটে চলে। ট্রেনিং সেন্টারের কাছে এসে পড়লে রুবাঈ হঠাৎ বলে, “পাখিদের ব্যাপারে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছো?”
“কি?”
“যে যত উপরে, সে তত একা, তত নিশ্চুপ”
ইন্দিরা বলে ফেলে, “কিন্তু আমরা তো পাখি নই রুবাঈ…” বলেই বোঝে তার সংযত হওয়া প্রয়োজন… রঞ্জনার গলা কানে বাজে… নগ্ন হওয়া চলবে না।
রুবাঈ হাসে, উত্তর দেয় না কোনো।
ট্রেনিং সেন্টারে এসে পৌঁছোতে তারা দেখে দক্ষিণ ভারতীয় দু একজন এসে বসে আছে এদিকে ওদিকে। ইন্দিরা পছন্দমত একটা কোণ বেছে নেয়। একটু ঘেরাটোপে থাকা নিজের সীটে বসে তার সহজ বোধ হয়। বাকীদের নজরের একটু আড়ালে বসে ইন্দিরা তার সামনের কম্পিউটার অন করে।
পাশে বসা রুবাঈ বলে ওঠে, “আচ্ছা ধরো যদি আনন্দীরও একই ডোমেন হয়, আর ও এই ট্রেনিং সেন্টারেই আসে?”
এটা মাথায় আসেনি ইন্দিরার, আরো একটু কোণের দিকে সরে বসে সে।
রুবাঈ অল্প হাসে তাকে দেখে।
তখনই তাদের পাশে একটা মেয়ে এসে বসে পড়ে। একটু লম্বাটে গড়ন, দেখে উত্তর ভারতীয় বলে মনে হয়। তার লম্বা বেণী কোমর পর্যন্ত পৌঁছে থেমে গিয়েছে। বড় বড় চোখ মেলে মেয়েটা কিছুক্ষন তার চারপাশটা দেখে নিয়ে রুবাঈকে জিজ্ঞেস করে সে সময়ের আগে এসে পৌঁছেছে কি না…
রুবাঈ তাকে কিছু জবাব দেয়, ইন্দিরা শোনে না। সে ততক্ষণে নিজের মধ্যে ঢুকে এসেছে। আনন্দীরও কি একই ডোমেন? আনন্দীকে জানিয়ে আসা উচিত ছিল কি? যদি ঘুম থেকে উঠে তাকে না দেখে আনন্দীর দুশ্চিন্তা হয়? ইন্দিরা আনন্দীর কথা ভাবছে কেন? নিজের ভিতর থেকে হুড়মুড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে ইন্দিরা।
সে খেয়াল করে বড় বড় চোখ নিয়ে মেয়েটা তাকে কিছু একটা প্রশ্ন করছে, সে বলে, “সরি, আরেক বার বলো…”
“তোমার কাছে এক্সট্রা পেন হবে?”
কিছু না বলে নিজের পেনটা এগিয়ে দেয় ইন্দিরা তার দিকে।
পেন নিয়ে মেয়েটা অল্প হেসে বলে, “আমার নাম হিরণ”
“আমি ইন্দিরা”, হিরণ… সোনার? ইন্দিরা মনে মনে ভাবে।
“এই কোণায় এসে বসেছো কেন? সামনে গিয়ে বসি চলো…”
ইন্দিরা না বলতে পারে না। সামনে থাকা কম্পিউটার বন্ধ করে সে আর রুবাঈ উঠে এসে হিরণের সাথে সামনের সারিতে বসে।
হিরণ জিজ্ঞেস করে, “তুমি কোলকাতা থেকে এসেছো, তাই না?”
“হ্যাঁ,” ইন্দিরা অবাক হয়, এরা সবাই কিভাবে যেন বুঝে ফেলছে যে সে বাঙালি, তার মধ্যে বাঙ্গালিয়ানা কি অতই প্রকট, বিস্ময় নিজের মধ্যে রেখেই ইন্দিরা জিজ্ঞাসা করে, “তুমি?”
“চণ্ডীগড়, তুমি শোনোনি, যখন ইন্ট্রোডাকশান চলছিল ট্রেনার আমায় চণ্ডীগড় সম্পর্কে বলতে বলেছিলেন…”
ইন্দিরার মনে পড়ে না, সে রুবাঈয়ের দিকে তাকায়, রুবাঈ হাসে ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে।
হিরণ বলে চলে, “তুমি সত্যিই শোনোনি? তুমি তো ছিলে সেখানে, হ্যাঁ, মনে আছে আমার, এক কোণায় বসে ছিলে ক্লাসের… নাহ্ তুমি হয়তো অন্যমনস্ক ছিলে, নয়তো আমার স্পিচ তুমি মিস করতে পারো না।”
এতসব রায় এবং সিদ্ধান্তে একটু হকচকিয়ে যায় ইন্দিরা, আর তখনই ক্লাসে ঢোকে আনন্দী। যেন ইন্দিরা বা রুবাঈকে দেখতে পায়নি সে, একটু পিছনে গিয়ে বসে আনন্দী পাশের দক্ষিণ ভারতীয় মেয়েদের সাথে কথা বলতে শুরু করে।
ইন্দিরা তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে শোনে হিরণ বলছে, “আমার হবিই হোল বিভিন্ন সভায় বক্তব্য রাখা, আমি তাৎক্ষনিক বক্তৃতায় ইন্টার কলেজ চ্যাম্পিয়ন ছিলাম পর পর তিন বছর, তুমি কি করো?”
বাঙময়তায় বিপর্যস্ত ইন্দিরা বলে, “লিখি।”
“কি লেখ?”
“ওই গল্প, গদ্য…”
“ইংলিশে?”
“না, বাংলায়”
হিরণ আশাহত হয় অল্প, পরমুহূর্তেই বলে, “তোমার বই আছে?”
“না”
আরো একটু আশাহত শোনায় হিরণের গলা, “তাহলে ব্লগ লেখ?”
“না, ই-ম্যাগাজিনে লিখি”
“আচ্ছা, খুব ভালো” বলেই অদ্ভুত চুপ করে যায় হিরণ।
ইন্দিরা রুবাঈয়ের মুখের দিকে তাকায়, রুবাঈকেও একই রকম বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে। রুবাঈ ফিসফিস করে ইন্দিরাকে বলে, “আনন্দী কিন্তু আমাদের দেখেছে”
ইন্দিরা বলে, “তো?”
রুবাঈ হেসে ফেলে, “কিছু আসে যায় না বলছো?”
ইন্দিরার রাগ হয় রুবাঈয়ের ওপরে, সে কিছু বলে না, মাথা শক্ত করে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্লাসে ট্রেনার ঢুকতে সবাই সুপ্রভাত জানায় তাঁকে।
অল্প অল্প করে কাজ শুরু হয়, ট্রেনার বিভিন্ন তত্ত্বের সাথে পরিচিত করতে থাকেন তাদের। ইন্দিরা যদিও তার কিছুই বুঝতে পারে না। সে খেয়াল করে সবাই খুব মন দিয়ে শুনছে, এমনকি আনন্দীও, খুবই মন দিয়ে সে নোটস নিচ্ছে তার খাতায়। ইন্দিরা নিজের খাতার দিকে তাকায়, সেখানে ডুডল আঁকা, একটা মাথা, পুরুষ না নারীর বোঝা যায় না- তার মধ্যে একটা মাইক্রোফোন, সেই মাইক্রোফোনে ক্রমাগত আওয়াজ উঠছে “Do, dodo, dodo dodo dodo, dodo!!!!”
ইন্দিরা সামনের দিকে তাকায়, হোয়াইট বোর্ডে নীল কালিতে লেখা আছে, “the wound is the place where the Light enters you…” চমকে ওঠে ইন্দিরা, ভালো করে তাকাতে সে দেখে, না, রুমি নয়, অন্য কিছু অর্থহীন লাইন লেখা আছে বোর্ডে।
লাঞ্চ ব্রেকে রুবাঈ আর হিরণের সাথে খাবার খেতে আসে ইন্দিরা। একটু দূরে দক্ষিণ ভারতীয় মেয়েদের সাথে খেতে বসেছে আনন্দী। এখনও যেন সে ইন্দিরা বা রুবাঈকে দেখেনি এমন ভাবে হেসে গল্প করে চলেছে টেবিলের বাকীদের সাথে। খাবারের সারিতে সবই প্রায় দক্ষিণ ভারতীয় খাবার। টকের মাত্রা সবেতেই বাঙালি খাবারের তুলনায় অনেকটা বেশি। একটা খিচুরির মত দেখতে খাবার নিয়ে আসে ইন্দিরা। পাশ থেকে রুবাঈ বলে, “এটা বিসিবালাবাথ, তুর ডাল দিয়ে তৈরি হয় সাধারণত, খেয়ে দেখো, ভালো লাগতে পারে”
এক প্লেট বিসিবালাবাথ নিয়ে ইন্দিরা টেবিলে এসে বসে। প্রথম চামচ তুলতেই আনন্দীর সাথে চোখাচুখি হয়, তাকে দেখে আনন্দী চোখ সরিয়ে নেয় সাথে সাথে। ইন্দিরা চট করে চামচটা মুখে পুরে দেয়,- গরম চামচ মুখে পুরে ফেলায় তার জিভের অনেকখানি পুরে যায় দুম করে। ইন্দিরার চোখে জল চলে আসে যন্ত্রণা চাপতে গিয়ে, সে অন্য দিকে তাকায়। অন্য দিকে আকাশ, নীল, মেঘ হীন, এক ঘেয়ে নীল আকাশ। খাবারটা খিচুড়ির মতই প্রায়, তবে মশলার হেরফের হওয়ায় স্বাদ অনেকটাই আলাদা, ইন্দিরা খাবারটা গিলে ফেলে। আকাশে চোখ রেখেই ইন্দিরা আন্দাজে বোঝে, পাশে বসে রুবাঈও বিসিবালাবাথ খাচ্ছে, চামচে ফুঁ দিয়ে দিয়ে।
এসবের মাঝেই হিরণ বলে, “তুমি কি নিয়ে গল্প লেখো?”
ঘোর কাটে ইন্দিরার, সে বলে, “সেরকম কিছু না, যা মাথায় আসে…”
“রোম্যান্টিক?”
“খুব একটা না”
“তবে?”
উত্তর খোঁজে ইন্দিরা। একটু ভেবে বলে, “নির্দিষ্ট কিছু নেই, যা দেখি, যা মনে দাগ কেটে যায়, যেমন ধরো এই লাঞ্চব্রেক, আমাদের একটা গোটা দিনকে ভেঙে ফেলে বিরতি তৈরি করা হয়েছে। বিরতিতে আমাদের কাজ থেমে যায়, আমরা চুপ করে বসে থাকি। তেমনই হয়তো গোটা একটা মানুষ ছিল, আর তুমি ধরো তাকে ভেঙে ফেললে। ভেঙে যাওয়া মানুষটা কি করবে এখন… চুপ করে বসে থাকা ছাড়া…”, ইন্দিরা দেখে হিরণ তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। পাশে বসে রুবাঈ আকাশের দিকে তাকিয়ে শিস দিয়ে খুবই চেনা কোনো গান গাইছে,- ইন্দিরা ধরতে পারে না, সে মুখের কথাটা শেষ করে, “এইসব নিয়েই লিখি আর কি”, তার গলা ধরে আসে।
“এই ব্রেক নিয়েও তার মানে তুমি লিখবে?”, হিরণ জানতে চায়।
“হয়তো, কোনো একদিন…”, আনন্দীর দিকে তার চোখ চলে যায়।
 
ক্লাসে ফিরে আসার বেশ কিছুক্ষণ পর ইন্দিরা বোঝে তার মাথায় ট্রেনারের কোনো কথাই ঢুকছে না, উলটে রুবাঈ যে গানটা শিস দিয়ে গাইছিল, সেটাই ঘুরে ফিরে বেজে যাচ্ছে তার মাথায়,- “আ ফির সে মুঝে ছোড়কে যা নে কে লিয়ে আ” আরামে চোখ বুজে আসে তার। হঠাৎ খেয়াল হয় ট্রেনার তাকে কিছু জিজ্ঞেস করছেন। ইন্দিরা সতর্ক হয়,
“তুমি কিছু একটা গাইছিলে মনে হয়…”
সে কি তাহলে মনে মনে গাইছিল না?! “না মানে, গাইছিলাম না…” লজ্জায় ইন্দিরার কান গরম হয়ে যায়।
“একটু জোরেই গাও, আমরাও শুনি…”
ট্রেনারের হাসিমুখ দেখে ইন্দিরা চারপাশে তাকায়, ক্লাসের সবাই হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
গলাটা একটু পরিষ্কার করে ইন্দিরা গেয়ে ওঠে, “রঞ্জিশ হি সহি…”
ক্লাসরুম সুরে ভরে ওঠে, চোখ বুজে গাইতে গাইতে ইন্দিরা খেয়াল করে মারাসিম শব্দটার মানে তার মনে নেই, কি যেন মানে ছিল শব্দটার… মনে পড়ে না। প্রানপনে চোখ বুজে নিজেকে সামলে গেয়ে চলে ইন্দিরা। সে থামলে ক্লাসের সবাই হাততালি দিয়ে ওঠে।
“তোমার গলাটা বেশ ভালো, গান শিখেছো?”
ইন্দিরা ধরে আসা গলায় জবাব দেয়, “বাঙালি পরিবারে গান বাজনার চর্চা চলে সবসময়, সেভাবেই…”
“আচ্ছা, খুব ভালো, গান তো হল, এবার বলো ওয়াটারফল মডেল বলতে কি বোঝ”
ইন্দিরার অসহায় লাগে, এখনও পর্যন্ত সে কিছুই মন দিয়ে শোনেনি। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন বলে ওঠে, “The waterfall model is a sequential, specifically non-iterative design process, used in software development processes, in which progress is seen as flowing steadily downwards just like a waterfall through the phases of conception, initiation, analysis, design, construction, testing, production or implementation and maintenance.”
পিছন ফিরতে ইন্দিরা দেখে আনন্দী দাঁড়িয়ে আছে।
ট্রেনার বলেন, “আমি যদিও ওকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, তবুও খুব ভালো উত্তর দিয়েছো। ধন্যবাদ। বসে পড়ো দুজনেই।”
আনন্দী চেয়ারে বসে, খাতায় তাড়াতাড়ি কিছু লিখে নেয়। ইন্দিরা ধীরে ধীরে বসে নিজের জায়গায়। রুবাঈ জিজ্ঞেস করে, “কি হল?”
“খারাপ লাগছে”
“কেন?”
পায়ের প্রায় সেরে আসা ক্ষতটা মনে মনে পরখ করে ইন্দিরা বলে, “ওকে না ডেকে চলে আসাটা উচিত হয়নি।”
রুবাঈ আর হিরণের সাথে ট্রেনিং শেষে রাস্তায় বেরিয়ে ইন্দিরা দেখে একটু আগে আগে দক্ষিণ ভারতীয় দলটার সাথে হেঁটে যাচ্ছে আনন্দী। তাদের সাথে কিছুটা দূরত্ব রেখে ইন্দিরারা হেঁটে চলে।
হিরণ বলে, “গানটা খুব সুন্দর গেয়েছো তুমি”
“ধন্যবাদ”, ইন্দিরার মনে পড়ে কিভাবে প্রতিটা শব্দ ধরে ধরে রঞ্জনা তাকে গানটা তুলে দিয়েছিল। শব্দের অর্থ, তার প্রয়োগ, বিরতি, সুর- সমস্তটা। ঠিক সেভাবে কি গাইতে পারলো? না মনে হয়, কত কি সে ভুলে গিয়েছে, কত কি সে ভুলে যায়। ইন্দিরাদের সামনে হেঁটে চলা দল থেকে দক্ষিণ ভারতীয় ছেলে মেয়েরা বাঁ দিকে বেঁকে যায়, রাস্তার মোড়ে একা দাঁড়িয়ে পড়ে আনন্দী। ইন্দিরা থমকে যায়।
রুবাঈ আর হিরণ দুজনেই জিজ্ঞাসা করে, “কি হল?”
“তোমরা এসো, আমি ওর সাথে একটু কথা বলে আসি”
হিরণ বলে, “কে ও?”
কোনো জবাব না দিয়ে ইন্দিরা আনন্দীর দিকে হেঁটে চলে আসে।
“হাই”
আনন্দী ভ্রূ কুঁচকে তাকায় ইন্দিরার দিকে, “হাই”
“তুমি কি জানতে যে আমি উত্তরটা জানিনা?”
“kind of”
“কি করে?”
গম্ভীর ভাবে আনন্দী বলে, “সারাক্ষণ বোর্ডের দিকে ড্যাবড্যাব করে কেউ তাকিয়ে আছে মানে তার মন পড়ায় নেই, অন্য কোথাও আছে”
“শুধু বোর্ডের দিকেই তাকিয়ে থাকিনি, খাতায় একটা ডুডলও করেছি, দেখবে?”
ইন্দিরার কথায় আনন্দী হেসে ফেলে। আনন্দীর মুখ থেকে ইন্দিরা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে, “আমি জানতাম না যে তুমিও আমার সাথে ট্রেনিঙে আছো”
“তাই বলে সকালে উঠে না খেয়ে বেরিয়ে আসবে? আর আমি জানি আমি রান্না ভালো করি। তাই তুমি বলতেও পারবে না যে বাইরের খাবার বেশি ভালো খেতে। সকালে উঠে খাবার বানিয়ে তোমার দরজায় নক করতে বুঝলাম তুমি আমায় না জানিয়ে চলে গেছো”
“আমারও ইডলিটা খেতে মোটেও ভালো লাগেনি”
আনন্দী কিছু বলেনা।
“কাল থেকে সকালে উঠে এক সাথে খাবার বানাবো”
আনন্দীর ভ্রূ সহজ হয়, সে বলে, “গানটা খুবই ভালো গেয়েছো”
“যে শিখিয়েছিল খুব যত্নের সাথে শিখিয়েছিল, তাই আর কি…”
“শুধু যত্ন… না দর্দ দিয়েও শিখিয়েছিল?”
রঞ্জনার মুখটা ভেসে উঠেই মিলিয়ে যায়, দর্দ… অর্থাৎ দরদ।
“হ্যাঁ। দর্দ দিয়েও শিখিয়েছিল।”
বলতে বলতে একটা বাস এসে থামে ইন্দিরাদের সামনে। ইন্দিরা হিরণ আর রুবাঈয়ের দিকে তাকায়। তারাও বাস ধরার জন্য এগিয়ে এসেছে। বাসে উঠতে উঠতে কি মনে হতে ইন্দিরা আনন্দীকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা মারাসিম মানে জানো তুমি?”
“না তো, কি?”
“আমিও জানিনা”, নিজেকে শুধরে নিয়ে ইন্দিরা বলে, “জানতাম… এখন আর মনে নেই।”
চলবে