ধারাবাহিক উপন্যাস — তারাদের ঘরবাড়ি । অলোকপর্ণা ।। অষ্টম পর্ব

                                                   ৮ম পর্ব

 

সকাল কিভাবে আসে? বাসে যেতে যেতে ভাবতে থাকে ইন্দিরা।

অতর্কিত ভাবে? আচম্বিতে? অযাচিতভাবে না অবশ্যম্ভাবী? আনন্দী তার কাছে রাত শেষে সকাল হওয়ার মতো এসে পড়ছে। দরজা জানালা বন্ধ করে রাখার পরেও ঘুলঘুলি দিয়ে এসে পড়া গোপন রোদের মতো ইন্দিরার মাথায় ঢুকে আসছে আনন্দী। আবার আনন্দীর আসাটাকে রোদ আসা বা সকাল হওয়া বলা যাবে কি? রাতের পরে কি আরো রাত আসতে পারে না?

বাসটা ঝাঁকুনি দিয়ে থামে।

দরজার কাছ থেকে রুবাঈ চেঁচিয়ে ডাকে ইন্দিরাকে, “নামবে না?!”

চমকে উঠে দরজার দিকে দৌড়ে যায় ইন্দিরা। আনন্দী আর হিরণ সামনের দরজা দিয়ে নামছে। আনন্দীকে আড়চোখে দেখে ইন্দিরা। কাঁচা হলুদ কুর্তির রঙ তার গায়ের সাথে মিশে যাচ্ছে। বাস থেকে নেমে আসে সে। দেখে আনন্দী হিরণের সাথে কি বিষয়ে যেন কথা বলছে। সে আনন্দীর মুখের দিকে তাকায়। উত্তর ভারতীয় মুখটাকে কি সুন্দর বলা চলে? শারীরিক সৌন্দর্য্যবোধ ইন্দিরার বরাবরই কম। সংশয় নিয়ে রুবাইয়ের দিকে তাকায় সে।

রুবাঈ বলে, “কিছু বলবে?

কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই ইন্দিরা জিজ্ঞাসা করে, “আনন্দীকে দেখতে কেমন?”

রুবাঈ বলে, “তোমার কেমন লাগে?”

“কোনো মানুষকে দেখতে কেমন তা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। অন্যের উপর নির্ভর করতে হয় আমায়”

“কেউ আমার চোখে সুন্দর হলে কি তোমার চোখেও সুন্দর হবে? বা তার উল্টোটা?”

“তাও জানি না, প্রথাগত সৌন্দর্য যা দিয়ে মাপা হয় তা যদি কারোর মধ্যে থাকে তবে আমি পর্যবেক্ষণ করে হয়তো বলতে পারবো, কিন্তু সৌন্দর্যবোধ থেকে সহজাতভাবে বলতে পারবো না…”

“ভালো করে দেখো তাহলে… নজর খালি ভিতরের দিকেই হলে চলবে? চোখের দিকে চোখ রেখেছো খালি, বাইরেরটুকু তোমার নজরে ধরা পড়েনি তাই” বলে ইন্দিরাকে নিয়ে রুবাঈ হিরণদের কাছে চলে আসে।

হিরণকে নিয়ে রুবাঈ ব্যস্ত হয়ে পড়লে আনন্দী আর ইন্দিরা পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে।

“ভাবছি রাতে পনির পরোটা বানাবো”

আনন্দীর কথায় ইন্দিরা তার মুখের দিকে তাকায়। রুবাঈয়ের কথা মতো ইন্দিরা বাইরের দিকে চোখ পাতে… ঝকঝকে সাদা দাঁত, এই শহরের সবকিছুর সাথে মিলিয়ে যেন সে রঙ রাখা হয়েছে। আপাত পুষ্ট ঠোঁট, গোলাপি নিজের রঙেই, যার নরম ছোঁয়াচ কাল রাত থেকে এখনও ইন্দিরার কপালে লেগে আছে। ঠোঁটের সাথে মানানসই নাক, সুচাগ্র নয় অথচ উন্নত। চোখ… উজ্জ্বল। ইন্দিরা সেটা আগেই লক্ষ্য করেছে। চোখের ব্যাপারে সবার আগে রঞ্জনার কথাই মনে পড়ে ইন্দিরার… রঞ্জনার চোখের কথা। অমন বাঙময় বোধ হয় জয় গোস্বামীর কবিতাও নয়।

“খাও তো তুমি, পনির পরোটা?”

আনন্দীর প্রশ্নে বাস্তবে ফিরে এসে মাথা নেড়ে সায় দেয় ইন্দিরা, আনন্দীর চোখে রোদ্দুর সুলভ অস্থিরতা আছে, বা প্রজাপতির মতো সামান্যতা। সমান উজ্জ্বল।

মাথা নামিয়ে ইন্দিরা ভাবে, তাহলে কেমন দেখতে আনন্দীকে? এত খুঁটিয়ে দেখার পরেও বুঝতে পারে না সে। হতাশ লাগে। একটু এগিয়ে যাওয়া রুবাঈকে ডেকে তা জানাতে ইচ্ছে হয়।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে উত্তেজিত স্বরে আনন্দী বলে, “আরে দেখো দেখো!”

ইন্দিরা দেখে ছোট ছোট দুটো কুকুর ছানা তাদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে। রুবাঈ আর হিরণও আনন্দীর গলা শুনে পিছিয়ে এসেছে। ইন্দিরার হাতে নিজের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে কুকুরছানাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে আনন্দী। আশকারা পেয়ে ছানা দুটো এগিয়ে এসে শুঁকতে শুরু করেছে আনন্দীকে। রুবাঈ আর হিরণও যোগ দিল আনন্দীর সাথে। ইন্দিরা দেখে বাচ্চা দুটোকে আদর করতে করতে আনন্দী হাসছে। ইন্দিরার শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।

চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না, এই হাসির নিজের আলো আছে যেন। তবু ইন্দিরা জোর করে হাসতে দেখে আনন্দীকে, গলা শুকিয়ে আসে তার। এর সাথে কিসের তুলনা হয়? সকাল? হলুদ আবির? ডি মেজর কর্ড?… নেশা, নেশার মতো। আনন্দীকে নেশার মতো দেখতে।

আর কিচ্ছু জানার নেই ইন্দিরার।

 

 

রুবাঈ আর হিরণকে মাঝে রেখে আনন্দীর থেকে একটু দূরে বসে ইন্দিরা। ট্রেনার হোয়াইট বোর্ডে লিখতে শুরু করলে রুবাঈকে সে গতকাল রাতের কথা বলতে শুরু করে।

“তুমি ঘুমের মধ্যে কি বলেছিলে?”

“জানিনা”, মায়ের প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যায় ইন্দিরা।

“দেখো, আমি সামনে থেকে সেই মুহূর্তে তোমাদের দেখিনি, তাই বলতে পারবো না আনন্দীর মনের মধ্যে ঠিক কি চলছিল তখন। কিন্তু এটা তো মানো যে দুটো পুরুষ বা দুজন নারী পুরুষের সম্পর্কের থেকে দুজন নারীর সম্পর্ক অনেকটা আলাদা হয়। তারা একে অপরকে যে স্তরে বুঝতে, জানতে, ভাগ করে নিতে পারে আগের দুটো ক্ষেত্রে তা ততটা হয় না। একটা না জানা থেকেই যায়। একটা দূরত্ব থেকেই যায়। আমার মনে হয় ও বুঝতে পারছে তোমাকে। ধরতে পারছে। আমিও পারি, কিন্তু তার কারণ তুমি অনেকগুলো কথা আমায় জানিয়েছো, আমার সাথে বেশ কিছুটা সময় থেকেছো। কিন্তু যতই হোক ও তোমার যতটা কাছে আসতে পারবে, যে স্তরে পৌঁছোতে পারবে সেই স্তরে আবার আমি পারবো না আসতে, সে তুমি যত কাছেই আমাকে আসতে দাও না কেন। মানে বলতে চাইছি আমাকে তোমার হাত ধরে তোমার ভিতরে নিয়ে এলে তবে আমি আসতে পারবো কিন্তু অতটা গভীরেও না যতটা ও অনায়াসে চলে আসবে, ওর জন্য কিন্তু কোনো হাত ধরার প্রয়োজন নেই। রাস্তাটা ওর অজান্তেই ও চেনে।”

রুবাঈয়ের কথাগুলো ইন্দিরা ভাবে। আর সেই সময়েই ক্লাসের অনেকের ফোনে মেসেজ আসার আওয়াজ শোনা যায়। পাশ থেকে রুবাঈ বলে, “স্যালারি এসেছে!”

ক্লাসের আরো অনেকেরই স্যালারি এসে গিয়েছে, একটা চাপা গুনগুন আওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। ইন্দিরার ফোনেও একটা মেসেজ এসেছে। ফোন খোলে ইন্দিরা।

একটা ব্ল্যাঙ্ক মেসেজ। প্রেরকের জায়গায় লেখা- রঞ্জনা মজুমদার।

ভুল করেই হয়তো… ফোন সরিয়ে রেখে ইন্দিরা ভাবে, শূন্যতা দিয়ে কত কিছুই না বোঝানো সম্ভব। শূন্যতার একটা আলাদা ব্যপ্তি আছে। সমস্ত কিছুতে কিভাবে ঢুকে থাকে শূন্যতা, ইন্দিরা সবার অলক্ষ্যে নিজের হাতের পাতাদুটো দেখে, দেখে কিভাবে সেখানে শূন্যতা ছেয়ে আছে। ঠিক “ব্ল্যাঙ্ক” গল্পের অপুর মতো। যার হাতের পাতায় কোনো দাগ ছিল না। গত কমাসে ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে নিজের হাত ওরকম বেদাগ দেখেছে ইন্দিরা। ঘুম ভেঙে গেছে তার। ইন্দিরার ফোনে আবার আরেকটা মেসেজ আসে, ফোন খুলে ইন্দিরা দেখে তার জীবনের প্রথম স্যালারি নোটিফিকেশন উজ্জ্বল হয়ে আছে স্ক্রিনে। মেসেজটায় একটা পাঁচ অঙ্কের সংখ্যা, যা দিয়ে এক বছর আগেও তার সমস্ত স্বপ্ন সফল হয়ে যেত… ফোন রেখে সামনের বোর্ডের দিকে তাকায় সে, খালি বোর্ডটা শূন্যতা লালন করছে সারা গায়ে।

 

 

রুবাঈকে নিয়ে বিভিন্ন শপে ঢুকে ঢুকে বেরিয়ে আসছে হিরণ। প্রথম পারিশ্রমিক পাওয়ার আনন্দ উপচে পড়ছে হিরণ রুবাঈ আনন্দীসহ সবার মধ্যে। আজকে ট্রেনিঙের পর ক্লাসের সবাই মিলে কাছের একটা শপিং মলে এসেছে তারা। সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে যেতে একটু আলাদা হয়ে ইন্দিরা বাড়ির নম্বর ডায়াল করে। ফোন বেজে বেজে কেটে যায়। হয়তো জ্যেঠুর কানে আওয়াজ পৌঁছচ্ছে না।

“বাড়িতে ফোন করছো?”

ইন্দিরা দেখে আনন্দী এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। কাল রাতের পর আনন্দীর ব্যবহারে কোনো পরিবর্তন সে দেখতে পায়নি। যেন এরকমই হতে হয়, ঠিক ততটাই স্বাভাবিক সে।

“হ্যাঁ”

“কিছু কিনবে না? বাড়ির জন্য, বা নিজের জন্য?”

“কেনার মতো কিছু মনে পড়ছে না…”

আনন্দী তার হাতের ব্যাগ দেখিয়ে বলে, “আমি মা-বাবার জন্য দুটো ঘড়ি কিনলাম, দেখো…”

নিজে থেকে বাক্স খুলে নারী ও পুরুষ দুটো ঘড়ি দেখায় আনন্দী।

“সুন্দর হয়েছে… তুমি রাতে পনির পরোটা বানানোর কথা বলছিলে না? পনির কিনে নেবে এখান থেকে?”

“হ্যাঁ, ভালো মনে করিয়েছো, চলো…”

 

আনন্দী আর ইন্দিরা খাবারের সেকশানে চলে আসে। এক্সপায়ারি ডেট বুঝে শুনে এক প্যাকেট পনির বেছে নেয় আনন্দী। পাশের সেকশানে সার বেঁধে জামা কাপড় রাখা। কি মনে হতে ইন্দিরা বলে, “তুমি ক্যাশ কাউন্টারে যাও, আমি আসছি একটু”

“দেরি কোরো না,” আনন্দীর গলা শুনতে পায় সে পিছন থেকে।

জামা কাপড়ের সেকশানের একপাশের একটা তাকের সামনে এসে দাঁড়ায় ইন্দিরা। সেখানে পর পর নানা রঙের মোজা রাখা। কোনোটা হাঁটু অবধি, কোনোটা গোড়ালি পর্যন্ত। কোনোটাতে চৌকো স্কটিশ চেক, কোনোটাতে ছোটো ছোটো ঘুড়ি আঁকা। বেছে বেছে পাঁচ ছ জোড়া অ্যাঙ্কেল সক তুলে নেয় ইন্দিরা। আনন্দীর কাছে ফিরে আসতে আসতে দেখে হিরণ আর রুবাঈও ক্যাশ কাউন্টারে এসে দাঁড়িয়েছে।

রুবাঈ জিজ্ঞেস করে, “এত মোজা একসাথে?”

“আমার ভালো লাগে, বিভিন্ন রঙের মোজা, একটা সময় খুঁজে খুঁজে কিনতাম”, কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়ে পরে ইন্দিরা।

পাশের কাউন্টারের লাইন থেকে হিরণ বলে, “have you read harry potter?”

ইন্দিরা বলে, “না, পড়া হয়নি। কেন?”

“there’s a character, ডবি। ও হলো হাউস এলফ, অনেকটা ক্রীতদাস জাতীয়, মানুষ্যেতর প্রাণী। জে কে রাউলিং লিখেছেন, হাউস এলফরা তখনই মুক্তি পায় যখন তাদের প্রভু তাদের কোনো জামা কাপড় দেন। তো ডবির প্রভু যিনি ছিলেন তিনি খুবই অত্যাচারী ছিলেন। হ্যারি তাই বুদ্ধি করে এমন একটা কাজ করে যাতে ডবিকে তার প্রভু ভুলবশত একটা মোজা দিয়ে ফেলেন। আর ডবি মুক্তি পায়। তোমার হাতের মোজাগুলো দেখে আমার ডবির কথা মনে পড়ল। Dobby was freed by a sock,”

ইন্দিরাকে মোজাগুলো অন্য কেউ দেয়নি। সে নিজেই নিজেকে উপহার দিয়েছে। তার প্রথম পারিশ্রমিক দিয়ে কিনে। কি থেকে নিজেকে মুক্তি দিয়েছে ইন্দিরা? সেভাবে দেখলে মুক্তি দেওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে আবার মুক্ত হওয়ার মতো কিছু নেইও। তার পকেটের মধ্যে মোবাইল ফোনটা খচখচ করে ওঠে। ফোন বের করে ইন্দিরা কিছুক্ষণ রঞ্জনার ব্ল্যাঙ্ক মেসেজটা মুখের সামনে খুলে ধরে রাখে। তারপর কি ভেবে যেন টাইপ করে,

“আজ প্রথম স্যালারি পেলাম। পাঁচ জোড়া অ্যাঙ্কেল সক কিনলাম, নিজের জন্যই।
তুই হ্যারি পটার পড়েছিস?”

মেসেজটা সেন্ড করে ইন্দিরা সামনের দিকে পা বাড়ায়, হিরণ, রুবাঈ আর আনন্দী অপেক্ষা করছে সেখানে তার জন্য।

 

পনিরের ব্লকটাকে ঈষৎ উষ্ণ জলে ডুবিয়ে রেখে টমেটো গ্রেট করছে আনন্দী। পাশে দাঁড়িয়ে পেঁয়াজের খোসা ছাড়াচ্ছে ইন্দিরা। আনন্দী বলে চলেছে পনির পরোটা করার রেসিপি, যা তার মায়ের থেকে সে উত্তরাধিকারসূত্রে বহন করে চলছে, “পনিরটা একটু সিদ্ধ হয়ে এলে জল থেকে তুলে রাখতে হবে। তারপর অল্প তেলে কুঁচি কুঁচি করে কাটা পেঁয়াজ, লঙ্কা ভাজতে হবে। ভাজাটা সোনালী হয়ে এলে তাতে অল্প নুন, অল্প জিরে গুঁড়ো আর চাইলে গরম মশলা দিয়ে গ্রেট করা টমেটো মিশিয়ে দিতে হবে। তারপর পুরো মিশ্রণটা রান্না হয়ে গেলে অল্প আঁচে তাতে আদা পেঁয়াজ বাটা মিশিয়ে দিতে হবে। কিছুক্ষণ নাড়িয়ে নেওয়ার পর তার মধ্যে স্ম্যাশ করে রাখা অর্ধসেদ্ধ পনির মিশিয়ে দিতে হবে। এবার ভালো করে বেশ খানিকক্ষণ পুরোটা কষিয়ে নামিয়ে রাখতে হবে। আর তারসাথে আটাটা মেখে নিতে হবে। অল্প তেল আর অল্প নুন দিয়ে একটু আটা মেখে দাও আমায়”

পেঁয়াজ কাটা হয়ে এলে এক ডিশ আটা নিয়ে বসে ইন্দিরা। তাতে অল্প তেল আর নুন মিশিয়ে হাত চালিয়ে দেয় আটার শরীরে। নরম আটার মধ্য দিয়ে ডান হাত এগিয়ে পিছিয়ে নিয়ে আসে ইন্দিরা। আরামে চোখ বুজে আসে তার।

“ইন্দিরা! ফোন বাজছে তোমার!” আনন্দীর গলায় ঘোর কেটে যায় ইন্দিরার, “কতক্ষণ ধরে ডাকছি, কোথায় যে হারিয়ে যাও মাঝে মাঝে…”

আটার ডিশটা রেখে উঠে ফোনটা নিয়ে ইন্দিরা দেখে বাড়ির নম্বর থেকে ফোন এসেছে।

“হ্যালো,”

ওপাশ থেকে ধীরেশের গলা শোনা যায়, “কেমন আছিস?”

“ভালো, আজ স্যালারি ঢুকলো”

“বাহ, কিছু কিনে নিস নিজের জন্য। শোন এদিকে একটা কাণ্ড ঘটেছে, তোর দাদাকে সামলা, তোর কাছে যাবে বলে উঠে-পড়ে লেগেছে”

“মানে!” ফোন হাতে ইন্দিরা বারান্দায় বেরিয়ে আসে।

“আর বলিস না, একটু আগে বাপি এসে ফ্লাইটের টিকিট দিয়ে গেছে”

“ও টিকিট কাটিয়ে ফেলেছে!” ইন্দিরা উদ্বিগ্ন হয়।

“হ্যাঁ, কাউকে কিচ্ছু জানায়ওনি, বাপি টিকিট দিতে আসার পর আমরা জানতে পারলাম”

“একা একা আসবে দাদা?!”

“কারোর কথা শুনলে তো, অপু রেগে গেছে খুব, বলছে আমায় সাথে যেতে, কিন্তু তোর দাদা একাই যাবে বলে ঠিক করেছে। কেউ কারোর সাথে কথা বলছে না। আমার হয়েছে এই এক যন্ত্রণা। তুই একটু কথা বল তো ওর সাথে, দাঁড়া আমি ডেকে দিচ্ছি”

ধীরেশের গলা শুনতে পায় ইন্দিরা, “পিকলু! তিতির কথা বলতে চাইছে তোর সাথে”

তিতির… হারিয়ে যাওয়া ডাকনামটা শুনতে পায় ইন্দিরা অনেক দিন পর। কাছাকাছি থাকলে নাম ধরে ডাকার প্রয়োজন পড়ে না। দূরে এলে তবেই… অথচ দূরে আসতে আসতে কত যে ডাকনাম হারিয়ে যায়,

“আমি আসছি।” পিকলুর গলা শোনে ইন্দিরা।

“দাদা, একা আসবি কি করে!”

“চলে আসবো”

“কি হয়েছে তোর? আমি ঠিক আছি এখানে, আসার দরকার নেই কোনো”

“আমি আসছি”

ইন্দিরা বোঝে পিকলু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, আর তা বদলাবে না।

“কবে আসছিস?”

“হয়তো পরশু বিকেলে”

“হয়তো মানে? কটায় পৌঁছবি এখানে?”

“ছটা পঞ্চাশ”

“ঠিক আছে, আমি আনতে যাবো তোকে”

“আচ্ছা”

ফোন কেটে যায়। ধীর পায়ে ইন্দিরা ঘরে ফিরে এসে দেখে আনন্দী আটা মেখে ফেলেছে এর মধ্যে।

“আমি মাখছিলাম তো…”

“তুমি যা ভালোবাসা দিয়ে আটা মাখছিলে, তাতে পরোটা খেতে রাত বারোটা বেজে যেত… কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?”

“হ্যাঁ, ঠিক আছে”

“তোমাকে কেমন একটা যেন লাগছে,”

“আমার দাদা যদি এখানে এসে কয়েকদিন থাকে তোমার অসুবিধা হবে?”

“না, কিসের অসুবিধা, আমার মা-বাবাও তো কয়েক মাস পরে আসবে বলেছে”

“আচ্ছা”

 

দাদার অসুখের সম্পর্কে আনন্দীকে বলা উচিৎ কি না বুঝতে পারে না ইন্দিরা। আগে রুবাঈয়ের সাথে কথা বলতে হবে তাকে। নিশ্চুপে পরোটা খেয়ে উঠে পরে ইন্দিরা।

“ভালো লাগেনি না?”

“হ্যাঁ? কি?” ইন্দিরা জানতে চায়।

“পরোটা?” আনন্দী অবাক হয়, “তুমি মাঝে মাঝে যে কোথায় চলে যাও, বুঝতে পারি না”

অল্প হেসে ইন্দিরা বলে, “খুব ভালো হয়েছে, মাঝে মাঝে বানিয়ে খাওয়া যেতে পারে”

“জানি আমি, আমার মায়ের রেসিপি খারাপ হতে পারে না”, হেসে বলে আনন্দী।

আনন্দীর হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ইন্দিরা। এতক্ষণ ধরে যে অসহায়তা তাকে ঘিরে ফেলছিল তা যেন কেটে যায় আস্তে আস্তে।

 

 

আলো নিভিয়ে বিছানায় পড়ে আছে ইন্দিরা। আনন্দী অনেকক্ষণ নিজের ঘরে চলে গেছে। কোনো সাড়া আসছে না তার ঘর থেকে। দরজার নিচ দিয়ে আলোও এসে পড়ছে না। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে তার মানে। আনন্দী কিভাবে ঘুমিয়ে পড়ে দেখতে ইচ্ছে করে ইন্দিরার। তারপরেই নিজের ইচ্ছেতে লাগাম পরিয়ে ঘরের মধ্যে আটকে রাখে সে। দাদা আসছে… কেন? কিসের টানে? আর এসে পড়লে কি কি হতে পারে ইন্দিরা ভেবে পায় না। রঞ্জনা কি দাদার সাথে যোগাযোগ করেছে? রঞ্জনা কি দাদাকে আসতে বলেছে এখানে? তা কি করে হয়! রঞ্জনা এখন অনেক অনেক দূরে ইন্দিরার থেকে। এত দূরে যে তার থেকে আলোটুকু পর্যন্ত এসে পৌঁছোয় না ইন্দিরার কাছে।

হয়তো কয়েক হাজার বছর পর সে আলো এসে পড়বে ইন্দিরার গায়ে। যখন সে আলোর আর কোনো প্রয়োজন থাকবে না। হোয়াটসঅ্যাপ খুলে সমিত দে কে পিং করার কথা ভাবে ইন্দিরা। সমিত দের স্ট্যাটাসে চোখ আটকে যায় তার, “The wound is the place where the light enters you”

আবার রুমি… রুমির লেখা ইন্দিরার প্রিয় লাইন। আলো আসার অপেক্ষা করছে সে কত বছর থেকে। অন্ধকারে।

বাইরে কিছু একটা পড়ার আওয়াজ হয়। আনন্দী…

বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে আসে ইন্দিরা। রান্নাঘর থেকে আনন্দীর গলার স্বর শুনতে পায় সে।

“তুমি চাও তো সব শেষ হয়ে যাক! করছি শেষ। আজকেই,”

রান্নাঘরের দরজায় এসে ইন্দিরা দেখে আনন্দী পেঁয়াজ কাটার ছুড়িটা তুলে নিয়েছে এক হাতে। তার অন্য হাতে ধরা নিজের সেলফোন। রান্নাঘরের স্ল্যাবে কিছু কাটা চামচ ছড়িয়ে আছে।

“আনন্দী!”

রান্নাঘরের স্ল্যাবে ফোন নামিয়ে রাখে আনন্দী, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে, এক হাত দিয়ে ইন্দিরাকে দূরে ঠেলে দিতে চায় সে, “আমায় আটকাবে না ইন্দিরা, তুমি কিছুই জানো না এসবের, বেটার দূরে থাকো”

আড়চোখে আনন্দীর ফোনের ভাঙা স্ক্রিনটা দেখে ইন্দিরা, যে ফোনটা এসেছিল সেটা কেটে গেছে।

ছয় মাস আগের কিছু দিনের কথা মনে পড়ে যায় ইন্দিরার, সে বলে, “ছুড়িটা নামিয়ে রাখো আনন্দী”

“না। তুমি এর মধ্যে এসো না। আমাকে আমার কাজ করতে দাও”

“তুমি যদি ছুড়িটা না নামিয়ে রাখো আমি বাধ্য হবো ওটা কেড়ে নিতে”

“কেন তুমি এর মধ্যে আসছো ইন্দিরা! আমি কি বলেছি তোমায় আসতে? তোমার কোনো অধিকার নেই আমার উপর”

ইন্দিরা আনন্দীর কাছে এগিয়ে আসে, “নেই জানি। সে দাবীও করিনি।”

“তবে? দূরে থাকো।”

হাত পেতে আনন্দীর চোখে চোখ রেখে ইন্দিরা বলে, “নিজের মা-বাবার কথা ভেবে অন্তত ছুড়িটা দাও আমার হাতে, এতটা স্বার্থপর হয়ো না।”

আনন্দী স্থির হয়ে যায়। ধীরে ধীরে ইন্দিরার হাতে ছুঁড়িটা নামিয়ে দেয় সে। মাটিতে বসে পড়ে। রান্নাঘরের স্ল্যাবে ছুড়িটা রেখে দিয়ে ইন্দিরাও বসে পড়ে তার পাশে। ইন্দিরা দেখে হাঁটুর ভাজে মাথা গুঁজে দিয়েছে মেয়েটা,-  হয়তো কাঁদছে। ভিতরটা মুচড়ে ওঠে ইন্দিরার। কেন,- সে বোঝে না।

আনন্দীর কাঁধে হাত রাখে সে। কি বলা উচিৎ তার জানা নেই।

“তুমি আমায় না আটকালে…” মাথা তোলে আনন্দী, তার চোখ লাল হয়ে আছে, “আজকে সব শেষ করেই দিতাম”, নিজের চোখ মুছে আনন্দী বলে, “কেন আটকালে আমায়? তুমি তো কিছুই জানো না”

“হয়তো সে কারণেই আটকেছি, জানার জন্য।” বলে ইন্দিরা, তোমাকে জানার জন্য,- বলে মনে মনে।

ইন্দিরার কাঁধে মাথা রাখে আনন্দী।

রান্নাঘরের মেঝেতে পাশাপাশি বসে রাতের বয়স বেড়ে যায়। (চলবে)



সপ্তম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

শেয়ার