ধারাবাহিক উপন্যাস — ‘তারাদের ঘরবাড়ি’ ।। অলোকপর্ণা ।। সপ্তম পর্ব

                                                       ৭ম পর্ব

 

“পিসি, ও পিসি!”

“কি হল কি!”

“মরে গেলে কেমন লাগে? জানো?”

“এ আবার কেমনতর প্রশ্ন! ও কথা কেউ বলে!”

“বলো না! কেমন লাগে?”

“আমি যখন মরব তখন এসে তোকে বলে যাবো যে মরলে এমন লাগে… যা চানে যা এখন!”

পিসির গলা শুনে ঘুম ভেঙে যায় ইন্দিরার। চোখ খুলতেই রোদে ধাঁধিয়ে যায় দৃষ্টি। মাথার মধ্যে যেন একটা সূর্য ঢুকে আছে। আরো একবার চোখ খোলে ইন্দিরা, আবার প্রচন্ড আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে ওঠে। বিছানায় চুপ করে চোখ বুজে পড়ে থাকে সে। ঢোক গিলতে গিয়ে গলা জ্বলে উঠতে সে বোঝে তার গলা চিড়ে গিয়েছে। তারপর মনে পড়ে কাল রাতে অতিরিক্ত অ্যালকোহল নিয়ে ফেলায় তার বমি হয়েছে আর ফলত গলায় চাপ পড়েছে বেশ। চোখ অল্প ফাঁক করতে ইন্দিরা বোঝে সে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। আনন্দীই কি তাকে নিয়ে এসেছে?… বিভ্রান্ত লাগে, কারণ বমি করার পর কি হয়েছিল মনেই পড়ছে না তার এই মুহূর্তে। একটু হাতড়িয়ে টেবিল থেকে সান গ্লাসটা নিয়ে চোখে পরে নেয় সে। তারপর বিছানায় উঠে বসে। আর তখনই খেয়াল হয় তার গায়ে অন্য কারোর পোষাক পরানো হয়েছে। সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে ইন্দিরা। আর মাথাটা ঘুরে যায়। বিছানায় বসে পড়তে পড়তে ইন্দিরা ভাবে,- আনন্দীই কি?! ভীষণ লজ্জা করে তার। কেন কাল রাতে অতটা মদ খেয়ে ফেলেছিল ইন্দিরা! নিজের উপর ভয়ানক রাগ হয়। রুবাঈয়ের সাথে কথা বলাটা জরুরী বলে মনে হয়। মোবাইল ফোন তুলে ইন্দিরা দেখে ফোন স্যুইচড্‌ অফ, একটু পরীক্ষা করতে বোঝে ব্যাটারী শেষ, স্বাভাবিক, গোটা রাত বিনা চার্জে পড়ে ছিল ফোনটা। মোবাইল ফোন চার্জে বসিয়ে ইন্দিরা ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরোয়। উলটো দিকে আনন্দীর ঘর ভিতর থেকে বন্ধ। হলঘরে এসে ঘড়ি দেখে ইন্দিরা বোঝে বেলা এগারোটা বাজে। একটা ঘোরের মধ্যে সে রান্নাঘরে আসে। গ্যাস সিলিন্ডার ওভেন পড়ে আছে গতকাল রাতে যেমন ছিল। ফ্রিজ থেকে দুটো ডিম বার করে ইন্দিরা। গ্যাস জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে দুটো অমলেট বানিয়ে ফেলে। এক প্লেট অমলেট নিয়ে বিস্বাদ মুখে হল ঘরের টেবিলে বসে ইন্দিরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে কখন আনন্দী জেগে উঠবে। কাল রাতে আর কি হয়েছিল জানতে হবে ইন্দিরার, বিশেষত বিপজ্জনক কিছু সে ইতিমধ্যে করে ফেলেছে কি না তা জানা প্রয়োজন। এই পৃথিবীতে নিজের অবচেতনকে সব থেকে বেশি ভয় পায় ইন্দিরা, অন্তত গত জুন মাসের পর থেকে। রুবাঈয়ের সাথে কথা বলা আরো দরকারি বলে মনে হয় তার।

হঠাৎ এক ঝলকে ইন্দিরার মনে পড়ে, বমি করার সময় আনন্দী কিভাবে তাকে আগলে রাখছিল, অজান্তেই আরাম লাগে ইন্দিরার। ভালো লাগে। সে বোঝে এই ভালো লাগাটা যেন বহু বছর পর তার মধ্যে জন্মালো। দেশলাই ঘষে দেওয়ার মত ফস্‌ করে কেউ একটা এই ভালোলাগাটার জন্ম দিল। যা হয়তো একটু পরেই হাওয়া লেগে নিভে যাবে। নিভে যেতে বাধ্য।

 

আনন্দীর ঘরের দরজা খুলে যায়। আনন্দী বেরিয়ে আসে, ঘুমের পোষাকে অগোছালো হয়ে। ঘুম জড়ানো গলায় বলে, “মর্নিং”

“মর্নিং, তোমার জন্য অমলেট রাখা আছে রান্নাঘরে”

“ধন্যবাদ” রান্না ঘরে ঢুকে যায় আনন্দী, বলে, “ঘরের মধ্যে সানগ্লাস পড়ে আছো কেন?”

“চোখ খুলতে পারছি না”

“হ্যাং ওভার? হ্যাঁ হওয়াটাই স্বাভাবিক, কাল যা করেছো তুমি তারপর এটাই হওয়ার ছিল”

আনন্দী এসে বসে ইন্দিরার উলটো দিকে, ইন্দিরা চোখ সরিয়ে নেয় তার মুখ থেকে, ভীষণ লজ্জা করছে ইন্দিরার। পোষাকের কথাটা জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও বলতে পারছে না সে। পরে সে কথা জানা যাবে ভেবে নিয়ে ইন্দিরা জিজ্ঞেস করে, “কাল তুমি আমায় ঘরে নিয়ে এসেছিলে?”

“আর কে আনবে? সবাই আউট ছিল কাল”

ইন্দিরা সানগ্লাসের পিছন থেকে আনন্দীর উপর চোখ রাখে। উজ্জ্বল চোখ, চওড়া কাঁধ, সবল গঠন, মাড়ওয়ার বংশোদ্ভূত মেয়েরা যেমন হয় ঠিক তেমনই। ঘন কালো কাঁধ ছাপানো চুলে আনন্দীকে সব সময়ই আত্মবিশ্বাসী দেখায়। ওর পক্ষে ইন্দিরাকে ঘরে এনে ফেলাটা কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। কিন্তু পোষাক? ইন্দিরা মন অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে বলে, “কখন নিয়ে এলে আমায়?”

“কিছুই মনে নেই দেখছি”, আনন্দী অল্প অল্প হাসে, “বাথরুমে বমি করার পর আমার মনে হল তোমায় ওখানে রাখাটা আর ঠিক হবে না, তাই আমি তোমায় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করেছিলাম। ঠিক অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকবো, দরজার লক খুলছি, এমন সময় তুমি আবার বমি করলে, নিজের গায়ে তো বটেই আমার গায়েও খানিকটা।”

ইন্দিরার ইচ্ছে করে এই মুহূর্তে কোথাও পালিয়ে যাবে। রুবাঈয়ের সাথে কথা বলতেই হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

আনন্দী বলে চলে, “তারপর আমি তোমার ড্রেস চেঞ্জ করিয়ে তোমায় বিছানায় রেখে এলাম। ততক্ষণে আমার নেশা ছুটে গেছে”

“আই অ্যাম সো সরি, সো- সো সরি”।

আনন্দী কিছু না বলে অমলেট খেয়ে চলে।

খালি প্লেট হাতে ইন্দিরা উঠে রান্নাঘরে চলে আসে। মনে মনে শপথ নেয় আর কখনো মদ ছোঁবেনা। বাইরে হলঘর থেকে আনন্দীর গলা শোনা যায়, “মন খারাপ কমেছে?”

মন খারাপ!… রান্নাঘর থেকে ইন্দিরা জিজ্ঞাসা করে, “মন খারাপ?”

“কাল রাতে বমি করার পর থেকে ঘুমিয়ে পড়া অবধি তুমি খালি কেঁদে গেছ”

কান্না!… অবাক হয়ে যায় ইন্দিরা।

“মাঝে বমি করাটা বাদ দিলে ধরো প্রায় মিনিট কুড়ি হবে।”

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে ইন্দিরা, সতর্কতার সাথে প্রশ্ন করে, “আর কি কি করেছি আমি কাল রাতে?” প্রমাদ গোনে ইন্দিরা।

অমলেটের শেষ টুকরো মুখে ভরে আনন্দী বলে, “আর কিছু না”

বুক থেকে যেন পাথর সরে যায়। ইন্দিরা আনন্দীর প্লেটটা তুলে নিয়ে রান্নাঘরে ফিরে আসে।

বাইরে থেকে আনন্দীর গলা শোনা যায়, “আমি কত জিজ্ঞাসা করলাম কেন কাঁদছ, কীসের অসুবিধা, কিচ্ছু বললে না, তোমায় শুইয়ে দিতে সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লে”

চাপা অস্বস্তিটা কেটে যায়, ইন্দিরা বলে, “আমার এসব কিছুই মনে নেই”। প্লেট ধুয়ে রেখে ইন্দিরা হলঘরে এসে বলে, “থ্যাঙ্ক ইউ”

উত্তরে আনন্দী কিছু বলে না।

স্নানে যাওয়ার জন্য ইন্দিরা ঘরের দিকে পা বাড়ায়। তখন আনন্দী মুখ খোলে, “ইন্দিরা, did you know, তুমি ঘুমের মধ্যে কথা বলো?”

কি উত্তর দেওয়া উচিত বোঝেনা ইন্দিরা, আনন্দীর দিকে তাকিয়ে সে থমকে যায়। দেখে আনন্দীর দৃষ্টি কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। পিঠ বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত মাথা অবধি উঠে আসে। তার মনে পড়ে কাল রাতেও একবার ঠিক এভাবেই আনন্দী তার দিকে তাকিয়ে ছিল। একটা অসহায়তার মধ্যে তার মনে পড়ে একারণেই রুবাঈকে তার প্রয়োজন ছিল কাল রাতে। ঘুমের মধ্যে সে কি বলেছিল তা জিজ্ঞাসা করার সাহস হয় না ইন্দিরার। ঘরের দিকে পিছিয়ে আসতে আসতে ইন্দিরা বোঝে একটা রাতে নিজের সম্পর্কে অনেকটা সে জেনে গেছে। আনন্দীও কি একটু বেশিই জেনে ফেলল না তাকে? নিজেকে নগ্ন লাগে। শীত করে, ভয় করে ইন্দিরার। নিজের ঘরে ঢুকে এসে সে দরজা বন্ধ করে দেয়। যেন দরজা বন্ধ করে রাখলে আনন্দী আর জানতে পারবে না, বুঝতে পারবে না তাকে।

 

শনিবার দুপুরের রোদ এসে পড়ছে টেবিলে, রুবাঈকে কালকের কিছু ঘটনা, যা যা তার মনে পড়েছে, তা শোনানোর পর চেয়ারে বসে ইন্দিরা টাইপ করে চলেছে অনেকক্ষণ। কিছুক্ষণ পর হিরণের আসার কথা। লেখা শেষ হয়ে এলে চাপা স্বরে পুরোটা পড়ে ইন্দিরা দুই তিন বার। শেষ লাইনটা একটু বদলে লিখে দেয়, “বইমেলার মত জীবন পার করতে করতে মেয়েটা এখন গোটা পাঁচ নিজেকে চিনেছে,
যদিও তাদের কাউকেই শ্যামলীর মত দেখতে নয়।”

পুরোটা ইংলিশে বুঝিয়ে দেওয়ার পর রুবাঈ জানতে চায়, “শ্যামলী কে?”

“জানিনা”

“তাহলে তাকে নিয়ে লিখলে যে…”

“লিখতে বসে প্রথম যে নামটা আমার মাথায় আসে আমি তাকে নিয়েই লিখি”

“তোমার মাথায় তো ফারহানাও আসতে পারতো?”

“এই লেখাটার ক্ষেত্রে না, কারণ যাকে নিয়ে লিখছি সে ছাপোষা হিন্দু ঘরের ঘষটে অর্ধেক আবছা যাওয়া একটা মেয়ে”

“তা শ্যামলী কেন? এর নাম তো প্রতিমাও হতে পারতো, তাই না?”

“না, শ্যামলী,- নামটা শুনলে আমি ভীড়ে মিশে যাওয়া প্রতিভাহীণ একটা মেয়েকে দেখতে পাই। পৃথিবীর সমস্ত শ্যামলীর প্রতি ক্ষমা চেয়েই বলছি, যদি তাকে একা একা ঘুরতে না দেখো, তবে তার বিশেষত্ব ধরতে পারবে না, এমন মেয়ে। কিন্তু প্রতিমা,- এই নামকরণে যত্ন আছে। ছোটবেলায় তার দাদু বা ঠাকুমা আদর করে তাকে প্রতিমা বলে ডেকেছিল। প্রতিমার বিরল কোনো গুণ হয়তো নেই, কিন্তু সে হয় খুব ভালো সেলাই জানে, নয় খুব সুন্দর বাটি চচ্চড়ি বানাতে পারে অথবা ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়। মোট কথা ভীড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে তুমি প্রতিমাকে দেখতে পাবে। তারপরেই হয়তো সে ভীড়ে হারিয়ে যাবে, তবু সে একবার দেখা দেবেই। আর শ্যামলী,- তার নামকরণটার মধ্যে আমি একটা অবহেলা দেখতে পাই, জানি না তা ভুল না ঠিক। একটা অবাঞ্ছনা। একজন অবাঞ্ছিত মানুষকে আমার দরকার ছিল এই লেখাটায়। তাই প্রতিমা নয়। শ্যামলী।” কথা শেষ করে বড় একটা নিঃশ্বাস নেয় ইন্দিরা।

“তুমি বললে তোমার মাথায় যে নামটা প্রথম আসে… তার মানে তুমি চরিত্রদের নাম ঠিক করার সময় যত্নবান নও?”

“হ্যাঁ, যত্নবান। তুমি কি মনে করো বহ্নিশিখা বা ঋজুরেখ জাতীয় নাম খুঁজতেই যত্ন লাগে? শ্যামলী বা বাপি জাতীয় নাম খুঁজে বের করতে যত্ন লাগে না?”

“তা নয়। কিন্তু চারপাশে যে নামগুলো আমরা দেখতে পাই, তা তো অতি সাধারণ, মানে তাকালেই এই ধরণের নাম মুখে চলে আসবে”

“তাতে ক্ষতি কি? কিন্তু এটা তো ঠিক যে, একজন মহাকাশচারীর নাম যা হতে পারে, কলেজের অধ্যক্ষের নাম তা হবে না, আবার একজন হার্ট সার্জেনের নাম যা হবে লন্ড্রিতে কাজ করা লোকটার নাম তা হবে না। মাথায় যে চেহারাটা ভাসছে সেই চেহারার সাথে নাম মানানসই হওয়া প্রয়োজন। তার চেয়েও বড় কথা তার পারিবারিক, আর্থ সামাজিক অবস্থান কি সেটাও ভেবে নিতে হবে। কারণ একটা মানুষ তার নিজের নাম রাখেনা। রাখে তার মা বাবা বা পরিবারের অন্য কেউ। দুজন শিক্ষক মা বাবা সচরাচর যেমন তাদের ৯০ দশকের সন্তানের নাম সদানন্দ বা অন্নদাসুন্দরী রাখবেন না, তেমনই দুজন দিনমজুর মা বাবা তাদের শূন্য দশকের সন্তানকে অর্ণ বা বিবস্বান বলে ডাকবেন না। এর ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। যদিও তা স্বল্প ক্ষেত্রেই ঘটে। আবার তার মানে এটা নয় যে কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখা চলবে না। কিন্তু সেই পদ্মলোচনের কান্নাটুকু at least পদ্মপাতায় টলটল করা জলের মত হতে হবে। একই সাথে একজন বেলি ড্যান্সারের নাম আমি কখনোই অলোকপর্ণা রাখার পক্ষপাতি নই। তাই রুবাঈ নামটা আমার ভীষণ প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও আমি শ্যামলীকে শ্যামলীই বলবো। আমি হয়তো সম্পূর্ণ ভুল, কিন্তু এটাই আমার মনে হয়। ব্যাপারটা বোঝাতে পারলাম কি?”

“কিছুটা। তা এই লেখাটার নাম কি দিলে?”

ইন্দিরা চুপ করে ল্যাপটপের পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা চাপা শ্বাস ফেলে বলে, “মাথায় আসছে না কিছু”

“লেখার নামকরণ কি চরিত্রদের নামকরণের মত করা যায় না?”

“কে জানে… আমি চিরকালই লেখার নাম দিতে খুব একটা পটু নই।” সেলফোনের দিকে চোখ চলে যায় ইন্দিরার। লেখাদের নাম যে দিত তার নম্বর ওখানে ঘুমিয়ে আছে।

রুবাঈ বলে, “লেখাটার নাম দাও,- বইমেলার সময়টা যার দুর্গাপুজো দুর্গাপুজো লাগত”

কিছু না বলে ইন্দিরা নামটা টাইপ করে দেয়।

 

আকাশের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ইন্দিরা বুঝল, এখানে ঘুড়ি ওড়ে না। তার বাড়ির আর এই অ্যাপার্টমেন্টের আকাশের মধ্যে এটাই একমাত্র তফাৎ। তার পাশে বসে হিরণ আর রুবাঈ পকেট চেস খেলছে। হিরণ প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছে রুবাঈকে। চেস বোর্ডের দিকে তাকিয়ে ইন্দিরা বোঝে মিনিট দশেকের মধ্যে রুবাঈয়ের হেরে যাওয়া উচিত।

রুবাঈয়ের ঘোড়াটাকে কোণঠাসা করে ফেলতে ফেলতে হিরণ বলে, “জিতে গেলে আমি কি পাবো?”

বোরে এগিয়ে দিয়ে রুবাঈ বলে, “যুদ্ধজয়ের আনন্দ”

হিরণ ভ্রূ কুঁচকে ইন্দিরার দিকে তাকায়, যেন তার নালিশ শোনার জন্য ইন্দিরা বসে আছে ওখানে।

ইন্দিরা হেসে বলে, “যেই হারুক বা জিতুক, খেলা শেষে কোথাও একটা ঘুরে আসি চলো।”

খুশি হয়ে আরো উদ্যমে চাল চালতে থাকে হিরণ, রুবাঈয়ের বোরে, নৌকা, ঘোড়া সব মারা পড়তে থাকে একেক করে। একটু পরেই হিরণকে বলতে শোনা যায়, “চেক মেট!”

ব্যর্থ কিছু চেষ্টার পর দাবার বোর্ড গুটিয়ে নাজেহাল রুবাঈয়ের সাথে হিরণ আর ইন্দিরা অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসে। তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসার সময় কি খেয়াল হতে হিরণ বলে, “আনন্দীকেও ডাকা উচিৎ আমাদের”

ইন্দিরাকে কিছু বলতে না দিয়েই সে আনন্দীর ঘরে ঢুকে যায়। মিনিট দশেক পর বেরিয়ে আসে আনন্দীকে নিয়ে।

 

শহরের মাঝ বরাবর এই পার্ক। দিনের বেলাতেও বড়ো বড়ো গাছের নীচে সবুজ হয়ে থাকে এখানকার আলো। মাঝে মাঝে একটা দুটো পাথর, তার উপর বসে শান্তি নিচ্ছে দুচারজন। ইন্দিরারা হেঁটে যায় এর মাঝ দিয়ে, মানুষের পায়ে চলা পথ দিয়ে। হিরণ নিজের মতোই মুখর হয়ে আছে। রুবাঈ নিজের মত তার মুখরতাকে আশকারা দিচ্ছে। আনন্দী ঘুরে ফিরে ছবি তুলছে ইচ্ছে মতো। পাশ দিয়ে জগিং করে বেরিয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্যসচেতন কয়েকজন। কেউ কেউ আবার সাথে করে তাদের কুকুরদেরও এনেছে। কোলকাতার মত এখানে যত্রতত্র প্রেমিক প্রেমিকা দেখা যাচ্ছে না, বোধ হয় বিধি নিষেধ তেমন নেই বলেই। ইন্দিরা এসবই দেখছে।

হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে দিয়ে হিরণ চেঁচিয়ে উঠল, “বরফ! বরফ!”

ইন্দিরা দেখে পাশে একটা বিরাট কালচে গাছের তলায় মাটিতে পড়ে আছে সাদা সাদা তুলো। ভালো করে লক্ষ্য করতে সে বোঝে আশেপাশে আরো অনেক গাছের তলায় এরকম ‘বরফ’ ঝরে আছে। হিরণ আর রুবাঈ ছুটে গিয়ে সেই সব বরফের মত সাদা তুলোয় হাত ভরে ফেলল নিমেষে। আনন্দী হাসতে হাসতে ছবি তুলছে তাদের। ইন্দিরার আনন্দ হল হঠাৎ। মনে হল এতক্ষণ যেন চোখে একটা সানগ্লাস পরানো ছিল তার। সেটা যেন এখন সরে গেছে। উজ্জ্বল সবুজে চোখ ভরে গেল তার। সেও এগিয়ে এল হিরণদের দিকে। দুইহাত ভরে তুলে নিল সদ্য ফেটে চারদিকে ছড়িয়ে পড়া তুলোর দলা। নরম। আর নিরীহ। শব্দদুটো মাথায় নিয়ে কিছুক্ষণ খেলল সে। হিরণ আর রুবাঈ তখন একে অপরের গায়ে তুলো ছুড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইন্দিরা টের পেল কখন যেন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আনন্দী।

“তুমি লেখ, তাই না?”

“হ্যাঁ, হঠাৎ জানতে চাইছো?”

“মনে পড়ল তুমি ট্রেনিঙে পরিচয়পর্বে বলেছিলে একদিন”

“আচ্ছা”

“তাই কি এমন অন্যমনস্ক থাকো সারাক্ষণ?”

ইন্দিরা জানেনা কি জবাব দেবে এই প্রশ্নের, খানিকটা নিজের মনেই সে বলে, “কতটা অন্যমনস্ক হলে তাকে অন্যমনস্ক বলা উচিৎ?”

ইন্দিরা আশা করেনি এই প্রশ্নের জবাব পাবে সে, কিন্তু আনন্দী উত্তর দেয়, “কারোর কাছে কেউ এসে দাঁড়ালে, কারোর পাশে কেউ এসে দাঁড়ালে, কারোর ভিতরে কেউ এসে দাঁড়ালেও যখন সে টের পায় না যে কেউ এসেছে, আমার মতে তখন তাকে অন্যমনস্ক বলা যায়”

ইন্দিরার প্রতিক্রিয়া দেখার আগেই আনন্দী আবার ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ইন্দিরার মনে হয় তার পা যেন কেউ মাটিতে আটকে ফেলছে, ঠিক পকেট চেসের কোণঠাসা কালো ঘোড়াটার মত। যেন পায়ের তলায় চুম্বক আটকে আছে তার। আর কেউ একজন তাকে আড়াই চালে চেলে দিচ্ছে। ক্রমাগত হেরে যাওয়ার মুখে ঠেলে দিচ্ছে ইন্দিরাকে।

 

আজ ম্যাক ডোনাল্ডসে ইন্দিরা একক টেবিলে বসেনি। হিরণ রুবাঈ আর আনন্দী সমেত তারা একটু বড় একটা টেবিল দখল করে বসেছে। ইন্দিরার এক কোণে পড়ে থাকা একক টেবিলটার দিকে তাকায়, সেখান থেকেই সে প্রথমবার দেখেছিল আনন্দীকে। ইন্দিরা বাদে বাকী তিনজন নিজেদের বাড়ির কথা বলছে। হিরণের দুই দাদা আর এক কুকুর ‘ম্যাঙ্গো’র কথা জানতে পারে ইন্দিরা। রুবাঈয়ের গম্ভীর বাবা আর ভুলোমনা মায়ের খবর পাওয়া যায়। কঠোর শাসনের মাঝে আনন্দীর বড় হওয়ার গল্প শোনে তারা এরপর। খাওয়া যখন প্রায় শেষের দিকে, তখন হিরণ ইন্দিরাকে বলে, “আর তুমি? তোমার কথাও বলো কিছু”

এমন অনির্দিষ্ট প্রশ্নের সামনে বরাবর বিহ্বল লাগে নিজেকে তার। রুবাঈ সাহায্য করে তাকে, “তোমার বাড়িতে কে কে আছেন বলো”

ইন্দিরা বলে, “বাবা। দাদা। জ্যেঠু। জ্যেঠি। আর মা।”

ইন্দিরা দেখে রুবাঈয়ের চোখে হালকা হতাশা ফুটেই মিলিয়ে গেল। ইন্দিরা বোঝে রুবাঈ আশা করেছিল সে হয়তো সত্যিটা বলবে। কিন্তু ইন্দিরা পারে না। কারণ তার কাহিনীর যা কিছু শুরু সবই মায়ের থেকে। মায়ের চলে যাওয়াটা ইন্দিরার জীবনের ব্লু প্রিন্ট তৈরি করে দিয়েছে। সেটাকে হাতে ধরে জ্যান্ত করে চলা ছাড়া ইন্দিরার করণীয় কিছু নেই আর।

হিরণ বলে, “তোমার দাদা কি করেন?”

“ইংলিশের প্রফেসর”, অর্ধসত্যটা যেন তৈরি ছিল ইন্দিরার জিভের ডগায়।

“বাবা?”, আনন্দী জানতে চায়।

“ব্যাঙ্ক এমপ্লয়ী”

“জ্যেঠু? তোমায় এরকম পুলিশি জেরা করতে হবে আমাদের?” হিরণ জানতে চায়।

ইন্দিরা অবিকৃত মুখে জবাব দেয়, “জ্যেঠু অবসর নিয়েছেন, আগে স্কুল টিচার ছিলেন, ইতিহাসের। জ্যেঠি হাউসওয়াইফ” জয়তীর প্রসঙ্গে ‘হোমমেকার’ শব্দটা মানানসই লাগে না ইন্দিরার।

আনন্দী জিজ্ঞেস করে, “আর মা?”

“কবি। কবিতা লেখেন।” আরো একটা অর্ধসত্য।

“গ্রেট! তোমার মায়ের গুণ পেয়েছো তুমি!” হিরণের গলায় উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ে। ইন্দিরা কিছু বলে না। হিরণ বলে চলে, “তোমাকে কার মতো দেখতে ইন্দিরা? বাবার মতো না মায়ের মতো?”

নির্বিকার স্বরে ইন্দিরা বলে, “মায়ের মতো”

“তুমি বোঝো? আমি তো বুঝিই না আমাকে কার মতো দেখতে”, রুবাঈ জিজ্ঞেস করে হিরণকে।

ইন্দিরা বোঝে রুবাঈ চাইছে কোনোভাবে প্রসঙ্গ বদলে ফেলতে। উত্তরে হিরণ বলে, “না বোঝার কি আছে, কি ইন্দিরা, বলো-”

হিরণের কথা শেষ হওয়ার আগে আনন্দী বলে, “রাত হল, এবার ফেরা যাক”

রুবাঈ আর ইন্দিরার চোখাচুখি হয়। দুজনেই টের পায় হিরণকে থামিয়ে দেওয়ার জন্যই আনন্দী ফিরে যাওয়ার কথা বলেছে।

 

বাইরে বেরিয়ে কিছু দূর হেঁটে আসতেই নিজের বাস পেয়ে যায় রুবাঈ, কিছু পরে অটো ধরে বেরিয়ে যায় হিরণও। প্রায় জনশূন্য রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আনন্দী আর ইন্দিরা বাড়ির পথ ধরে।

ঠান্ডা হয়ে আছে সামনের রাস্তাটা, খুব দ্রুত কিছু গাড়ি চলে যাচ্ছে আলো ফেলে। স্বেচ্ছায় আনন্দীর থেকে একটু দূরত্ব রেখে চলে ইন্দিরা। দ্রুত বড্ড কাছে এসে পড়ছে যেন তারা। ফুটপাথ ঘেঁষে উঁচু একা বসন্ত রাণী গাছ পার করতে করতে আনন্দী আলগোছে বলে ওঠে, “তোমার মায়ের না থাকাটা হন্ট করে তোমায়”

ইন্দিরা দাঁড়িয়ে পড়ে, “মানে… তুমি কি করে!…”

আনন্দী বলে চলে, “নিজেকে অসম্পূর্ণ ভাবো তুমি। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগো। You miss your mother, you lack your mother.”

হতবাক হয়ে যায় ইন্দিরা।

“কাল রাতে ঘুমের মধ্যে তুমি তোমার মাকে খুঁজছিলে। আমি বাংলা বুঝিনা খুব একটা, তবে এটা বুঝেছিলাম যে তোমার আর তোমার মায়ের মধ্যে ব্যবধান অনেক, ঠিক যেমন একটা তারা অন্য একটার থেকে দূরে দূরে সরে থাকে। কয়েক আলোকবর্ষ। অথচ টানও আছে প্রবল, নাহলে কেউ ওভাবে কাছে আসার জন্য…” বলতে বলতে ইন্দিরার খুব কাছে চলে এসে কথাটা শেষ করে আনন্দী, “…কাতরায়?”

ইন্দিরা টের পায় আনন্দীর নিঃশ্বাস তার কপালের চুল ছুঁয়ে যাচ্ছে।

ইন্দিরার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায় আনন্দী।

ইন্দিরা চোখ বুজে ফেলে।

ইন্দিরা টের পায় হাওয়া শহরের ঠান্ডা হাওয়া তাদের ছুঁতে পারছে না আর। আর নিজের অজান্তে “চেকমেট!” বলে কেউ একজন হারিয়ে দিচ্ছে তাকে। ইন্দিরা কোণঠাসা হওয়া হেরে যাওয়া পরিশ্রান্ত একটা কালো ঘোড়ার মত স্থির হয়ে থাকে। চোখ বুজে। ঠান্ডা হাওয়ায় তার শ্বাস ফেলার ধোঁয়াটুকু শুধু দেখা যায়। [চলবে]



ষষ্ঠ পর্ব

শেয়ার