ধারাবাহিক উপন্যাস – তারাদের ঘরবাড়ি ।। অলোকপর্ণা ।। ১৮ পর্ব

                                  তারাদের ঘরবাড়ি  ১৮

 

সকাল হতে ইন্দিরার চোখ খুলে যায়। হলঘরের ঠাণ্ডা মেঝে ছেড়ে সে ছুটে বাইরে চলে আসে। বারান্দাটা ফাঁকা। ঠাণ্ডা একটা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে সেখানে। বাইরে সামনে দৃষ্টি এফোঁড়-ওফোঁড় করে চলে যাওয়া কারেন্টের তার বেয়ে কাঠবিড়ালি ছোটাছুটি করছে। নরম রোদ পড়ে সামনের রাস্তাটা আড়মোড়া ভাঙছে। কিছু মানুষ রাস্তায়। কিছু মানুষ নিজের নিজের বারান্দায় ব্রাশ হাতে দাঁড়ানো। আজ শনিবার। পৃথিবীর বাদবাকি শনিবারগুলোর মতই একটা দিন। রোদ, কাঠবিড়ালি, পড়শি মানুষগুলো, তাদের জীবন সবই তো আর পাঁচটা দিনের মতো একই রকম, পৃথিবী বদলায় নি, ইন্দিরার জীবন থেকে আনন্দী হারিয়ে গেছে, তবু পৃথিবীতে কিছুই বদলায় নি। ইন্দিরা চুপ করে সামনের বহুতলের দিকে তাকায় আর তার বুক ধক্‌ করে ওঠে। শিশুটা নেই। বেপরোয়া হাওয়ায় উড়ছে ছেঁড়া একটা পোস্টার। শিশুটা উড়ে গেছে কোথাও। ইন্দিরা স্থির হয়ে থাকে। পৃথিবীতে সত্যিই কি কিছু বদলায়নি? ইন্দিরা ভাবে, যেভাবে আর পাঁচজন ভাবেন, তার/ তাদের-ই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ বা তারা আছে বলেই চাঁদ আছে, তেমনই ইন্দিরা ভাবে ইন্দিরার বিষন্নতায় হাওয়াশহরের হাওয়ায় অবশেষে উড়ে গেছে পোস্টারের শিশুটা। ঘরে ফিরে আসে ইন্দিরা।

 

একটা শূন্য সাদা ঘরে সে দাঁড়ায়। নিজের অস্তিত্ব সম্বল করে। যেন আর কিছু নেই তার, খিদে নেই, শোক নেই, বোধ নেই, বিষাদ নেই, লক্ষ্য নেই, অভিসন্ধি নেই, ভার নেই, যেন নিজের পায়ে ইন্দিরা দাঁড়িয়ে নেই, তার শুধু অস্তিত্ব আছে, থেকে যাওয়া আছে। আর এই থেকে যাওয়াটুকু নিয়ে সে কি করবে, তার কি করা উচিৎ বুঝতে পারে না ইন্দিরা। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে, ফটফটে একটা ভোরবেলা ইন্দিরার চোখে আঁধার নেমে আসে। হলঘরে পাক খেতে শুরু করে সে। অনাবশ্যক, উদ্দেশ্যহীন, নিজেকে ঘিরে পাক খেয়ে চলে ইন্দিরা, অনির্দিষ্টকাল ধরে। তারপর একটা সময় একেক করে নিজের পরিধান খুলে ফেলতে থাকে। হলঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে থাকে তার গায়ের জামা, প্যান্ট, অন্তর্বাস। হলঘরে পাক খাওয়া থামে না তার। ছেড়ে ফেলা জামা কাপড়ের উপর দিয়ে হেঁটে চলে ইন্দিরা চৌধুরী, এবং সে আবার টের পায় ফরেস্ট গাম্প কেন মাইলের পর মাইল দৌড়েছিল। ইন্দিরা থামতে পারে না। চিৎকার করে গেয়ে ওঠে, “ওই আকাশে আমার মুক্তি…” তারপরই ভীষণ চুপ হয়ে যায়, নিজেকে বোবা লাগে তার। গত বছর জুন মাসের মতো, তার মনে হতে থাকে আর যেন গলা থেকে আওয়াজ বেরোবে না। ভীষণ ভয়ে ইন্দিরার শীত করতে থাকে। নগ্ন দেহের প্রতিটা রোমকূপে একটা জমাট ঠাণ্ডা ছেয়ে যায় যেন। ইন্দিরা ছুটে চলে আসে নিজের ঘরে। আলমারি খুলে অ্যাসেসমেন্টের দিন কিনে আনা, না খোলা একটা হুইস্কির বোতল বের করে আনে। তারপর দ্রুত পায়ে কিচেনে ছুটে যায়। ছুঁড়ি দিয়ে বোতলের মুখ খুলতে চেষ্টা করে, হাত ফসকে যায় তার। ছুড়ির আঘাত এসে পড়ে তার বাঁ হাতে, বুড়ো আঙুল বরাবর চামড়া চিড়ে যায়। ইন্দিরা অপেক্ষা করে। রক্ত বেরিয়ে আসার। ইন্দিরা দেখে তার বাঁ হাত থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছে। রক্তমাখা হাতে বোতলের মুখ খুলে ফেলে ইন্দিরা। রক্ত মাখা হাতে বোতল আঁকড়ে হলঘরে ফিরে এসে গলায় ঢেলে দেয় গরম পানীয়। ইন্দিরা টের পায় না যে তার গলা জ্বলছে, ইন্দিরা টের পায় না তার বুক জ্বলছে, টের পায় না বোতলটা শেষ করতে করতে কি ভীষণ ঘামছে সে। বোতলের পানীয় শেষ হতে পৃথিবীর কোনো এক শনিবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ ইন্দিরা চৌধুরী পা হড়কে গিয়ে হলঘরের মেঝেতে নিজের খুলে ফেলা জামাকাপড়ের উপর পড়ে যায়। মাটিতে পড়ে গিয়ে ইন্দিরা সোজাসুজি তাকিয়ে থাকে সামনের দেওয়ালে। তার চোখের পলক পড়ে না। তার নজর দেওয়ালের ছবিগুলোর উপরে পড়ে থাকে। কিন্তু সে টের পায় না সে কি দেখছে। ইন্দিরা চৌধুরী কিছুই দেখছে না এখন। সে শুধু চেয়ে আছে। কারণ তার চোখ আছে, সে দৃষ্টিবান। এছাড়া অন্য কোনো কারণ না থাকায় ইন্দিরা স্থির তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। তার বাঁহাতের ক্ষত থেকে রক্ত বেরিয়ে এসে হলঘরের মেঝেতে ঝরতে থাকে।

হঠাৎ প্রচণ্ড গা গুলিয়ে ওঠে ইন্দিরার। আর সাথে সাথে তার সমস্ত বোধ ফিরে আসে। নিজেকে টেনে তোলার চেষ্টা করে ইন্দিরা। পারে না। হাতের ক্ষতয় চাপ পড়ায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হয় তার। ব্যথায় শিউড়ে উঠতে মুখ খোলামাত্রই বমি করে ফেলে। নিজের গায়ে, নিজের জামা কাপড়ের উপর বমি করে ফেলে ইন্দিরা। এবং নিজেকে সেখান থেকে সরাতে পারে না। বমি করতে করতে গলা চিড়ে যায় তার, বমি করতে করতে কাঁদতে থাকে সে। তার কানে ভাসে সমীকের জন্মদিনের পার্টিতে শোনা আনন্দীর গলা, “যখন পারো না তখন চেষ্টা করো কেন?” ইন্দিরার কান্না থেমে যায়। আবার সেই বোধহীনতা তাকে ছেয়ে ফেলতে থাকে। নিজের উগড়ে দেওয়া অর্ধপাচিত খাবারের অবশিষ্ট অংশগুলো গায়ে মেখে হলঘরের মেঝেতে পড়ে থাকে ইন্দিরা। তার চোখ সামনের দিকে মেলা থাকে। অথচ ইন্দিরা কিছুই দেখে না।

 

 

একটা ঘোরের মধ্যে নিজেকে তুলে নিয়ে বাথরুমে আসে ইন্দিরা। শাওয়ার অন করে দেয়। কনকনে ঠাণ্ডা জল এসে পড়ে তার গায়ে। কিন্তু বাকি সব বোধের সাথে সাথে তার শীতবোধও লোপ পাওয়ায় ইন্দিরা স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। তার কাঁধ ও হাত থেকে বমি ও জমতে থাকা রক্ত ধুয়ে যেতে থাকে। যন্ত্রবৎ শাওয়ার বন্ধ করে ইন্দিরা। ওয়াশরুম থেকে বাইরে এসে দাঁড়ায়। তার নগ্ন দেহ বেয়ে জল ঝরে পড়তে থাকে মেঝেতে। নিজের মতো হেঁটে হেঁটে ভেজা গায়েই ইন্দিরা হলঘরের সোফায় এসে বসে পড়ে। তার চোখ সামনের দেওয়ালে আটকে থাকে। ভিজে গায়ে জল শুকিয়ে যায়।

বেলা বারোটা নাগাদ ডোর বেল বেজে উঠতে ইন্দিরা হেঁটে হেঁটে চলে আসে দরজার কাছে। দরজা খুলতে দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রুবাঈ, তার হাতে ধরা দুধের প্যাকেট। রুবাঈ আপাদমস্তক নগ্ন ইন্দিরাকে দেখে। তারপর অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

বিন্দুমাত্র কাল বিলম্ব না করে রুবাঈ বলে, “listen Indira, I am telling you where she is, you just go, please go!”

“না! আমি শুনবো না!” নিজের কান দুহাতে চেপে ধরে ইন্দিরা চিৎকার করে ওঠে। বমি করে চিড়ে ফেলা গলা ভেঙে যায় তার।

রুবাঈ হলঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা জামা কাপড় ও তাতে লেগে থাকা বমির দিকে তাকায়।

তার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ইন্দিরা।

একেক করে সমস্ত জামা কাপড় তুলে নিয়ে রুবাঈ ইন্দিরার ওয়াশরুমে রেখে দিয়ে এসে, ওয়াইপার দিয়ে মেঝে মুছে দেয়। গোটা সময়টা ইন্দিরা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে রুবাঈয়ের সামনে।

 

মেঝে মোছা হয়ে গেলে হাত ধরে ইন্দিরাকে তার ঘরে নিয়ে আসে রুবাঈ। বিছানার কাছে তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আলমারি খুলে ভাঁজ করে রাখা জামা প্যান্ট ও অন্তর্বাস বের করে আনে। যেভাবে শিশুকে সাজায় পিতা, সেভাবে একেক করে ইন্দিরার গায়ে জামাকাপড়গুলো পরিয়ে দেয় রুবাঈ। জামার কলার ভাঁজ করতে গিয়ে ইন্দিরার গলায় হাত লেগে যায় তার, সাথে সাথে রুবাঈ ইন্দিরার কপালে হাত রাখে, “তুমি জানো, তোমার গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে?!”

ইন্দিরা কিছু বলে না।

ইন্দিরাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে রুবাঈ ইন্দিরার আলমারি হাতড়ায়, “তোমার ওষুধ কোথায় থাকে ইন্দিরা?”

“আমার ওষুধ লাগবে না”

“লাগবে না মানে?”

“I don’t want a cure, rather I don’t deserve a cure, রুবাঈ”

“চুপ! একদম চুপ! অপরাধবোধ আর অভিমান, deadliest combo ইন্দিরা, আমি তোমায় সেইদিকে ঠেলে দিতে পারি না”

“কেন? সে তো পারলো! আমার মা তো পেরেছেন!” ইন্দিরা চেঁচিয়ে ওঠে।

রুবাঈ চুপ করে থাকে।

“তুমি কি আমায় ভালোবাসো রুবাঈ?”

“না ইন্দিরা”

“তবে তুমি আজ এখানে কেন এসেছ?”

“একজন মানুষ আরেকজন মানুষের কাছে যে কারণে আসে,- অকারণে। সবকিছু কি ভালোবাসা হতে হবে? সবকিছু কি স্বার্থে হতে হবে? কই একটা ফুলকে তো জিজ্ঞেস করো না, করো নি, কেন ফুটছো? রোদ্দুরকে জিজ্ঞেস করো নি কেন জ্বলছ? পাখিকে বলো নি কেন গাইছো, তবে আমায় কেন জিজ্ঞেস করছো, আমি মানুষ বলে?”

“হ্যাঁ, কারণ মানুষ এরকম হয় না রুবাঈ। মানুষের কাছে অকারণ বলে কিছু হয় না”

“তবে মানুষ লেখে কেন, গান গায় কেন, তুমি তো লেখ, কেন লেখো? তুমি ‘তুমি’ হয়ে যাও বলে? ‘তুমি’ কি? মানুষ নও?!”

ইন্দিরা কিছু বলতে পারে না।

“আমি আজ বিকেলে গিয়ে আমার সব জিনিসপত্র এখানে নিয়ে আসবো… না, তুমি একটাও কথা বলবে না, আমি তোমার কোনো বারন শুনবো না, অন্তত যতদিন তুমি ফিরে না আসো, পাশের ওই ফাঁকা ঘরটায় আমি থাকবো।”

আত্মসমর্পন করে ইন্দিরা, বলে, “মাঝের তাকের বাঁদিকে, আমার ওষুধ।”

 

 

 

দুপুরের খাবার খাওয়া হলে গলা অবধি চাদর টেনে বিছানায় কুঁকড়ে শুয়ে থাকে ইন্দিরা। জ্বরের কাছে, পরিস্থিতির কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। একটা সময় সে দেখে তার মাথার কাছে এসে বসেছে রঞ্জনা, বিড়বিড় করে কি যেন বলছে সে ইন্দিরাকে। ইন্দিরা বলে ওঠে, “একটু জোরে বল, আমি শুনতে পাচ্ছি না,”

সাথে সাথে রঞ্জনার বদলে আনন্দী চলে আসে ইন্দিরার সামনে, বলে, “তুমি শুনতে পাও না, না?”

গলার কাছটা দলা পাকিয়ে আসে ইন্দিরার, যন্ত্রনায় তার ভ্রূ কুঁচকে যায়, ঘুমের ঘোরে ছটফট করে উঠলে রুবাঈ জলপট্টি দিতে শুরু করে ইন্দিরার কপালে। একটু পরে শান্ত একটা ঘুম নেমে আসে ইন্দিরার মাথা দিয়ে, একটা ব্যাগ হাতে চেয়ার ছেড়ে উঠে আনন্দী চলে যায়, রঞ্জনা আবার ফিরে আসে তার চোখের সামনে, শান্ত স্বরে বলে, “কখনো কারোর সামনে পুরোপুরি নগ্ন হবি না,”

“মানে?

“ইবাদৎ কর, ইবাদৎ”

“কি বলছিস বুঝতে পারছি না” অধীর হয়ে জানতে চায় ইন্দিরা।

রঞ্জনা চলে যায় ইন্দিরার চোখের সামনে থেকে, এবার জয়তী ভেসে ওঠে।

“কি বলেছিলাম মনে আছে? ফুল না, আয়না… আয়না”

 

 

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়তে ধীরে ধীরে জাগে ইন্দিরা। দেখে বিকেল পেরিয়ে যাওয়া আলোয় তার ঘরের টেবিলে রাখা জলের বোতল আর ইন্দিরার মোবাইলের পাশে একটা নোট রেখে গেছে রুবাঈ,- তেষ্টা পেলে জল খেও, আমি আমার সব জিনিস নিয়ে একটু পরে আসছি।” ইন্দিরা দেখে তার বাঁ হাতের ক্ষতয় ব্যান্ডেজ বাঁধা।

ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসল ইন্দিরা। তারপর জোর করে নিজেকে টেনে নিয়ে গেল আলমারির দিকে। একটা ড্রয়ার খুলে খবরের কাগজে মুড়ে রাখা জয়তীর দেওয়া ছোপ পড়া আয়নাটা বের করে আনল। খবরের কাগজের আবরন সরিয়ে আয়নাটা মুখের সামনে তুলে ধরতেই ছিটকে পিছিয়ে এল সে,- আয়নায় অপার শান্ত দুটো চোখ নিশ্চুপ তাকিয়ে আছে তার দিকে।

এই প্রথম যেন নিজেকে দেখল ইন্দিরা। শান্ত, দূরের দিকে তাকিয়ে থাকা নিজের চোখ দুটো দেখতে পেল। আয়না হাতে বিছানায় এসে বসল সে। আরো মিনিট খানেক নিজের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ইন্দিরা আয়নাটা নামিয়ে রাখল পাশে। টেবিল থেকে মোবাইল তুলে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে এল। গতকাল রাত থেকে আনন্দী ‘লাস্ট সিন’ ফিচার বন্ধ করে রেখেছে। হঠাৎ করে আনন্দীর নামের নিচে ভেসে উঠল একটা শব্দ- অনলাইন। চুপ করে যতক্ষণ না শব্দটা মিলিয়ে যায় ততক্ষণ মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকল ইন্দিরা। মিনিট খানেক পর শব্দটা নিজে থেকে মিলিয়ে গেল। শব্দটার ফেলে যাওয়া শূন্যস্থান দেখতে দেখতে ইন্দিরার বোধ হল, সে হেরে গেছে। একেবারে হেরে গেছে। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠতে চমকে ওঠে ইন্দিরা, একটা আননোন নাম্বার স্ক্রিনে ভাসছে।

“হ্যালো”

পুরুষ কন্ঠ বলে, “তুমি আমার ফোন রিসিভ করছ না কেন?”

“কে বলছেন আপনি?”

“নীলেশ, আনন্দীর…”

কথা শেষ হওয়ার আগেই ইন্দিরা বলে, “ও নেই এখানে। চলে গেছে।”

“চলে গেছে মানে? কোথায় গেছে?!”

“কোথায় গেছে বলে যায় নি”

“বলে যায় নি মানে! ইয়ার্কি হচ্ছে! কবে গেছে?”

“ভদ্রভাবে কথা বলুন, ও গতকাল এই শহর ছেড়ে চলে গেছে”

“আর তুমি আমায় সেটা জানানোর প্রয়োজন বোধ করো নি,”

“না করি নি”

“ওর যদি কিছু হয়ে যায়, রেসপন্সিবিলিটি কে নেবে?!”

“আমি নেবো”

“Who you are! Who you are to her!” বিশ্রীভাবে হেসে ওঠে নীলেশ।

ইন্দিরা কিছু বলতে পারে না। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে ভারতবর্ষের সর্বাধুনিক শহরে বসেও নীলেশের প্রশ্ন ইন্দিরাকে চুপ করিয়ে দেয়।

কিছুক্ষণ পর ইন্দিরা বলে ওঠে, “কেউ না হয়েই, I know her more than you do, I am closer to her in all aspects, I have been where you would never be able to reach, আমায় ফোন করা বন্ধ করুন। নাহলে I will let you know how far I have reached, আর সেটা আপনার সহ্যক্ষমতার আওতায় পড়বে না।”

ফোন কেটে দেয় ইন্দিরা। আর টের পায় সে কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে মোবাইল রেখে জয়তীর আয়না আবার হাতে তুলে নেয় ইন্দিরা। নিজের চোখে চোখ রাখে। সে এতদিন জানত হেরে যাওয়া মানুষেরা অপরেশের মত দেখতে হয়, আজ সে জানল তাদেরকে খানিকটা ইন্দিরার মতও দেখতে।

 

ডোরবেল বেজে ওঠে, ইন্দিরা চঞ্চল হয় না, সে জানে আর কেউ নয়, রুবাঈ এসেছে, পায়ে জোর এনে সে হেঁটে যায় দরজার দিকে। দরজা খুলতে একেক করে নিজের সব জিনিসপত্র নিয়ে ভিতরে চলে আসে রুবাঈ। দরজা বন্ধ করতে করতে ইন্দিরা দেখে বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।

হলঘরে দাঁড়িয়ে রুবাঈ বলে, “তোমার অনুমতি না নিয়ে চলে এসেছি, তোমার সঙ্গত আপত্তি থাকলে বলো, আমি অন্য কোনো উপায় বের করব”

ইন্দিরা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

“ইন্দিরা…”

“তুমি যদি ওই ঘরে থাকো… তবে…”

“তুমি আহত হবে?”

ইন্দিরা চুপ করে থাকে।

রুবাঈ বলে, “আমি হলঘরে থাকব, তবে আপত্তি নেই তো?”

“আমায় স্বার্থপর ভেবো না রুবাঈ। ওটা শুধু একটা ঘর নয়, আমার কাছে আনন্দীর অস্তিত্বের একটা অংশ। এখনও যদি দরজা বন্ধ করে রাখি, মনে মনে ভেবে নিতে পারবো ও আমার কাছেই আছে, ভিতরেই আছে।”

“তুমি কেন ওর সাথে কথা বলছো না ইন্দিরা, এটা কি শুধুই অভিমান,- অহংকার নয়?”

“অহংকার…? আমি জানলামই না আমি কে…” নিজের মনে বলে ইন্দিরা।

“মানে?”

“ও কিছু নয়, ভুল বকছি, আগের মত, সময় দাও ঠিক হয়ে যাবে”

“Are you having a nervous breakdown again?”

“বুঝতে পারছি না”

“ইন্দিরা, এবার কিন্তু তুমি আর একা নও,”

“ঘুমের আগে প্রতিটা মানুষ একা, ভুলে যেও না রুবাঈ”

জবাবে কিছু বলতে পারে না রুবাঈ। ইন্দিরার ফোন বেজে ওঠে।

ঘর থেকে রুবাঈ ফোন এনে ইন্দিরার হাতে দেয়। আবার একটা আননোন নাম্বার।

ফোন রিসিভ করেই ইন্দিরা বেশ জোরের সাথে বলে, “I asked you not to call me again, did you NOT hear me?”

“ইন্দিরা,” মহিলা কন্ঠ ইন্দিরাকে চুপ করিয়ে দেয়, সে শুনতে পায়, ওপার থেকে,- “ইন্দিরা… আমি মা বলছি”

এক হাতে পাশে দাঁড়ানো রুবাঈয়ের হাত খামচে ধরে ইন্দিরা।


প্রথম পর্ব

শেয়ার
সর্বশেষ সংখ্যা