দ্বিতীয় দশকের কবিতা: সামান্য তাকায়ে দেখা | কাজল শাহনেওয়াজ

কারো কবিতা সম্পর্কে কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে প্রথম পাঠের পরের অনুভূতি কী ছিল? কবিতাটা কি পাঠকের কাছে ভাল লাগলো? উত্তীর্ণ লাগলো? রসসঞ্চার করতে পারলো? যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে এর মেরিট যাচাইয়ের প্রশ্ন আসবে। এই পর্বটা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তি নিরপেক্ষতা নির্ভর। কে বিচার করতে চাইছে? তার কাব্যপাঠের অভিজ্ঞতা কেমন? এবং তাঁর কি বৈদগ্ধের গভীরতা আছে? এসবে আস্থা স্থাপন করতে না পারলে, এইপথে বেশি আগানো ঠিক হবে না। সেটা হবে যান্ত্রিক কাব্য বিচার।

আমি পাঁচজন নির্ভরযোগ্য ও কালোত্তীর্ণ কবির কাব্যবিচারকে আমার আজকের অনুসন্ধানে প্রয়োগ করেছি। প্রথমে এঁদের কয়েকটা বাক্য স্মরণ করি:

‘যে কবির কল্পনা-প্রতিভা আছে তিনি ছাড়া আর কেউ কাব্যসৃষ্টি করবার মতো অন্তঃপ্রেরণার দাবি করতে পারে কি? …কিন্তু ভাব-প্রতিভাজাত এই অন্তঃপ্রেরণাও সব নয়। তাকে সংস্কারমুক্ত শুদ্ধ তর্কের ইঙ্গিত শুনতে হবে, এ জিনিস ইতিহাসচেতনায় সুগঠিত হওয়া চাই।’

– কবিতা প্রসঙ্গে, জীবনানন্দ দাশ

 

আদম এবং ঈভ পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হয়ে তাদের শ্রম, ঘাম ও দুর্ভাগ্যের উপার্জনের শস্য আহরণ করে পৃথিবীতে বাস করতে শুরু করলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে ফেলে আসা স্বর্গের স্বপ্ন সুপ্ত হয়ে থাকল। এই স্বপ্ন তাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্যেও সঞ্চারিত থাকল। মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে সে আবার স্বর্গোদ্যানে ফিরে যাবে। এই স্বপ্নের নামই হলো কবিতা।

– কবির কররেখা, আল মাহমুদ

 

কবিতা নানা ধরনের। মূলত আত্মপ্রকাশের তাগিদে কবি কবিতা লেখেন। তার কিছু বলার কথা আছে, সেগুলো তিনি নিজেকে শোনান, অন্যদের শোনাতে চান। বিভিন্ন কবির বলার কথা বিভিন্ন, বলার ভঙ্গি নানা ধরনের। একটি শর্ত প্রত্যেক প্রকৃত কবিকেই মেনে চলতে হয়। অর্থাৎ তার পঙ্ক্তিমালাকে কবিতা হয়ে উঠতে হবে, রসোত্তীর্ণ হতে হবে। কবিতায় এমন কিছু থাকতে হবে, যার জন্য পাঠক বারেবারে ফিরে যাবে সেই কবিতার কাছে। যে কবিতার আকর্ষণ একবার পড়লেই নিঃশেষিত হয়, সেই রচনা ক্ষীণায়ু হতে বাধ্য। ক্ষীণায়ু কবিতা কোন্ কবি লিখতে চান? দু’দিন বাজার গরম করেই যারা তৃপ্ত তাদের কথা আলাদা।

– কবিতা একধরণের আশ্রয়, শামসুর রাহমান

 

কবিতাই আরাধ্য আমার, মানি; এবং বিব্রত

তার জন্য কিছু কম নই। উপরন্তু আছি পড়ে উপাধিবিহীন, জানি

বাণিজ্যে বসতি যার সেই মা’ লক্ষ্মীর সংসারেই উন্মূল, উদ্বৃত্ত, তবু

কোনমতে টিকে-থাকা, যেন বেঢপ ভূমিকাশূন্য তানপুরা।

– কবিতাই আরাধ্য জানি, শহীদ কাদরী

 

পাশ্চাত্যের বুদ্ধি, যুক্তি, গণিত, প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদির বিপরীতে প্রাচ্যে বিশেষত বাংলার ভাব সাধনার ধারায় কাব্যই সাধনার ভাষা।

– ফেসবুক, ফরহাদ মজহার

 

উপরোক্ত বাক্যাবলি থেকে সমকালীন কবিতা বিচারের একটা মাপকাঠি উদ্ভাবন করা যায়। রূপরেখা ঠিক করা যায়। আমি সে চেষ্টাই করেছি।

 

বিচার পদ্ধতি:

আমি চেষ্টা করেছি এটা ডিফাইন করতে, কোন এক কবির আলোচ্য কবিতাগুচ্ছ কতটুকু সংস্কারমুক্ত শুদ্ধ তর্কের ইঙ্গিত দেয়? তার ইতিহাসচেতনা কেমন? পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য সাধনার ভাষা সম্পর্কে সচেতনার চিহ্ন আছে কিনা। কবিতাটা কি স্বর্গোদ্যানে ফিরে যাবার স্বপ্ন বা ইঙ্গিত ধারণ করে? কবিতাটার কি রসোত্তীর্ণতা, স্মরণযোগ্যতা আছে? এতে ব্যবহৃত শব্দ কেমন? প্রসঙ্গ ও বাক্যে সৃজনশীলতা এবং নতুনত্ব আছে কী?

এছাড়া আরো কয়েকটা বিষয় দেখার চেষ্টা করেছি। কবি কি উপাধি বা পুরষ্কারকামীতা থেকে মুক্ত? তিনি কি চিরকালীন বৈষম্যবিরোধী? তাঁর বাক্য কি ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গবিদ্বেষমুক্ত?

আলাদাভাবে কারো সম্পর্কে এই অল্প পরিসরে বিস্তারিত বিচার করা যাচ্ছে না। তবে সবাইকে একটা সামগ্রিক বিচারে বলা যায়, আলোচ্য কবিরা সবাই কবিতা গঠনে চমৎকার। নতুন বাক্য বা শব্দবন্ধ সৃজনে আকর্ষণীয়। তাঁদের কবিতা কমবেশি উপভোগ্য। তবে সবাই কমবেশি একটাই জগতকে দেখছেন বলে মনে হয়।

তবে তাঁদের কবিতায় ইতিহাসচেতনা মৃদু, শুদ্ধ তর্কের চিহ্ন কম। দেশ-কাল দুটাতেই বেখেয়ালি অনেকে। স্বর্গোদ্যানে ফিরে যাবার স্বপ্ন অর্থাৎ দেশাত্মবোধ, সমসাময়িক মুখের কথাভিত্তিক বাকভঙ্গি, ব‌্যঙ্গ বা ব‌ক্রো‌ক্তি ইত্যাদি কবিতায় অনুপস্থিত। মাল্টিভার্সে যাতায়াত কম।

আলোচ্য কবিদের জন্ম ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ এর মধ্যে অর্থাৎ তাঁদের বয়স ৩৪ থেকে ৪১ এর মধ্যে। তাঁরা তাদের কাব্যমেধা পূর্ণপ্রকাশের দ্বারপ্রান্তে। কাউকে না কাউকে সময়ের এবং কবিতার পথে দুঃসাহসি অভিযাত্রি হতে হবে একটা সময়। এখনো ঢের সময় আছে ওঁদের। আশা করি ততদিন আমরা অপেক্ষা করবো। শব্দ ও বাক‌্যচূ‌র্ণের মধ্যে আরো বে‌শি এনট্রপি বা উত্তেজনা হোক, আরো শক্তি বিকীর্ণ হোক।


শুরু করা যাক কবিদের সংক্ষিপ্ত অনুসন্ধান


অনুপম মণ্ডল [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ১৯৮৮, ডিসেম্বর

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: সন্ধ্যামণির কাছে, রাতচরা পাখি, নিঝুম উঠোনের, ব্যথার পাশে রোদ, সোনার বাউটি, ঝরে পড়া ফুল, মথেরা ওড়ে, বন-পাথালির মাথায় এতোটুকু অন্ধকার, শুকনো নাড়া পেরিয়ে, নিজেকে বিছিয়ে দিচ্ছে ভুবনডাঙার পথে পথে, সন্ধ্যামণির কাছে জেগে উঠলো তমোমণির দল, অস্তরাগরেখা, বঁইচি গাছের এলোমেলো ডালপালায়

মন্তব্য: মিষ্টি জীবনানন্দ বা বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিসর্গ উল্লেখের জগৎ যেন। অল্প মৃদু চিন্তা, ইশারা। যেন গতকাল থেকে কবিতা। দ্বন্ধদ্বৈরথহীন প্যাস্টোরাল জীবন।

 

অস্ট্রিক ঋষি [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ৩০/৬/১৯৯০

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: ফাটতে না পারার যন্ত্রণায় ভিতরে ভিতরে লাল হয়ে ওঠে যে ডালিম, বিপদখচিত কালবৈশাখী, রক্তিম শাঁস, যদি ধাত্রী হয়, হাতে তো অস্ত্রই ছিলো, মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে, কম্পনরতা তলপেট, মেঘ কত কথা বলে, ছেলে শিশুর না ফোটা শিশ্নের অগ্রভাগে চর্মের স্ফিত হবার উত্তেজনায়, রাস্তা যেইখানে দুইপা ফাঁক ক’রে, আলোর অর্গাজম ঘটিয়ে যাচ্ছে, দুটো আত্মহত্যাপ্রবণ পাখি একটা বোঁটাভাঙা গোলাপ, অন্তর্বাসপ্রবণ মেঘ

মন্তব্য:  বাক্যে নাটকীয়তা। শব্দ নয় বাক্যাংশে তেজ। সমকালের দৃশ্য। প্রসঙ্গের জাক্সাপোজ। স্মরণযোগ্য, মনে থাকে কিন্তু হৃদয় চমকায় না।

 

আল ইমরান সিদ্দিকী [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ২/১০/১৯৮৩

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: গোধূলি ঘনছাই, আঁধারে কালো কালো গাছ, নগ্ন ডালপালার অতুল বিন্যাসকে, ছিল এক তিমিঙ্গিল হাঙর ধড়ের থেকে যার মাথার গতি বেশি, মুমূর্ষুতা ও বলিষ্ঠতার দিকে তাকিয়ে, মিরর-মেইজ, সিঁড়ির গোড়ায় কম্পিত টিউলিপ, বনের প্রান্তে এক ঘোরানো সিঁড়ি, কাচা তামাক-পাতার মতো বাতাসে স্থির, ভাষাকে নাচাতে, ঘোরাতে, পেঁচাতে আর চাবাতে ভালোবাসে অভিব্যক্তির পর অভিব্যক্তি এঁকে,  ক্যাথ্‌রিনের চাকা যেন সারাটা আকাশ

মন্তব্য: শব্দ ও চিত্র ব্যবহারে সৌখিন এবং স্টাইলিশ। বিদেশপ্রিয়।  সময়চেতনা গভীরতায় অস্পষ্ট। শুদ্ধ তর্ক অনুপস্থিত। স্বর্গের অর্থাৎ দেশের চিহ্ন নাই।

 

উপল বড়ুয়া [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ১৯/১২/১৯৮৮

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: এক শুকনো শীর্ণ নদী, একটু দূরে মরা পাতার স্তুপ, হালকা শীতে রোদ পোহাচ্ছে বক, যেন বহু আগের দৃশ্য তৈরি করে রাখা, আমারই না হয় কোথাও যাওয়ার নেই, বসন্ত এক হলুদ দাগ, চলে এলো শিকারে যাওয়ার দিন, ভুলে যাবো অস্ত্রচালনা, তত কাছে নয়, যতটা ভাবি বহুদূর, তোমার চোখ ও চিবুক সে এতোই তীব্র ঘন ডাকলে ডাহুক ভয়ে ভীষণ কাঁপত অরণ্য, গাছ মরে গেলে পাখি উড়ে যায় অন্যত্র পাখি মরে গেলে গাছ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে অন্য পাখির আশায়

মন্তব্য: ব্যক্তিগত অনুভূতিতে মোড়ানো। প্রকৃতি থেকে বিষাদ নিষ্কাশন। প্রসিদ্ধ কাব্যিকতা-সম্পন্ন প্রকাশ।

 

তানিম কবির [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ২৫/৩/১৯৮৯

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: চিরস্থায়ী দুখের সঙ্গে, যেন একটা ফেরি একুল থেকে সেকুল করে, ভিন্ন দ্বীপের কাঁকড়া খোঁজায়, ‘ছিলাম পৃথক, আছি, থাকব পৃথক সম্ভবত’, এক টাকাও কলচার্জ কাটে নি, তুমি কি জানো, কান্ট্রিকোডসহ পুরো নাম্বারটার যোগফল এখন ৪৮ হয়েছে, চলো ভৈরব, চলো তিনদিন, তুমি মেঘনার ঘাটে থাকবা, তুমি শর্মি তুমি পুরনো, কোনো বৃষ্টিতে ভেজা ওয়াগন, ‘ঘোলা বাষ্পে, চলো মিশ খাই’, পেশেন্ট তো তার বাস করে নিজপ্রাণে, জেগে উঠি নিজ নিজ মরু উদ্যানে পায়ের তালুতে প্রতিদিন

মন্তব্য: হালকা চালে গভীর দর্শন, দৈনন্দিন কথা থেকে কবিতা বানানো। তবে যখন ‘কাটে নাই’ না বলে বলেন ‘কাটে নি’ – মনে হয় মাত্রা মিলানোর জন্য। হেসে খেলে ছন্দ মেলান, সহজ যোগাযোগের রহস্য জানেন যেন। দেশ চেতনার চিহ্ন দৃশ্যে দৃশ্যে। স্মরণযোগ্যতা বিস্ময়কর রকম ভাল।

 

বিধান সাহা [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ২১/৩/১৯৮৪

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: অব্যক্ত সন্ধির, অভেদ আগুন, উড়ন্ত মিথুন, ধুম অন্ধকার, শাখায় রচিত কুয়াশার ফুল, স্মৃতিময় আরশিতে, নিজের নিয়তি, নিঃসঙ্গ ঐ প্রুফরিডারকেই, অক্ষরের বিষ, পুরোনো মলিন, আড়ে-ঠারে চাই, পুজো শেষ হয়ে গেছে, চিনচিনে ব্যথা, ভুলের দেশে, জ্যান্ত চিতা, গণিতের সাঁকো, ঘ্রাণের মৌতাতে, নিজস্ব রেণু, আত্মা গলে যায়, ব্যাস, ব্যাসার্ধ, ফুল ও পাপড়ি, মরে যাচ্ছি জ্বরে

মন্তব্য: যেন-র ব্যবহার রয়েছে। উদ্ভাবনে উৎসাহি নয় মনে হয়। চিত্রকল্প স্থবির। নিজস্ব দৃশ্য রচনায় অলস। পাঠ থেকে কবিতার জন্ম হয়েছে মনে হয়।

 

মিছিল খন্দকার [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ২০/১২/১৯৮৫

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: কে যেন বাবল ফোলায়, রোমান হরফ, শিস বাজাচ্ছে গাছের শাখা, ফজর আজান, চাইছি আবছাভাবে অন‍্য হাঁটা, সব গ্রামেই একটা মীরাবাড়ি থাকে, আচানক তেঁতুলগাছ, গোলাকার পুকুরের কোমর ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়ে কয়েকটা শেকড়, মানবশরীর রূপান্তরিত হবে রাতে, মাগরিবের আজানকেও মুয়াজ্জিনের নিরুপায় কান্নাধ্বনি মনে হয়, পুরোনো পত্রিকা পড়ে গ্র্যাজুয়েট বেকার বন্ধুটা, চোখ রেখেছেন দূর পৃথিবী হেলান দিয়ে শুয়ে

মন্তব্য: স্পষ্ট চিত্ররূপ, বলার অনেক আছে। ইঙ্গিতে, কিন্তু পরিষ্কার প্রকাশ। বহুস্তরের ম্যাচিউর দৃষ্টি।

 

মোস্তফা হামেদী [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ২৭/৮/১৯৮৫

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: শহরে কোথাও ভালো রান্না হচ্ছে না, হেঁশেলের, কয়েন ছিটাচ্ছে, মেঘোত্তমার নাচ, শেমিজের ফুলগুলি, ঢেঁকিঘরজুড়ে হাসি, মগ্ন নিশিগঞ্জ, মোহনদীর ধ্বনি, ঋতুরহস্যের ড্রাম, জুনিপোকারা, অবনতপর ঘর, কলাকৈবল্যের হাব, ছায়াশিহরিত গেঁয়ো গান, নিকেল গলিত তেরচা হয়ে থাকা আলো, ফিনফিন ধ্বনি, রাতের বাথানে, কানে মাকড়ি ছাড়া মেয়ে যথা হীন লাগে, ভোরের রূপ এসেছে গাভির বাঁট বেয়ে, গুলগুলি (ঘুলঘুলি?)।

মন্তব্য: বৈচিত্রময় দৃষ্টি। চিত্রপ্রকাশে সাবলিল, বাক্যে অপরিসীম কন্ট্রোল। চিন্তাকে অনেকদূর নিতে পারে। কাব্যিক প্রকাশে সতর্ক। বহুস্তর। দৃশ্যকল্প থেকে সময়চেতনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

 

রিমঝিম আহমেদ [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ৮/৭/১৯৮৫

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: কথার জোনাক, প্রগাঢ় জঙ্গল, মত্ত-ফড়িঙ-প্রবণতা, পিঁপড়েছন্দ, আস্কারা দিই, দখলের বিদ্যা, রাক্ষুসে সব্বনাশী, মানতের হিজলফুলে, বেকসুর কুর্চি , মাতাল শামুক, কাঠের ডালিম, বিরহ বপন

মন্তব্য: বাক্যে পয়ারের চাল। সহজ শব্দের প্রয়োগ। বহুল ব্যবহৃত কিন্তু সফট শব্দের ঘরোয়া বিয়ে।

 

শামশাম তাজিল  [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ১/৪/১৯৮৪

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: আদম হাওয়া, হাজরে-আসওয়াদ, রৌরব, আলিফ, মূর্খের ফিকির, খোদা, পাষাণভার, পাথরের পুনর্জন্ম, ঈশপ, উলুধ্বনি, আজান, অপার বিজ্ঞান, দর্জিবালক, স্বপ্নে নিজের ঠোঁট সেলাই করে বাঁচি, খুনিয়ারা, শীলভদ্রের বুদ্ধবাণী,

মন্তব্য: সেমেটিক ও সনাতন দর্শনের শব্দাবলীর দিকে ঝোঁক। অস্পষ্ট কালহীন দার্শনিকতা। চিত্র বা বয়ানে সরল স্থবির, নতুনত্ব কম।

 

শাহ মাইদুল ইসলাম [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ২০/৬/১৯৮৬

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: আশ্লেষে, পরবশ, প্রকট, আর্ত দিন, গুঢ়-রাত্রি, বাহুসন্ধি, চুলোয় ফুটছে, কনীনিকায় গাঢ় হচ্ছে লেবুঝাড়, চোখের বাতানে, আংরাখা চাঁদ, পাতার রাজ্য তূরীয় মনে হয়

মন্তব্য:  গ্রামীণ নিসর্গের রূপ। ছোট ছোট চিত্রকল্প। পুরনো শব্দগুচ্ছ, প্রচলিত প্রয়োগ।

 

সালেহীন শিপ্রা  [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ২০/১২/১৯৮৯

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: বসন্তের কাম আলুথালু, কচি ধানক্ষেত, রণদৌড়ের ঘোড়া, হৃদয় টলছে, প্রেম নাকি পাপ, কটেজের রাত,  বাহুডাল যেন রাস্তাই, স্তনবৃন্ত এত ভালো লাগে যেন সমতলে অমসৃণ গোল ভূমি, সুনসানে এক সাইলেন্ট রূপমাত্র, পাথর-খাঁজে ছড়ার চলন, ঝুমসন্ধ্যায় সাগর-জলে ঢুকে যাচ্ছ, কাঁটাবিদ্ধ আলো, ঘৃণামেঘ, নত অন্ধকারটিকে, নীল অবাক প্রজাপতি, কারো মাতাল করা ঘাম, মন খারাপের রঙ, বিষাদ হচ্ছে শুধুই গাঢ়, কুটুম্ব চুক্তির

মন্তব্য: কাব্যিক ঢঙ। মাত্রাগোনা উচ্চারণ। মনে হয় প্রকাশভঙ্গি অনেক ব্যবহৃত। কিছুটা নার্সিসিস্ট অবলোকন। দেশ-কাল-সময়চেতনা থেকে অন্য আরেক জগৎ।

 

হাসান রোবায়েত [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ১৯/৮/১৯৮৯

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: কোথাও একটা সাইকেল, আড়া-জঙ্গল পার হয়ে, আতনা ফুলের, খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে, মানুষ সাঁকো বানায় নির্জন বিষণ্নতার উপর, কুয়াশা বোঁটাতে বোঁটাতে, বিবাহবিলীন হাওয়ায়, নাড়াকাটা চকে, থালাবাসনের উপর বৃষ্টি ঝরবে, তোমার পায়ের রহমটুকু, স্যান্ডেলে গোরের কাদামাটি, শিমলতার নিচে, মাগরিবের নামাজ শেষে, ছোট মেয়েটার লাল ফ্রক

মন্তব্য: সহজ সরল। বাক্যে যুক্তাক্ষর কম। অচেনা শব্দবন্ধ বানাতে পারঙ্গম। সাধারণ কথাবার্তাকে কবিতা বানাতে ইচ্ছুক। গদ্য সাহিত্যের প্রভাব রয়েছে। মুসলিম জীবনযাপনের বর্ণনা আছে কবিতায়। মুসলিম জীবন প্রণালী, ইসলামি শব্দ ও রেফারেন্স ব্যবহারে উৎসাহী।

 

হাসনাত শোয়েব [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ৪//৯/১৯৮৯

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: চ্যাপলিনকে, সেল্টা ভিগোর, লিভ ইন, আঙুল দিয়ে মাটি কেটে কেটে নদী, সীল মাছের সাথে শীতের যেটুকু দূরত্ব, পাতার যন্ত্রণা, জেনেসিসের ড্রাকুলারাও, শিরীষকুসুম, জয়তুন নগরে

মন্তব্য: শব্দ নয়, বাক্য ব্যবহার করেই অন্য একটা অর্থ দেয়, অচেনা বয়ান তৈরি করে। পুরনো প্রসঙ্গের সামান্য রেফারেন্সকে বাঁক ঘুড়িয়ে দিতে উৎসাহী।

 

হিজল জোবায়ের [কবিতা পড়তে কবি’র নামে ক্লিক করুন]

জন্ম: ৩/৫/১৯৮৭

কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বাক্যাংশ: ছাই আর পারদ, তমসাসম্বলিত, মার্কারি রং, সমুদ্রে নেমে কোন্‌ মহিলা সাবানের ফেনায় তার যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করছিল, জাইলেম, নিরঙ্কুশ পাতনযন্ত্রে ঘেরা, বৃহদন্ত্রময় মৃত এক জন্মপত্রহীন, বজ্রোৎপাদনশীল মেঘের মেশিন, এপিলেপটিক ঘুমের মধ্যে, ফেলে দিয়ে আসা বস্তার মুখ খুলে যায় অবশেষে বিপরীত স্রোতে মার্জার সাঁতরায়

মন্তব্য: বিপরীত বা সম্পর্কহীন শব্দের বিয়ে দিতে উৎসাহী। ব্যবহার করেন অতি পরিচিত শব্দগুচ্ছ অচেনা প্রসঙ্গে, গোপন লজিকে। আপাত বিচ্ছিন্ন বৈজ্ঞানিক টার্ম, সাংকেতিক যুক্তি। উপচে পড়ে প্রচুর চিন্তার গতিস্রোত। কখনো রূপকথার উদ্দেশ্যবিহীন উল্লেখ। সমকালীন বিষয়ের স্মার্ট ব্যবহার। অস্পষ্ট সময়চেতনা। তবে একটা আণ্ডারগ্রাউণ্ড সচেতন সময়চেতনা পাকায়ে পাকায়ে উঠতেছে টের পাওয়া যায়।


কবিদের নির্বাচন করা হইছে তাদের কবিতাচর্চার সময়কাল, লেখার ধারাবাহিকতা, একাধিক বই প্রকাশ হবার পরেও তাদের লেখার স্ট্যান্ডার্ড ধরে রাখতে পেরেছেন বা নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন কিনা, নিজের ভাষা-স্বর আছে কিনা এসব বিবেচনায়। সর্বোপরি সংকলনভুক্ত মাত্র ৫টা কবিতা থেকে ধারণা নেয়া হয়েছে। ফলে কোনভাবেই এই বিশ্লেষণ তাঁদের সামগ্রিকতাকে ধরতে পেরেছে, তা বলা যায় না।

আলিঙ্গন জানাই কবিদের। আগামির কবিতার জন্য।



কাজল শাহনেওয়াজ

কবি ও কথাশিল্পী।

জন্ম বিক্রমপুরের লৌহজং থানার দিঘলি গ্রামে (এখন পদ্মাগর্ভে বিলীন), ১৯৬১ সালের পয়লা জুন। পিতা আবু বকর সিদ্দিক পেশায় ভেটেরেনারী ডাক্তার ছিলেন। মায়ের নাম সুরাইয়া। শৈশব কাটে ফরিদপুরে। তারপর কৈশোর কিশোরগন্জে ও যৌবন ময়মনসিংহে। বর্তমানে ঢাকার ধানমণ্ডিতে একটা এপার্টমেন্টে স্থায়ী বসত।

ময়মনসিংহস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি প্রকৌশলে গ্রাজুয়েশন।

পেশা শুরু করেন সেচ প্রকৌশলী হিসাবে, দুই বছর পরে তথ্য প্রযুক্তিতে। পেশাগত দক্ষতা অর্জন করেন জিওগ্রাফিক ইনফর্মেশন সিস্টেম বিষয়ে। বারো বছর একটা কন্সাল্টিং ফার্মে চাকুরি করার পর আরও বারো বছর কাজ করেছেন সাইবার শক্তি নামে নিজের সফটঅয়্যার প্রতিষ্ঠানে। এক সময় পছন্দ ছিল নতুন নতুন প্রোগ্রামিং ভাষা শেখা ও কোডিং করাতে।

জীবনের উচ্চ ও নীচ, সফল ও অসফল, সামান্য ও অসামান্য – সব কিছুতেই অপরিসীম আকর্ষণ নিয়ে বসবাস করেন। কবিতায় কল্পনা ও গদ্যে বাস্তবতা দিয়ে শুরু করেছিলেন লেখালেখি। বর্তমানে বাংলার ভূমি-ইতিহাস-রাজনীতি প্রধান আগ্রহ।

কাজ করেছেন গ্রাম ও নগর দুই ধরণের জগতেই।

প্রকাশিত বই:

কবিতা

ছাঁট কাগজের মলাট (১৯৮৪), জলমগ্ন পাঠশালা (১৯৮৯), রহস্য খোলার রেঞ্চ (১৯৯২), আমার শ্বাসমূল (২০০৭), কাঠকয়লায় আঁকা তোমাকে আমার (২০০৯), তালগাছ হাতির বাচ্চা (২০১১), একটা পুরুষ পেপে গাছের প্রস্তাব (২০১৫), একটা ব্যাঙনি আমাকে পিঠে চড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে (২০১৯),কবিতাসমগ্র (২০১৮), জলমগ্ন পাঠশালা (২য় সংস্করণ ২০২৩)।

ছোটগল্প

কাছিমগালা (১৯৯৩), গতকাল লাল (২০০৭), কাছিমগালা ও গতকাল লাল (২০১১),

গল্পসমগ্র (২০১৮), কাছিমগালা (২য় সংস্করণ ২০২৩)

সাক্ষাৎকার

ঘোড়ার প্রেমপত্র (২০২০)

উপন্যাস

শে (২০২১)

আত্মজৈবনিক গদ্য

দিঘলী (২০২৫)

সম্পাদনা

বিকল্প কবিতা, যৌথ সম্পাদনা, ১৯৮৯

ফৃ, লিটল ম্যাগাজিন, ১৯৯৫-৯৮

ফৃ গ্রন্থিকা সিরিজ (পাতলা মলাটের এক ফর্মার বই), ১৯৯৮-৯৯, ২০০৭, ২০১১, ২০১৫

শেয়ার