দেয়াল লিখন থেকে গ্রাফিতি : অবদমিত শাসন বাস্তবতার বিরুদ্ধে হক -কথার সংস্কৃতি | ইমরান ফিরদাউস

ঢা.বি. ছবি : ইমরান ফিরদাউস

পাথরে লিখো নামপাথর ক্ষয়ে যাবে

বুলেটে লিখো নামরক্তে ধুয়ে যাবে

বুলেটে লিখো নামকার্তুজ খোসা পড়ে রবে

দেয়ালে লিখো নামনগর পুরসভা এসে মুছে দিয়ে যাবে

 

দেয়াল এক নাগরিক প্রাকার, পৌরাণিক পাহাড়ের কাল্পনিক আকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দুই বা ততোধিক দালানের মাঝে, আম-পাবলিক আর ক্ষমতার মাঝখানে, গতকাল আর সমকালের মধ্যেখানে। দেয়ালের চারা প্রকৃতিতে আপনা থেকে রোপিত হয়ে থাকবে আদিমকাল থেকেই, পরে সেই দেয়াল ছড়িয়ে গেল আর এন ঠাকুরের সঙ্গীতের মত সবখানে। যেমন কী… হালের অন্তর্জালিক সামাজিক যোগাযোগীয় মাধ্যমের সংস্কৃতিতেও দেয়াল হাজির, তার গতরে অক্ষরের মালা, ছবি দিয়ে ইতিহাস লেখার পটভূমি হিসেবে।

প্রাগৈতিহাসিক মানুষ থেকে আজকের শিশু – সবার কাছেই দেয়াল মনের কথার এক উদাম মাঠ। তাই যুদ্ধ-বিগ্রহ, সভ্য-অসভ্য, দাস-ক্যাপিটাল, প্রভু-ধান্ধাবাজ, বিশ্বযুদ্ধ-দেশভাগের সাত সমুদ্র তের হাঙ্গর নদী গ্রেনেড পার করে জরাবিধ্বস্ত মানুষ যখন নিজেকে নব্য বাস্তবতায় রাজনৈতিক প্রাণীরূপে ঠাহর করে নিতে পারলো; আরও পারলো ক্ষমতার ভালোবাসায় মত্ত শাসক-শোষক গোষ্ঠীকে চিনে নিতে… সেদিন দেখতে পেলো ঢাউস ঢাউস সংবিধান বহিতে আহত-নিহত আত্মার রক্ত দিয়ে, ‘মানুষ’কে নিয়ে অনেক মিঠা কথা লেখা হলেও, মানুষের পক্ষের কথা, মানুষের জন্যে কথা লেখা হয়েছে সামান্যই। পরন্তু, মানুষ তো জেনে গেছে সে রাজনৈতিক প্রাণ, তার আছে গলা চড়াবার দেমাগ, টুঁটি চেঁপে ধরলে উন্মাদ আস্ফালনের স্পর্ধা। আর, কপাল খারাপের রাতে ঠিক গুম হয়ে যাওয়ার আগে দেয়ালকে চিরকুট বানিয়ে, ভয়শূন্য চিত্তে যুতের কথা লিখে রেখে যাওয়ার শক্তি।

তো এই মর্মে, আজকের বাংলাদেশে দেয়ালে পোস্টার লাগানো/লেখা নিষেধের আদেশমূলক সতর্কবাণীর কালে, দেয়াল যখন শুধুই ক্ষমতার গদিনসীনের ‘দেশ এগিয়ে চলছে’ মূলক সংখ্যাতাত্ত্বিক মিঠে কথার কলেবর, তখন সেখানে জনমনের রোষ, ক্ষোভ, চাওয়া-না-পাওয়ার বাক্য ফুটে উঠতে দেখা যায় না। যদিও, পরিস্থিতিটা মানে দেয়াল লিখন চর্চার হালতটা এমন ছিলো না দেশভাগ পরবর্তী পূর্ব-বাঙলায় এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে।  

ধানমন্ডি, ছবি: ইমরান ফিরদাউস

দেশভাগ পরবর্তী পূর্ববাঙলা

রাজনৈতিক ডামাডোল ও রাজনীতি সচেতন ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ এর সময়কাল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের নগর-বন্দর-গ্রাম জনপদে দেয়ালে দেয়ালে রটিয়ে দেয়া হত মজলুমের কথা, জালিমের বিরুদ্ধে হুশিয়ার হুংকার আর মুক্তির শ্লোগান। যেমন মনে করা যাক, ভাষা আন্দোলেনের রব ওঠার অব্যবহিত ক্ষণ থেকে দেশের দেয়ালে দেয়ালে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাঙলা চাই’ শ্লোগানটি অষ্টপ্রহর ফুটে থেকেছে আত্মপরিচয়ের চিহ্নরূপে। আরও, দেখা যেতো ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ একই সময়ে শ্লোগান থেকে দেয়ালের বুকে ঠাঁই করে নেয় ‘জয় বাঙলা’ বা আপামর জনতার স্বায়ত্তশাসনের প্রতীক। রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে গোটা গোটা বোকা বোকা অক্ষরগুলোর মৃতদেহে নতুন দিনের আছড় পড়ে, বধির দেয়াল ভাষা খুঁজে পায়। এ সময়ের আরেকটি চেতনায় শাণ দেয়া শ্লোগান দেয়াল লিখনে জায়গা করে নেয়, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ আরও ছিল ‘তুমি কে, আমি কে, বাঙালি, বাঙালি।’

ছবি : ইমরান ফিরদাউস

এক্ষণ, লক্ষ্য করা যাক এসব দেয়াল লিখনে কথামালা বারংবার ব্যবহার করা হলেও চিত্র সংবলিত প্রথম দেয়াল লিখন উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসানের হাত ধরে – ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে।’ বলা বাহুল্য, এসব শ্লোগান, দেয়াল লিখন তৎকালে জনমত গঠনে ও জুলুমবাজ-অন্যায় পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধে সক্রিয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ

অসংকোচ, ঠোঁটকাটা দেয়াল লিখনের এ প্রবাহ জারি থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও। ১৯৭০, ১৯৮০, ১৯৯০-এর দশক জুড়ে গণপ্রজাতন্ত্র, একদল, সামরিক শাসন, স্বৈরাচার, বহুদলীয় গণতন্ত্র – সকল অবস্থাতেই দেয়াল লিখন আওয়াজ দিয়ে গেছে অবদমিত শাসন বাস্তবতার বিরুদ্ধে হক-কথার সংস্কৃতিকে। এই ভাগে ভরপুর অঞ্জর বেদনা-ভারাতুর বিহ্ববল বাংলাদেশে রাজনীতি বা অধিকার নিয়ে জবান চালানোর পরিসর সীমিত হয়ে পড়ে। তারপরও শহর ঢাকার এ দেয়ালে, সে দেয়ালে দেখা যেতো ‘বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস’, ‘মার্কিন দালাল হুঁশিয়ার’। রানের চিপায় আটকে পড়া গণতন্ত্রকে উদ্ধার করতে যখন বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা-কর্মজীবী-শ্রমজীবী মানুষ পথে নামে, তখন সেই যাত্রায় সামরিক শাসনের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেয় ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ শ্লোগানটি, এটি দেয়াল লিখনের বিস্মৃত ইতিহাসে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

ছবি: ইমরান ফিরদাউস

একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৯০/২০০০ সন অবধি দেয়াল লিখনের সাথে রাজনৈতিক বার্তা, রাজনৈতিক কর্মসূচী, আঁকিয়ে/লিখিয়েদের মাঝে রাজনৈতিক কর্মীদের অংশগ্রহণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় ঘটে থেকেছে। অর্থাৎ, দেশের-দশের অধিকার, দাবি-দাওয়া, ইনসাফের প্রশ্নে রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সঙ্ঘ সমাজের কণ্ঠস্বর হিসেবে ভূমিকা রক্ষার চেষ্টারত ছিল। এরপর মানে নব্বই পর দেয়াল লিখা/আঁকার সবচেয়ে বড় দেয়াল বার্লিন ওয়ালের পতন ঘটে, স্নায়ুযুদ্ধের বরফ গলা নদীতে ভাসতে দেখা যায় অনেক অবসরপ্রাপ্ত বামদের। আন্তর্জাতিক দুনিয়া হয়ে ওঠে বৈশ্বিক পৃথিবী, ব্যক্তিমানুষ সরকারের ছায়াবীথিতলে পাঠ নিতে শুরু করে নব্য-উদারনৈতিক বাস্তবতার, যেখানে রাষ্ট্রের কামাই সরকারের, ব্যক্তির টাকাও সরকারের।   

হঠাৎ করেই, তখন দেশ বাঙলায়, শহর ঢাকায় নিঃসন্তান একক বা দম্পতির সংখ্যা বেড়ে যায়, তবে আশার কথা হলো তারা কেউই যৌনবাহিত কারণে নিঃসন্তান নয়। এরা নিঃসন্ততির মত দুঃখী কারণ তাদের কোন অ্যাচিভমেন্ট নাই, জিপিএ ফাইভ নাই, মিথ্যা বড়লোকি নাই, আদেখলেপনা নিয়ে আহ্লাদী করার মত কোন সুযোগ নেই। আর এইসবের চক্করে মেট্রোসেক্সুয়াল বনে যাবার তাড়াহুড়ায়, তারা (হয়তোবা) ভুলে বসেছে মানবিক বোধের মত সুকুমার বৃত্তিগুলো।

ছবি: ইমরান ফিরদাউস

ঠিক এই সময়ে বাঙলার বুকে, ঢাকার সিনায় সিনায় টানা টানা হাতের লেখায় ভাস্বর হয়ে উঠে একজন অজ্ঞাতনামা লেখক। পশ্চিমা পথশিল্প সংস্কৃতির ভাষায় যাকে বলা হয় ট্যাগিং অর্থাৎ যিনি একটা লাইন লিখে রেখে চলে যান। আর এই নাম না জানা মাস্তান অনবরত লিখে গেলো ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’, সেঁটে দিয়ে গেলো বেদনার সিলমোহর। কিন্তু, মানুষ ততদিনে তাদের আত্মা বিক্রি করে দিয়ে ব্যাংককে হলিডে ট্যুর কিনতে শিখে ফেলেছে, তাই এই নগরের পয়লা গ্রাফিতি শিল্পীরে আমাদের কবুল করা হয়ে উঠে না।

বলে রাখা ভালো, গ্রাফিতি মানে প্রতি-সংস্কৃতির কালি-কলম। নন-কনফর্মিস্ট বা প্রচলবিরোধী জীবনযাপন পদ্ধতি। সময়ের মতি-গতিকে পরিহাস করা একেকটা গ্রাফিতি যেন শহরের শরীরে খোদাই করা একেকেটা ট্যাটু। সবাই সবার মত হতে চাওয়া ও নিজের গল্পটাই ইউনিক এমনতর বেকুব অনুভূতি নিয়ে হাইব্রিড সারে বেড়ে ওঠার কালে, আমাদের সময় থাকে না গুম, হত্যা, লুটপাট, সড়ক দুর্ঘটনা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি নিয়ে মাথা ঘামানোর। কেননা, আমরা বেচে দিছি আত্মা, কিনে নিছি সরকারী হত্যা। এমন মনোলিথিক সময়ে ঠিকই প্রতিবাদের হাতিয়ার নিয়ে হাজির হয় গ্রাফিতিশিল্পীরা।

পরীবাগ, ছবি: ইমরান ফিরদাউস

সে বা তারা স্টেন্সিলে আঁকে/লেখে ‘আই অ্যাাম অভিজিত, কিল মি’, শান্ত বুদ্ধ নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে লিখে লিখে বলে ‘লেট মি ডাই’ বা ধর্ষণ-নিপীড়ন-যৌন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেয়ালে দেয়ালে এ শহরে ভেসে উঠে বল্লম হাতে আগুয়ান নারীর প্রতিকৃতি যেথায় লিখা থাকে ‘হিট ব্যাক’। এই গ্রাফিতিগুলো এই শহরের দেয়ালের ফুটে থেকেছে, চাপা পড়ে গেছে পোস্টারে বা দলীয় উন্নয়নের গুণকীর্তনে। নিউজফিড স্ক্রলিংয়ের ক্ষণস্থায়ী স্মৃতি শক্তি নিয়ে আমরা অপেক্ষায় থাকি ভাইরাল হবার মুহূর্তের সাক্ষী হবার জন্য। তথাপি, ভাইরাল হলেই কী পথে আঁকা কোন দৃশ্যপট যৌক্তিক হয়ে উঠে কি না বা স্পষ্ট করে বললে তা গ্রাফিতি হয়ে উঠবে কিনা সে প্রশ্ন তোলার ঈমানী দায় বাংলাদেশের শিল্প ও বিদ্বৎ সমাজ এড়িয়ে যায় যেন কাশফুলের নরম ছোঁয়ার মমতায়।

ধরা যাক, সুবোধ ধারার পথচিত্রের কথা। এখানে গ্রাফিতির বয়ন বিন্যাস অনুসরণ করে পথচিত্রটি করা হয়েছে – এটি উন্মুক্ত স্থানে, অ্যাানোইনিমাস শিল্পীর দ্বারা, জনপরিসরে, দ্ব্যর্থবোধক শব্দ চয়ন এবং শেষাবধি একটি কনফর্মিস্ট আলাপ। এবং এটি ভাইরালের মর্যাদাও পেলো। আমরা নাগরিক আহ্লাদে আটখানা হলাম, ভাবলাম পেয়ে গেছি বুঝি বাঙলার শেষ বিবেক। দুঃখজনক হলেও সত্যি, গ্রাফিতির প্রতিভাস দিয়ে গড়া বস্তু গ্রাফিতির মতো দেখতে বলেই তাকে গ্রাফিতি বলা চলে না। আর, এই বলা বা কওয়ার ভেতর দিয়ে বরং আরও প্রকটিত হয় নগরবাসীর অন্তঃসারশূন্যতা। প্রমাণিত হয় কত সহজেই তাদের ছেলে ভুলানো প্রপাগান্ডায় ভুলানো যায়। কেননা, এই তথাকথিত গ্রাফিতি সমস্যার মূলকে প্রশ্ন করে না, বলে না কেন পালাবো বা পালাবো কোথায়— গ্রামগুলো তো মুছে ফেলেছি স্থায়ী ঠিকানার ঘর থেকে। যে হানা দিলো নির্বিবাদী জীবনে তাকে জায়গা জমিন দিয়ে আমি কেন পালাবো? বরং, এই দেয়ালে আঁকা চিত্র বুঝিয়ে দিলো আমরা এখন অনেক চৌকস নিও-লিবারেল মেশিনে উত্তীর্ণ হতে পেরেছি, যে মেশিন জানে কিভাবে পলায়নবাদী হতে হয় শিল্পের মেকী দোহাই দিয়ে। হালে রাজনৈতিক শুদ্ধতা ও রাজনৈতিক যথার্থতা চর্চার কালে মানুষ ভুলে যাচ্ছে অবলীলায় – হারানোর কিছুই নেই— শৃঙ্খল ছাড়া। 

ইদানীং সময়ে বৈশ্বিক সংস্কৃতির পিঠে চেপে চালু অনেক শব্দ মানুষ-আমরা পকেটে পুরতে শিখেছি বিনা দোহাইয়ে। বিনা তালাশে যা পকেটে ভরছি তা আমার ঘরেই আছে বা ছিল কিনা তার খোঁজ ব্যতিরেকে। তাই, নিছক পথচিত্র ভাইরালের সুবাসে মত্ত জমানায় বলতে হয় বাংলাদেশের জন্ম পূর্বাপর সময় থেকেই এ অঞ্চলের দেয়ালের কান আছে, মুখ আছে। আছে অবদমিত শাসন ব্যবস্থার গালে ঝামা ঘষে দেয়ার ঐতিহ্য, আছে ইনসাফের শ্লোগান তোলার সিলসিলা। বিজয় দিবসের প্রভাতে তাই উষ্ণ করমর্দন তোলা থাকুক অজ্ঞাতকুলশীল সেইসব গ্রাফিতি আঁকিয়ে/লিখিয়েদের প্রতি, যারা ধারণ করে যৌবনের ভাষা, রচনা করে শ্লেষের পঙতিমালা। সিস্টেমের শ্যেন নজর উপেক্ষা করে ছড়িয়ে দিচ্ছে, দিবে নিঃশব্দ শ্লোগানের অস্থিরতা।


 প্রথম প্রকাশ : দৈনিক দেশ রূপান্তর, বিশেষ সংখ্যা ১/ মুক্তির সংস্কৃতি, বৃহষ্পতিবার ২০ ডিসেম্বর ২০১৮ 

ছবি : আনিকা শাহ

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা, সংস্কৃতিবীক্ষক ও কলাসমালোচক। ইউনিভার্সিটি অভ টেকনোলজি সিডনি-তে ফিল্ম স্টাডিজে পিএইচডি করছেন। আগ্রহীরা দেখতে পারেন <https://imranfirdaus.wordpress.com/>।

x

x

শেয়ার