দায়ভার অথবা শোকসভার গল্প | আহমাদ মোস্তফা কামাল

তার নাম আদৌ পথিক কি না, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। আমরা তো নই-ই, এমনকি আমাদের সিনিয়ররাও নিশ্চিত নন, যাদের কাছে গল্প শুনেই তাকে দেখার আগেই চিনেছিলাম আমরা। তিনি কোথায় থাকেন, কী করেন, বাড়ি কোথায়, আত্মীয়স্বজনরা কোথায় এসবের কিছুই জানি না; এমনকি তার বয়স সম্বন্ধেও কোনো আন্দাজ করতে পারি না।

 

পথিক ভাইকে নিয়ে যে শঙ্কাটা ছিল আমাদের, সেটিই সত্যি হলো। খবর পেলাম, গণপিটুনি খেয়েছেন তিনি, এখন হাসপাতালে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। না, নিজের দোষে নয়, তিনি কখনো কারো সঙ্গে বিবাদে জড়ান না, গণপিটুনি খাওয়ার মতো কোনো কাজকর্মও করেন না। কিন্তু এই শহরে চলে-ফিরে বেড়াবার মতো কৌশলও তার জানা নাই। কাউকে বিপদে পড়তে দেখলে তিনি এগিয়ে যাবেন, যাবেনই। সে চোর হোক, ডাকাত হোক, পকেটমার হোক, ছিনতাইকারী হোক, কিংবা হোক সাধারণ মানুষ; বিপদাপন্ন মানুষ দেখলেই তাকে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা তাকে অনেকবার বুঝিয়েছি। বলেছি, যে-শহরে সন্তানের ভর্তি সংক্রান্ত বিষয়াদির খোঁজখবর নেওয়ার জন্য স্কুলে যাওয়া এক মাকে স্রেফ ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়, সেই শহরে কেউ নিরাপদ না। আপনি এসব ঝামেলায় যাবেন না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! উপকার করতে গিয়ে অপমানিত হন, কটুকথা শোনেন, গালিগালাজও খেতে হয়, তারপর পাংশু মুখে ফিরে আসেন। কেন গিয়েছিলেন জিজ্ঞেস করলে বলেন, একজন মানুষ বিপদে পড়েছে, যাবো না?

কিন্তু ও তো চোর/পকেটমার/হাইজ্যাকার! ওর পক্ষে যাবেন কেন?

মানুষ তো! — ছোট্ট করে উত্তর দেন তিনি।

আমরা আর কী বলবো? যে লোক অপরাধীকেও বাঁচাতে যান, সে মানুষ বলে, তাকে বোঝানোর কোনো উপায় আছে? কিন্তু এবার আর রক্ষা পেলেন না। শুনেছি, বাসে উঠেছিলেন তিনি কোথাও যাবেন বলে। সেখানেই এক পকেটমারকে ধরে ফেলেছিল লোকজন, শুরু হয়েছিল পিটুনি, তিনি আগ বাড়িয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন ওকে বাঁচাতে। লোকজন ‘তুইও এই দলের লোক’ বলে তাকে শক্ত পিটুনি দিয়েছে। সত্যিকারের পকেটমার কিন্তু ততটা পিটুনি খায়নি যতটা তিনি খেয়েছেন, কারণ তিনি বারবার প্রতিবাদ করেছিলেন। এ শহরের মানুষ প্রতিবাদ জিনিসটা সইতেই পারে না, ফলে যা হবার তাই হয়েছে। কেবল মেরেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, ধাক্কা দিয়ে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিয়েছে তাকে, বেকায়দায় পড়ে মাথাটা গিয়ে বাড়ি খেয়েছে কংক্রিটের রাস্তার সঙ্গে। রাস্তার লোকজন যে দয়া করে তাকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে গেছে এই তো বেশি।

আমরা খবর পেলাম কীভাবে? তিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না, ছোট্ট একটা নোটবুক থাকে তার পকেটে, সেখানেই লেখা থাকে প্রয়োজনীয় ফোন নাম্বারগুলো। অবশ্য কোনটা যে তার জন্য প্রয়োজনীয় আর কোনটা নয়, তা আমাদের জানা নাই। তবু তার নোটবুকে যে আমাদের নাম্বারগুলো উঠেছে, তাতেই আমরা আনন্দিত।

 


না, বাড়িতেই ছিলাম। কিন্তু ওটাকে থাকা বলে না। যতদিন ছিলাম, বাবার সঙ্গে কখনো কথা বলিনি, কোনোদিন আর মকবুল ভাইয়ের বাড়িতে যাইনি, এমনকি তার দিকে তাকিয়েও দেখিনি।

 

মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না জেনে অবাক হলেন? আরো অবাক হবেন যখন শুনবেন, তার নাম আদৌ পথিক কি না, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। আমরা তো নই-ই, এমনকি আমাদের সিনিয়ররাও নিশ্চিত নন, যাদের কাছে গল্প শুনেই তাকে দেখার আগেই চিনেছিলাম আমরা। তিনি কোথায় থাকেন, কী করেন, বাড়ি কোথায়, আত্মীয়স্বজনরা কোথায় এসবের কিছুই জানি না; এমনকি তার বয়স সম্বন্ধেও কোনো আন্দাজ করতে পারি না। একটু কুঁজো হয়ে হাঁটেন তিনি, মানে সামনের দিকে সামান্য একটু ঝুঁকে, দেখে মনে হয় কাঁধের ওপর একটা ভারী বস্তু বয়ে চলেছেন। সাধারণত বয়স্ক মানুষরা এরকম কুঁজো হয়ে হাঁটেন, তদুপরি তার কাঁচাপাকা লম্বা চুল-দাড়ি-গোফ দেখে মনে হয়, পঞ্চাশোর্ধ্ব তো হবেনই; ষাট বা সত্তরও হতে পারে তার বয়স। ভাবছেন, এত অজানা নিয়ে কীভাবে তাকে চিনলাম? কারণ, আমরা হচ্ছি এ দেশের তরুণ লেখক সম্প্রদায়ের সদস্য, আমাদের অনেক কিছু জানতে হয় ভাই।

পথিক ভাই নিজে লেখক না হলেও লেখক-সমাজে খুবই পরিচিত এবং আকর্ষণীয় মানুষ। তার কারণও আছে। তাকে প্রায়ই চারুকলা বা ছবির হাট বা আজিজ মার্কেট বা কনকর্ড মার্কেটের আড্ডায় পাওয়া যায়। খুব যে কথা বলেন তা নয়, শোনেন বেশি আর মাঝেমধ্যে এমনসব মন্তব্য করেন যে মনে হয়, শিল্পসাহিত্যের ব্যাপারটা তিনি সকলের চেয়ে বোঝেনও বেশি। শুনেছি, তার সুনির্দিষ্ট পেশা নাই। তবে বাংলাবাজারের প্রকাশকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে, সবাই তাকে খুবই সুনজরে দেখেন। কারণ নামমাত্র সম্মানির বিনিময়ে তিনি প্রুফ দেখে দেন, এমনকি সম্পাদনায়ও তার হাত খুব ভালো এবং সেটিও করেন অল্প টাকার বিনিময়ে। প্রয়োজন মিটে গেলে বাড়তি আয়ের চেষ্টা করেন না, এখানে-ওখানে ঘুরেফিরে বেড়ান। পুরান ঢাকার কোনো এক অন্ধ গলিতে একটা জরাজীর্ণ বাসার একটা রুম ভাড়া করে থাকেন বলে শোনা যায়, কিন্তু সেটা যে কোন এলাকায় তাও আমরা জানি না। সম্ভবত কেউই জানে না। নিজের সম্বন্ধে কিছুই বলেন না তিনি, কিন্তু তার পড়াশোনার পরিধি যে ব্যাপক বিস্তৃত তা তার কথা শুনলেই বোঝা যায়। তরুণ লেখকদের যা স্বভাব— কিছু একটা লিখেই কাউকে পড়াতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কেউই পড়তে চায় না— আমরা তার হাতে আমাদের সদ্যপ্রসূত লেখাটা তুলে দিই। তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়েন, পকেট থেকে লাল কালির কলমটা বের করে প্রথমে বানান সংশোধন করেন, তারপর কিছু কিছু অংশ আন্ডারলাইন করেন, তারপর লেখাটা নিয়ে আলাপ করেন। আলাপের সময় এমন সব রেফারেন্স দেন যেগুলোর নামই আমরা কখনো শুনিনি। যিনি এত যত্ন নিয়ে আমাদের মতো অখ্যাত-অভাজনদের লেখা পড়েন, মূল্যবান মতামত দেন, তাকে ভালো না বেসে পারা যায়, বলেন?

আরেকটা বিষয় নিয়ে কথা না বললে তাকে বোঝাই যাবে না। যেহেতু তিনি চাকরিবাকরি করেন না, তরুণ লেখকদের বৈশিষ্ট্য-অনুযায়ী আমরাও মাঝেমধ্যে বেকার থাকি, ফলে দুপক্ষই ঘোরাঘুরির ব্যাপারে সময়ের অভাবে ভুগি না। টাকাপয়সা অবশ্য একটা সমস্যা, কিন্তু ভ্রমণ যদি বিলাসবহুল না হয় তাহলে ওটা কোনো-না-কোনোভাবে জোগাড় হয়েই যায়। তো, তার সঙ্গে কোথাও গেলে, ঢাকায় বা ঢাকার বাইরে, একটা ব্যাপার খুব চোখে পড়ে। মানুষকে তো বটেই, জগতের সকল জীবজন্তু, পশুপাখি, এমনকি কীটপতঙ্গকেও ভালোবাসেন তিনি। ধরা যাক, আমরা কোনো এক দূর মফস্বলের গরিব-দুঃখী নামহীন টং দোকানে বসে চা খাচ্ছি কিন্তু মশার যন্ত্রণায় বাঁচা যাচ্ছে না। অবিরাম হাত পা নেড়ে মশা তাড়াতে তাড়াতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি, তখনও তিনি থাকেন নির্বিকার। আমরা যদি জিজ্ঞেস করি, বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছেন কেন, একটু হাতপা তো নাড়াতে পারেন! তিনি নির্বিকারভাবে বলবেন, কী দরকার! মশা আর কতটুকু রক্তই বা খাবে! ওদেরও তো খাদ্যের প্রয়োজন!

এহেন লোককে আপনি কী বোঝাবেন? যিনি অবলীলায় মশাকে রক্ত খাওয়ার অনুমোদন দেন তিনি যে চোর-ডাকাত বিবেচনা না করেই মানুষের বিপদে এগিয়ে যাবেন, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে? কিন্তু তিনি বোঝেন না, পোকামাকড় বা জীবজন্তু তার ক্ষতি করবে না যতক্ষণ না ওরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কিন্তু মানুষ বিনা কারণেই তার ক্ষতির কারণ হতে পারে। মানুষের তৈরি বিশ্বাসহীন পৃথিবীতে তিনি মানুষের ওপরই অগাধ বিশ্বাস নিয়ে বসবাস করেন। আশ্চর্য! জগৎ সম্বন্ধে তার এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণ আমরা বুঝি না, কিন্তু কিছু অদ্ভুত দৃশ্য দেখে মনে হয়— গোপন কোনো রহস্য তিনি লুকিয়ে রেখেছেন নিজের ভেতরে। উদাহরণ দিচ্ছি। একদিন ভরদুপুরে শহরের বিখ্যাত পার্কটিতে ঢুকেছি গাঁজার খোঁজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলেপেলে পার্কটাকে গাঁজা বেচাকেনা এবং সেবন করার জন্য স্বর্গোদ্যান বানিয়ে ফেলেছে, তা তো জানেনই। মাঝেমধ্যে ওরা ছিনতাইটিনতাই করে, কিন্তু আমরাও তো বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, তদুপরি লেখক, আমাদের সঙ্গে তাই বিশেষ ঝামেলা করে না। যাহোক, গিয়ে দেখি পথিক ভাই চিত হয়ে শুয়ে আছেন, চোখের ওপর রুমাল বিছানো, সম্ভবত দিনের আলো থেকে চোখ ঢাকার ব্যবস্থা, হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছেন। সেটা ব্যাপার না, দর্শনীয় ব্যাপার হলো— তার চারপাশে অন্তত গোটা দশেক কুকুর! কেউ শুয়ে, কেউ বসে, কেউ বা দাঁড়িয়ে। কিন্তু সবাই সতর্ক। যেন পাহারা দিচ্ছে। আমরা একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম তার দিকে, দু-তিনটা কুকুর এমনভাবে তেড়ে এলো যে ভয়ে আমরা দৌড় দিলাম। উনি ঘুমাচ্ছেন আর রাস্তার কুকুররা তাকে পাহারা দিচ্ছে, কেমন অবিশ্বাস্য লাগে না ব্যাপারটা? এরকম আরো অনেক অদ্ভুত ব্যাপার দেখেও এসব নিয়ে আমরা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। করলেও লাভ হতো না। অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তরেই তিনি মৃদু হাসেন এবং চুপ করে থাকেন।

যাহোক, গণপিটুনিতে এবং চলন্ত বাস থেকে পড়ে গিয়ে আহত হওয়ার খবর পেয়ে আমরা দেখতে যাই তাকে। তারপর টানা দু-সপ্তাহ তার চিকিৎসা এবং সেবা-শুশ্রƒষা করার পর একটু সেরে ওঠেন তিনি। আমরা জানতাম, অতি দয়ালু মানুষ বিপদে পড়বেনই। এ শহর দয়ালু মানুষদের জন্য নয়। একথা শুনেও তিনি হাসেন, কিছু বলেন না। কেন আপনি এরকম করেন, আপনি কেন আমাদের মতো না, এসব প্রশ্নেরও উত্তর মেলে না।

কয়েকদিন পর আরেকটু সুস্থ হয়ে উঠলে একদিন তিনি বলেন, তোমাদের একটা গল্প বলি শোনো।

বলেন। অনেকদিন আপনার গল্প শুনি না।

এই গল্প আমার নিজেরই। আমার ছোটবেলার।

আমরা সতর্ক হয়ে যাই, উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করি। তার ছোটবেলার গল্প! কত বছর আগের? চল্লিশ না পঞ্চাশ না তার বেশি? এই প্রথম তিনি নিজের গল্প বলতে যাচ্ছেন। কোনো কারণে যেন মন বদলে না ফেলেন, যেন আমাদের অনন্ত কৌত‚হল মেটার সম্ভাবনা বরবাদ না হয়ে যায়, সেজন্য সতর্ক হতেই হয়। কোনো প্রশ্ন নয়, কেবল গল্পটাই শুনি আমরা।

 


অসাধারণ কিছু নয়, তবু সেটি আমাদের কাছে বিশেষ হয়ে উঠেছিল। কারণ বাড়ির বাসিন্দারা রিফিউজি। ওই শব্দের মানে তখন জানতাম না, ভাবতাম, গ্রামে যেমন অনেকরকম বংশ-পদবীর লোকজন বাস করেন, রিফিউজি শব্দটাও সেরকম কিছু।

 

আমাদের গ্রামে একটা বিশেষ বাড়ি ছিল। অবশ্য দেখতে আর দশটা বাড়ির মতোই ছিল ওটা, গৃহস্থ পরিবারের যেমন থাকে আর কি! একটা বড় টিনের ঘর, ভেতরের দিকে; বাইরের দিকে আরেকটা। বাড়িঘেঁষে একটা পুকুর, পুকুরের ওপারে, পুবদিকে, বাঁশঝাড়, তারপর একটা ফলের বাগান। উত্তর দিকে পায়ে হাঁটার রাস্তা, বাজারের দিকে চলে গেছে; দক্ষিণদিকে ফসলের মাঠ। অসাধারণ কিছু নয়, তবু সেটি আমাদের কাছে বিশেষ হয়ে উঠেছিল। কারণ বাড়ির বাসিন্দারা রিফিউজি। ওই শব্দের মানে তখন জানতাম না, ভাবতাম, গ্রামে যেমন অনেকরকম বংশ-পদবীর লোকজন বাস করেন, রিফিউজি শব্দটাও সেরকম কিছু। ভুলটা ভাঙিয়েছিলেন বাবা। জানিয়েছিলেন, ওরা এদেশের মানুষ নয়, ভারত থেকে এসেছে, দেশ ত্যাগ করে, যেমন এ দেশ থেকে অনেকে গিয়েছে ভারতে। এই ধরনের লোকদের রিফিউজি বলা হয়। বাড়িটি ছিল গ্রামের অন্য সব বাড়ির চেয়ে পরিচ্ছন্ন এবং পরিপাটি, তাদের কথা বলার ধরণ ছিল আলাদা, রান্নার স্বাদও আলাদা।

রিফিউজি বাড়ির মকবুল ভাই ছিলেন আমাদের আপনজনের মতোই। তার বাবা-মা ছিলেন না, এদেশে আসার কয়েক বছর পর মারা গিয়েছিলেন দুজনেই, আমার বাবাকে তিনি ডাকতেন চাচাজান বলে আর মাকে ডাকতেন আম্মা বলে। সম্ভবত মাকে আম্মা বলে ডাকার জন্যই আমাদের বাড়িতে তার একটা আলাদা আদর ছিল। সব আয়োজন-অনুষ্ঠানেই তিনি নিমন্ত্রিত হতেন সপরিবারে। পরিবার মানে তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এবং এক বোন। সঙ্গে বাঘা। তার পোষা কুকুর, সে-ই পরিবারের সবচেয়ে আদরের এবং গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। নিমন্ত্রণ ছাড়াও আসতেন। কাজেও আসতেন, কাজ ছাড়াও আসতেন। আপনজন ছিল না বলে পারিবারিক যেকোনো বিষয়ে পরামর্শের জন্য বাবার কাছে ছুটে আসতেন। বাবা ছিলেন হাই স্কুলের হেডমাস্টার। তেমন বড় কিছু নয় নিশ্চয়ই, কিন্তু ওটা ছিল একেবারে গণ্ডগ্রাম, শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ছিল খুবই কম, হাইস্কুল ছিল ওই একটিই। বিদ্যুৎ তখনও পৌঁছেনি ওই অঞ্চলে, নিচু এলাকা বলে স্বাভাবিক বর্ষায়ও মাঠঘাট ডুবে যায়, অনেক বাড়িতেও পানি উঠে যায়। বন্যা হলে তো কথাই নেই— পুরো এলাকাই পানির নিচে। সেজন্যই ওই অঞ্চলের বাড়িগুলো একটু উঁচুতে। মানে ফসলি-জমির বা মাঠের সমতলে বাড়ি করার উপায় নাই, মাটি তুলে উঁচু করে ভিটা বাঁধতে হয়, তারপর বাড়ি। যার ভিটা যত উঁচু তার বাড়ি তত নিরাপদ, বর্ষায় বা বন্যায় তলিয়ে যাবার ভয় থাকবে না। কিন্তু অত উঁচু করে ভিটা বাঁধার সামর্থ্যও তো সবার থাকে না, ফলে ভোগান্তিতে পড়া মানুষই বেশি। গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে পায়ে হাঁটার রাস্তা, আলপথ ইত্যাদি। সেগুলোও বর্ষায় ডুবে যায়। তখন চলাচলের জন্য নৌকাই ভরসা। সব পরিবারের আবার নৌকাও নাই। তাদের অপেক্ষা করতে হয় প্রতিবেশী কারো নৌকার জন্য, যদি দয়া করে নিয়ে যায়! কিংবা এ-বাড়ি ও-বাড়ির ওপর দিয়েই চলাচল করতে হয় তাদের। স্কুলে বা থানা সদরে যাওয়ার জন্য উঁচু এবং বড় রাস্তা আছে বটে, কিন্তু সেটিও পাকা নয়। পাকা রাস্তা নেই বলে যান্ত্রিক গাড়িও চলে না, এমনকি রিকশা বা ভ্যানও না। এরকম অঞ্চলে হাই স্কুলের হেড মাস্টার যে সম্মানিত মানুষ হবেন তাতে আর সন্দেহ কী? রাশভারী মানুষ ছিলেন বাবা, হাসতে দেখা যেত না, খোশগল্প বা আড্ডায়ও পাওয়া যেত না তাকে। একটা সন্তসুলভ নির্লিপ্তি, নিরাসক্তি আর উদাসীনতা ছিল তার। কেউ ধারেপাশে চাপত না। একটা দুর্ভেদ্য দেয়াল তিনি তুলে রেখেছিলেন নিজের চারপাশে। যদিও তিনি রাগী মানুষ ছিলেন না, অন্তত আমরা কখনো রাগতে দেখিনি, তবু ওই অঞ্চলের মানুষ তাকে দারুণ ভয় পেত। অবশ্য ভয় না সমীহ তা এতদিন পর আর বলতে পারবো না; তবে দেখতাম, তিনি রাস্তা দিয়ে চলার সময় লোকজন একপাশে সরে দাঁড়াচ্ছে, সাইকেল চালাত যারা তারা বাবাকে দেখলে সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াচ্ছে, ইত্যাদি। মকবুল ভাই কিন্তু ভয় পেতেন না। সমীহ নিশ্চয়ই করতেন, যতবার আসতেন ততবার বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করতেন, তারপর নানা বিষয়ে গল্প করতেন। শান্ত মানুষ হলেও এবং কারো সঙ্গে বিরোধে না জড়ালেও মকবুল ভাই বাবার কথা ছাড়া গ্রামের আর কথাতেই বিশেষ কান দিতেন না। সেজন্য তাকে লোকজন ‘ঠ্যাটা মকবুল’ নাম দিয়েছিল।

আমরাও মকবুল ভাইয়ের বাড়িতে যেতাম। ঠিক বেড়াতে নয়, বাজারে যাওয়ার সময় তার বাড়ির ওপর দিয়ে গেলে শর্টকাট হতো। সেজন্যই যেতাম। উদ্দেশ্য বাজারে যাওয়াই কিন্তু যেহেতু ওই বাড়ির ওপর দিয়ে যাচ্ছি তাই একবার ভাবীকে ডেকে, দু-চার মিনিট গল্প করে, এক গ্লাস শরবত খেয়ে ফের রওনা দিতাম। তো, ও বাড়িতে পা রাখা মাত্রই বাঘা দৌড়ে আসতো, আমাকে চিনতো বলে লেজ নাড়িয়ে লাফঝাঁপ দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতো। কিন্তু আমি দুটো জিনিসকে যমের মতো ভয় পেতাম। সাপ আর কুকুর। সাপ তো সচরাচর চোখে পড়তো না, পড়লেও লোকজন ধাওয়া দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলতো, তা সে অন্যের ক্ষতি করুক আর না করুক। কিন্তু গ্রামে কুকুর তো অহরহই চোখে পড়বে। যদিও রিফিউজি বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়িতেই পোষা কুকুর ছিল না কিন্তু ওরা ছিল জনজীবনেরই অংশ। যেকোনো বাড়িতে যেকোনো সময় ঢুকে পড়তো ওরা— ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে বাড়ির গৃহকর্ত্রী এটা-সেটা খেতে দিতেন আর খারাপ হলে গৃহকর্তারা ধাওয়া দিতেন। গ্রামময় ঘুরে বেড়াতো কুকুরগুলো, খেলতো, মারামারি করতো, শেয়ালদের তাড়িয়ে নিয়ে যেত বহুদূর পর্যন্ত, এভাবেই ওরা বেঁচেবর্তে থাকতো। কিন্তু বাঘা তো রাস্তার কুকুর নয়, আদরযত্নে লালিতপালিত কুকুর। নিয়মিত খাবার পেত বলে তার স্বাস্থ্যটাও ছিল দারুণ সুন্দর। তো, বাঘা দৌড়ে এলে আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যেতাম, ওর ওসব লেজ নাড়ানো আর লম্ফঝম্ফ দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যেত, তখন মকবুল ভাইয়ের ছেলে কামরুল অথবা ভাবী এগিয়ে আসতেন। বাঘাকে ধমক দিয়ে দূরে সরিয়ে আমাকে ভেতরে নিয়ে যেতেন। কিন্তু অন্যদের ভাগ্য তো এত প্রসন্ন ছিল না, বাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, আশপাশ দিয়ে গেলেই বাঘার ঘেউঘেউ চিৎকারে সবাই বেসামাল হয়ে পড়তো। আর কেউ যদি ওর চিৎকারকে অগ্রাহ্য করে বাড়ির ওপর উঠেই পড়তো, তাহলে এমন এক হুংকার দিয়ে লাফ দিতো সে যে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার জোগাড় হতো।

বাঘার এহেন কর্মকাণ্ডে গ্রামের লোক বিরক্তই ছিল। মুরুব্বীরা বলতেন, ও মকবুল, তুমি কুত্তা পালো ক্যান? কুত্তা তো নাপাক। তুমি দেহি ওরে ধরো, নাওয়াও-খাওয়াও, তোমার শরীলের সাথে ও লেপ্টালেপ্টি করে, তোমার তো নামাজ অয় না।

মকবুল ভাই হাসতেন। খুব বেশি কথা তিনি এমনিতেও বলতেন না। বাঘাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে আরো চুপ করে যেতেন। তার ভাষাটিও ঠিক আামদের গ্রামের ভাষার মতো ছিল না। ওপার থেকে এসেছেন, তার কথায় অন্য রকম এক টান। আমরা তা আয়ত্ত করতে পারিনি কোনোদিন। কে জানে, হয়তো সেজন্যই চুপ করে থাকতেন। কিন্তু মুরব্বীরা তো থামার পাত্র না, তারা ঘ্যান ঘ্যান করেই চলতেন।

একদিন কেবল তাকে বলতে শুনেছিলাম, খোদার সৃষ্টি জীব। নাপাক হইবু ক্যান?

মুরুব্বীরা তাতে দমে তো যানইনি, উল্টো খেপে গিয়ে বলেছিলেন, আল্লায় তারে নাপাক কইরা বানাইছে, সেইজন্যি নাপাক।

তাই কি হয় চাচা? খোদা কাউরে নাপাক কইরা বানাইবেন ক্যান? তিনি কি কোনো সৃষ্টির উপর অবিচার করতে পারেন?

এত তর্ক করো ক্যান? দুনিয়ার সব মানুষ জানে কুত্তা নাপাক জীব আর তুমি একলা কইলে হইবো?

তর্ক না চাচা। বুঝার চেষ্টা করি। রাস্তার কুকুররা খাদ্য পায় না বইলে নাপাক জিনিসে মুখ দেয়। সেইজন্যি মানুষ তারে নাপাক বলে। আমাগোর বাঘা তো সেইরকম না। আপনেরা যদি গেরামের সব কুকুরগো খাইতে দেন, তাইলে আর নাপাক জিনিসে মুখও দিবু না, নাপাকও হইবু না।

তুমি বেশি বুঝো! মাস্টার সাবরে জিগায়া দেইখো।

এটা হলো মুরুব্বীদের বহ্মাস্ত্র। যখন তর্কে পারবেন না তখন মাস্টার সাবরে, মানে আমার বাবাকে, সাক্ষী মানবেন। তারা জানে ঠ্যাটা মকবুল আর কারো কথা না শুনলেও মাস্টার সাবের কথা শুনবেই। কিন্তু মকবুল ভাই তাদের কথায় গা করেন না। করবেনই বা কেন? তিনি যখন যান আমাদের বাড়িতে তখন বাঘাও তো যায়, সবসময় না হলেও মাঝে মাঝে। মকবুল ভাই বাবার পা ছুঁয়ে যখন সালাম করেন, বাঘাও তখন বাবার পায়ের কাছে বুক ঠেকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে থাকে কিছুক্ষণ। বাবা ওর গায়ে আর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন। নাপাক হলে কি আর উনি এভাবে আদর করতেন? মকবুল ভাই নিজের চোখে সেটা দেখেছেন বলেই ফের জিজ্ঞেস করার কথা ভাবেন না।

প্রতিবেশী এবং গ্রামের লোকদের কথাবার্তাকে আমলে না নিলেও মকবুল ভাই বাঘাকে নিয়ে একবার চিন্তায় পড়ে গেলেন এক বিশেষ কারণে। সেবার বর্ষাটা ছিল দীর্ঘস্থায়ী। আষাঢ়ের শুরুতের জোয়ারের পানি এসে মাঠঘাট ডুবিয়ে দিয়েছিল, শ্রাবণ-ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিনেও সেই পানি নামেনি। মেঠোপথ ডুবে যাওয়ায় লোকজনকে এ-বাড়ি ও-বাড়ির ওপর দিয়েই বাজারে যেতে হয়। গ্রামের মানুষ এতে অভ্যস্তও। ওখানে বাইরের লোক বলে কিছু নাই, গ্রামের মানুষ মানেই নিজেদের লোক, বাড়ির ওপর দিয়ে তারা যেতেই পারে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে মকবুল ভাইয়ের বাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়ার সময়। বাঘা তেড়ে আসে। আগেও আসতো, কিন্তু এবারকার আসাটা অন্যরকম। বাড়ির লোকজন ডাকলেও সে থামে না, চেঁচামেচি করতেই থাকে। লোকজন এমনিতেই বিরক্ত ছিল, এবার বিরক্তি একেবারে চরমে পৌঁছলো। পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠলো যখন বাঘা খেপে গিয়ে লোকজনকে কামড়ানো শুরু করলো। মকবুল ভাইয়ের চিন্তার কারণও সেটাই। বাঘা যতই চিৎকার চেঁচামেচি করুক, কখনোই কাউকে কামড়ায়নি। ওর হলোটা কী? কিছুদিন ওকে শেকলে বেঁধে রাখার চেষ্টা করলেন তিনি। তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হলো না। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো ও। এত তীব্র স্বরে অবিশ্রান্ত-অবিরাম ডাকতে লাগলো ও যে গ্রামের শেষ বাড়ি পর্যন্ত সেই ডাক পৌঁছে যেতে লাগলো। তাতেও যখন শেকল খুললো না তখন করুণ অথচ উঁচু গলায় কাঁদতে শুরু করলো। কুকুরের কান্না তো ভয়ানক। অমঙ্গলের চিহ্ন আছে ওতে। লোকজনের বিশ্বাস— কুকুর কাঁদলে দেশে হয় যুদ্ধ লাগে, নইলে দুর্ভিক্ষ হয়, নিদেনপক্ষে মহামারী আসে। লোকজনের বুক দুরুদুরু করে ওর কান্না শুনে। মকবুল ভাই উপায়ন্তর না দেখে একদিন শেকল খুলে দিলেন। কিন্তু ও যাবে কোথায়? চারদিকে থৈ থৈ পানি! বাড়ির এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে সে অবিশ্রান্ত ঘেউ ঘেউ করে চললো। কেউ কেউ কামড়ও খেলো ও বাড়ির কাছ দিয়ে যাওয়ার সময়। একদিন আমাকেও ধাওয়া করেছিল ও, কামরুল এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে বাঁচানোর আগেই কামড় বসিয়েছিল আমার হাতে।

 


আমাদের মনে হলো, এই সেই ক্রুশ, যীশু যা বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন বধ্যভূমি পর্যন্ত, এটা বোঝাতে যে, সব মানুষকেই ক্রুশ বহন করতে হবে। একেক মানুষের জন্য একেকরকম ক্রুশ।

 

এই সমস্যার সমাধান কারো জানা ছিল না। লোকজন বাবার কাছে এসে অভিযোগ জানাতে লাগলো। কিন্তু বাবাই বা কী করবেন? তিনি তো পশুডাক্তার নন। সমস্যাটা দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠতে লাগলো। কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্ক রোগ হয়, বাবা জানতেন। রোগটা ভালো নয়। ভয়ংকর কষ্ট পায় রোগী। সেজন্য কুকুরে কামড়ালে নাভির চারপাশে একমাস ধরে চৌদ্দটা ইনজেকশন নিতে হয় নিয়ম মেনে, বাবা তাও জানতেন। কারণ আমাকে কামড়ানোর পর এই ভয়াবহ কষ্টকর চিকিৎসাটা আমাকে গ্রহণ করতে হয়েছিল। ওই এলাকায় কোনো সরকারি হাসপাতাল ছিল না, সেজন্য ইনজেকশন নেয়ার জন্য আমাকে যেতে হতো পনের মাইল দূরে জেলা সদরে। বাবাই নিয়ে যেতেন। কিন্তু সবার তো সেই সামর্থ্যও নাই। দু-একজন হাতুড়ে ডাক্তার এ এলাকায় থাকলেও তারা কুকুরের কামড়ের চিকিৎসা জানে না। আবার বাঘার চিকিৎসারও কোনো উপায় নাই। দশ গ্রামে কোনো পশুডাক্তার নাই, হাসপাতাল তো নাই-ই। চিকিৎসা করাতে চাইলে যেতে হবে ওই জেলা সদরেই। এদিকে কামড় খাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

এরকম এক সময় মকবুল ভাই এলেন বাবার কাছে। বাঘাকে নিয়েই। তবে আনার পদ্ধতিটা অদ্ভুত। তিনি এসেছেন নৌকা নিয়ে, বাঘাকে শেকল দিয়ে বেঁধেছেন গলুইয়ের সঙ্গে, তবে ও নৌকার ওপরে নয়, ভেসে আছে পানিতে, কোনোরকম মুখ উঁচু করে। শেকলটা এমনভাবে বাঁধা যে ও কোনোভাবেই নৌকার ওপরে উঠতে পারছে না।

মকবুল ভাই বাবার কাছে এসে ভেঙে পড়লেন— চাচাজান, বাঘা তো পাগল হইয়ে গিছে। সামনে যারে পায় তারেই কামড়ায়। ওরে নিয়ে আমি কী করবু?

বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, সদরে নিয়ে যাও মকবুল, চিকিৎসা করাও।

কিন্তু সদরে নিবু কেমনে? এত দূর!

কষ্টসৃষ্ট করে নিয়ে যাও।

বর্ষার দিন না হইলে চেষ্টা করতাম। বাড়ি থেইকে এইখানে আনতেই আমার জান বাইরেয়ে গেছে, অতদূর নিবু কেমনে?

বাবা দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, গ্রামের মানুষ তোমার ওপর খেপে উঠেছে মকবুল। যদি চিকিৎসা না করাও তাহলে ওকে মেরে ফেলো।

মকবুল ভাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন বাবার দিকে। অবাক গলায় বললেন, মেরে ফেলবু? আমার বাঘারে আমি মেরে ফেলবু?

বাবা আর কিছু না বলে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। মকবুল ভাই কিছুক্ষণ স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর যে কী হলো, ভীষণ ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে ফিরে গেলেন নৌকায় এবং বৈঠা দিয়ে বাঘাকে অবিরাম আঘাত করতে লাগলেন। বাঘা একেকটা মার খায় আর কুঁইকুঁই করে ওঠে। কে একজন তখন বললো, ‘মাথায় মারেন, মাথায়। নইলে মরবো না।’ মকবুল ভাই পাগলের মতো ওকে মারতেই লাগলেন। বাঘা প্রাণপন চেষ্টা করছে নৌকার ওপরে উঠতে, তার চোখে কাতর মিনতি, তখন কে একজন লাঠি নিয়ে যোগ দিলো মকবুল ভাইয়ের সঙ্গে। দুজনের সম্মিলিত মার খেতে খেতে বাঘা নেতিয়ে পড়লো। খুব ক্ষীণ কন্ঠে কুঁইকুঁই ধ্বনি তখনো ভেসে আসছে তার কণ্ঠ থেকে। চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে। মুখখানি করুণ, বেদনায় বিবর্ণ। হতবিহ্বল হয়ে ঘটনাটা দেখছিলাম আমি, আমাকে কামড়েছে বলে এবং নাভির চারপাশে চৌদ্দটা ইনজেকশন নিতে হয়েছে বলে আমারও ওর ওপর রাগ ছিল। একদিন ইনজেকশনের ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বাবাকে বলেছিলাম, বাঘাটা মরে না কেন? মরুক মরুক মরুক। কিন্তু ওকে যে এভাবে মরতে হবে, তা তো চাইনি! মনে হলো, আমার জন্যই বাঘাকে এভাবে মরতে হচ্ছে, আমাকে না কামড়ালে বাবা নিশ্চয়ই ওকে মেরে ফেলতে বলতেন না! আমার যেন কী হলো হঠাৎ। এক দৌড়ে উঠে পড়লাম নৌকায়। ছোট্ট শরীর আমার, তবু ঝাঁপ দিয়ে মকবুল ভাইয়ের হাতের বৈঠা ধরে ফেললাম, চিৎকার করে বললাম— আর যদি একবার মারেন, আপনাকে খুন করে ফেলবো।

মকবুল ভাই থামলেন, অন্য লোকটাও ভয় পেয়ে সরে গেল। আমি অনেক কষ্টে শেকল খুলে বাঘাকে টেনে তুললাম। ও যে ভারী, আমার মতো ছোট্ট মানুষ কি ওকে টেনে তুলতে পারে? তবু তুললাম। কিন্তু বাঘা তখন আর বাঘা নেই। ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলাম, ও আমার কোলে মাথা এলিয়ে দিলো, রক্তে ভিজে যেতে লাগলো আমার জামাকাপড়। করুণ চোখ তুলে ও আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো জল, একবার খুব কষ্ট করে জিহ্বা বের করে আমার হাত চেটে দিলো, তারপর শরীর ছেড়ে দিলো।

আমি বাঘাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সেই যে বেরোলাম, আর কোনোদিন ফিরিনি।

ফেরেননি মানে? বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন? আর ফেরেননি? — আমরা জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।

না, বাড়িতেই ছিলাম। কিন্তু ওটাকে থাকা বলে না। যতদিন ছিলাম, বাবার সঙ্গে কখনো কথা বলিনি, কোনোদিন আর মকবুল ভাইয়ের বাড়িতে যাইনি, এমনকি তার দিকে তাকিয়েও দেখিনি। কীভাবে তাকাবো বলো, আমার কাঁধে যে বাঘার লাশ! কয়েক বছর পর, যখন কলেজে উঠলাম, সত্যি সত্যি বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম। সারাজীবনের জন্য। বাড়ি ছাড়লাম, গ্রাম ছাড়লাম, কিন্তু বাঘাকে কাঁধ থেকে নামাতে পারলাম না। সারাজীবন আমি ওকে কাঁধে করে বয়ে বেড়িয়েছি। বইতে বইতে আমার কাঁধটা কুঁজো হয়ে গেছে— সোজা হয়ে হাঁটতে পারি না। ওকে যে নামিয়ে দেবো, রাখবো কোথায় বলো?

পথিক ভাই থামলেন। তার মুখমণ্ডল বিবর্ণ, চোখ ভেজা।

আমাদের মনে হলো, এই সেই ক্রুশ, যীশু যা বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন বধ্যভূমি পর্যন্ত, এটা বোঝাতে যে, সব মানুষকেই ক্রুশ বহন করতে হবে। একেক মানুষের জন্য একেকরকম ক্রুশ। কারোটা পাহাড়ের মতো ভারী, বইতে গিয়ে কাঁধ নুইয়ে যায়, কারো কারোটা একটু কম ভারী, দৃশ্যমান না হলেও মনে মনে বয়ে চলতে হয়।

তারপরের গল্প খুব দীর্ঘ নয়। পথিক ভাই সেবার আর হাসপাতাল থেকে ফেরেননি। সম্ভবত জীবন ও পৃথিবীর সঙ্গে লেনদেন চুকে গিয়েছিল তার। ওই যে গণপিটুনি খাওয়া, ওটা যেন বাঘার মার খাওয়ারই প্রায়শ্চিত্ত ছিল। হয়তো শেষ পর্যন্ত বাঘাকে তিনি কাঁধ থেকে নামাতে পেরেছিলেন, কিংবা গণপিটুনি খাওয়ার পর বাঘা নিজেই তার কাঁধ থেকে নেমে পড়েছিল।

মারা যাওয়ার পর আমরাই তার মরদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করলাম। কী করবো বলুন, গল্প শোনার সময় যে জিজ্ঞেসই করা হয়নি— কোথায় তার ফেলে আসা গ্রাম, সেখানে বা অন্য কোথাও তার আপনজন কেউ আছে কি না! দায়িত্বটা তাই আমাদেরই। তাতে আমাদের আপত্তি নাই। এই শহরে থাকি, কত কত অপমৃত্যু দেখতে হয়, কত মানুষের সৎকারে যেতে হয়, সেই তুলনায় পথিক ভাই তো আপনজনই ছিলেন। কিন্তু কাজটা করতে গিয়ে অদ্ভুত একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। তার লাশ নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরোতেই দেখলাম, তিন-চারটা কুকুর আমাদের পিছু নিয়েছে। আমরা তার গোসলের ব্যবস্থা করলাম, কাফন পরালাম, জানাজার ব্যবস্থা করলাম, এবং অদ্ভুতভাবে কুকুরের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। জানাজা শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যখন গোরস্তানের দিকে রওনা দেবো ততক্ষণে কুকরের সংখ্যা একশো ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের কৌত‚হল হলো। এত কুকুর আসছে কোত্থেকে? কী চায় ওরা? একটু খোলা জায়গা দেখে কফিনটা নামালাম আমরা, দাঁড়ালাম একটু দূরে গিয়ে, ব্যাপারটা বোঝার জন্য। যা দেখলাম, তা অবিশ্বাস্য। দলে দলে কুকুর এসে কফিনের চারপাশে জড়ো হতে লাগলো। শত শত কুকুর, হাজার হাজার কুকুর। নীরব, নিঃশব্দ তারা। একদল কফিনের কাছে যাচ্ছে, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকছে, তারা চলে এলে আরো একদল এগিয়ে গিয়ে একই কাজ করছে। কেউ কুঁইকুঁই করে কাঁদছে, কারো চোখ বেয়ে ঝরছে জল, কেউ বা কফিনে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে তো আছেই। যেন তাদের এক পরম আপনজন এই মায়ার পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে আজ। যেন এক শোকসভায় মিলিত হয়েছে তারা। অপূর্ব, অভ‚তপূর্ব এক শোকসভা।


আহমাদ মোস্তফা কামাল

(১৪ ডিসেম্বর ১৯৬৯) বাংলাদেশের একজন সাহিত্যিক ও শিক্ষক। সৃজনশীল সাহিত্য গ্রন্থের জন্য তিনি ২০০৭ সালে (বঙ্গাব্দ ১৪১৩ সালে) প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার, ২০০৯ সালে কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার, ২০১২ সালে জেমকন সাহিত্য পুরস্কার, ২০১৮ সালে সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০২১ সালে পূর্বপশ্চিম সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন।

প্রকাশিত গ্রন্থ

গল্পগ্রন্থ

  • দ্বিতীয় মানুষ । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮। প্রকাশক : দিব্যপ্রকাশ।
  • আমরা একটি গল্পের জন্য অপেক্ষা করছি । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০০১, প্রকাশক : সন্দেশ।
  • অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০০৪, প্রকাশক : কাগজ প্রকাশন।
  • ঘরভরতি মানুষ অথবা নৈঃশব্দ্য । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০০৭, প্রকাশক : সন্দেশ।
  • ভোর অথবা সন্ধ্যারা নামছে বেদনায় । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০০৭।  প্রকাশক : ঐতিহ্য।
  • অশ্রু ও রক্তপাতের গল্প । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১০।  প্রকাশক : শুদ্ধস্বর।
  • একলা থাকার গল্প । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১৩।  প্রকাশক : নান্দনিক।
  • প্রেম-অপ্রেমের গল্প । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১৪।  প্রকাশক :সন্দেশ।
  • কোথাও এখনো মায়া রহিয়া গেল ।  প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১৬।  প্রকাশক : গদ্যপদ্য।
  • দ্বিধা, ভয় ও উদাসীনতার গল্প । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১৮।  প্রকাশক : সন্দেশ।
  • নির্বাচিত গল্প । প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর : ২০১৯।  প্রকাশক : বাতিঘর।
  • বড়োদের গল্প যেমন হয় । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০২০।  প্রকাশক : নাগরী।
  • গল্পসংগ্রহ (দুই খণ্ড), প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০২২।  প্রকাশক : পাঠক সমাবেশ।

উপন্যাস

  • আগন্তুক ।  প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০০২; প্রকাশক : সন্দেশ।
  • অন্ধ জাদুকর । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০০৯; প্রকাশক : সন্দেশ।
  • কান্নাপর্ব । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১২। প্রকাশক : সন্দেশ।
  • পরম্পরা । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১২। প্রকাশক : সন্দেশ।
  • অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। প্রকাশক : সন্দেশ।
  • বর্ষামঞ্জরি ।  প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। প্রকাশক : চন্দ্রবিন্দু।
  • সবচেয়ে করুণ সুন্দর । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। প্রকাশক : বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ।
  • প্রেম অথবা দহনের গল্প (নভলেট)। প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। প্রকাশক : গ্রন্থ কুটির।
  • নিরুদ্দেশ যাত্রা । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১৮। প্রকাশক : প্রথমা।

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-দর্শন বিষয়ক সৃজনশীল প্রবন্ধ সংকলন

  • সংশয়ীদের ঈশ্বর । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০০৬। প্রকাশক : অ্যাডর্ন।
  • শিল্পের শক্তি, শিল্পীর দায় । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১০। প্রকাশক : অ্যাডর্ন।
  • রবীন্দ্রনাথ : ছোটগল্পে ছোটরা । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১২। প্রকাশক : মূর্ধণ্য।
  • বাংলা গল্পের উত্তরাধিকার । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। প্রকাশক : রোদেলা।
  • কতিপয় যতিচিহ্ন। প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০২২।  প্রকাশক : পাঠক সমাবেশ।

মুক্তগদ্য

  • একদিন সব কিছু গল্প হয়ে যায় । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১৫। প্রকাশক : সন্দেশ।
  • যেভাবে কবিতা পড়ি । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১৮। প্রকাশক : গ্রন্থ কুটির।
  • যে পথে হেঁটে এসেছি । প্রথম প্রকাশ: মার্চ, ২০২১ । প্রকাশক: নাগরী।

সাক্ষাৎকার গ্রন্থ

  • তাঁহাদের সঙ্গে কথোপকথন । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। প্রকাশক : রোদেলা।

বিজ্ঞান-প্রবন্ধ

আমাদের মহাজাগতিক পরিচয়। প্রথম প্রকাশ : মে, ২০১৯। প্রকাশক : প্রথমা।

ভ্রমণ গদ্য

পাখির চোখে দেখা । প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০২০। প্রকাশক : সন্দেশ।

সম্পাদিত গ্রন্থ

  • বাঙালির সংস্কৃতিচিন্তা, প্রথম খণ্ড। প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
  • বাঙালির সংস্কৃতিচিন্তা, দ্বিতীয় খণ্ড। প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
  • বাঙালির সংস্কৃতিচিন্তা, তৃতীয় খণ্ড। প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
  • বাঙালির সংস্কৃতিচিন্তা, চতুর্খ খণ্ড। প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
  • বাংলাদেশের ছোটগল্প, প্রথম খণ্ড। প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
  • বাংলাদেশের ছোটগল্প, দ্বিতীয় খণ্ড। প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
  • বাংসাহিত্যের সেরা গল্প। কিশোরতোষ গল্প সংকলন। প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
  • শ্রেষ্ঠ গল্প : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
  • শ্রেষ্ঠ গল্প : আবু ইসহাক। প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
  • শ্রেষ্ঠ গল্প : সৈয়দ শামসুল হক। প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
  • শ্রেষ্ঠ গল্প : হাসান আজিজুল হক। প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
  • শ্রেষ্ঠ গল্প : রাহাত খান। প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
  • শ্রেষ্ঠ গল্প : আবদুল মান্নান সৈয়দ। প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
  • রৌদ্র ছায়ার খেলা। কিশোরতোষ রবীন্দ্র-গল্প। প্রকাশক : শুদ্ধস্বর।
  • হিরন্ময় কথকতা, মাহমুদুল হকের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার। প্রকাশক : পেন্ডুলাম।

পুরস্কার ও সম্মাননা

  • কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার, (২০০৯)
  • প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার, (২০০৭)
  • জেমকন সাহিত্য পুরস্কার, (২০১৩)
  • সিটি – আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার, (২০১৮)
  • পূর্বপশ্চিম সাহিত্য পুরস্কার, (২০২১)
শেয়ার