দশটি কবিতা | সানজিদা আমীর ইনিসী

খোয়াবনামা

মন জঙ্গলের পথে
সহজে গুঁড়ায়ে যাইতেছি 
অনাবাদী বাতাসের সাথে

তারপর
কত-পর
আমাদের ছোট ডিঙি
তার বিস্তৃত জীবন 
চলতেছে 
আমাদের বাঁকে বাঁকে
ছোট জীবন— আরও জড়ায়ে
আরও-আরও জড়ায়ে একা হইয়া থাকলে
বহু বীথি সে পার হইয়া যাবে
আমরা 
শুধু আমরা থাকব
নিরন্তর মাছেদের সাথে
ডাঙায় উজায়ে ঘাসেদের সাথে
মাছের আঁশটে গন্ধ মুখে নিয়া শরীর বাইয়া বাইয়া ক্লিভেজে জমা থাকবা তুমি
আর 
কিছু তুমি গড়ায়ে নাভি উপকূলে 
স্নানেরও আগে 
আরও একবার
সকালে উইঠা এক উদ্দাম ঘাড় 
সৌষ্ঠবহীন আঁচল সরায়ে পাহাড়ের মত ঢেউঢেউ কম্প্র— 
তোমার জন্য লাগাতার সমান্তরাল 
হইতে থাকলে—
বুকে আইসা 
যেন দরিয়া
তার কলকল শব্দের মধ্যে 
মাথা রাইখা ঘুমায়ে পইড়ো তুমি
এইসব শান্তির ঘুমের
খেইহারা দিনে
উত্তাল উপকূল থেকে 
ডিঙি কি চইলা যাবে সাদা বকের গ্রামে?

 

 

তোমার আর্তির দিনগুলিতে

তোমার আর্তির দিনগুলিতে—
এক নারী ঝলমল কইরা নাইমা যাইতেছে
এক নারী হাত রাখতেছে তোমার হাতে
আরেক নারী
তুমি তারে পারো না এড়াতে

নিঃশেষে প্রাণ চইলা যাওয়ার মুহূর্তে—
তোমার একলা নারী প্রকৃতির সকল পৃষ্ঠার বিস্তারও নিঃসঙ্গ তোমার মত
সব স্টেশনে-স্টেশনে 
পারিবারিক ছোটাছুটি কেবল
সিলভিয়া প্লাথ আগুন জ্বালায়ে 
বইসা আছে শিয়রে
আমরা-যে-যার মত
গভীর খাঁজে শুইয়া সিলভিয়ার হাতের আগুন দেখতেছি
আগুনের এক কোণে মৃত্যু
দুই কোণে অস্মিতা
ছুইটা আইসা ক্যান 
তোমার হাত কপালে
রাখতেছো না— সেই অভিমান

যে আগে আয়নায় তাকাইয়াছি আগুনের সাথে
মৃত্যু বইলা প্রাণপণ আকুতি জানাইছি সিলভিয়ার কাছে
অপরজন পরে শুধু ছুটিয়াছি—
ছুটিয়াছি পারিবারিক আবহকে প্রেমে উত্তাল কইরা
গিয়া 
দুইজনই 
দেখলাম 
আমরা নাই
এমনকি শুকনো শষ্পের মত যে শরীর লুটায়ে থাকে সবার চোখের ‘পরে—
তাও নাই
কবে নাকি নিষ্পত্তি হইয়া গেছে
তুমি
আমি
আর আমাদের সবটা।

 

 

বিশৃঙ্খল অর্কেস্ট্রা

“ওইপাশে ছিলাম রাস্তায়
মনে হইতেছিল এইদিকটা ফাঁকা
আমার দিকে সব গাড়ি
এখন যখন এইপাশে আসলাম
তখন মনে হইতেছে আসলে সব গাড়ি এইদিকেই..
জীবন এমন অদ্ভুত ভাই”

পাশের বাইকের ড্রাইভারের সাথে আমিও একমত হই
জ্যামে পইড়া যেমন ভাবতেছিলাম
দুনিয়ায় তোমার সাথে যারা পরিচিত তাদের সাথে তোমার ব্যবহারের কথা
জ্যাম না ছুটতেই সিদ্ধান্ত নিলাম, এইগুলি নিতান্ত কব্জার মধ্যে রাখার চার-ছয় ব্যাপার তোমার
যে চার-ছয় ব্যাপার হয়ত আমার সাথেও চলতেছে
কিন্তু আমি তারে পাশ কেটে এড়াই
আর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে থাকি
আজকে মিরপুরের ভাঙা রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট কইরা মরলে তুমিই দায়িত্ব নিয়া আমার মরদেহ আমার পিতার নিকট পৌঁছাইয়া দিবা
সাথে অনিবার্য কারণবশত সবাইরে তোমার থিকা দূরে থাকতে বইলা দুইদিন ভাতই খাবা না

আমার ভাবতে ভালো লাগে..

আমি তোমার দুইদিনের শোক সমাপ্ত কইরা
গন্তব্যস্থলে গিয়া পৌঁছাই
ব্যাগ থিকা টাকা বাইর করতে থাকলে
ড্রাইভার হেলমেট খুলতে খুলতে কন, “আপা, ভালো গল্প আছে? নাটক বানাইতাম”

আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না কইরা সে খুব আস্তে আস্তে গান গাইতে থাকে

আমি কোনো উত্তর না দিয়া মনেমনে জ্যামে থাকা পাশের ড্রাইভারের সাথে হ্যান্ডশেক করি, মাথা ঝাকাইয়া বলতে থাকি, “জীবন আসলেই অদ্ভুত ভাই”

 

 

ডুবছি ঝিলাম নদী

বিবাহ করিতে পারতাম
ব্যাগ কাঁধে আপিসে ছোটা লম্বা দেখতে লোকটারে 
যাইতাম বৈদেশ
দেখতাম স্বপ্ন
আমি আমাদের সন্তানের মা হইতেছি
বৈদেশের হাসপাতালে
পরম যত্নে 
কিনিয়া দিয়াছো শাড়ি আর সীতাহার
যেহেতু আমরা দেশে ফিরব।

আমি ফিরতে চাই আরও ওপরে
বা ভূতলে যাইতে চাই।
যাইতে চাই,
যাইতে হইলে সমন্ধ আসা সেই চাকরীওয়ালার বউ হইতে হইবে না
ওইযে সে
কবিতা লেখে
আর রাস্তায় হাঁটে দিকভ্রান্তের মত
আমি ওরে ভালোবাইসা যাব
ঘর থেকে অল্প দূরে
মানুষ কিছু কম
ব্রিজ হইছে নতুন
নদীর বুকের ওপর ভার হইয়া আছে সে
লম্বা সাইডওয়াক দুইপাশে
হাঁটতেছি
আমি ঠিকমত পা ফেলতে পারি না
দুঃখে বা ঘুমে।

নদীর শরীর আমারে জানে না 
জানবে
এইত কিছুক্ষণ
তার আগে দীর্ঘ পথ
কে জানি বলছিল আমারে 
“মাথায় নদী নিয়া কেউ নদীতে ডোবে না”
আমার মাথার চুলরে তার নদী মনে হইত 
ঝিলাম নদী

আমি মরতে চাইছিলাম একটা দীর্ঘ বারান্দায়;
সাদা শাড়ির লাল পাড় জড়াইয়া 
কপালে লাল টিপ
আর ইউকুলেলে শুনতে শুনতে

মৃত্যু কত সহজ 
তবে বাঁচতে কেন কঠিন লাগে?
যে কবিতা লেখে আমার জন্য
তার জন্য বাঁচাও কেন কঠিন?

ঈশ্বর
তুমি এক এবং অদ্বিতীয় বইলা আমি বিশ্বাস আনলাম মৃত্যুর আগে
আমি জলস্পর্শ পাওয়ার আগে 
ভাইসা থাকার এই মুহূর্তে
তুমি নির্বিষ করো 
পৃথিবী
প্রেমের জন্য পৃথিবী মৃত্যুকূপ।

বিতিকিচ্ছি প্রেমহীনতা ছাড়ছি 
আমি ডুবলাম
সূর্য মলিন
মাঝিরা নাই
আমি ডুবছি।

 

 

সম্মোহিত ঘুম
(জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’ কবিতা অবলম্বনে)

টানেলের মুখ সরায়ে 
তোমারে নিয়া আসা আমার সাইকেডেলিক ক্ষমতা
তিরতির কইরা রাত্তির 
একান্ত রাত হইয়া উঠলে তারে কী বলো তুমি—
ওপিয়াম, মারিজুয়ানা 
না কোকেইন?
টানেলের গা বাইয়া তোমার শরীরের গন্ধ যখন 
অভ্রংলিহ ব্যবচ্ছেদের আভাস দেয়—
রাতের পর চারিদিকে জ্ঞান ফেরা আলো
আর তারপর
তোমার সতর্কভাবে পা ফেইলা প্যাঁচানো দুনিয়ায় 
নাইমা যাওয়া—
যেন ব্রেইল

আমি অন্ধকারে 
তোমার পা-ফেলা পইড়া ফেলি

সকল মানুষ একলা একটা
পৃথিবী হবার পর 
পৃথিবীর জন্য কোনো ভর্ৎসনা থাকে না

ঘৃণা নাই
দোষ নাই
কারও কোনো ভুল নাই
—এমন প্রেমরে আলিঙ্গন কইরা দেখিয়াছি
এমন মানুষরে আত্মস্থ কইরা দেখিয়াছি
এমন প্রেম অন্তঃস্থ করিয়া ভুলিয়াছি
তার থিকা প্রেম পাইয়া দেখিয়াছি
তার নিকট দূর পথ ছুঁইয়াছি
কাল বদল হইলে সে মুখ ফিরাইয়াছে
দূরবর্তী মানুষ হইয়া দূরে সরিয়াছে

এই পৃথিবী 
বন্দুক হাতে শিকার খোঁজার
আর তারপর
শিকার পাইয়া গেলে বন্দুক রাইখা 
শিকার পোষার

আমার সব বোধ আজ তাই
কোনো মানুষ না—
পৃথিবীর পথে ধাবিত হইয়াছে
উর্ধ্বপানে তাকায়ে আমি মানুষ দেখি না
তোমারে দেখি না
আমার পা’র নিচ গইলা বের হওয়া শিকড় 
শান্তি চায় না
শাস্তি চায় না
মানুষের মুখ দেখতে চায় না
বিহ্বল একদিন সেই আমি
তোমার প্রাণের কাছে ফিইরা আসি

আমি নিলীন হইয়াছি তোমার কাছে

তুমি একটা পৃথিবী
অতএব আমি শেষ হইয়া গেছি পৃথিবীর কাছে
হারের স্বাদ তোমার শরীরের মত
হারের স্বাদ তোমার দেহের মত—
পচনশীল
আর তারচেয়েও বেশি নাশশীল আমার দেহ

আমি শান্তি চাই না
আমি শাস্তি চাই না
আমি ল্যাকটিয়্যেল মেঘ দেইখা
মেঘের গন্ধ নিতে চাই না
মেঘের শব্দ শুনতে চাই না
মেঘের আক্রোশে হাত হাতে রাইখা 
মিইশা যাইতে চাই না

এই বিবমিষা—
মানুষ হইয়া রাতের নক্ষত্রের আলোয় ভস্মীভূত হওয়া 
মানুষ হইয়া নিরংশু ছায়ার থিকা দূরে সইরা যাওয়া
মানুষ হইয়া মেছো পাড়ার মাছেদের সাথে কথা কওয়া
ফুঁসে ওঠা জল 
স্থবির 
হইয়া 
যাওয়া—
হঠাৎ চোখ বুইজা আসা বিস্তর এক সম্মোহিত ঘুম।

 

 

উষ্মা

বহুদিন
বহুবছর পর
একবেলা স্নান বাদ গেল 
বেলা-বেলা পট্টির তৎপর জল কপাল থেকে গড়ায়ে যাইতেছে কান-কান থেকে ঘাড়-ঘাড় থেকে চিবুকের দেশে
টুপটাপ ঘোর ছোঁয়াচের জল পায় না আস্তিন, জেগে থাকা ক্লিটোরিস
শরীরের প্রতি তার মায়া নাই আর
বিনিদ্র দুপুরে সে আত্মাকে নিয়া গহ্বরেষ্ঠে চলতেছে
এত ক্লেশ জন্মান্তরের—
আর কিছুদিন আমাকে ফিরাও 
আর কিছুদিন প্রবাহমান সিসিলির সিকোয়েন্স দেখতে দাও
দীর্ঘমেয়াদি জ্বরে পরাবাস্তবতার তরে 
যা কিছু ভীষণ ঠোঁট চেপে গেছি বলে—
সংসর্গ ত্যাগে আমি তা পাইয়াছি সব
রোদাক্রান্ত পাহাড়েও মর্মর ধ্বনি যায় না শোনা
আগামী কিছুদিনের সোনালি জ্বলজ্বলে ভাব 
বিগত তিনদিনের বৃষ্টিতে ম্রিয়মাণ হইয়া গেছে
একবুক শালবন 
রোঁয়া পড়া সময় আঁকাবাঁকা হইয়া উঠতেছে—
এক শুষে নেওয়া লাইন ধইরা
এক প্রতিসাম্য চক্রকেন্দ্রে
এই শরীরের কোথায় আজ অন্তিম সন্ধ্যায় তুমি ভিটা খুঁইজা নিবা?
স্বেদ কপালে
না এই জন্মের সব প্রভাময়-অপ্রমেয় প্রেম জমায়ে রাখা স্তনে?

 

 

মেলানকোলি

তীব্র জ্বর থিকা আরোগ্য হইতেছি
এখন উইঠা বসি প্রায় বিকালে
নাইমা যাই বড় রাস্তার ঢালু বাইয়া
নিচেই থাকা একহারা রাস্তায়
আরও ক্লান্ত পদাতিকেরা ছায়াসমেত বইসা থাকে 
অন্ধ আঙুলেরা গান গায়—
পৃথিবী যে আমার জন্য কখনো রয় নাই স্থির
থামে নাই একবেলা
বা চোখ-চেয়ে দেখে নাই
এইসবে আমার কষ্ট হয়
হলুদ দ্যুতিময় হইয়া আমাদের আর ঘিরা থাকা ব্যথাদের ধইরা রাখে
সন্ধ্যার ঘন হইয়া আসা হলুদ
দোকানি জ্বাল দিয়া তুইলা রাখবে তাফালে
কালকেও এরা বুকে হুহু জাগাবে 
এইখানে এমন চলবে নিরন্তর।

 

 

তোমাকে আগন্তুক ধরে নিয়ে 

দেখা হলে দেখে যাব

ধরে নেব, হৃদয়গ্রাহী আগন্তুক ইনি
যে আমার শরীর খসে যাওয়া 
অ্যালগরিদম জানে

ধরে নেব—
কার্তিকের ভোরে পা ডুবাইনি আমি কোনো
হিম রক্তের পায়ে
যেন আমি ঘুমজেগে শ্মশানের নদীঘাটে একলাই; বড়জোর হাতে নিয়ে আগন্তুক এক সুবাস—
ছুটে গেছি বারেবারে

ধরে নেব
শেষতক
আমার অতীত—
জাহাজের ভেঁপু শুনে প্রেম থেকে সরে কিঞ্চিত সতর্ক হয়ে জেগে থাকা ভোর
আমার ভিড়ের রাস্তায়
মেটাফোর হয়ে আছে অবিরাম

 

 

ছবি

একাধারে জগতের সব ঘণ্টা বাজতে থাকলে তোমার নিজেরে চিত্রকর মনে হয় 
ঘন্টার সঙ্গে ল্যাপ্টাইয়া গিয়া তুমি আঁইকা ফেলতেছো একের পর এক ছবি—
আমিও এমন ভাবি মাঝেমধ্যে 
অথচ কীভাবে আঁকাবাঁকা রেখা ছবি হইয়া ওঠে তুমি তা জানো না
আমি জানি

দূর-দূর, এই বহুদূর থিকা একঘেয়ে ঘণ্টারা বাজতে থাকলে আমি রওনা হইয়া যাই
নম্রতা— এরে আমি সরলীকরণ কইরা ফেলি পথিমধ্যে 
তোমার কাছে যাইতে বাধা পার হইতে যদি প্রয়োজন হয়
তবে নম্রতায় আমি নীচু হইয়া অন্যের কাছে হাত পাতি
এইভাবে সবকিছু, এই আলোছায়ারে সরল কইরা আমি ছবি আঁইকা ফেলব

তুমি বাকহীন
তুমি মূলত ক্যানভাস 
ঘণ্টারা বাজতে থাকলে চুপচাপ চোখ বন্ধ করতে থাকো
তোমার ওপর পৃথিবীর সব আলো আইসা নত হবে
সারা পৃথিবীর অন্ধকারে তোমার গায়ে একঘেয়েমির নিষ্ঠুরতার রেখারা পড়তে থাকবে

তুমি চিত্রকর না, তুমি ছবি — 
তোমারে বারবার দেইখা জন্ম থিকা জমতে থাকা বিষণ্ণতারা উইবা যাইবে

 

 

মধ্যরাত্তির

মধ্যরাত্তিরে
পাশের বাড়ি থিকা কুকুরের ডাক ভাইসা আসলে
আমার ঘুম ভাইঙ্গা যায়
যেন দূরে সইরা যাইতেছো মনে কইরা 
আরও জাপটাইয়া ধইরা শুই 
আমার শরীরের ভাষা কি তোমার শরীরে মুদ্রিত হয় না তখন?
দুই অক্ষর
এক অক্ষর
বা তার চেয়েও কম?



কবি পরিচিতিঃ 

সানজিদা আমীর ইনিসী

জন্ম নব্বই দশকের শেষদিকে বরিশাল শহরে। বাবার চাকরিসূত্রে শৈশব কেটেছে ফরিদপুর ও পটুয়াখালী জেলায়। বর্তমানে পড়াশোনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে।

একমাত্র কবিতার বইঃ ডুবছি ঝিলাম নদী
প্রকাশ কালঃ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
প্রকাশকঃ বৈভব
শেয়ার