বিন্দুর ভেতরে আকাশ
উড়তে উড়তে যে কোনো পাখিই
বিন্দুর মতো অথচ ধ্রুব আরেকটি আকাশ।
মেঘের আধিক্য বেড়ে গেলে দীর্ঘশ্বাসগুলো প্রতিদিন
অলৌকিক পাখি হয়ে যায়
উড়বার সাধ নিয়ে যে সব কুমারী আকাশ
নেমে আসে
ভ্রমণশীল পাখিদের বুকে, আমরা তাকে
ঝুলিয়ে রেখেছি ধাতব জানালায়
আর কোনো কোনো বিন্দুকে দূর থেকে
ভেবেছি বিস্তর মাঠ
ত্রস্ত অন্ধকারে ভেসে ওঠা মুখগুলো, ভেবেছি
শস্যের বার্তাবাহী কোনো নতুন হুদহুদ
হাতের রেখায় বয়ে যাওয়া যে সব নদীর গন্ধ
হনন হয়েছে সন্ধ্যার আগেই;
সেইসব মৃত নদী গেঁথে নিয়ে ঠোঁটের ডগায়
কোনো কোনো পাখি উড়তে উড়তে
বিন্দুর মতো অথচ ধ্রুব একটি আকাশ হয়ে গেলো
মানুষের তালিকা
আপনি যাকে পাখি বলছেন, মূলত সে পাখি নয়
সেও একজন মানুষ; ডানাঅলা মানুষ
আপনি যাকে গাছ বলছেন, মূলত সে গাছ নয়
সেও একজন মানুষ; শেকড়অলা মানুষ
এই সূত্র যদি মেনে নিই, তবে সূত্রমতে—
নদী একজন মানুষ—তরল মানুষ
মেঘ একজন মানুষ—উড়ন্ত মানুষ
চাঁদ একজন মানুষ—জোছনাঅলা মানুষ
সূর্য একজন মানুষ—রৌদ্রঅলা মানুষ
মাছ একজন মানুষ—জলচর মানুষ
ঘর একজন মানুষ—দেয়ালঅলা মানুষ
গোলাপ একজন মানুষ—গন্ধঅলা মানুষ
এভাবে, আপনার চারপাশ থেকে একেকটি উপাদান তুলে এনে
নামের পাশে ‘মানুষ’ শব্দটি যোগ করে দিন
এবং মানুষের একটি নতুন তালিকা তৈরি করুন
অতঃপর ভাবুন, পৃথিবীতে যা কিছু আছে বস্তুত সবই ‘মানুষ’
অর্থাৎ, গত শীতে আপনি সমুদ্র দেখতে যাননি; বরং বিচে বসে
একজন নোনা ঢেউয়ের নিঃসঙ্গ মানুষকেই দেখেছেন।
গত বরষায় আপনি বৃষ্টিতে ভেজেননি একদম—
ছাদে দাঁড়িয়ে অথবা রাস্তায়
অাপনি একজন মানুষের জলে ভিজে ভিজে একাকার হয়েছেন
অনুরূপ, গতকাল আপনার প্রেমিকাকে
যে গোলাপ উপহার দিয়েছেন, তা কি গোলাপ? না মানুষ?
সূত্রমতে, প্রেমিকার হাতে আপনি আরেকজন মানুষকেই তুলে দিয়েছেন
এবং আপনার সম্মুখেই আপনার প্রেমিকা তাকে
মুখে ও বুকে জড়িয়ে গন্ধ নিতে নিতে
আপ্লুত হয়েছে বারবার।
বিষণ্ন জুতোজোড়া
কোথাও যাই না তাই জুতোজোড়া সারারাত কাঁদে
জনৈক রাস্তার কাছে চেয়েছিলাম তোমার ঠিকানা
রাতভর অন্ধকার মুখস্ত করে করে
ইচ্ছে ছিলো, পথবাসী পাতাদের প্রার্থনাগৃহে
যাবতীয় দীর্ঘশ্বাস রেখে, এক বৃষ্টি-ভোরে
তোমার উদ্দেশে হাঁটব বিপুল
বিষণ্ন জুতোজোড়া জানে না, প্রতি রাত্রেই খালি পায়ে
আমি তোমার মন্দিরে যাই!
ঘুমের সাথে
আমি ঘুমিয়ে আছি
আমার পাশে ঘুমোচ্ছে আরেকটি ঘুম
ঘুমের গায়ে জড়িয়ে আছে হালকা ব্লু কালার
বালিশের পাশে জেগে জেগে একটা এলার্ম
পাহারা দিচ্ছে দুটো নিমীলিত চোখ
আমার কি জেগে ওঠা উচিত?
দরজার গোড়ে দাঁড়িয়ে আছে কলিংবেল
কারো কি আসার কথা ছিল?
আমি ঘুমিয়ে আছি
আমার ভেতরে জেগে আছে আরেকটি ঘুম
ঘুমের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা বিড়াল
একটা চাঁদ, একটা রাতজাগা গাছ;
বিছানার উপরে ঝরে পড়ছে পাতা
নরম পশমের ওম, সামান্য আলোর স্বভাব
আমার পাশে ঘুমিয়ে থাকা ঘুম, জেগে উঠবে এখনই
ঘড়ির ভেতরে এখনই লাফিয়ে উঠবে সকাল
আমার কি জেগে ওঠা উচিত?
হারানো কবরের শোক
আমার কবরটা ঠোঁটে নিয়ে সেদিন উড়ে যাচ্ছিলো চিল
আমি তার পিছু নিয়ে ছুটতে ছুটতে এক শূন্য মাঠে এসে দাঁড়ালাম
শূন্য মাঠ জুড়ে চিলের কান্না
শূন্য মাঠ ভরা কেবলই ক্ষুধা
আমি ডাকলাম। কাঁদলাম। ফেরত চাইলাম আমার সাড়ে তিন হাত
তারপর দেখলাম, মাঠের সমস্ত চিল আমার ভাঙা কবরটা
টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে
খেতে খেতে
উড়ে গেলো
অন্য কোন মাঠে।
ঘুমোনোর জন্য আমার শেষ আশ্রয়টুকুও রইলো না আর!
চক্র
কফির মগ হাতে তোমার বসে থাকার ভঙ্গির দিকে
গুটিপায়ে একটি টিকটিকি এগিয়ে আসে
গুটিপায়ে একটি টিকটিকি এগিয়ে আসার ভঙ্গিতে
কিছু বৃষ্টি নেমে যায়
হঠাৎ কিছু বৃষ্টি নামার গন্ধে আমাকে আলস্য চেপে ধরে
অলস কফির মগ হাতে আমি তখন বৃষ্টি দেখতে বসি
কফির মগ হাতে বৃষ্টি দেখার ভঙ্গির দিকে
সারি সারি পিঁপড়া নেমে আসে
সারি সারি পিঁপড়ার মতো তখন মানুষেরা
রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে
মানুষের হাঁটাহাঁটি বেড়ে গেলে শহরটা
আবার ব্যস্ত হয়ে ওঠে
আর ব্যস্ত একটা শহরের ছাদে বসে আমরা আবার
কফি হাতে একসাথে আকাশ দেখতে থাকি
এবং
আকাশ দেখতে দেখতে আকাশ দেখতে দেখতে
তুমি অার আমি এবং আমি আর তুমি
দু’জন ঘুরতে থাকি জন্মচক্রের মতো!
এক মেঘ মদের সন্যাস
যেখানে চাইনি যেতে, সেদিকেই বেঁধে দিয়ে স্রোত
উদাসীনতা তুমি, কেনো নদী আর নৌকার অভিসন্ধি শেখালে?
বৈতাল হাওয়ায় কতো কি বাঁধা আছে;
ছাইরঙা চাঁদ, ঘন রাত্রিচোখ, লোমশ নিঃশ্বাসের ছায়া,
সে সব গেঁথে নিয়ে পলাতক আগুনকে বলেছি—যে পথে
বিছানো আছে পাতাদের এজ্রাস, দগ্ধশীল হলুদ উপঘর
আমাকে সেদিকে ভাসাও, সেদিকেই জমে থাক যতো
মলিন কথনিকা…
যেতে চাইনি কোথাও, প্রেম অথবা মৃত্যুগামী
উদাসীন ট্রেনের কামরায় তবু বসে রই কেনো?
সরল পাতের উপর ঢেউ তুলে যে কথা লিখে দেয়
রাতের হুইসেল—তুমি তার কতটুকু জানো!
জীবন, পাপ ও পুনরুত্থানের মধ্যপাড়ায় পড়ে থাকে
এক মেঘ মদের সন্যাস!
তুমি একজন মায়াবী ঘর
তোমাকে দেখার আগে
রোদ এবং রাস্তার সাথে দেখা হয়ে যায়
রোদ আমার বন্ধুর নাম, রাস্তা আমার মা
আমি মায়ের হাতের রেখা ধরে হেঁটে হেঁটে
তোমার কাছে যাই
তুমি মানেই তো একজন মায়াবী ঘর
তুমি মানেই, আমার রোদেলা বেলকোনি
আমাকে জানালা দাও, এক বুক জানালা খুলে
উড়াবো আমার বিগত বিষ-শ্বাস যতো
বেজে ওঠা একলা নুপূরের মতো
ক্ষুধা এবং ক্লান্তির হাসি
তুলে দিয়ে দূর-পাল্লার রেলে
উড়াবো পুরাতন দৃশ্য-শোক
মেঘের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায় যেসব একলা জল
আমি তাদেরই আত্মীয়;
তোমাকে দেখার আগেই
আমি দেখে ফেলি মেঘ এবং রোদের ফারাক
সাবানের ছদ্মবেশে
আঙুল নেড়ে নেড়ে একেকটা তারা গুনছি
আর সশব্দে হেসে উঠছে তোমার হিরক তিলগুলো
শুনেছি, সমস্ত তিলের খোঁজ জানে সুগন্ধি সাবান
শাড়ির বিজ্ঞাপনে যে নদীটি গভীর গোপন
নাভিফুলে তার সাবানের ফেনিল মৈথুন;
তোমার স্নানঘর জুড়ে প্রতিদিন বেড়ে ওঠে
ঢেউয়ের কোলাহল
সাবানের ছদ্মবেশে, একদিন, জেনে নেবো
সুগোপন সব শিল্প-বিন্যাস-
সৈকতে হেঁটে হেঁটে লাল কাঁকড়ারা
যেভাবে জানে, উঁচু-নিচু বালুর ব্যাকরণ
বেদনা বোঝার ফিলোসফি
আসুন, আপনার ভেতরে ঢুকে পড়ি আমি
আর আমার ভেতরে সে
আপনি ঢুকে পড়ুন পাশের লোকটির মধ্যে এবং
পাশের লোকটি ঢুকে যাক পছন্দমতো অন্য কারো ভেতরে
পুলিশ ঢুকে পড়ুক খুনির ভেতরে এবং মৃত লাশের দেহে
ঢুকে যাক খুনি
মন্ত্রী মহোদয় ঢুকে পড়ুন শ্রমিকের ঘামে
আড়তদার ঢুকে যাক কৃষকের নিঃশ্বাসে
জনগণের গভীরে ঢুকে ঘুরে বেড়াক রাষ্ট্র
এবং ধর্ম ঢুকে যাক দ্রোহীর আত্মায়
অনুরূপ, পুত্রের ভেতরে ঢুকে যাক পিতা
বন্ধুর ভেতরে স্বার্থান্বেষী, প্রেমিকার কান্নায় প্রতারক
এবং বিত্তবানরা ঢুকে যাক অভাবীর বুকে
অতপর, এভাবেই একে অপরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে
আসুন আমরা পরস্পরের গভীর বেদনাগুলো বুঝতে শিখে যাই!