আমাদের স্ক্রিনময়ী জীবন অনর্গল ডিজি-ছবির বন্যায় চিন্ময়। এই নেটেড দর্শনের গ্লোবাল রাজত্ব শুধু আমাদের অবসরকেই শাসন করে না, কোন ছবির ঝাঁক কিভাবে ইন্টারনেট আর স্ক্রিন বেয়ে আমাদের চোখ ধাঁধায় আর মন মাতায়, তা দিয়ে গড়ে ওঠে আমাদের রোজওয়ারি গণদর্শন আর রাজনীতি। ভিসুয়ালের সেই সাইবারশাহীর নানা ঝাঁকিদর্শন নিয়েই এই কলামের নানান কিস্তি।
হাওয়ার খাঁচায় ভরা বিনি সুতোর জাল
‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’ নামের রচনা ইস্কুলে যাদেরই লিখতে হয়েছে তারাই জানে এর শেষ কিভাবে করতে হয়; বিজ্ঞান কোনটাই নয়, সে যে যন্ত্র, মোরা যন্ত্রী, যেমন চালাই তেমনি চলে – অর্থাৎ সে নাকি ভালো মন্দের অতীত। শুদ্ধ, নিরংকার এই বিশেষ জ্ঞানকে প্রযুক্তির প্যাঁচে পেড়ে ফেলার পরেই নাকি তাতে ভালো-মন্দের উদয় হ্য়, যথা পারমাণবিক শক্তি থেকে ভালো বিদ্যুৎ আর মন্দ বোমা।
কিন্তু পনেরো নম্বরের রচনা এভাবে শেষ করা গেলেও এই প্রশ্নের নটে গাছ অত সহজে মুড়োয় না।
প্রযুক্তির মধ্যে থাকে এফর্ড্যান্স (affordance)- তাকে ব্যবহার করার বাঁধা পথ। যেমন ধরা যাক, তরল খাওয়ার প্রযুক্তি অর্থাৎ কাপ, যে প্রযুক্তির প্রধান অঙ্গ আংটা, আঙ্গুল বেঁকিয়ে আলতো ধরে ঠোঁটে তোলার জন্য তৈরি। সেই আংটা ভেঙে, সেটিকে অস্ত্র বানিয়ে কাউকে আঁচড়ে রক্তপাত করা যেতেই পারে কিন্তু কাপ প্রযুক্তির কারিকা (affordance) , তার ব্যবহারকে সেই খাতে বইতে দিতে চাইবে না। এর জন্য আংটা প্রযুক্তির ইতিহাস, ভূগোল, বাণিজ্য ঘনীভূত ভাবে পথরোধ করবে, খোলা রাখবে শুধু আংটা ধরে পেয়কে পিয়ে খাওয়ার পথ। অর্থাৎ প্রযুক্তির মধ্যে নিরেট ভালো বা নিরেট মন্দের দুটো আলাদা আলাদা সোজা সড়ক খোলা নেই। প্রযুক্তি মানুষের তৈরী হলেও, তয়ের হবার পর তার কারিকাশক্তি দিয়ে মানুষকে অনেক কিছু করিয়ে নেয়। সে একসাথে যন্ত্রী এবং যন্ত্র।
এই যে এই লেখাটি, বিনিসুতোর জাল আন্তর্জালে ভেসে আপনাতে পশছে, আপনি যে মাউস, টাচপ্যাড বা আঙ্গুল দিয়ে নাচিয়ে নাচিয়ে উপর-নিচু-আগু-পিছু-ছোট-বড়-খোলা বন্ধ করছেন, কিছু টাইপ না করতে হলে কিপ্যাডে যে হাত দিতে হচ্ছে না, তার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য যে প্রযুক্তির তার নাম জি ইউ আই (GUI – Graphic User Interface)। এটি দিয়ে প্রায় কিছু টাইপ না করেই কম্পিউটারকে যা-চাই-তাই করানো যায়। এম এস ডস নামক কম্পিউটারচালক ভাষায় সওয়ার হয়ে, কাঁড়ি কাঁড়ি কোড টাইপ করে আপনি কি কোনদিন কম্পিউটার চালিয়েছেন? তাহলে বুঝবেন ছবি ছুঁয়ে ছুঁয়ে কম্পিউটার-ট্যাব-স্মার্টফোন চালনা কত সুখের- GUI-তে জন্মানো এই প্রজন্মকে সেটা বোঝানো মুশকিল, মানুষ যেমন হাওয়ায় ডুবে আছে বুঝতে পারে না, মাছকে যেমন বোঝানো মুশকিল সে জলে আছে।
জি ইউ আই-তে মানুষ আর কম্পিউটারের মধ্যে বার্তালাপের জন্য জরুরি কোডগুলো ঢাকা থাকে ছবির পরতের আড়ালে। কোড জানতে হয়না, শুধু স্ক্রিনছবি পড়ে কোথায় আঙুল ছোঁয়াতে হবে (নিজের বা মাউসের বা কার্সরের) সেটুকু জানলেই চলে।
জি ইউ আই এর মোহিনী মায়া শুধু তার সুবিধাসুখে নয় (প্রতিটি কাজের জন্য কোড টাইপ করা ক্লান্তিকর), বরং এর যা-চাই-তা-পাই (WYSIWYG – What You See Is What You Get)user কে দেয় পুরোপুরি পাড়ার, জানার, বোঝার আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারার মরীচিকা শুধুমাত্র অঙ্গুলিহেলন করে।
গুগলের দৃশ্যপাতা আর তার আড়ালের টেক্সটকোড
জি ইউ আই (GUI – Graphic User Interface)-এর এফর্ড্যান্স (affordance)বা কারিকা কেমন দেখা যাক, তেরো বছর আগে পিছে দুটো লোকপ্রিয় বইয়ের প্রচ্ছদ দিয়ে – বিষয় জি ইউ আই ডিজাইন।
বাঁয়ে – Don’t Make Me Think: A Common Sense Approach to Web Usability (2000)
ডাইনে – Seductive Interaction Design : Creating Playful, Fun and Effective User Experiences (2013)
ইন্টারনেট যেমন বিনিসুতোর জাল, জি ইউ আই তেমন হাওয়ার খাঁচা – থেকেও নেই। তার কাজ নিজে আড়ালে থেকে শুধু internet user যে তথ্য (যেমন এই লেখাটি) বা যেই কাজ (যেমন online payment)করতে চায়, ধাপে ধাপে তাকে সেই রসদ জুগিয়ে যাওয়া, সে চাওয়ার আগেই। সেই কিস্যা-উক্ত চাকরের মত, যে রাতে মনিবের পেটব্যথা হওয়ায় একসাথে ডাক্তার, ওষুধ, পুরুত, খাটিয়া এমনকি শ্মশানবন্ধু এনে হাজির করেছিলো, পাছে প্রয়োজন হয়।
2000 সালে জি ইউ আই-এর লক্ষ্য ছিলো যেন user কে একটুও মাথা খাটাতে না হয় আর 2013 তে সেই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল মাথা না খাটিয়েই user যেন তাঁর অভীষ্টের বেশি কিছু করে ফেলেন, seduced হয়ে বলেন, “যা চেয়েছ তার বেশি কিছু দিব, বেণীর সঙ্গে মাথা।”
চারটি ছবি দিয়ে ধাপে ধাপে এই গভীরজটিল পরিবর্তনকে বোঝার চেষ্টা করা যাক।
Don’t Make Me Think থেকে তথাকথিত ‘অকাট্য‘ প্রমাণ যে user জি ইউ আই ব্যবহার নিয়ে একটুও মাথা ঘামাতে চায় না (লেখকের স্ত্রী উবাচ)
জি ইউ আই user এর খোপড়ি যে খালি তা নিয়ে প্রমাণাত্মক মিম
Seductive Interaction Design থেকে জি ইউ আই usage এর সহজতা আর user কে দিয়ে যা চাই তাই করিয়ে নেওয়ার সহজতার মধ্যে সম্পর্কসূচক গ্রাফ
Seductive Interaction Design থেকে তথাকথিত ‘অকাট্য‘ প্রমাণ যে জি ইউ আই এর বুদ্ধিগত আর আবেগগত ব্যবহার এক
অর্থাৎ এই যুক্তিক্রম যে সব প্রতিপাদ্যের ধারাপাত তা এইরূপ – জি ইউ আই user-এর মাথা খাটানোতে অনীহা universal, তাই তার কাজ – আন্তর্জালে তথ্য, আমোদ বা সার্ভিস খুঁজে নেওয়া যথাসম্ভব সহজ করে দিতে হবে, এই সহজ থেকে সহজতর থেকে সহজতম-র সিলিপ-কাটা পথ বেয়ে তাকে বইয়ে নিয়ে যেতে যেতে তাকে user-এর অজান্তে তার চাক্ষুষ আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে তাকে দিয়ে বহু কিছু করিয়ে নেওয়া যায়। কারণ কাজ সহজ করে দেওয়া মানে অনেক সুযোগ কেড়ে নেওয়া আর সেই কেড়ে নেওয়া সুযোগের ফাঁক অন্য সুবিধামত জিনিস দিয়ে ভরে দেওয়া। এর একটা খুব সহজবোধ্য উদাহরণ হল search keyword এর autosuggest function.
অটোসাজেস্টের জঞ্জালি জ্বালা
জি ইউ আই এর যা-চাই-তা-পাই এর মরীচিকাকল্প যে কত অবলীলায় যা-চাওয়ানো-হচ্ছে-তাই-পেতে-হবে-র কৃষ্ণগহ্বরে বদলানো যায়, নিচে তার তিনটে চরম উদাহরণ রইল।
স্ক্রিনে চুল লেগে আছে এই ভ্রম দেখিয়ে ক্লিক করানোর ব্যবস্থা
আনসাবস্ক্রাইবের লিঙ্ক সাদার ওপর সাদা দিয়ে লেখা, যাতে খুঁজে না পাওয়া যায়
মিথ্যে ভয় দেখিয়ে সাবস্ক্রিপ্সন চালু রাখার কল
কিন্তু জি ইউ আই যদি তার user কে universal idiot ধরে না নিয়ে আর তার সামনে খুড়োর কল ঝোলানোর প্রকল্প না ফাঁদতো তাহলে তা কত চমৎকার সুন্দর আর বুদ্ধিদীপ্ত হতে পারতো তার এক উদাহরণ হ’ল রাশিয়ান সমকামী কবি ইয়েভগেনি খারিতোনভের জীবনসৌধ এই ওয়েবসাইটটি –
https://uzor.xyz/uzor/uzor
আরও পড়তে চাইলে:
https://uxdesign.cc/how-ux-designers-use-psychology-to-manipulate-their-users-1508e91c0efb
https://en.wikipedia.org/wiki/Yevgeny_Kharitonov_(poet)
Chun, Wendy Hui Kyong. “On software, or the persistence of visual knowledge.” grey room 18 (2005): 26-51.
Drucker, Johanna. Graphesis: Visual forms of knowledge production. Cambridge, MA: Harvard University Press, 2014.

সৌরভ রায়
লেখক, সম্পাদক, অনুবাদক ও চিত্রগবেষক
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের LGBTIQ+-সংক্রান্ত অনলাইন ভিসুয়াল কন্টেন্ট নিয়ে গবেষণা করছেন।