তুমি গান হও, শুনি | কায়েস মাহমুদ

সাহিত্যে, চিন্তায় আমি বিরতিহীন যাত্রার পক্ষপাতী। ভ্রমণকারী যেমন লিখে রাখেন প্রায়শই অভিজ্ঞতা এবং বিবরণ, কবিতা তেমনই এক ভ্রমণকথা আমার কাছে। চিন্তার ক্রমশ রূপান্তরের সাথে কবিতা বদলায়, ভাষা ও বিষয় বদলায়। “তুমি গান হও, শুনি”  ঠিক এই মুহূর্তে আমার চিন্তার সংকলন। পাঁচ বছর চিন্তা এমনই থাকবে কিনা আমি জানি না। সাহিত্যে, দর্শনে চিন্তার গতি প্রবহমান মেঘনার চেয়েও বেশি। তবে দিন শেষে কবিতার কিংবা দর্শনের পুস্তকে আমরা তাহলে কী পাচ্ছি? আমরা পাচ্ছি সময়। 

যেসময়টায় আমার প্রথম কবিতার বই, “পোস্ট মডার্নিজম বুঝি, তবু শেফালিকে চাই” প্রকাশিত হচ্ছে, সে সময় যে ধরণের চিন্তা করে এসেছিলাম তার আগ অবধি বিভিন্ন সময়ে তার বেশিরভাগেরই উপস্থিতি বইটিতে সংকলিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।  যার অনেক কিছুই এখন আমার কাছে আর প্রাসঙ্গিক নেই। যাপনে খানিক স্থিরতা, প্রবহমান মেঘনা, সুস্থতা-অসুস্থতা-সুস্থতা, বৃক্ষ আর মানুষ। প্রাসঙ্গিক কেবলই মেঘনা নদী।  “তুমি গান হও, শুনি” ঠিক এই সময়টার কায়েস মাহমুদের চিন্তার সংকলন। নাম থেকে নিশ্চয়ই খানিক আন্দাজ করতে পারছেন সম্ভবত চিন্তার সারকথা কিংবা, সারকথার সারকথা।

— কায়েস মাহমুদ


মাধ্বী, গান হয়ে এসো


প্রচ্ছদশিল্পীঃ রাফিদ মাহমুদ

কিছু সবুজ জমে থাকুক গাঢ় কোনো শীতে।
ক্রমশ পাতার পক্কল রঙ ধীর হাতে মুছে—
বৃষ্টি, তুমি নেমে আসো অচল যানের শহরে
ধুলো ঝেড়ে। মাধ্বী,  এসো শিউলি কুড়োই
রক্তিম ভোরে। রৌদ্র ঝিলমিল,
আকাশের নেই কোন প্রকৃত পলিস্তারা।
বাতাস বয়, ধানের ঘ্রাণ আনে দুপুর আলোচ্ছটা।
দেখি ঝরে পড়া পাতাদের পাশে,
উনুনের বিলম্বিত আঁচে
জ্বাল করা; মাছ-ক্লান্তি- শৃঙ্গার, আনাজপাতি।
বিরহ ফিরে এলে, জানি প্রেমে সুখি
হয় মানুষ। পুনরায় গর্ভবাস পেলে,
বিষণ্ণ বৃক্ষের মতো আবারো মাখামাখি
হলে, ডুবে যাবো—আকন্ঠ  স্মৃতির স্মারণে।
ল্যাম্পপোস্টে এসে বসে ছোট্ট এক শালিক,
চোখের ভেতর ইঁদুর সেজে রয়েছে এ কোন নাবিক?
গান হও,
শুনি,
হাসপাতালে যেমন ভীড় করে থাকে উৎকন্ঠায়, রোগিনী।
বাতাস বয়, পাল তুলে চলে যায় মাঝবয়েসী নৌকা।
রৌদ্র ঝিলমিল জল পান করে সূর্যের শব, সুধা।
তেমনই নদীর কাছে, পল্লবিত ঝাউয়ের বনে
প্রকৃত সুবাসে, তুমি গান হও, শুনি।
সুখের কাছাকাছি তবু দূর হতে
জানি—
পরাগায়ন খুন করে যায় সমস্ত শীতের ফুল ৷
গাছেদের মর্মরে গাঁথে, মৌমাছির আনন্দ প্রসারি হুল।


জাহাজ বন্দর ছেড়ে গেছে


সমস্ত মলিন দেশ, মলিনতর হয়ে ওঠে।
পাখি উড়ে চলে বায়ুর কাছাকাছি;
এবং, জল- ক্রমশ চলে প্রকৃত জলাশয়ের নিকটে।
মানুষের কাছাকাছি আসে না কখনোই রোদ।
কী ভীষণ অবহেলার মতো তুচ্ছ মানবজীবন।
আকাশে ফুটে উঠে সোনালী মাউথঅর্গান।
এমন মলিনের পর তবুও, উজ্জলতর দেশ আছে আরো,
আফগানি গালিচায় সাজানো আরো কিছু আসবাব।
পৃথিবীর সমস্ত রুক্ষতার ‘পরে হয় প্রাণের সঞ্চার।
জাহাজ বন্দর ছেড়ে গেছে;
সেকেন্ড ক্লাস যাত্রীদের ভীড় ঠেলে- ধীর- পায়ে পা ফেলে উঠে যাই ছাদে।
কোনদিন করলে নোঙর- একদিন কোন একদিন আরো দূর বন্দরে,
সবুজ ঘাসের ওপর – বন্ধুকে শোনাবো বলে একটা কবিতা লিখে রাখি বুকে।
জাহাজ বন্দর ছেড়ে গেছে;
লাউটহাউজ ঘিরে ক্রমশ বেরিয়ে আসছে এক নতুন জনপদ।


গড চাইল্ড-এর প্রতি


তোমাকে দেখাতে পারি শৈশবের নদী।
মেঘনার ঠিক তীরের আমার কবরের মাটি।
স্রোতে ভেসে আসা আমার প্রাচীন জনপদ।
যেখানে নদীর বুকে একদিন ভেসে যাবো আমি।
সবুজ ঘাসের ভিতর লুকানো সবুজ জোনাকি।
বকের শাদা ডানায় উড়ে আসবে মেঘ, বস্তুত শাদা অথচ ঘনকালো৷
তারপর বেরিয়ে পড়বো ধানক্ষেতের আইল ধরে।
চলে যাবো ততদূর, যতদূর গেলে পেয়ে যাবো হাটবারের কোলাহল।
আমার সমস্ত আয়ু দিয়ে তোমাকে কিনে দেবো ক্লান্তিহীন চোখ।
তুমি চলে যেয়ো নদী পেরিয়ে, না দেখা পাহাড়ের দিকে।
হেঁটে গিয়ে ছুঁয়ে দেখো, আমার না ছোঁয়া পাহাড়ের জল।
আমাকে গড়েছে খোদা এমন আগুন ঢেলে,
জলের পাশে বইতে গেলে বাষ্প শুধু মেলে।
আমি তাই পারবো না ছুঁতে কোনদিন, আমি জেনে গেছি।
তুমি এসব জানতে চেয়ো না, ফিরে এসে আমার এফিটাফে লিখে দিও অভিজ্ঞতা।


ড্রিম সিকুয়েন্স


গোলাপি আকাশ, গোধূলির নেই কোন নিজস্ব রঙ আর।
ঘোর সন্ধ্যায় ভাজ করেছি ব্যাকপ্যাক।
দুপুর থেকে বিকেলের পথ হেঁটে এসে,
গোধূলির আলোয়-
নিয়নের আলোয়-
বনের ভেতর, নদীর ভেতর, ঝিঁঝিঁ পোকার আস্তাবলের ভেতর,
এবারে নিচ্ছি বিশ্রাম; বহুদিন হয় না দেখা সঙ্গে যে তার।
মানুষ ক্রমশ যাচ্ছে মরে।
ক্রমশ মানুষ করছে খুন।
কোথাও কখনো মানুষ প্রার্থনা করছে নিস্তার।
ক্লান্তি;
কেবলই অবসাদ এসে জমে।
ঢিবি থেকে বের হয়ে আসে পিঁপড়ের ঝাঁক।
ফুরিয়েছে শীতকাল, এখন বসন্ত।
পিঁপড়ের খাদ্য শিকার দেখে মনে পড়ে একদিন-
আমিও তো শিকারী ছিলাম।
বাইসনের পিছে ছুঁটে পেরিয়েছি নদী থেকে পর্বতের পথ।
আহঃ শিকার!
টগবগে তাজা মাংস।
নিশাচর পাখি জাগে, সন্ধ্যাপোকা ডেকে যায় অবিরাম।
বনের ভেতর এখন রাত্রি নামার কাল।
কাল রাতে সে ভীষণ রাতের মৃত্যুসংবাদে বেরিয়েছি পথে।
মৃত্যু;
এমন গোধুলী না দেখে, কেনই বা যেতে হলো মরে?
ভয়
সেদিন থেকে জানতে পেরেছি, যেদিন শিকারী থেকে পরিণত হয়েছি শিকারে।


পুষ্পচ্যুত সৌরভে


রোষের শৃঙ্গার জানি, সংহারী
প্রাণ-পবন অঘোরে। তপস্বী
গৃহ ছেড়ে যার যার জ্ঞানালয়ে
ফিরে আসি, মেদুর অনলে
প্রস্ফুটিত জল হঠাৎ।
কক্ষের প্রবোধ থেকে— কবাট
ডিঙিয়ে তবু ফের যাওয়া-আসা
যেমন, উত্তাপে গভীর হয় পারদের ওঠানামা।
পুষ্পচ্যুত সৌরভে, এভাবেই রয়েছি স্মৃতির গাঢ় পেলবে।


বসন্তের পর

(সামিহা হায়দার-কে)


পৃথিবী জুড়ে আশ্চর্য সব শালিখের বাস,
আমরা যারা বেড়ে উঠি রোজ। মধুকুপী ঘাস
কিংবা বাঁকানো নদীর মতন,
পাঁচিলে রোদ উঠে গেলে ছাদ থেকে
বাগানে ফড়িং-এর ভেতর,
মরা যারা বাঁচতে চেয়েছি বেঁচে থাকি রোজ।
আমরা যেন মনে রাখি, যাপিত সবুজের ঘরদোর।
যেন একটা শিশিরের জোৎস্না ফোটে, তারো আকাশে সূর্য ওঠে।
আজন্ম সহোদরার মতো আগলে রেখো প্রিয় অক্ষর,
আর তোমায় যা কিছু দিতে চেয়েছি, মধুকুপী ঘাস, বাঁকানো নদী, ফড়িং এর বাগানের ভেতর৷


adiós, amor, adiós


মারিয়া তেরেসা, মারিয়া তেরেসা,
চুপ করে থেকো না।
এবারটা কথা বল লক্ষ্মীটি।
রাত বাড়ছে,
বাতাসে বাড়ছে শীত।
গিটারের তারে
আমার জমে ওঠা আঙুলের মতো,
জমে যাচ্ছে কফির কাপ।
মারিয়া তেরেসা,
রাত পেরোচ্ছে।
ঘুম পাচ্ছে ভীষণ, মারিয়া তেরেসা।
পাশ ফিরে থেকো না আর।
আধখাওয়া সিগারেট হাতে,
গেয়ে শোনাও
বিষণ্ণ
মেক্সিকান গান।
কী ভীষণ বিষণ্ণ প্রেম!
গিটারের তালে এলোকেশে নাচো তুমি,
আঁকাবাঁকা শরীর গণিতে৷
মারিয়া তেরেসা,
রাগ করে থেকো না আর।
এবারে বিদায় দাও, মোন আমোর।
বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।
আদিওস,
আদিওস, আমোর, আদিওস।
রাত পেরোচ্ছে, ভোর হবে এক্ষুনি।
ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে লিখে যাই আরো হাজার রাত।
অথচ— রাইফেল গোছাতে হবে।
জঙ্গল পেরিয়ে যেতে হবে,
শহরে।


কায়েস মাহমুদ

পেশায় বেকার, একজন কবি। আগ্রহী ভাষাতত্ত্ব, চলচ্চিত্র, সংগীত, দর্শন ও সাহিত্য সমালোচনায়। গত শতাব্দীর ন’য়ের দশকে মেঘনা অববাহিকায় জন্ম। মৃত্যুর এখনো ঠিক নেই।

প্রকাশিত বই

পোস্ট মডার্নিজম বুঝি, তবু শেফালিকে চাই। ( ২০২২)
তুমি গান হও, শুনি (২০২৪)

 

শেয়ার