তানভীর মোহাম্মদের চোখে সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’

চিত্তের উদাসীন খেল-তামাশায় এই ভাবনাটা আসা স্বাভাবিক, চলচ্চিত্র কেবলি কিছু খেয়ালি ঘটনার দৃশ্যায়ন। কিন্তু দৃশ্যসর্বস্বতার আড়ালে চলচ্চিত্র যে একটি ভাষার আকার নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে, তার উপলব্ধির জন্যে কিছুটা সচেতনতার প্রয়োজন বৈকি। একজন নির্মাতা তার দর্শকদের সাথে মুহূর্তকাল দৃশ্যের ভাষায় আলাপ-আলোচনা করছেন; নিজস্ব দর্শন বা মতামত ব্যক্ত করছেন। আবার দর্শকও জানাচ্ছেন তার প্রতিক্রিয়া। হয়তো একমত হচ্ছেন নয়তো ভিন্নমত। সবকিছুই তিনি জানান দিচ্ছেন অভিব্যক্তির ভাষায়। নির্মাতা এবং দর্শকের এই কথোপকথনের ফলে দেখা যায়, মানুষের চিন্তার অবারিত ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। নিছক বিনোদনের পাশ কাটিয়ে যে চলচ্চিত্র আমাদের বুদ্ধি-বিবেচনা-আবেগ ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে বাস্তব জীবনে প্রতিফলন সৃষ্টি করে, তাকে নিশ্চয়ই নির্দ্বিধায় শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম বলা যায়। এসব আলাপের সাথে তো আমরা দীর্ঘকাল পরিচিত। কিন্তু উল্লেখ করতে হলো সত্যজিৎ রায়ের “আগন্তুক” চলচ্চিত্রের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে। শক্তিমান এই চলচ্চিত্রটি দেখে মনে হচ্ছে, তিনি এইসব আলাপে খুব বেশি একটা উৎসাহী নন। তাঁর অদ্ভূত শক্তিমত্তা এবং সৃজনশীলতার মেরুদণ্ড নিয়ে তিনি চলচ্চিত্রকে রূপ দিলেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রকাশমাধ্যম হিসেবে। যেনবা আড্ডায় হেসে-খেলে বলে যাচ্ছেন চারিপাশে ঘটে যাওয়া মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি, পরিচয় সংকট নিয়ে তার বীক্ষণ। গল্পের আদলে বলে যাচ্ছেন, এ কি আসলেই কোনো গল্প? নাকি কবিতা? গল্পের যেমন সময়কাল থাকে, তার বক্তব্যের তো তেমন কোনো নির্দিষ্ট সময়কাল বেঁধে দেওয়াও যাচ্ছে না। তবে কি তা কবিতা নয় যে, যা বলা হয়েছে, যেভাবে বলা বলা হয়েছে, চিরকালীন তা-ই তার অবয়ব?

 proves nothing

চলচ্চিত্রের ভাষায় তিনি কি অতুলনীয় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, তা তাঁর “পোস্টমাস্টারে” কিছুটা অনুভূত হয়। রবীন্দ্রনাথ তার মূল গল্পে রতনের বেদনা বোঝাতে শব্দ ব্যবহার করেছেন অনেকগুলো। এবং সেখানে দেখা যাচ্ছে, গল্পটা সেই স্থানে প্রত্যেকটা শব্দকেই ডিমান্ড করছে। কিন্তু সত্যজিৎ রায় এই ভাষার পরিবর্তনটা করলেন কী অপূর্ব! মাত্র দু’সেকেন্ডের একটি শটে সেই বেদনা তিনি যথাযথভাবেই উপস্থাপন করলেন। এমন শক্তিমত্তার অধিকারী চলচ্চিত্র-কথকের ছবি দেখতে তো একটু নড়েচড়েই বসতে হয়। যার প্রতিটি বক্তব্য বহন করে তীব্র ভাবনা। “আগন্তুক” শুরু করবার পর দেখা গেলো সেই চেনা সত্যজিৎ। আঘাত করছেন বিশ্বাসের মূলে; ভাবিয়ে তুলছেন পরিচয় নিয়ে। সজোরে ধাক্কা দিচ্ছেন এতোকালের প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে। তার সেই সচেতন মানবিক জিজ্ঞাসা, বিশ্বাস এবং ভালোবাসাই যদি মানুষের প্রকৃত মূল্যবোধ হয়ে থাকে, তবে দরোজায় অপরিচিতের কড়া শুনে আমরা কেন ভীত হই? কোন মাপকাঠিতে আমরা বিচার করি, সেও আমাদের একজন? কেন একজন অপরিচিতের সম্মানের ক্ষেত্রে শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কের আচরণ ভিন্নতর? খুব সুক্ষ্মভাবে সত্যজিৎ রায় প্রশ্ন করে বসলেন মানবতা আর পাশবিকতার ভিত্তিহীন ধারণার ওপর। তিনি যেন চোখে চোখ রেখে জোর গলায় বলতে চাইছেন, সভ্যতার ধারণাটিই ভুল।


একটা গাছ যেমন চারপাশে তার শিকড় ছড়িয়ে দেয়, মানুষও তেমনি। গাছের পরিসর ক্ষুদ্র আর মানুষের পরিসর বিশাল। এই গভীর জীবনবোধই হয়তো মানুষকে অনেকদূর পথ দেখিয়ে দেয়। 


পরিবারের একজন মানুষ ভ্রমণের নেশায় ঘর ছেড়েছে দীর্ঘ ছত্রিশ বছর। ফিরে আসার পর সে এখন এক অচেনা আগন্তুক। ‘সভ্য’ মানুষ তাকে দেখছে সন্দেহের চোখে। তার বস্তুগত উদ্দেশ্য ব্যতীত এমন প্রত্যাবর্তনের কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছে না তারা। চাইছে কিন্তু মেনে নিতে পারছে না আপন হিসেবে। এই তো আত্মকেন্দ্রিক প্রতিযোগ। নেতিবাচকতাই যার সারমর্ম। জলজ্যান্ত একটা মানুষের আচরণ, কথাবার্তা তার পরিচয় হতে পারে না। সভ্যতার দরকার তার সত্যায়িত আইডেন্টিটি। দর্শক একটা সময় ধরে পরিচয়ের সংকট নিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন থাকতে বাধ্য। ঠিক এমন সময়ই সভ্যতার সেঁটে দেওয়া নিদর্শনের বিপরীতে শক্ত আওয়াজ উচ্চারিত হতে শোনা যায়। “দিস পাসপোর্ট প্রুভস নাথিং!” পাসপোর্ট দেখে বাড়ির কর্তা যেই নিশ্চিত হতে যাবেন, তখনই ঠুনকো এই পরিচয়ের বিপরীতে মনোমোহন মিত্রের শক্ত এই উচ্চারণ। তবে কী দেখে আমরা জানতে পারি তার পরিচয়? সত্যজিৎ সক্রেটিসের অনুসরণ করেন হয়তোবা এ ক্ষেত্রে। সক্রেটিস তার নিকট সত্য থাকার ব্যাপারে যেভাবে বলেছিলেন, এই তর্ক সত্যের সন্ধান দিতে পারে না। তার জন্য সময়ের প্রয়োজন। সত্যজিৎও অপরিচিতের পরিচয় পাবার একটাই সমাধান বাতলে দেন, ‘সময় লাগবে’। তার মতে দুর্নীতির এই সময়ে ছবি আর নাম-ঠিকানা লেখা পাসপোর্ট জাল করা কঠিন কোনো ব্যাপারই না। ছোট্ট একটা বই কীভাবে একজন মানুষের পরিচয় বহন করতে পারে? তার জন্য তাকে বুঝতে হবে, গভীরভাবে পড়তে হবে। তবেই না সম্ভব একজন মানুষের পরিচয় লাভ।

 

আমৃত্য তো আমরা খুঁজে বেড়াই। আমাদের অন্বেষণের এই জার্নি কি আরও বেশি বর্ণিল হয়ে ওঠে, যখন সত্যজিৎ আমাদের চিন্তায় হস্তক্ষেপ করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন? তিনি কি এ-ই চেয়েছেন, শৈল্পিক ভাষায় নির্মিত তার জীবন-জিজ্ঞাসা অনাগত কালকে অস্থির করে রাখবে? প্রবলভাবে তাড়িত করবে গন্তব্যের খোঁজে? আমাদের যাপিত জীবনে অসংখ্য বৈপরীত্য আছে, যেগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে না দিলে আমরা কখনও তা অনুভব করতে চাই না। হয়তোবা ইচ্ছে করেই। সত্যজিৎ বিদায়ের আগ মুহূর্তে একরকম জোর করেই ক্লান্ত অস্তিত্বে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তেমন কিছু বৈপরীত্য। মূর্তিমান দম্ভের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সুরম্য অট্টালিকা থেকে বেড়িয়ে যখন রিকশায় আয়েশি ভঙিমায় চোখরাঙানি হাসে, তখনই হয়তো উৎপল দত্তের তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে ভর করে সত্যজিৎ অসভ্যতার একটা তিলক এঁকে দেন ‘সভ্যের’ কপালে। শুধু কি তা-ই? ভাঁড়ামি আর পরনিন্দায় সুখ খুঁজে পাওয়া আমাদের ইন্টেলেকচুয়াল দৈন্যতাও স্মরণ করিয়ে দিতে চান তিনি। সক্রেটিস, প্লেটোদের দর্শন, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে চক্রের উল্লেখ করে তিনি হয়তো পথপ্রদর্শন করতে চান সভ্য নাগরিকদের। অথবা একপ্রকার হা-হুতাশ করে ওঠেন ‘নিম্নগামী’ মেধার বিষয়বৈচিত্রহীন আলাপচারিতার প্রতি ইঙ্গিত করে। কিন্তু কেবলই বাঙালির সাথে একে বিশেষায়িত করবার প্রয়োজনটা বোধহয় পুরোপুরি ধরতে পারিনি। সভ্যতার সোপান কি তবে অন্য কোনো জাতির ক্ষেত্রে এভাবে পরচর্চার জঞ্জালে রুদ্ধ হয়ে যায়নি? তবে একটি বিষয় এদিকে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, সত্যজিৎ কিন্তু গ্রাম ছেড়ে নগরের বয়ানে শিফট করেছেন ইতোমধ্যেই। ফলে তিনি এমন কোনো শ্রেণিকে বুদ্ধিচর্চা করতে বাধ্য করছেন না, যাদের জীবিকার বাইরে ভাববার তেমন ফুরসত নেই। আরও একটি ব্যাপারে খুব সুক্ষ্মভাবে ‘স্যাটায়ার’ করলেন আগন্তুক সত্যজিৎ রায়। মারামারি-হানাহানির যুগে পলিটিক্সই একমাত্র হাসির খোরাক। যথার্থ বৈকি!

 Agantuk

চিন্তক হিসেবে সত্যজিৎ কতোটা অগ্রসর ছিলেন, তার ব্যাপারে হয়তো কোনো কথা নেই। কিন্তু তার সর্বশেষ চলচ্চিত্রে একটা দৃশ্য দেখে অভিভূত হতেই হয়। জীবনবোধ-সমৃদ্ধ সাহিত্য নাকি ক্রাইম ফিকশন। এ ব্যাপারে সরাসরি কিছু না বলে ছোট্ট করে একটা সংলাপ গেঁথে দিলেন দর্শকের মনে। বড় মামা মনমোহনের ওপর অনীলার সন্দেহের কার্যকারণ হিসেবে দায়ী করলেন ক্রাইম ফিকশনকে। বলতে চাইলেন, সরল মানবিক চিন্তা থেকে কতো দূরে আমাদের বর্তমান অবস্থান। একেকটা টুইস্ট কীভাবে আমাদের উদ্বুদ্ধ করছে নেতিধারণায় অংশগ্রহণ করতে। সভ্য থেকে দিন দিন সন্দেহবাতিক অসভ্যে পরিণত হচ্ছে মনন। এই অসভ্য সন্দেহ, এই তীব্র অহং আর ঠুনকো পরিচয়সর্বস্বতার বিপরীতে তিনি দাঁড় করিয়ে দেন আগন্তুককে। কিন্তু এই আগন্তুক কি তিনি নিজেই নন? উৎপল দত্তকে যখন তিনি বলেন, ইউ আর প্লেয়িং মি, তখন তার পরিচয় মনমোহনের আদলে প্রতিষ্ঠিত হতে আর কিছু কি বাকি থাকে? তিনি নিজেই তো এক এক করে বলে যাচ্ছেন এস্কিমোদের স্থাপত্যবিদ্যার কথা, গুহামানবদের আঁকা বাইসনের কথা। তার নৃতাত্ত্বিক পড়াশোনার বিস্তৃতিও অনেকটা ফুটে ওঠে এই ‘আগন্তুক’ বেশ ধারনের মধ্য দিয়ে। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই ক্ষেত্রে আলোকপাত করেন সত্যজিৎ। শুধু পাঠই কি জ্ঞানের পূর্ণতা দিতে সক্ষম? আগন্তুক তার অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্বাস করেন, না। অভিজ্ঞতাহীন পাঠ যে পূর্ণ উপলব্ধি প্রদানে সক্ষম নয়, সেটা খুব জোরালোভাবেই উচ্চারিত হতে শোনা যায় মনমোহনের উক্তিতে, “অভিজ্ঞতাই আমার জ্ঞানেন্দ্রীয় উন্মেষের প্রধান কারণ।”

 

“জীবনটাই তো ছোটাছুটি। কয়দিন বিশ্রাম করে আবার ছুট।” ঘরকুনো জীবনযাপনের কথা ভাবলে সত্যজিৎ কি খুব বেশি বিতৃষ্ণ আর নিস্পৃহ হয়ে উঠতেন? হয়তোবা। তারেক মাসুদের একটা উক্তি মনে পড়ছে। তিনি মানুষকে গাছের সদৃশ ভাবতেন। একটা গাছ যেমন চারপাশে তার শিকড় ছড়িয়ে দেয়, মানুষও তেমনি। গাছের পরিসর ক্ষুদ্র আর মানুষের পরিসর বিশাল। এই গভীর জীবনবোধই হয়তো মানুষকে অনেকদূর পথ দেখিয়ে দেয়। দলবদ্ধ সব সভ্য মানুষকে আগন্তুকের মতোন ‘কুয়োর ব্যাঙ’ বলা কি আর এমনিই সম্ভব! এর আগেই তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছেন, যূথবদ্ধ হয়ে তিনি মোটেও অনুতপ্ত নন। মিছিলের বাইরে গিয়ে তিনি দেখলেন, এ কি! আলো নেই, বাতাস নেই, চোখ অন্ধ, স্যাঁতস্যাঁতে। তার মধ্যে পড়ে থাকে সারাটা জীবন। কূপমণ্ডুকদের জীবনও একটা জীবন! বৈচিত্রহীন, অভিজ্ঞতাহীন, নিরস কিছু অভ্যাস যাপন করে যাওয়া কেবল।

আগন্তুক ছবিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় পৃথ্বীশের সাথে মনমোহনের কথোপকথনটা। এই কনভার্সেশনের উপসংহারে আমরা লক্ষ্য করি, পৃথ্বীশ চরম আক্রোশে বলছে, আপনি নো বডি না সামবডি, তা এদের বলে দিচ্ছেন না কেন? এই পুরো কনভার্সেশনের প্রশ্ন কিন্তু এটাই। অথচ এই প্রশ্ন কিন্তু বিভিন্নভাবে আগেও উচ্চারিত হয়েছে। সত্যকির সংলাপে আমরা দেখি, সে বলছে, তুমি আমার দাদু। হতেও পারো আবার নাও হতে পারো। কী অদ্ভূত না? একই প্রশ্ন দুই প্রজন্মের জবানে। কিন্তু একটা কী রুক্ষ আরেকটা কী কোমল! এর মাধ্যমে কী সাধারণ মনোযোগের অগোচরে সত্যজিৎ আরও একবার সভ্য-অসভ্যের সংজ্ঞা দিয়ে বসলেন? কাহিনী-বিন্যাসে তার দক্ষতার প্রমাণ রাখলেন বরাবরের মতোই। আমরা বোধহয় খুব তাড়াতাড়ি চলে এসেছি বিজ্ঞানের কল্পে। মানবিক ব্যাপারগুলোকে আমাদের আরও একটু সময় নিয়ে গভীরভাবে বুঝবার দরকার ছিলো। কোনো মন্তব্য ছাড়াই একটা উক্তি তুলে দেওয়া যাক। “সভ্য কে জানেন? সভ্য হচ্ছে সেই মানুষ, যে আঙুলের একটি চাপে, একটি বোতাম টিপে, একটি বোম নিক্ষেপ করে সমস্ত অধিবাসীসমেত একটা গোটা শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। সভ্য কারা জানেন? যারা এই অস্ত্র প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।”

 

চলচ্চিত্রে ভাষা আর দৃশ্যকল্প ব্যবহারে তার দক্ষতা নিয়ে বলার কিছু নেই। ছবি যখন প্রায় শেষের দিকে, তখন মুগ্ধ হবার মতো অসাধারণ একটা ব্যাপার কিন্তু সত্যজিৎ ফুটিয়ে তুলেছেন অদ্ভূত কিছু দৃশ্যের মাধ্যমে। আদিবাসীদের নৃত্যের সময় সুধীন্দ্র এবং অনীলা একসাথেই দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু পার্থক্যটা ধরা পড়ে ছন্দের সাথে দৃশ্যের মিলন যখন ঘটে। সুধীন্দ্র একজন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী মানুষ। ওদিকে অনীলা থাকে সংস্কৃতিমনা। এবং সুর নিয়ে তার চর্চা আছে। ফলে সুরের ওঠানামায় সে ছন্দটা ধরে ফেলে এবং মনের অজান্তেই সে হাত নাচাতে থাকে। একজন সাধারণ মানুষ আর সুরের জগতের মানুষ। সুরের অধিবাসীর যে আলাদা একটা ছান্দিক বিবেচনা বা কান থাকে, এই পার্থক্যও সুনিপুণভাবে বর্ণনা করলেন তিনি। এ তো রয়েছেই। পরের দৃশ্যে তিনি আদিবাসী আর তথাকথিত সভ্যের সাংস্কৃতিক মিলন ঘটালেন অনীলার নাচে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে।

শিশুচরিত্রের সাথে সত্যজিৎের প্রচণ্ড মায়াবী একটা সম্পর্ক সেই পথের পাঁচালী থেকেই। মাঝেমধ্যে মনে হয়, সেই সম্পর্ক খুব সম্ভবত স্নেহের পর্ব পেরিয়ে শ্রদ্ধায় স্থান নিয়েছে। নিষ্পাপ কোমলতার প্রতি তো শ্রদ্ধাই হয়, তাই নয় কি? “হাসির চেয়ে ভালো থ্যাঙ্কইউ আর হয় না” উক্তির মাধ্যমে বিশ্বাসটা আরও প্রবলভাবে জেঁকে বসে। শিশুদের প্রচণ্ড ভালোবাসেন কিনা, তাই হয়তো সেই প্রজন্মের মুখে কূপমণ্ডুক না হবার প্রত্যয় করিয়ে নিলেন। সব মানুষ তো আর তার কালকে অতিক্রম করতে পারে না। তবে সত্যজিৎ যে কাল পেরোনোর ক্ষেত্রে সফল, তা শেষবারের মতো প্রমাণ করে গেলেন ‘আগন্তুক’-এর মাধ্যমে। আরও শতবর্ষ প্রাসঙ্গিক থাকুন শক্তিমান এই চিন্তক চলচ্চিত্র-নির্মাতা।



ছবি: আগন্তুক

প্রারম্ভিক মুক্তি: ২২ মে, ১৯৯২ (নিউ ইয়র্ক সিটি)
পরিচালক: সত্যজিৎ রায়
সিনেম্যাটোগ্রাফি: বরুণ রাহা
গল্পের লেখক: সত্যজিৎ রায়
চিত্রনাট্য: সত্যজিৎ রায়

শেয়ার