জোকার / শুভ আঢ্য
(বেসিক্যালি খুব ব্যক্তিগত কিছু জায়গা থেকে আর বাংলাদেশের অসাধারণ শিল্পী অফ্রিদা তানজিম মাহীর অকালমৃত্যুর পর তাঁরই একটি ছবি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এই লেখা। ছবিটির জন্য কবি আন্দালীবের কাছে কৃতজ্ঞ। আর অনস্বীকার্য ঋণ কবি স্বদেশ সেনের প্রতি)
২৫
এবং তাঁতের বনে দেখো কি নীল, কে নিল…
তোমার নীলে অযথা বেগুনি মিশলো
আর ভাঙো, তাহাদের কথা, তাহাদের প্রিজম
যা কেবলই কেবিনে কেবিনে বেড়ে আছে গাছের মত
ববিনে ববিনে সুতোর ডেলার মতোও বেড়ে আছে
মেয়েটির কৌতুহলে জোকারের হাত পড়ল, তাদের
তাঁতের বনে পড়ে ছিল তাদেরই পোষা কুকুর,
তার গ্রাফ, তার চেয়ে থাকা কলের পুতুলের দিকে…
মেয়েটি চেয়েছিল কি নীল একটি জোকার ভয়ানক হয়ে
তাহাতে মিশবে… দেখো কি নীল, নিল কে…
অযথা বেগুনি লালেতে মিশলো, আর ভাঙো প্রিজম
সাদা হয়ে ভাঙো, তাদের নিভে যাওয়া তাঁতের বনে
২৬
এবং সে জানে মৃত্যু শুধুই একটা সময়
আলোড়ন তুলে আনা মেহেদি ফুলের মত নয় তা,
অথচ তার গন্ধ জোকারের টোম্যাটোরঙা নাকে লাগে
তার অর্থ জোকারের পিঠের ভেতর তাকে বলে –
স্থির থাকো, ওই দেখো মেয়েটির বুক বৃন্তহীন স্থির আছে
নত হয়ে আছে যেন শিলা জলেতে রয়েছে ডুবে আর
টুপ… শব্দটুকুও গচ্ছিত রয়েছে তার ভেতর
এ বড় স্থিরপদ এ খুব স্থিতি তুমি ভাবো হে জোকার
কিভাবে কোন ভানে তুমি ভাঙিয়ে উঠবে তা? ভাবো
শুধুই সময়ের ওপর একটি টোম্যাটো তুমি কিভাবে
বদলে দেবে? ভাবো কি করুণাময় মেহেদি ফুলটিকে
তুমি আলোড়নহীন ছেড়ে যাবে? যদিও মনে তুমি
রাখো মেয়েটিকে ঘড়িতে বসাও সময় আর মৃত্যু
শুধুই আলগা এক সময়ের বিক্ষেপ
কোনো বিকেল আর সন্ধ্যের মাঝে মেহেদি ফুলটির ওপর
২৭
এবং শুরুয়াৎ দেখো জোকার করেছে
যেন খেলা, যেন লাট্টুটির ওপর বসে আছে সময়
আর ঘুরছে যে তার নাম আলেকজান্দ্রা… এসো
আমরা বিরতি থেকে ফিরে দেখি মাঝের সময়ে
কি নিদারুণ অ্যামক্সিসিলিন থেকে জোকার দেখেছে
আলো, আর ছায়াটুকু তার তার গভীরে পড়ল, ওহে
শুরুয়াৎ দেখো, দেখো অতলান্তিক এক জাহাজের
ছায়ায় বেড়ে উঠছে তার ফুল… তার ফুলেল জামা
ঢেকে ওই আছে, ডেকে দেখো সেখানে সমুদ্রতট,
জোকার বালিতে রেখেছে মুখ… আর নিপাট সূর্য
আল্পস পেরিয়ে আলো ওই দেয়, ওহ্, কান্ট্রিসাইড
তার ছায়া, তার দু’দিনের বারোমাস… ঘুরছে ফিরছে
মুখে যেন লাট্টুটি ধরা আছে, দড়ি তার ছাড়ানো হবে
তখনই আর বিরতিতে আমরা তাদের আসল চেহারা
দেখে উঠবো, চিৎকার করে উঠবো, এ সার্কাসে
২৮
এবং ওই তো ঘুঘুর ফাঁদ দেখি পড়ে আছে
আছে ওই মেয়েটির মত, যেন সকালে
বুক খুলে স্তন ঠাসার নামে জোকারকে আসলে
একচোট খুন করে নেবে… নেবে সেই পুরানো দলিল,
গাড়ির ভেতর রাখা যা কিছু অবয়বহীন অথচ সবুজ,
অথচ বাষ্পময়, তার মোচন ঘটেনি যে, জোকারও
জানে না কি তা? সেই তো ফাঁদের প্রাকার ঘুরে চলে
ভালো ডালিমের পাশে খারাপ কথার মত ঘুঘুরঙা
এত তো পড়ে আছে ফাৎনা দেখেছে জোকার
মুখটুকু বাড়িয়ে দেখেছে দেখেছে নামিয়ে ওই
মেয়েটির মতো কি সে চেপে ধরবে… আলো না কি
হাড়হিম হেডলাইট, গাড়ির ভেতর সে শোনে শুধু
‘ডোন্ট গো অ্যাওয়ে হোয়েন দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ বার্নিং’
চলে বেজে গান যেন ফাঁদ কোনো আর সে তা’তে বসেছে
২৯
এবং তাহাদের ঝাঁপি খুলে খুলে-আম ঝাঁপ
আর জানলা জুড়ে বরফ তবু কবেকার টবে
কে যে ফোটালো ফুল কালও তার নাম বর্তমান
এবং পেট ওই বর্তুলাকার ওঠে নামে তাহাতে
জোকার জুনিয়র পোকা লাগে, খোলে পোকা
তার দরোজা খানিক মুখটুকু দেখায় আর শরীর সে তো
রেখেছে লুকিয়ে আর ঝাঁপ তার, তাল তার
কোন পাহাড়ের খাদ থেকে পড়ে যে কোথায়
এবং ইকো আর সিস্টেমেটিক ডায়াস্টোলে রক্ত ফুলছে
ফোলে দেখো জোকারের গান, পথপাশে
ঝাঁপ ওই পড়েছে যেখানে সেখানে চিৎকার হয়
মেয়েটি জানে, জান তার জানাজা পেরিয়ে
উঠে বসে, জানাজানি হয়, কানাঘুষো ওহ্ জোকার
দাও খুলে-আম জঙ্গলে ঝাঁপ ওই পেট আর বর্তুল ওই
ভালবাসো, তার নিচের আঁধারটুকুও বাসো খানিক ভালো
৩০
এবং এত যে পাখিডাক তার সমস্তটুকু ঘিরে
বুকের ভেতর চর আর করাতের আনাগোনা
শোনে কি রাশিয়ান? কখনও কি কারুবাসা ঘিরে
ওঠে কি এতটুকু ছলাৎ এতটুকু জমানত
সাজিয়ে রেখেছে কি সে জোকারের প্রাণের ভেতর?
ওই অভয়ারণ্য ঘিরে তাহাদের ছোটোছোটো বাড়ি
তার চেয়েও ছোটোখাটো বাদামের খোলার মত দিন
ভেঙে যায় সরোবরের পাশে দরবারি কানাড়ার মত
শোনো ওহে রাশিয়ান… যত ওই পাখিডাক থাকে
খাঁচার ভেতর জেনো ততধিক জোকার তাসে বসে থাকে
বসে থাকে পাশে বিনম্র দিনের মত নামিয়ে মুখ যেন
এতটুকু আভা জোকারকে দিল ছায়া আর আনাগোনা
অগুন্তি করাতের ভেতর ভেতর প্রাণে ও পরশে
৩১
এবং তার ভেতর পতন, আহা শব্দ তার
চুঁইয়ে পড়ছে বনপাহাড়ের ডাকে, ওই রাশিয়ান
সেখানে আসেনি, বলেনি তো সন্ধ্যের সময় যেটুকু
কালোবাড়ি থেকে মুখ খুলে আনে তারা সেটুকুই
ব্লার হওয়া ফোটো, আহা ফোটো তার… সেই কি ভীষণ
উজ্জ্বল সরোবর যেন, তাহাতে পাঁচটি হাস ডুব দেয়
আর ভেসে ওঠে যা, তাই’ই তো মৃত আত্মা
এ শরীর ক্ষেত… কৃশকায় ক্ষেতে পতন তার এবং
ওহ্… ছেড়ে দাও, যীশু আমাদের ছেড়ে যাওয়া ভালো
কিংবা আরও ভালো টিলার ওপর থেকে ঝাঁপ দেওয়া
মৃতদেহ দুটি যা শাদা ফ্যাটফ্যাটে বাতাসে ভাসছে, যদিও
পতন… আর শব্দ তার নড়ে ওঠা বনে এতটুকু হাওয়া
বয় দেখো যেখানে সেখানে
এবং শেষতক মুখ খুলে বলা, হে জোকার
দাও খুব ছেড়ে ওই পতনের ভেতর নিজেকে, দেখো
সন্ধ্যের সময় কালোবাড়ি, বাদামের পথ আর ফুটেছে
কতটুকু, কতটুকু ক্ষেতে আর ফসল উঠেছে, নষ্টই বা
হয়েছে কতটুকু ফোটোর ভেতর আমাদের মুখ
৩২
এবং পায়রার ডানায় ভর করো সকাল
অথচ এই জল, এই ভেজা পিচ জোকার চিনেছে যেমন
কাজুবনে গামিনী মেয়েটি জেনেছে ছায়া মানে সে’ই
আর দাঁতের ভেতর নড়েচড়ে বসেছে তাহাদের চুমু
তাজা রুটির মতোই, এই সকাল ভরো পায়রার ডানায়
আর পারো তো পরগণা ঘিরে বসাও সার্কাস,
ওহ্, সেই টোম্যাটো রঙের নাক, ক্ষুদে দাঁত বসো
ওপর আমার, যেন সকাল পরীটিতে বসেছে
যেন পরকীয়া ওই জলে ভেজা করুণার ভেতর
ঘুঘুটির মত আছে বসে, একচোখ… তাকাও তাকাও
শুধু বসো, যেভাবে শরীরসরণি বেয়ে কাজুবনে
হাসে মেয়েটির গজদাঁত, দেখো সেভাবে… করো,
ভরাট সকাল তুমি, টোম্যাটোর বনে করো, জোকার হে
৩৩
এবং তার সবটুকু নাও, মুদ্রার ভেতর
দোষটুকু, তার ভেতর ধাতুটুকু অবয়বখানি
নাও, গলুইয়ের জলটুকুও, শুধু বড় ঢেউখানি
যা তোমায় অন্ধ করে, যা তোমায় আলোর অধিক
দুই শতাংশ উজ্জ্বল করে তোলে এ সার্কাসে তেমন
আয়নায় সাজাও তাকে হাসের মত যেন জল, এক্ষুনি
ডুবে উঠবে শব তোমার, আর হাসিগুলো খুবলে যাবে
তোমার অঙ্গ, এ ছবি আর শুধুই তরঙ্গময় এ হাসি
শুধুই ব্যথানাশক চাপা কথা ফুটে যাবে – এমন কথা
জোকার ভাবে, আর দিনমান অভ্রের মত উড়ে যায়
অস্থির ঝিলের ওপর বয়ে যায় ভিন অক্টেভে, শোনো
রাশিয়ান ফল, শোনো বিহার শেষে
মুদ্রার দোষটুকু নিয়েছিল সে, ভরে নিয়েছিল
৩৪
তার ওইটুকু আলো, বাকিটুকু প্রসাধন
গরীবখানা জুড়ে সকাল নেমেছে, জোকার
নেমেছে আলোয়, তার ওইটুকুই আততায়ী হাসি
আর বত্রিশের কোঠায় একটিই মেয়ে, রাশিয়ান
দু’চোখের কিনারায় খসে পড়ছে টসকানো সকাল
মাখনের ওপর ঝরে পড়ছে লোভ, লোভের ওপর
একনাগাড়ে মোমবাতি মেয়েটির, গতরাত শুধুই
আঙুল… তার ওইটুকুই সুখ, বাকিটুকু প্রসাধন
গরীবখানা জুড়ে এক পা, দু’পা করে জোকার নামছে
গুটিসুটি নিঃশব্দে নামছে সকাল এমন
তাদের বাকিটুকু নেই, শুধুই আবডালে প্রসাধনী আছে
রঙ আছে, আধারিত অবয়ব তারা, শুধুই ঘুরছে
চোখ সেই… ঘুরছে, তাদের ওপর, বাহিরমহলে
কবিকথা
যতটুকু যা লেখালিখি সিরিয়াসলি, সবই ২০১৫’র পর থেকে। আগে যেমন মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে হয়ে থাকে, ‘খোকা একটা কবিতা শুনিয়ে দাও তো, কাকুকে’ তেমন; আর স্কুলে, কলেজে টুকটাক, হাতের আড়ভাঙা বলা ছাড়া আর কি’ইবা বলা যায় তাকে। তো আড় ভাঙল। ভাঙল এমনই আর উঠে তো দাঁড়ানো গেল না কোনোভাবেই। আচ্ছা, কবিতার দায় কি? বিপ্লবের অস্ত্র, রেশনের খরচ? কোনোটাই তার কাছে নয়। তার যাবতীয় লেখালিখি জোর করে, না পেরে হাঁপিয়ে উঠে। কবিতা ক্রাফট যেমন, তেমন ফ্লো’ও বটে। শুধু ছেনি হাতুড়ি নিয়ে বসে গেলাম, আর রোদে পিঠ পুড়িয়ে প্রচুর ঘাম ঝরালাম তা’তে কিছুটা হলেও কবিতা পালায় (তার মানে এই নয় যে এখানে শ্রমকে অশ্রদ্ধা করা হচ্ছে) তবে কিছুটা তো ভেতর থেকেও আসে। মানে ধরুন আপনি প্রভূত মদ খেয়েছেন, কথা বলার জন্য আপনার পাশে একটি মেয়েও নেই সমমনষ্ক, ধরুন আপনি রগরগে বলিউডি সিনেমা দেখতে পারবেন না, তো আপনি কি করবেন? সামান্য লেখালিখির অভ্যেস থেকে এভাবেই কিছুটা লিখে ফেলা হয়। নেশার বাইরে বসেও যে লেখা হয় না একথাও সত্যি নয়, আসলে সব সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলা যায় নাকি! ও আপনি গ্রে ব্যাপারটা ঠিকই ধরে ফেলবেন, এ বিশ্বাস বা ঘোষ বা চক্রবর্তী থাকা উচিৎ। পড়াশুনো যৎসামান্য, সে অ্যাকাডেমিক দিক থেকেই হোক বা এই ‘মার্কেটে’। হ্যাঁ, এ’-ও এক মার্কেট, যেখানে বায়ার যে সেলারও সে। মানে সমসংখ্যক বায়ার এবং সেলার একে অপরে রূপান্তরিত হচ্ছে সদাসর্বদা। এই ফেসবুক আসার পরে তো বটেই। এটুকুই। নিজের লেখাকে কবিতা বলে দাবি করেন না যে, তার কাছে কবিতা যাপন যারপরনাই একটি পাথরের মতো শব্দ, যাতে তিনি চাপা পড়ে যান। শেক্সপীয়রের রঙ্গমঞ্চ ব্যাপারটি খুবই জটিল যেমন কবিতা তৈরি হবার প্রক্রিয়া। নিজেকে জোকার ছাড়া কিছুই মনে না করা একটি লোক, যে ওই মদ খেয়ে সমমনষ্ক মানুষের অভাবে নির্বান্ধব হয়ে কিচ্ছু করার না পেয়ে শুধুই উদগীরণ করে চলেছেন। শুধুই উদগীরণ। পাঠক, আপনিই তো বলবেন এগুলো কবিতা হয়ে উঠল কিনা, নাকি শুধুই একজন জোকার, আলো নিভে গেলে যে কেবলই তার ছায়ার সাথে সঙ্গম করে উঠবে।