মাইরি বলছি, বাংলা কবিতায় অন্ত্যমিল দেওয়ার সময় ‘কেউ’-এর সঙ্গে কত ‘ঢেউ’ দেখলুম, ‘ফেউ’ও দেখেছি দু’একবার। কিন্তু ‘ঘেউ’ চোখে পড়লো না একবারটিও। ভাবুন তো, প্রয়োজনীয় পরিস্থিতিতে একটি ‘ঘেউ’ কী পরিমাণ ব্যঞ্জনা আনতে পারে! ‘হঠাৎ পেছন থেকে কেউ/ ভালোবেসে ডেকে গেল ঘেউ’- এই দেখুন, একটি সার্থক প্রেমের টু-লাইনার লিখে ফেললাম। ‘ঘেউ’ শব্দটির যে ব্যবহারিক ইমেজ, আক্রোশ, যে বিরক্তি- তা ভেঙেচুরে কেমন আদরে পরিণত করলাম! ‘ভালোবেসে ডেকে গেল ঘেউ’। আহা! একটি নরম পিছুডাক। পাঠক, ‘ঘেউ’ কে এখনও কুকুরের ডাক হিসেবেই দেখছেন? সামান্য কুকুর থেকে অসামান্য প্রেমিকায় কি উত্তরণ হলো না শব্দটির?
যুগ যুগ ধরে প্রচারিত হলেও কুকুরের সীমায় ‘ঘেউ’টিকে বেঁধে রাখতে আমি নারাজ। এবং এখানেই এক তরুণ কবির স্পর্ধা। বললে বিশ্বাস করবেন না, সময়ের নিয়মে শব্দটির স্বত্ত্ব ক্রমে মানুষের হাতে এসে পড়েছে। কুকুর এখন ‘ভৌ’ আর ‘কুঁই কুঁই’ ছাড়া কিছুই বলতে পারে না। এ দুটির ওপরেও মনুষ্যথাবা এগুচ্ছে ক্রমশ। অচিরেই দেখতে পাবেন, চাকরির ইন্টারভিউয়ে প্রশ্নকর্তার উত্তরে প্রার্থী নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলছে – ‘কুঁই কুঁই কুঁই, ভৌউউউ…’ অর্থাৎ ‘ইংরিজিতে এতো প্রশ্ন করবেন না স্যার, বেকার ছেলেপুলেকে আর কত মুরগি বানাবেন?’ দেখুন, মুরগি কুকুর আর মানুষ কিভাবে একাত্ম হয়ে গেল একটি জবাবে। মিথোজীবীতার এহেন অ্যাঙ্গেল নিয়ে কেউ এর আগে ভেবেছে কি?
এটাও সত্যি, একুশ শতকেও ফাঁকা রাস্তা পেলে নেড়িকুত্তাগুলো তাদের আদিম প্রবৃত্তিতে ফিরে যায়। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এক শুনশান দুপুরে সাইকেল চেপে ফিরছি, দল বেঁধে পেছনে শালারা। ‘কুত্তার বাচ্চা’, ‘শুয়োরের বাচ্চা’ ইত্যাদি কোনও উপমাই যখন কাজে লাগল না তখন মনে পড়ল, বাঙালির সব দুঃখ-কষ্টের সমাধান রেখে গেছেন রবিঠাকুর। ফলে জ্ঞানী-জ্ঞানী মুখ করে কুকুরগুলোর দিকে তাকিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে বললাম– ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/ আমি তোমাদেরই লোক।’ বাঙালি কুকুর বলেই বোধহয় রবিঠাকুরের মর্ম বুঝল না। উল্টো তেড়ে কামড়াতে এলো ক’জন। সেদিন কোনো মতে বাড়ি ফেরার পরে শাশ্বত রবিঠাকুর মনে আসেননি আর, বরং উঁকি দিচ্ছিলেন হেলাল হাফিজ– ‘আমিও গ্রামের পোলা চুতমারানি গাইল দিতে জানি।’
কিন্তু এরকম দু’একটা ছুটকো কারণে সমগ্র কুকুরজাতিকে ‘ঘেউবাদী’ আখ্যা দেওয়া উচিৎ নয়। সে পেটেন্ট এখন রাজনীতিক আর বুদ্ধিজীবীদের দখলে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ‘কুঁই’ গোত্রের প্রাণী। কাজেই বন্ধুবান্ধবদের দেখলে আনন্দ হওয়া স্বাভাবিক! গত সপ্তাহে দোকানে মিষ্টি কিনতে গেছি, হাফপ্যান্ট পরা। হঠাৎ পায়ে একটি থাবড়া। পাত্তা দিলাম না। আবার, একটু জোরে। মুখ ফিরিয়ে দেখি একটা কুকুর বজ্রাসনে বসে ছলোছলো চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মাংস ছেড়ে মিষ্টি খেতে চায়! কুকুরটির এমন সাত্ত্বিকতায় আনন্দ হলো খুব। চোখদুটো দেখে মনে পড়ল, ছেলেবেলায় আমিও ঠাম্মার কাছে এভাবেই আবদার করেছি একটু আলুভাজার জন্য। না, মিষ্টি কিনে খাওয়াইনি তাকে। তবে পায়ের থাবড়াটুকু পুষে রেখেছিলুম বহুক্ষণ। স্ট্রাগল ফর একজিস্টেন্সের এই প্রতিক্রিয়াগুলি একমাত্র কুঁইগোত্রভুক্ত প্রাণীরাই বুঝতে পারে।
যে যাই বলুক, ‘ভৌ’ যে একটি ইউনিভার্সাল ল্যাংগুয়েজ তা অনস্বীকার্য। আদর-আনন্দ-আবদার বোঝানোর জন্য এর থেকে ভালো ভাষা আর নেই। প্রেমিকার কাছে আদর খেতে ইচ্ছে করছে? আধো-আধো গলায় বলুন– ‘ভৌউউউ’, কিছুটা টেনে-টেনে, যাতে ‘বৌ’ এর মতো লাগে শুনতে। শত্রুকে ল্যাং মেরে আনন্দ পেয়েছেন? আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠুন– ‘ভোউউউউউউ’। পরের তিনদিন গলা ভেঙে না থাকলে বুঝবেন, পারেননি ঠিকঠাক। আসলে ‘ভৌ’-ডাকের কিছু নিয়ম আছে। আপনার গলাটিকে নিদেনপক্ষে সঙ্গীতশিল্পী বা, বাচিকশিল্পীর মতো হতেই হবে। এবং নাকে সর্দি থাকলে চলবে না।
সবশেষে, একটা ফর্মুলা জানাতেই পারি, প্রতিবাদের ক্ষেত্রে ‘ঘেউ’, আবেদন-নিবেদনের ক্ষেত্রে ‘ভৌ’ আর দুঃখ-কষ্টের বেলায় ‘কুঁই কুঁই’ রপ্ত করতে পারলেই কেল্লাফতে। বাড়ির লোককে আলাদা করে কুকুর পুষতে হবে না। দু’বেলা ফ্রি মাংস-ভাত পাবেন, যতক্ষণ খুশি ঘুমোবেন, পাবেন লয়ালিটির ইমেজ। আর হ্যাঁ, যদ্দুর সম্ভব ফোক কুকুর হওয়ার দিকে এগোন। আজকাল শৌখিনদের বাড়িতে নেড়ি পোষার চল হয়েছে বেশ!