গেল জুমায় ইমাম সাহেব সুরা কাহাফের তাফসিরে আসহাবে কাহাফের গল্প বলেছিলেন। রোমের সাত যুবক খোদাদ্রোহী শাসকের হাত থেকে ইমান বাঁচাতে গুহায় আশ্রয় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই ঘুমের ওপর উত্থান-পতনের তিনশটি বছর কেটে যায়।
আমাদের তালতলা লেনের ভাড়াবাড়ির ওপর নওল সূর্যের ছায়া পড়েছে। পেপার হাতে দোতলার ঝুল বারান্দায় বসতে বসতে নরোম রোদের চনমনে স্পর্শটুকু অনুভব করি। আমার এই বারান্দা ছুঁয়ে ঝাঁকড়া মাথার এক পেঁপে গাছ দাঁড়ানো। সকালের অনাবিল বাতাসে পেঁপের পাতা এক একবার বারান্দার গ্রিল ছুঁয়ে সরে যাচ্ছে। যেন গ্রিলের সাথে তার এক অদ্ভুত ছোঁয়াছুঁয়ির খেলা।
ঝাঁকড়া সবুজ মাথার ওপর আজ সচেতন চোখ পড়তেই চমকে উঠি। দেড় বছর আগে যখন এখানে সংসার পাতি, পেঁপে গাছটা মানব শিশুর মতো ছোট্ট ছিল। কবে কবে যে দোতলার গ্রিল ছোঁয়ার মতো বড় হয়ে উঠল, টেরও পাইনি। একবার মনে হলো রত্নাকে ডাকি, দেখাই গাছের তরতর করে বেড়ে ওঠা। ও খেয়াল করেছে কি না জিজ্ঞেস করি। পরক্ষণে ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখি। রত্না রাঁধছে। কিচেন থেকে ডিম ভাজির সুবাস আসছে আর খুন্তির টুংটাং আওয়াজ।
পেঁপে গাছটা কি জানে আমরা ছয় বছরের চেষ্টার পরও নিঃসন্তান? এতদিনে জেনে যাওয়ার কথা। নয়তো কেন ওর এত দ্রুত বড় হয়ে ওঠা! ধাতব গ্রিল হটিয়ে আমার পা ছুঁয়ে কেন ওর আদর খাওয়ার খায়েশ! নিচু হয়ে ওর খসখসে পাতায় হাত বুলিয়ে দিই, যেভাবে বাবারা কিশোর ছেলের চুলে আঙুল ঢুকিয়ে আদর ছড়ায়। আমার হাতে ওর সবুজের গন্ধ লেগে যায়। আমি কষকষ গন্ধের ভেতর শিশুর খলবল হাসির শব্দ পাই।
শান্ত হারিয়ে যাওয়ার পর আমাদের নিঃসঙ্গতা বেড়েছে। শান্ত ছিল আমার সন্তানতুল্য ছোট ভাই। আমার কাছে থেকে ও ইউনিভার্সিটিতে পড়ত চারুকলায়। দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই জড়িয়ে পড়েছিল বাম রাজনীতির সাথে। ওর হাতে ছিল খোদপ্রদত্ত এক জাদুকরী ক্ষমতা। কত রকম কার্টুন যে এঁকেছে ওর তরুণ হাত! তারপর একদিন শেষ রাতের চাঁদের মতো দুম করে হারিয়ে গেল। আমরা আজও ওর শেষ চিহ্নটুকু খুঁজে বেড়াই। আজও নিয়ম করে তাকিয়ে থাকি রকির দোকানের সামনে দিয়ে নদীর মতো বয়ে যাওয়া রাস্তার পানে। একদিন নিশ্চয় মায়াবী হাসি ছড়িয়ে, নদীর মতো রাস্তা ধরে ও ফিরে আসবে আমাদের সংসারঅরণ্যে।
পেপারে মন বসে না। কোনো ভালো খবর নেই। এগারোটা খুন, চারটা গুম, পাঁচটা ধর্ষণের সংবাদ। ফ্লাইওভারের গার্ডার ছিঁড়ে মারা গেছে আরো তিনজন। সময় নিয়ে গোসল করে খেতে বসি। তখনই ফোন আসে জুয়েলের। রকির দোকানে নাকি এক আজব ঘটনা ঘটেছে। অনেক দিন বাদে আজ একটু দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করে আমার। ইদানীং ইউরোপ থেকে প্রেমের টানে অনেক মেয়ে বাংলাদেশে চলে আসছে। গেল মাসে আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাটে ফ্রান্স থেকে এসে জুটেছে এক মেয়ে। তাই নিয়ে কত হইচই! সেই উপলক্ষ্যে একদিন অফিসও কামাই দিলাম। সেদিকে ইঙ্গিত করে বলি, আজব ঘটনা! এবার ব্রাজিলের কোনো মেয়ে চলে আসল নাকি!
আরে না না! তারচেয়েও আজব। তুই শিগগির আয়।
জুয়েল ম্যান্দামারা ছেলে। কিছুটা বোকাও। জগতের কোনোকিছুই ওকে উত্তেজিত করে না। সেই জুয়েলের কণ্ঠে যখন চিকন তারের টোন—নিশ্চয় গুরুতর কিছু। খুশি হয়ে উঠি—আজ বোধহয় অফিসে না গেলেও চলবে। বেরোনোর আগে রত্নাকে চুমু খেয়ে যাই প্রতিদিন। আজ তাড়াহুড়োয় চুমু দিতে ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম দুই বোগলে পারফিউম স্প্রে করতেও। মাঝ সিঁড়িতে যখন মনে পড়ল, তখন আর ফেরার সময় নেই। টিউবের পেস্ট এবং অফিসের কামলা একবার বেরিয়ে গেলে আর ফেরত আসে না।
বাইরে এসে হোঁচট খেলাম। যে কোনো আজব ঘটনার সাথেই ভিড়ের সম্পর্ক আছে। যেখানেই আজব ঘটনা সেখানেই ভিড়। অথচ বাইরেটা বসের টাক মাথার মতো ঠা ঠা করছে। রকির চায়ের দোকানে বসে আছে জুয়েল। পাশের চাঙে এখনই উঠে দাঁড়াবে ভঙ্গিতে বসা এক অচেনা যুবক, কিছুটা সন্ত্রস্ত। যুবকের পায়ের কাছে নতজানু বসা এক কুকুর। অফিস কামাইয়ের আশা ভঙ্গ হলো। যে ঘটনায় জনারণ্যের অংশগ্রহণ থাকে না, সেই ঘটনায় অফিস কামাই করা যায় না। বিরক্ত হলাম জুয়েলের কাণ্ডজ্ঞানের ওপর। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি দোতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রত্না। গ্রিলের ফাঁকে ওর উৎসুক মুখ বিস্ময়কর গল্পের সাক্ষী হতে ব্যগ্র। একবার হাতের ফরসা কব্জি বের করে ‘কই’-এর ভঙ্গি করল। রত্নার ওই মুদ্রিত ভঙ্গিটা ধার নিয়ে আমিও কব্জি নাড়লাম জুয়েলের দিকে—কই?
আমাকে দেখেই ছুটে এল জুয়েল। ঠোঁটের ওপর তর্জনীর চাপ বসিয়ে ফিসফিস করল—আসহাবে কাহাফ! আসহাবে কাহাফ!
গেল জুমায় ইমাম সাহেব সুরা কাহাফের তাফসিরে আসহাবে কাহাফের গল্প বলেছিলেন। রোমের সাত যুবক খোদাদ্রোহী শাসকের হাত থেকে ইমান বাঁচাতে গুহায় আশ্রয় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই ঘুমের ওপর উত্থান-পতনের তিনশটি বছর কেটে যায়। তাদের সঙ্গে ছিল কিতমির নামে এক কুকুর। কুকুরটিও তিনশ বছর ঘুমিয়ে থাকে গুহায়। তারপর একদিন জেগে উঠে তারা প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব করে। পরামর্শের পর সাত যুবকের এক যুবক ছদ্মবেশ নিয়ে দোকানে যায় রুটি কিনতে, তিনশ বছর আগের মুদ্রার থলে হাতে। বাজারের লোকজন দাগিয়ানুসের যুগের মুদ্রা দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। তারা যুবককে আটকে রেখে জেরা করতে থাকে। যখন তারা জানতে পারে, যুবক অত্যাচারীর শাসকের জুলুম থেকে বাঁচার জন্য গুহায় আশ্রয় নিয়ে অলৌকিক ঘুমে তিনশ বছর কাবার ফিরে এসেছে লোকালয়ে, তারা কান্নায় ভেঙে পড়ে। তাদের এই কান্না আবেগের। কারণ—ততদিনে রোমের চেহারা বদলে গেছে। রোমে এখন ইনসাফের সুবিমল হাওয়া। এই যুবক ও তার বন্ধুদের ওপর নিপীড়নের বীভৎসতা কল্পনা করেই তাদের কান্না।
আচমকা আমি কুকুরটির দিকে তাকাই। ইমাম সাহেবের বর্ণনার সাথে কুকুরটির বসবার অবিকল মিল। পেছনের দুই পা ভেঙে সামনে মেলে দেয়া দুই হাত। জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে আছে সামনের দিকে, যেন গুহার মুখে পাহারারত কিতমির।
গল্পের জন্য আমার কাতরতা আছে, তাই বলে গাঁজাখুরি গল্পের প্রতি কোনো আগ্রহ বা প্রশ্রয় নেই। কিন্তু জুয়েল নাছোড়। সে আমার হাত ধরে টানতেই থাকে—তোর পকেটে এক টাকার নোট আছে একটাও? নেই। এক টাকার নোট এই যুগে দুষ্প্রাপ্য। অথচ ওই যুবকের পকেটে আট আটটা এক টাকার নোট। তাও আবার ১৯৮৩ সালের।
হঠাৎ আমার শিরদাড়া বেয়ে ভয়ের ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়। কদম তুলে সামনে আগাব কিংবা ঘাড় ঘুরিয়ে রত্নাকে দেখব—পারি না। এক মুহূর্তে ডিপফ্রিজের ইলিশ মাছের মতো অসাড় ও অবশ হয়ে উঠি। আমার বিহ্বলতা কাটে না, যতক্ষণ না দ্বিতীয় বাক্যের অবতারণা করে জুয়েল : এই লোক এরশাদের আমলের টাকা দিয়ে রুটি কিনতে আইছে। রকির চায়ের দোকানের চাঙে এখনই উঠে দাঁড়াবে ভঙ্গিতে বসে থাকা যুবকের দিকে ইশারা করে জুয়েল।
বলিস কী! এরশাদ! বাংলাদেশ এরশাদের আমল ছেড়ে এসছে তেত্রিশ বছর আগে। অঙ্কে পাকা আমি তৎক্ষণাৎ হিসাব করে ফেলি। তারপর বলি, লোকটা এসছে কোত্থেকে?
জুয়েলের ঠোঁটে যেন কথা টাইপ করাই আছে—গুহা থেকে।
একটু আগের বিহ্বলতা কিংবা গা ছমছমে ভাব এবার দূর হয়ে যায় আমার। বুঝতে পারি, জুয়েল ফাজলামি করছে অথবা কোনো ফ্রডের খপ্পরে পড়ছে। আমি জেরার ঢঙে বলি, লোকটা তোকে বলল গুহার কথা?
তবে আবার! জুয়েলের উত্তেজনা একটুও নিম্নমুখী হয় না কিংবা বাতাসের ঘায়ে সলতের আগুনের মতো কেঁপেও ওঠে না। সে একই রকম আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমার হাত ধরে টানতে থাকে দোকানের দিকে এবং বলতে থাকে কথা। ওই সামান্য পথের দূরত্বে ও হড়বড় করে যা বলে, তা এই : রকির দোকানে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল আর চা খাচ্ছিল জুয়েল। চা তখনো কাপের গলা থেকে নামেনি, কুকুর-সহ অদ্ভুতদর্শী লোকটার আবির্ভাব ঘটে দোকানে। ঢোলা প্যান্টের ওপর ছাই রঙের ফুলহাতা শার্ট। কাঁধছোঁয়া মনোরোম বাবরি চুল। ক্লিনশেভ মুখ তবে ঠোঁটের ওপর দ্বিতীয় বন্ধনীর স্টাইলে কুচকুচে কালো গোঁফ। আশির দশকের বিখ্যাত নায়ক ওয়াসিমের মতো অনেকটা। বেশবাশে ওয়াসিম লাগলেও যুবকের মুখজুড়ে নায়ক জসিমের ক্ষুধার মালিন্য। সে খুব সন্তর্পণে রকির কাছে আটটা বনরুটি চায়। যুবকের বেশ এবং ইতিউতি দৃষ্টিপাত জুয়েলের মনে ঘনীভূত করে সন্দেহ। সে জিভ-ঠোঁটের ব্যবহারে চা খায় আর কান পেতে রাখে যুবকের মুখের কাছে। আটটা বনরুটির মূল্য হিসেবে সে যখন এক টাকার আটটা কাগুজে নোট বাড়িয়ে ধরে, তখন হতভম্ব হয়ে যায় রকিসহ জুয়েল। কতদিন আগে এক টাকার নোট চোখে দেখেছিল জুয়েল, স্মৃতি হাতড়েও মনে করতে পারে না সে। কিশোর রকি খেঁকিয়ে ওঠে—আটটা রুটির দাম আশি টেকা। আপনে আট টেকা দেন কোন হিসেবে!
যুবকের হিরোচিত নরোম চেহারায় এবার বিদ্রোহ ফুটে ওঠে। সে ভাষায় কোমল এবং ভঙ্গিতে কঠোর হয়ে বলে, এক টাকার রুটি রাতারাতি দশ টাকা হয়ে গেল কীভাবে?
যুবকের কথায় মজা পেয়ে যায় জুয়েল। সে অসমাপ্ত কাপ ফিরিয়ে দিয়ে পূর্ণ মনোযোগী যুবকের দিকে—তারমানে আপনি বলতে চাইছেন, গতকাল এই বনরুটির দাম ছিল এক টাকা পিস?
অবশ্যই। যুবকের আত্মবিশ্বাস টনটনে।
জুয়েল তাড়াতাড়ি নোটগুলোর ওপর নজর বোলায়। সবগুলো নোটের ছাপা সাল ১৯৮৩।
কোনো পাগলের পাল্লায় পড়েছে এবং বিলম্বে রুটিগুলো খোয়া যেতে পারে ভয়ে যুবকের হাত থেকে রুটির প্যাকেট কেড়ে নেয় রকি এবং বলে, আশি টেকার এক পয়সা কম হলেও দেয়ার সাধ্য নাই।
যুবক তখন মিনতি করে—আমার কাছে এর বেশি টাকা নেই এবং আমার সাথীরা ক্ষুধার্ত।
সাথীরা মানে? কোথায় তারা? জেরার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে জুয়েল।
গুপ্ত আস্তানায়।
যুবকের স্মৃতিভ্রষ্টতা বিষয়ে রকির কোনো সন্দেহই থাকে না আর, কিন্তু জুয়েলের সামনে নেচে ওঠে রহস্যের মায়াবী পর্দা। কিনতে চাওয়া আটটি রুটি সাক্ষ্য দেয়—সংখ্যায় যুবকেরা সাতজন এবং কুকুরসহ আট, ঠিক যেন সুরা কাহাফের গুহাবাসীর মতোন এবং তার পরপরই বন্ধুকে ফোন দেয় জুয়েল।
আমি থমকে দাঁড়াই। গল্পের জন্য আমার কাতরতা আছে, তাই বলে গাঁজাখুরি গল্পের প্রতি কোনো আগ্রহ বা প্রশ্রয় নেই। কিন্তু জুয়েল নাছোড়। সে আমার হাত ধরে টানতেই থাকে—তোর পকেটে এক টাকার নোট আছে একটাও? নেই। এক টাকার নোট এই যুগে দুষ্প্রাপ্য। অথচ ওই যুবকের পকেটে আট আটটা এক টাকার নোট। তাও আবার ১৯৮৩ সালের। মানলাম সে কোনোভাবে ম্যানেজ করছে নোটগুলো, কিন্তু সেই টাকায় সে কেন রুটি কিনতে আসবে! তার কি মান অপমানের ভয় নাই!
কথায় যুক্তি আছে। জুয়েলের সাথে আমি দোকানের সামনে যাই। নতুন গড়ে ওঠা এই পাড়ায় একটাই চায়ের দোকান। দোকানের মাথার ওপর বকুল গাছের ছাতা। পাতলা বসতি। ন’টা ছুঁই ছুঁই সকালেও তাই জনশূন্য রাস্তা। আমি, জুয়েল, রকি আর রাহস্যিক অথবা ভণ্ড যুবক—চারজনে কতটাই-বা ভরাট করতে পারি মহাশূন্যের গর্ভ। ও হ্যাঁ, আর আছে একটা কুকুর। জুয়েলের ভাষায় কিতমির। আমি উল্টোপাশের চাঙে বসতে বসতে কুকুরটির চোখে চোখ রাখি। অমনি হাজার বছরের পুরনো, সোঁদা গন্ধযুক্ত গা ছমছম অনুভূতি ভর করে আমার শরীরে। আমি আড়ষ্ট হয়ে যাই। আমি বিপন্ন হয়ে উঠি। কুকুরের অদ্ভুত জ্বলজ্ববলে চোখ থেকে আমি কোনোভাবেই সরাতে পারি না চোখ। ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে—পুরনো দিনের পোশাক, চুলের কাটিং, মুদ্রা সবই সংগ্রহ করা যায়; কিন্তু এই রকম একটি কুকুর সংগ্রহ করা যায় না। মন বলে, হাজার বছরের ইতিহাসের মাটি ফুঁড়ে আসহাবে কাহাফের সেই অলৌকিক কুকুর নিদ্রা ভেঙে চোখ মেলেছে আমাদের তালতলা লেনের ভাড়াবাড়ির সামনে। যুবকের প্রতি আমি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ি। আমার ষষ্ঠ ঈন্দ্রীয় বলে দেয়—আসহাবে কাহাফের মতো এই যুবকের জীবনেও আছে বেদনার কোনো গল্প, যা শোনার জন্য প্রয়োজন শিশির ঝরার মতো নৈঃশব্দ্য। আমি তাকে বনরুটি ও চা খাওয়াই। যুবক তেত্রিশ বছরের প্রাচীন ক্ষুধা নিয়ে বনরুটি ও চা চোখের পলকে নিঃশেষ করে। গুহায় থাকা অবশিষ্ট সাথীদের রুটির প্যাকেট তার হাতে গুঁজে দিয়ে বিল শোধ করি। এরপর জুয়েল ও আমি তাকে নিয়ে হাঁটতে থাকি পুবের রাস্তা ধরে। আমাদের পেছন পেছন হাঁটতে থাকে কিতমির।
আমার জবাবের প্রেক্ষিতে চেহারা থমথমে হয়ে ওঠে আরমানের। সে পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। যেন পোড়োবাড়ি অথবা গুহার চেয়ে নিরাপদ, প্রার্থিত কোনো আশ্রয় তার জানা নেই।
যুবকের নাম আরমান। আশির দশকের প্রবল স্বৈরতন্ত্র আরমান ও তার ছয় বন্ধুকে দংশন করতে থাকলে তারা অস্থির হয়ে ওঠে। চারদিকে নিপীড়ন, গুম-খুন-জেল আর বাকস্বাধীনতা হরণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর হাতে রক্তাক্ত রাজপথ। এমনই এক আগুনের দিনে সাত বন্ধু চৌরাস্তার মোড়ে সমবেত হয়। জেনারেল শাসকের কুশপুত্তলিকা দাহ করে জমানো ঘৃণা উগরে দেয় রাজপথে। মুহূর্তে সংবাদ পৌঁছে যায় পেটোয়া বাহিনীর কানে। খটখট বুট, বন্দুকের নল ধাওয়া করে সাত যুবককে। বুলেট থেকে বাঁচতে জীবন হাতে নিয়ে দৌড় শুরু করে তারা। এ সময় আরমানের পোষা কুকুরটাও ভাগ করে নেয় মনিবের বিপদ। চেনা পথ, পরিচিত গলি পেরিয়ে তারা আছড়ে পড়ে অচেনা পথের সীমানায়। হঠাৎ সন্ধ্যা নেমে আসা এক পোড়োবাড়ির মুখে শেষ হয়ে যায় তাদের গন্তব্য। নিরূপায় যুবকেরা সে রাতের জন্য ঠিকানা বানায় পোড়োবাড়িকে। নির্দেশ ছাড়াই আরমানের শিকারী কুকুরটি পোড়োবাড়ির দরজার মুখে বসে যায় প্রহরায়। রাতের নিবিড়তা ঘুম নামায় সাত যুবকের চোখে। পরদিন সকালের পেট খুবলানো ক্ষুধায় জেগে ওঠে সাত যুবক। বন্ধুরা মাথাপিছু এক টাকা চাঁদা তুলে আরমানকে পাঠায় খাদ্যের সন্ধানে। আরমানের যেহেতু শিকারী কুকুর আছে, আপদকালে কুকুর তাকে রক্ষা করতে পারবে, এই ভরসাতেই আরমানকে বাছাই করা। কিন্তু বাইরের দুনিয়াতে এসে সবকিছু অন্যরকম লাগে আরমানের। যে পৃথিবীকে রেখে সে ঘুমোতে ঢুকেছিল, এ যেন সেই পৃথিবী নয়। তারপরও কুকুরের সহায়তায় খুঁজে খুঁজে সে রকির দোকানে আসে এবং সেখানে দেখা হয় জুয়েলের সাথে।
আরমানের চেহারা বলে, সে আমার বয়সী। অথচ আশির দশকেও সে এই বয়সীই ছিল। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তার আর আমার বাবার জন্ম কাছাকাছি সময়ে। অথচ আমার বাবা বৃদ্ধ হয়ে মৃত্যুভাবনা ভাবছেন আর সে এখনো তরতাজা যুবক। বাবার বয়সী আরমানকে আমি নাম ধরে ডাকব নাকি চাচা সম্বোধন করব—বুঝে উঠতে পারি না। আমার এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ভেতরই সামনের রাস্তা নদীর মোহনার মতো ডানে-বাঁয়ে দুইদিকে ভাগ হয়ে যায়। রাস্তা দুটো আমার চেনা হলেও আরমানের জড়তাগ্রস্ত পা বলে দেয়, কোন পথ তার পোড়োবাড়িতে মিশেছে, জানে না সে। এ সময় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় কিতমির। আমার দু পায়ের ফাঁক দিয়ে সে সামনে চলে আসে এবং ডানহাতের রাস্তা ধরে এগিয়ে যায়। তখন বাঁয়ের রাস্তায় এক মর্মান্তিক ঘটনার অবতারণা হয়। দুজন পুলিশ হাতকড়া পরিহিত এক যুবককে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে উল্টোপথে। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে জুয়েল আর আমার তখন মনে পড়ে শান্তর কথা। তিন বছর আগের এক মেঘ গুড়গুড় সন্ধ্যায় শান্ত এভাবেই হাতকড়া পরে বিলিন হয়ে গেছে মহাশূন্যের ক্যানভাসে।
পুলিশ দেখে মুখ শুকিয়ে যায় আরমানের। আমি তার কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করি—এই পুলিশ তোমাকে ধরবে না। এই পুলিশ শান্তদের ধরে। তোমাদের ধরা পুলিশ হয়তো আর ইহজগতেই নেই।
শান্ত কে? এই প্রথম আরমানকে সহজ আর আপন মনে হয়।
আমার ছোট ভাই। ওকে গুম করা হয়েছে।
আমার জবাবের প্রেক্ষিতে চেহারা থমথমে হয়ে ওঠে আরমানের। সে পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। যেন পোড়োবাড়ি অথবা গুহার চেয়ে নিরাপদ, প্রার্থিত কোনো আশ্রয় তার জানা নেই। আমার মনের ভেতর উঁকি মারে লোভ—সব ছেড়েছুড়ে আরমানের সাথে চলে গেলে কেমন হয়! আমার মনের অব্যক্ত অক্ষর যেন পড়ে ফেলে কিতমির। অমনি এক খোলা মাঠের সামনে আচমকা সে আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর পথের ওপর লালা ঝরিয়ে রেখা অঙ্কন করে। আরমান বলে, এখানেই থেমে যাও। রেখা পাড়ি দিলে বিপদ হবে তোমাদের। আরমানের ওই নির্দেশ এতটাই ভৌতিক লাগে—সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে আটকে যায় আমাদের দুই বন্ধুর দুই জোড়া পা।
বিদায়ের আগে রুটির জন্য আরমান আমাকে ধন্যবাদ জানায়। তারপর কোলাকুলি করতে গিয়ে কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, পৃথিবী থেকে এখনো স্বৈরতন্ত্র বিদায় হয়নি। এই পঙ্কিল পৃথিবীতে বসবাস করার চেয়ে গুহায় ঘুমিয়ে থাকাই শ্রেয়।
রেখাকে সামনে নিয়ে আমরা দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে থাকি স্থির। যেভাবে প্রথমবার কেউ সাগরের কাছে গেলে আত্মমগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিশ্চল। আমাদের অনুভূতিশূন্য চোখের সীমানায় ধীরে ধীরে ছোট হয় রহস্যময় যুবক ও কিতমিরের অবয়ব। মাঠের শেষ প্রান্তে, আমার ঝাপসা চোখের সম্মুখে একটি বিন্দু হয়ে প্রকৃতির সাথে মিশে যায় তারা। তখনো আমার কানের পাশে বাজতে থাকে আরমানের উচ্চারিত শেষ বাক্যটি : এই পঙ্কিল পৃথিবীতে বসবাস করার চেয়ে গুহায় ঘুমিয়ে থাকাই শ্রেয়।
২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
সাব্বির জাদিদ
জন্ম ১৭ আগস্ট কুষ্টিয়ায়। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে মায়ের ইচ্ছায় মাদরাসায় ভর্তি হওয়া। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আল-হাদিস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজের ওপর অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।
শৈশব থেকেই বই পড়ার নেশা। সেই সূত্রে লেখালেখির জগতে প্রবেশ। ছোটগল্প দিয়েই যাত্রা শুরু। ২০১৭ সালে একটি শোক সংবাদ নামে তার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ছোটগল্পের এই বইটি প্রকাশ করে ঐতিহ্য। ২০২০ সালে মুহাম্ম সা. এর দাদা আব্দুল মোত্তালিবের জীবন ও জাহিলি আরব নিয়ে রচনা করেন প্রায় সাড়ে পাঁচশ পৃষ্ঠার বৃহৎ কলেবরের উপন্যাস পিতামহ। বইটি বিপুলভাবে পাঠকনন্দিত হয়েছে। ২০২২ সালে বের হয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনভিত্তিক উপন্যাস গোত্রহীনের ইতিকথা। এই বইটিও বিজ্ঞ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
গ্রন্থতালিকা :
১. একটি শোক সংবাদ (ছোটগল্প)
২. রুদ্ধ হাওয়ার দিন (ছোটগল্প)
৩. পাপ (উপন্যাস)
৪. ভাঙনের দিন (উপন্যাস)
৫. পিতামহ (উপন্যাস)
৬. গোত্রহীনের ইতিকথা (উপন্যাস)
৭. জীবনঘড়ি (উপন্যাস)
৮. প্রজ্ঞায় যার উজালা জগৎ (রাসুল সা. এর প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার গল্প নিয়ে রচিত সিরাত বই)
৯. আজাদির সন্তান (উপন্যাস)