ডাক্তারকে দেখে সবিশেষ ভক্তির এক হাসি দিলাম। তিনি প্রত্যুত্তরে দিলেন- ‘ইহারে পাইয়াছি মর্মের’ এক ব্যক্তিগত হাসি! খুব ভালো এই ডাক্তার। তাঁর শ্রোতাকুলের মধ্যে বোধকরি আমিই শ্রেষ্ঠ। শরীরে তাঁর এখনো যৌবন টলটল করছে। এ এক জাদু কাহিনি- শুনিয়েছেন আমায় সে রহস্য। আমি কৃতার্থ তাঁর প্রতি, যদিও তাঁর বাতলানো পথে হাঁটাহাঁটি করেও যৌবন আমার কেবল পিছলেই যাচ্ছে! ডাক্তারের বয়স পঞ্চান্ন। ছোটখাট মানুষ; খুবই ছোট- গজ ফিতায় মাপা চলে না। যখন দেখি সামনের দোলানো চেয়ারে শরীরটাকে বসিয়ে প্রাণান্ত চেষ্টায় চাইছেন আমার চোখের ওপর ভেসে থাকতে- আফসোস এই সমস্ত চেষ্টা তাঁর সমূলে বিনষ্ট হয়, মায়ের কোলের নিশ্চিন্তে চোখ মুঁদে থাকা শিশু হয়ে ওঠেন তিনি। আসলে তাঁর এই চেষ্টার পেছনে আছে অপাপবিদ্ধ এক ইচ্ছা, তা তাঁর এই পঁচিশ বছরের চিকিৎসক জীবনের সাফল্যের প্রতি এক নির্ভেজাল বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করা- যে বিশ্বাসের চোখে আমি খুশি মনে তাকাতে পারি এবং বলতে পারি তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ নয়। এ কি মানুষের সহজাত প্রবণতা কোনো অন্তত একজনের চোখে সে নিজেকে সফল দেখতে চায়? আমি দেখেছি অনেক মানুষকে যারা প্যানপ্যান করে একথাই বলতে চায়- তারা যা করেছে সঠিক অর্থাৎ জীবনের সিদ্ধান্তে তারা ব্যর্থ নন, সফল! যদিও খুব স্পষ্ট দেখা যায় তাদের বিগত যাপনে পড়ে আছে ভুলের পর ভুল আর ব্যর্থতার পাহাড়! তবু এক চোখে নিজেকে সফল দেখার ইচ্ছা হয়ত খুবই নিষ্পাপ। যাহোক, ডাক্তারের প্রসঙ্গে ফিরি। বলছিলাম, আমি ডাক্তারের শ্রোতাকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ডাক্তারের কাজ ওষুধ দেয়া গল্প করা না। তবে অইযে বলেছি, ‘ইহারে পাইয়াছি’- আমাকে তিনি পেয়েছিলেন, আমিও তাঁকে সেই বিশ্বাসের চোখে দেখতাম। দেখতে ভালো লাগত।
আমার সিজার হয়েছিল।
প্রথমদিন শুনেই আপসোস করলেন, ‘নিজের সর্বনাশ তো করে ফেলেছেন, চিরকালের মতো পঙ্গু হয়ে গেছেন!’
আমি তাঁকে আশ্বস্ত করলাম, ‘সমস্যা নেই, কিছু তো করার ছিল না’
তিনি টেবিল চাপড় দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘অবশ্যই ছিল। এই হাত দেখুন- বললেন তিনি, এই হাতে কতজনরে ওষুধ দিলাম, সব সোজা হয়ে গেল! নরমালে হবে না মানে, হওয়ায়ে ছাড়ব।’
আমার বাচ্চা ছিল একদম বুকের ওপর, মাথা ছিল উল্টানো আর ডাক্তারের দেয়া সম্ভাব্য ডেট পার হলেও সে গ্যাঁট হয়ে উপরেই রয়ে গেল, নামল না একটুও, তখন সিজার ছাড়া উপায় ছিল না!
তবু উনাকে খুশি করার জন্য বললাম, আপনাকে সেসময় পেলাম কোথায়?
তিনিও জানেন পাওয়ার সুযোগ ছিল না কারণ তখনো তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় নি, আর সেসময় আমি একটা ছোট্ট শহরে চলে গেছিলাম, সেখানকার সবচেয়ে অভিজ্ঞ ডাক্তারের হাতে আমার অপারেশন হয়েছিল। যদি আগে এই সাক্ষাৎ হত আমি তাঁর ধূসর কাঁচের বোতলের টলটলে সঞ্জীবনী এক বারের জন্য হলেও গলায় ঢালতাম!
তাঁর আফসোস রয়ে গেল। রয়ে গেল আমারও। সত্যি যে সিজারের কাটা জায়গা খুব চুলকায়, রান্নার জন্য চুলার কাছে দাঁড়ালে সেখানে মৃদু জ্বালা করে।ওজন এত বেড়েছে একটু জোড়ে হাঁটব কী দৌড়াব চকিতে মনে পড়ে আমার তলপেটটা ফাঁড়া! আর সবচেয়ে মারাত্মক বলে যেটা মনে হতে পারে, আমার মেয়েটার একটা ভাই-বোনের ইচ্ছা আমার গায়ে কাঁটা দেয়া অনুভূতি জাগিয়ে দিত- সে ছিল আমাদের চরম কৌতুহলের ফসল। সেটা আমি স্বীকার করি। মা ডাক শুনছি, এই যে ভালোবাসছি- সেই অনেক! অই দীর্ঘ কষ্টের পর ঝুলানো ছোট্ট পর্দার সামনে চোখ রেখে পেটটা আমার ছুরি-কাঁচির সামনে দেয়ার আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।
এসমস্ত শুনে ডাক্তার আফসোস করতেন। যখনই তাঁর ওখানে যেতাম নানা কিছু নিয়ে কথা হত আমাদের; যদিও সবই তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত। অসামঞ্জস্য প্রেমবন্ধ নিয়ে কথা হলো একদিন। তিনি তাঁর পঁচিশ বছরের চিকিৎক জীবনে কী কী রোগের চিকিৎসা সফলতার সঙ্গে করেছেন বা করছেন সেসবের একটা তালিকা করেছিলেন। আমাকে সেটা পড়ার জন্য দিলেন। যতরকমভাবে তাঁর চিকিৎসার কার্যকারিতা সম্পর্কে আমাকে বিশ্বাসী করে তোলা যায় সে চেষ্টার ত্রুটি করতেন না। কোনো এক বৃদ্ধ বছরের পর বছর হাঁটতে পারতেন না। দিব্যি এখন হেঁটে বেড়াচ্ছেন তাঁর ওষুধে! একজন উঁচু দেয়াল থেকে পড়ে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙেছে- বিছানা থেকে উঠতে পারত না, এখন গটগট করে সারা বাড়ি ঘুরছে! আর নারী-পুরুষের গোপন সমস্যা তো তাঁর ওষুধে জাদুর মতো কাজ করে!
নিঁচু স্বরে বলতেন, সন্ধ্যার পরে আসবেন- কত বড় বড় মানুষ এখানে তাদের পায়ের ধুলো দিচ্ছে!
এসব বলতে নিলে দেখতাম ডাক্তারের শরীরের মতো ছোট ছোট চোখ দুটো অহংকারে চূড় চূড় করছে! আমিও সত্যি তাঁকে বিশ্বাস করতাম বা চেষ্টা করতাম। অবিশ্বাস করার মতো কিছু ছিল না। কিন্তু তাঁর প্রতিটা কথাতেই প্রকট হয়ে উঠত অব্যর্থতা, এমন কোনো টানা উদাহরণের কথা বলতে পারি না, যেখানে তাঁকে অসফল বলে চিহ্নিত করা যায়!
আমাকে দেখতে পেলেই হতো- বলতেন, আসেন আসেন- আজ এই এই হলো, অমুক দিন তমুক এসেছিল, তমুক যাবার জন্য খবর পাঠিয়েছে- এগুলো ছিল তাঁর ধরাবাঁধা কথা!
সেদিন যেতেই অনেকক্ষণ চেপে রাখা অব্যর্থ কাহিনি গড়গড়ালেন। বলার জন্য আসল লোক দেখে খুশিতে চকচক করে উঠলেন।
বললেন, ‘আসেন আসেন, এইত একটু আগে একজন সব নোংরা করে দিচ্ছিল!’
কাহিনি কী? বললেন- ‘একটু আগে একজন এসেছে, পেটের অসুখ- বাথরুমে যাওয়া বন্ধ হচ্ছিল না।’
রোগী নামলেন গাড়ি থেকে ডাক্তারের দুয়ারে; নেমেই করে দেবেন এমন অবস্থা!
ডাক্তার নামাজে ছিলেন। অপেক্ষা করতে বললেন ডাক্তারের চেম্বার দেখাশোনা করা চাচাটা। রোগীর অপেক্ষার সময় নেই। চাচা হইহই করে উঠলেন, ‘সর্বনাশ কইরেন না তখন আমারই পরিষ্কার করতে জান যাইব।‘
এই অবস্থায় ডাক্তার দ্রুত নামাজ সংক্ষিপ্ত করে ওষুধ দিলেন। কোথায় পেটের অসুখ, কোথায় পেট কামড়ানি- জায়গা নষ্ট করার ভয় সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আর দুইদিন সেই লোকের পায়খানা হবে কিনা সন্দেহ!
আমি তেমন কোনো অসুখ নিয়ে তাঁর কাছে যেতাম না। মেয়ের একটু কাশি হলো কী জ্বর- যাই একটু ঢু মেরে আসি এই বলে যেতাম। পারতপক্ষে মেয়েকে ওষুধ দিতে চাইতাম না। চাইতাম সে নিজের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হোক। সেখানে ডাক্তারের ধূসর কাঁচকে মাঝে মাঝে ঘরে টেনে নিতাম, আমার মেয়ের অসুখও হত কম। হয়ত ভালো শ্রোতা আমি সেই ভাবনা থেকে যেতাম সেখানে। অনেক গল্প হত। তাঁকে থামানো যেত না। গল্পের শ্রোত বইয়ে দিতেন। বাইরে তখন হয়ত দু’একটা রোগী এসে বসেছে, তাদের বসিয়েই রাখতেন। এর কারণ ছিল আমি তাঁর মনোযোগী শ্রোতা। তখনকার মতো হাতছাড়া করতে চাইতেন না। আমি যে তাঁর কথার সঙ্গীতে খুব তাল দিতাম তা না, তবে আমি তাঁর চোখে চোখ রেখে গল্প শুনতাম। আমি তাঁকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে ফেলেছি এই বোধ তাঁর ভেতর তৈরি করে দিতে পেরেছিলাম।
এক বিকেলে গেলাম। ভীষণ উত্তেজিত তিনি। বললেন, ‘আপনার আগ্রহের বিষয় আজ এসেছিল।’
বুঝলাম- অসামঞ্জস্যপ্রেমবন্ধ!
বললেন, ‘আগেও এর সফল চিকিৎসা আমি করেছি, বলেছি আপনাকে।’
বললাম, জ্বী বলেছেন।
ডাক্তার মাথা নাড়লেন।
জানতে চাইলাম কাহিনি।
মিটিমিটি কিছুক্ষণ হেসে নিলেন তিনি। বললেন, ‘মেয়েটার মা এসেছিল। লজ্জায় মরে যান এমন অবস্থা- কথা বলতে পারলেন না অনেকক্ষণ। আমিও সময় নিলাম। চাচা পানি দিল খেতে। বোরকা ঢাকা মুখ খুলে পানি খেলেন। খুব ঘামছিলেন মনে হলো- ফ্যানের দিকে বার কয়েক তাকাতে স্পিড বাড়ালাম। এরপর হাত চেপে ধরে কাঁদলেন। তাকে আগে থেকেই চিনতাম।’
বললেন, ‘কাউকে বইলেন না ভাই!
আশ্বস্ত করলাম, ‘কী বলেন আপা, আমি ডাক্তার, গোপন কথা আমাকে বলবেন নাতো কি পুলিশরে বলবেন?’
বোরকা পরা মা কেন লজ্জা শরমে মরে যাচ্ছিলেন ডাক্তার এবার তা বলতে শুরু করলেন, ‘মহিলার মেয়েটা প্রেমে পড়েছে এক বুড়া হাবড়ার। মেয়েটার বয়স এগার। ক্লাস ফাইভে পড়ে আর অই বুড়ার বয়স পঞ্চান্ন কি ছাপান্ন। চিন্তা করেন, ‘অই ব্যাটার নাতনির বয়স!’ মেয়েটারে এমন পটাইছে এখন সে মরার হুমকি দিচ্ছে। একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি করে লোকটা। ছোট্ট অফিস। বাড়ির পাশেই বলে অই অফিসে মেয়েটার বাড়ির লোকের যাতায়াত ছিল। মেয়েটা রোজ যেত, কেননা অফিসের বাউন্ডারির ভেতরেই রয়েছে অনেকগুলো বাড়ি, যার একটা বাড়িতে থাকে মেয়েটার স্কুলের বান্ধবি। মেয়েটাকে তাই যেতে আসতে লোকটা দেখত। এভাবে একদিন মেয়েটাকে কাছে ডাকে। লোকটার টেবিলে ছিল কম্পিউটার। মেয়েটার বাসায় কারো কম্পিউটার নেই। খুব আগ্রহ ওর কম্পিউটার শেখার। এই শখেই সে লোকটার অযাচিত আহ্বানে সেখানে যেতে থাকে। লোকটা তাকে কম্পিউটার শিখিয়ে দেবে কথা দেয়। একদিন, দুইদিন করে অনেকগুলো দিন যায়। কোনো কোনো দিন পাশের টেবিলগুলো খানিক সময়ের জন্য ফাঁকা হ’লে লোকটা মেয়েটার হাতে হাত রাখত। মেয়েটা বোঝে আবার বোঝে না। কম্পিউটার শেখার লোভ তাকে ভুলিয়ে রাখে। তারপর একদিন কার যেন ঘরের চাবি এনে মেয়েটাকে যেতে বলে সঙ্গে। ঘোরগ্রস্ত মেয়ে সেই ফাঁকা ঘরে চলে যায়! কোনোমতে সেদিন পালিয়ে এলেও এখন সে বলছে, লোকটাকে সে ভালোবাসে, তাকে সে বিয়ে করতে চায়! অথচ দেখেন লোকটার অই মেয়েটার চেয়েও অনেক বড় ছেলে আছে। কী লজ্জার কথা! এখন ওকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। মরার হুমকি দিচ্ছে। মেয়েটার মা কেঁদেও কূল পায় না।’
ডাক্তারের বর্ণনা শুনে দুঃখ জানানোর বদলে আমার হাসি পেল! মনে হলো ডাক্তারের কাছে এসব এখন ডালভাতের মতো, নিশ্চিত আমি! তবু না হেসে আতঙ্কের সুরে বললাম, ‘কী হবে তাহলে, মেয়েটা এই অসম বন্ধ থেকে মুক্ত হবে তো?’
ডাক্তার হেসে উঠলেন, বললেন, ‘কোনো সন্দেহ নাই, বাপ বাপ বলে প্রেম ছুট লাগাবে।’
আমি মিষ্টি মিষ্টি হাসছিলাম, যদিও সে হাসি বোঝাচ্ছিল ডাক্তারের প্রতি আমার অকুণ্ঠ সমর্থন।
দুঃখ হচ্ছিল মেয়েটার জন্য- বেচারি!
মেয়েটা কি একাই এই বন্ধে পড়েছে, বললাম আমি-‘ওর চিকিৎসা হলে লোকটারও চিকিৎসা হওয়া উচিত!’
ডাক্তার আমার কথায় পাত্তা দিলেন না। বললেন, ‘কী যে বলেন, অই ব্যাটা কি সত্যি প্রেমে পড়েছে নাকি, এও বুঝলেন না!’
ডাক্তার বিজ্ঞের হাসি হাসছিলেন। ভাবলাম কথাতো সত্য! অনেকটা দুঃখবোধ নিয়ে সেদিন চলে এসেছিলাম। ‘যাক মেয়েটা রেহাই পেলেই হয়!’ নিশ্চিত ছিলাম আসল লোকের হাতেই পড়েছে সে। ডাক্তারকে আমার বিপুল ক্ষমতার অধিকারী ব’লে মনে হচ্ছিল! শ্রদ্ধাও বাড়ল! এরকম কত গল্প শুনতে পাব তাঁর কাছে! তিনিতো সবগুলোকেই সারিয়ে তুললেন। কতবার বলেছেন- ক্যানসারের রোগিকেও সুস্থ করেছেন। মৃত্যুর সময় বেঁধে দেয়া রোগিকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। সবচেয়ে আশ্চর্য কথা হলো তিনি লক্ষণ দেখেই বলে দিতে পারেন কার ভেতরে এই মরণবীজ বাসা বেঁধেছে! আমার হঠাৎ হঠাৎকার বিষণ্নতা নিয়ে বলছিলেন একদিন- আমি যেন সব সময় উজ্জ্বল রঙের কাপড় পরি। অনুজ্জ্বল পোশাক মানুষকে মৃতদের কাতারে শামিল করে। আয়ু কমে! যাইহোক, এরপর আর অনেকদিন সেখানে যাওয়া হয় নি। আসলে গল্পের লোভেই তো যেতাম! কিন্তু সেদিন কী হলো আয়েশ করে বিকালে খেতে বসেছি- দুপুরের ভাত দিয়ে লাল ঝোলের কই মাছ। মা রান্না করে পাঠিয়েছে। এমন ঝাল আর স্বাদ- নাকে-চোখে পানি আসছিল তবু খাওয়া থামাচ্ছিলাম না! হাপুড়-হুপুড় করে খাচ্ছি, এমন যে কাঁটা শুদ্ধ মাছ চালান করছি পেটে। একবার, দুইবার, তিনবারে আটকে গেল গলায় কাঁটা। সাদা ভাত গিলি, পানি খাই ঢকঢক। মা বলল, ‘লেবুর রস চিপে খা।’ খেলাম। কীসের কী আটকেছে তো আটকেছেই। এরপর আমার ডাক্তারের কথা মনে পড়ল। উঁ আঁ করে কাপড় বদলে গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি অনেক মানুষের ভীড়। কী হয়েছে ভাবতে ভাবতে ভীড় ঠেললাম। পায়ের কাছে মেঝেতে বিছানার চাদরে ঢাকা মানুষ- চমকে উঠলাম! ডাক্তার তাঁর চেয়ারে বসে ছিলেন। ডাক্তারের টেবিলে পেপার ওয়েট চাপা দেয়া কতক টাকা। কেউ কেউ সেখানে টাকা দিচ্ছিল। একটা মাঝবয়সি নারী ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কাঁদছে। ডাক্তারের স্ত্রী একবার বেরিয়ে বললেন, ‘কত ব্যবস্থা হলো?
দিন গড়াচ্ছিল বলে তিনি তাড়া লাগালেন, ‘না হয়ত নিজের গাঁটের থেকে খুলে দাও। কী আর করা মরা তো পৌঁছাতে হবে, এইখানে ফেলে রেখে পঁচিয়ে লাভ কী?’
তিনি এই বলে ভেতরে চলে গেলেন। সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। মরে যাওয়া মানুষটার মুখ দেখলাম আমি। ডাক্তারের চেম্বার দেখাশোনা করা সেই চাচা! অনেকদিন থেকে অসুস্থ ছিল, পেটের ভেতর ঘা হওয়াতে ঠিকমতো খেতে পারত না, জ্বর আসত খুব। ঘা থেকেই ক্যানসার। শুরুতে ধরা পড়ে নি, ঠিকমতো চিকিৎসাও হয় নি। জ্বর এলেই নাপা নয়ত এইচ খেয়ে থাকত। যখন এসব শুনছিলাম আমার গলা থেকে কই মাছের কাঁটার অন্তর্ধান হয়েছে, আমি তখন কেবল ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়া আসার সময়কার স্মৃতিতে বাইরে বসে থাকা এই মৃত মানুষটার জীবিত মুখটা কল্পনায় আনার চেষ্টা করছিলাম। কিছুতেই স্পষ্ট হলো না তাতে মানুষটার শরীরে কর্কট হেঁটে বেড়ানোর দৃশ্য! আমি ডাক্তার নই তাই হয়ত দেখতে পেলাম না কিন্তু ডাক্তার কী করলেন? দিনে দিনে যে প্রবল কথার তোড়ে বিশ্বাসের বন্দরে আমাকে নিয়ে তুলেছিলেন বা তুলতে চেয়েছিলেন, এই যে তাঁর সাজানো চেম্বার, সার বেঁধে সাজানো দামি ওষুধের সতত সুন্দর বোতল, এই যে তাঁর নিজ হাতে গড়ে তোলা নির্দিষ্ট একটি একার মুখ- দেখলাম ঝনাৎ শব্দে সব কেমন ভেঙে পড়ল!
একজন পয়সাওয়ালা ভদ্রলোক এসে বাকি টাকাটা দিলেন। টাকা গুণে যে ছেলেটার হাতে তুলে দেয়া হলো সে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘টাকার ব্যবস্থা হয়েছে।’ কেউ একজন তাড়াহুড়োয় ছুটল অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজে। এতক্ষণ এই গাড়ি ভাড়া, লাশের দাফন-কাফন এবং পরবর্তী কিছু খরচের ব্যবস্থার জন্য এরা বসে ছিল, চাচার বউটাকে বসিয়ে রেখেছিল। মহিলা কষ্ট করে লাশ নিতে গ্রাম থেকে শহরে এসেছে। নতুন মাসের বেতন হাতে পেতেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল চাচা। বেতনের সমস্ত টাকাই তাতে পানির মতো বেরিয়ে গেছে। ডাক্তার এরপরেও বাড়তি কিছু টাকা দিলেন যখন লাশটা অ্যাম্বুলেন্সে নেয়া হলো। এই দেয়া বা না দেয়া আমার ভেতর কোনো প্রতিক্রিয়া জাগাল না। ফিরে আসার সময় ডাক্তারের মুখটা শেষবারের মতো দেখলাম। দেখলাম দেয়াল আলমাড়ি জুড়ে থরে থরে সাজানো তাঁর অব্যর্থ, জাদুকরি অষুধের শিশি! আমি তখনো পড়তে পারছিলাম আমার হাতে দেয়া ডাক্তারের সেই লিস্ট। কর্কট যে শরীরে বাসা বাঁধে সে শরীর নির্ভুল নির্ণয়ের বিদ্যা তাঁর জানা ছিল!