তরুণ দলিত ছাত্র যারা ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে, তাদেরকে এতো কঠোরভাবে মূল্যায়ন করা উচিত হবে না। ভারতীয় বর্ণ-ব্যবস্থার মলাধার থেকে উঠে আসার সুযোগ তাদেরকে আর কেইবা করে দেবে? দলিত তরুণদের এই অবস্থার জন্য ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ওপরই লজ্জা ও দায়ের বড় অংশটি বর্তে। কেননা এদের নেতৃত্বে এখনো উচ্চবর্ণের প্রাধান্য রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে তারা জাতপাতের ধারণাকে জোর করে মার্কসবাদী শ্রেণী বিশ্লেষণের সাথে মানানসই করার চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু তত্ত্ব এবং বাস্তবতা- উভয় ক্ষেত্রেই এই চেষ্টা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। স্বপ্নদ্রষ্টা দলিত নেতা ড. ভীমরাও আম্বেদকর এবং ট্রেড ইউনিয়নিস্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এস এ দাঙ্গের ভেতরে কলহের জের ধরে দলিত সমাজ ও বামদের মধ্যে ফাটল শুরু হয়। ১৯২৮ সালে মুম্বাইয়ে বস্ত্র শ্রমিকের ধর্মঘটের সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি ড. আম্বেদকরের মোহমুক্তি ঘটে। এসময় তিনি বুঝতে পারেন শ্রমজীবী শ্রেণির ঐক্য সম্পর্কে যতোই বড় বড় কথা বলা হোক না কেন, সেলাই বিভাগ (এবং দলিতদের কেবল কম পারিশ্রমিকের সুতা কাটা বিভাগে নিয়োগের জন্য যোগ্য বিবেচনা করা হয়) থেকে ‘অচ্ছুৎদের’ দূরে রাখার কাজকে কমিউনিস্ট পার্টি আপত্তিজনক মনে করে না। পার্টির এই মনোভাবের কারণ হলো, এই কাজের সময় সুতোতে মুখের লালা ব্যবহার করতে হয়। আর অন্য বর্ণের লোকেরা দলিতদের এই লালাকে “অপবিত্র” বলে মনে করে।
আম্বেদকর বুঝতে পারেন, যে সমাজে হিন্দুশাস্ত্র- অস্পৃশ্যতা ও বৈষম্যকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য কাজ করে, সেখানে প্রতিশ্রুত কমিউনিস্ট বিপ্লবের চেয়ে “অচ্ছুৎদের” সামাজিক ও নাগরিক অধিকারের জন্য যুদ্ধ করাটাই আশু প্রয়োজন। আম্বেদকরবাদী ও বামপন্থীদের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠা ফাটলের জন্য উভয়কেই চড়া মূল্য দিতে হয়। এর ফলে দলিত জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যারা ভারতীয় শ্রমজীবী শ্রেণীর মেরুদণ্ড, তারা মর্যাদা ও কিছু পাবার আশায় নিয়মতান্ত্রিকতাবাদ, পুঁজিবাদ, এবং বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) এর মতো দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। বিএসপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড গুরুত্বপূর্ণ, তবে দীর্ঘ মেয়াদে তারাও নাম সর্বস্ব রাজনীতির নিশ্চল ব্রান্ড।
কর্পোরেট অনুদানে পরিচালিত ফাউন্ডেশনগুলো কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে এনজিও সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়েছে, আমরা তা দেখেছি। ১৯৯০-এর দশকে, নতুন অর্থনৈতিক নীতির যুগে ভারতে প্রবল বেগে কর্পোরেট সমাজসেবার সূচনা ঘটে । স্টার চেম্বারের সদস্যপদ খুব সস্তায় যে মেলে তা নয়; আমরা তাই দেখি, টাটা গ্রুপ হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের মতো অভাবী প্রতিষ্ঠানকে ৫০ মিলিয়ন ডলার এবং কর্নেল ইউনিভার্সিটিকে ৫০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিচ্ছে। ইয়েলে “ইন্ডিয়া ইনিশিয়েটিভ” এর প্রারম্ভিক তহবিল হিসেবে ইনফোসিস-এর নন্দন নিলেকানি এবং তার স্ত্রী রোহিনি পাঁচ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিচ্ছেন। এইসবেরই ধারাবাহিকতায় হার্ভার্ড হিউম্যানিটিজ সেন্টারও অনুদান পাচ্ছে- মহিন্দ্র গ্রুপের আনন্দ মহিন্দ্রের কাছ থেকে এযাবৎকালের বৃহত্তম অনুদান হিসেবে ১০ মিলিয়ন ডলার পেয়ে তারা এখন মহিন্দ্র হিউম্যানিটিজ সেন্টার হিসেবে পরিচিত।
দেশে খনি, ধাতব, ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে যাদের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে সেই জিন্দাল গ্রুপ জিন্দাল গ্লোবাল ল স্কুল চালায়, খুব শিগগিরই তারা জিন্দাল স্কুল অব গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক পলিসি নামের একটি প্রকিষ্ঠান খুলতে যাচ্ছে। (ফোর্ড ফাউন্ডেশনও কঙ্গোতে একটি আইন স্কুল পরিচালনা করে।) ইনফোসিস এর মুনাফা থেকে নন্দন নিলেকানির অর্থায়নের প্রতিষ্ঠিত নিউ ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন সমাজবিজ্ঞানীদের পুরস্কার ও ফেলোশিপ দিয়ে থাকে। জিন্দাল অ্যালুমিনিয়ামের চেয়ারম্যান এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর দ্বারা পরিচালিত সীতারাম জিন্দাল ফাউন্ডেশন- পল্লী উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও নৈতিক মানোনন্নয়ন, পরিবেশ, শান্তি ও সামাজিক সংহতি রক্ষায় যারা কাজ করছেন তাদের জন্য এক কোটি রূপি মূল্যমানের পাঁচটি পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা করেছে। বর্তমানে মুকেশ আম্বানির অনুদানে পরিচালিত, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ) রকফেলার ফাউন্ডেশনের মতো করে নিজেকে গড়ে তুলেছে। এই প্রতিষ্ঠানের গবেষণা “ফেলো” ও উপদেষ্টা হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত গোয়েন্দা এজেন্ট, কৌশলগত বিশ্লেষক, রাজনীতিবিদ (যারা পার্লামেন্টে একে অপরের বিরুদ্ধে গালিগালাজ করতে ইচ্ছুক), সাংবাদিক ও নীতিনির্ধারক হিসেবে কাজ করছে।
ওআরএফ-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দৃশ্যত সোজাসাপ্টা: “অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য জনমত তৈরি করা”। আর এই জনমত গঠন ও সেটাকে প্রভাবিত করতে- “প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর জন্য টেকসই, বিকল্প নীতি নির্ধারণ করা: যেমন পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোতে কর্মসংস্থার তৈরি এবং পারমাণবিক, জৈব, ও রাসায়নিক হুমকি মোকাবিলায় সর্বাধুনিক কৌশল নির্ধারণ।’’
ওআরএফের বর্ণিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে “পারমাণবিক, জৈব, ও রাসায়নিক হুমকি”-এর মতো বিষয় থাকায় আমি শুরুতে বেশ বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তবে সেটা বেশি সময়ের জন্য নয়। এর “প্রাতিষ্ঠানিক অংশীদারদের” দীর্ঘ তালিকায় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দুই অস্ত্র নির্মাতা রেথিয়ন ও লকহিড মার্টিনের নাম দেখতে পাওয়ার পর আমার হতবুদ্ধির ভাবটা কেটে যায়। ২০০৭ সালে রেথিয়ন ঘোষণা করে, তারা ভারতের দিকে নজর দিয়েছে। এর মানে কি এই যে, ভারতের ৩২ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা বাজেটের অন্তত একটি অংশ রেথিয়ন ও লকহিড মার্টিনের তৈরি অস্ত্র, নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান, রণতরী, আর পর্যবেক্ষণ সরঞ্জাম কেনায় ব্যয় হবে?
যুদ্ধ করার জন্য কি আমাদের অস্ত্র প্রয়োজন? নাকি অস্ত্রের বাজার তৈরির জন্য আমাদের যুদ্ধের প্রয়োজন? তবে আর যা-ই হোক ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, ও ইসরায়েলের অর্থনীতি বিপুলভাবে তাদের অস্ত্র শিল্পের উপর নির্ভরশীল। অন্তত এই একটি শিল্পকে তারা চীনে আউটসোর্স করেনি।
মার্কিন-রাশিয়া স্নায়ুযুদ্ধের সময় পাকিস্তান যেভাবে মার্কিন মিত্রের ভূমিকা পালন করেছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার নতুন স্নায়ুযুদ্ধে ভারতও সেটা করার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিয়েছে। (এবং দেখুন পাকিস্তানের কী হাল হয়েছে।) যেসব কলামিস্ট ও “কৌশলগত বিশ্লেষক” ভারত ও চীনের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, আপনি দেখবেন তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইন্দো-আমেরিকান থিংক-ট্যাংক ও ফাউন্ডেশনগুলোর সঙ্গে যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের “কৌশলগত অংশীদার” হওয়া মানে এই নয় যে, রাষ্ট্র দুটির প্রধানদের মধ্যে যখন তখন ফোনে আলাপ হয়। বরং এর মানে হলো, প্রতিটি পর্যায়ে সহযোগী হিসেবে কাজ করা (বা হস্তক্ষেপ করা)। এর মানে ইউএস স্পেশাল ফোর্সেসকে ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে দেওয়া (জনৈক পেন্টাগন কমান্ডার সম্প্রতি বিবিসিকে তা নিশ্চিত করেছেন)। এর মানে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, কৃষি ও জ্বালানী নীতি পরিবর্তন, বৈশ্বিক বিনিয়োগের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত খুলে দেওয়া। এর মানে খুচরা বাজার উন্মুক্ত করা। এর মানে একটি অসম বন্ধুত্ব- যেখানে আলিঙ্গনের মধ্যে ভারতকে জড়িয়ে ধরে ফ্লোর জুড়ে ওয়াল্টজ নাচছে তার এমন এক সঙ্গী, যে নাচতে অস্বীকার করা মাত্রই ভারতকে ধ্বংস করে দেবে।
ওআরএফ’র তালিকায় থাকা “প্রাতিষ্ঠানিক অংশীদারদের” মধ্যে আপনি পাবেন র্যান্ড কর্পোরেশন, ফোর্ড ফাউন্ডেশন, বিশ্বব্যাংক, ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন (যার ঘোষিত মিশন হলো- ‘‘এমন সব নতুন নতুন ও বাস্তবতানির্ভর সুপারিশ করা যেগুলো তিনটি বৃহত্তর লক্ষ্য এগিয়ে নেবে: আমেরিকান গণতন্ত্র জোরদার করা; সব আমেরিকানের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণ বেগবান, নিরাপত্তা ও সুযোগ সৃষ্টি করা; এবং তাদের জন্য আরো উন্মুক্ত, নিরাপদ, সমৃদ্ধ ও সহযোগিতামূলক আর্ন্তজাতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা’’)। আপনি জার্মানির রোসা লুক্সেমবার্গ ফাউন্ডেশনকেও দেখবেন। (দুর্ভাগা রোসা! তিনি সমাজতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়েছিলেন। অথচ তার নামও এই তালিকায় দেখা যায়!)
যদিও বলা হয়ে থাকে- পুঁজিবাদ হলো প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা, কিন্তু আসলে যারা খাদ্য-শৃঙ্খলের মাথায় বসে আছে তারা নিজেদের ভেতর স্বার্থকেন্দ্রিক একাত্মতা ও ঐক্যের এক বন্ধন গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে। পশ্চিমা মহাপুঁজিপতিরা ফ্যাসিবাদী, সমাজবাদী, স্বেচ্ছাচারী, ও সামরিক স্বৈরাচারের সঙ্গে ব্যবসা করেছে। তারা সবকিছুর সঙ্গেই সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণের নতুন নতুন রাস্তা বের করে নিতে তারা যথেষ্ট পারঙ্গম। তারা খুব দ্রুত চিন্তা করতে পারে এবং অবিশ্বাস্য ধূর্ত কৌশল প্রণয়ন করতেও তারা সক্ষম।
তবে অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে সফলভাবে ক্ষমতাধর হওয়া স্বত্ত্বেও, মুক্ত বানিজ্যের “গণতন্ত্র” প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ বাধিয়ে সামরিক শক্তিতে দেশ জয় করার পরও, পুঁজিবাদ একটি সঙ্কট অতিক্রম করছে, যার গভীরতা এখনো পুরোপুরিভাবে প্রকাশিত হয়নি। মার্ক্স বলেছেন, “বুর্জোয়ারা যা কিছু উৎপাদন করছে, সর্বোপরি, সেগুলো তাদের নিজেদেরই গোরখোদক। এর পতন এবং সর্বহারাদের বিজয় তাই সমানভাবে অনিবার্য।”
সর্বহারারা- মার্ক্স যেমনটি দেখেছিলেন, অব্যাহতভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছে: কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, চাকরি পাওয়া যায় না, ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ হয়। বছরের পর বছর ধরে সর্বহারাদের সম্ভাব্য প্রতিটি উপায়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দুর, খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে হিন্দুর, আদিবাসীর বিরুদ্ধে দলিতের, বর্ণের বিরুদ্ধে বর্ণের, অঞ্চলের বিরুদ্ধে অঞ্চলের লড়াইয়ের মাধ্যমে ভারতে এই প্রক্রিয়া কায়েম করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও বিশ্বজুড়েই সর্বহারারা প্রত্যাঘাত করছে। চীনে অসংখ্য ধর্মঘট, গণআন্দোলন হয়েছে। ভারতে, বিশ্বের দরিদ্রতম লোকজন তাদের ভূমিতে কয়েকটি ধনবান কর্পোরেশনকে রুখে দিতে সক্ষম হয়েছে।
পুঁজিবাদ এখন সঙ্কটে। চুইয়ে পড়া তত্ত্ব ব্যর্থ হয়েছে। এখন এর উত্থানও সমস্যায় পড়েছে। আন্তর্জাতিক আর্থিক মন্দার সৃষ্টি হচ্ছে। ভারতে প্রবৃদ্ধির হার ৬.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগ চলে যাচ্ছে। বিপুল অর্থের উপর বসে থাকা প্রধান আন্তর্জাতিক কর্পোরেশনগুলো বুঝতে পারছে না যে ঠিক কোথায় বিনিয়োগ করতে হবে, কিংবা কীভাবে এই আর্থিক সঙ্কট কাটবে। বৈশ্বিক পুঁজির বিশাল গাড়িতে বড় কাঠামোগত ফাটল দেখা দিয়েছে।
পুঁজিবাদের আসল “গোরখোদকরা” যারা মতাদর্শটিকে ধর্মে রূপান্তর করেছিল তারা হয়তো নিজেদের কার্ডিনালগিরির মোহমুক্তি ঘটিয়ে কোন রকমে টিকে যাবে। তাদের কৌশলগত দুর্দান্ত মেধা সত্ত্বেও তারা সম্ভবত এই সাধারণ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারছে না যে পুঁজিবাদ পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। “যুদ্ধ” ও “কেনাকাটা” নামের যে দুটো পুরোনো কৌশল তাদের অতীতের সঙ্কট থেকে মুক্ত করেছিল, ভবিষ্যতে এই কৗশলে আর কাজ হবে না।
আমি দীর্ঘ সময় অ্যান্টিলার বাইরে দাঁড়িয়ে সূর্য ডোবা দেখছিলাম। আমি কল্পনায় দেখছিলাম টাওয়ারটি যতটা উঁচু, ঠিক ততোটাই গভীর। এর লম্বা শেকড় সাপের মতো একেবেঁকে মাটির নিচে ২৭ তলা পর্যন্ত নেমে গেছে, বুভুক্ষুর মতো পৃথিবী থেকে বেঁচে থাকার রসদ শুষে নিয়ে এই টাওয়ার পৃথিবীকে ধোঁয়া আর সোনায় রূপান্তরিত করছে।
আম্বানিরা তাদের বাড়িটির নাম হিসেবে অ্যান্টিলা পছন্দ করলো কেন? অ্যান্টিলা হলো রূপকথার এক দ্বীপপুঞ্জ। ৮ম শতকের ইবেরীয় কিংবদন্তিতে এর হদিস মেলে। বলা হয়ে থাকে, মুসলিমরা যখন হিসপানিয়া জয় করে, তখন ৬ জন ভিসিগোথিক ক্রিস্টান যাজক এবং তাদের অনুসারীরা জাহাজে করে পালিয়ে যায়।
কয়েক দিন, কিংবা কয়েক সপ্তাহ সমুদ্রে কাটানোর পর তারা অ্যান্টিলা দ্বীপপুঞ্জে নামে এবং সেখানেই বসতি স্থাপন করে নতুন সভ্যতা গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বর্বরদের হাতে দখল হয়ে যাওয়া স্বদেশের সাথে স্থায়ীভাবে সম্পর্কচ্ছেদের জন্য তারা তাদের নৌকাগুলো পুড়িয়ে দেয়।
নিজেদের টাওয়ারকে অ্যান্টিলা বলার মাধ্যমে কি আম্বানিরা আশা করছে যে তারা তাদের দেশের দরিদ্র ও আবর্জনার সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে নতুন একটি সভ্যতার বিকাশ ঘটাতে পারবে? এটাই কি ভারতের সবচেয়ে সফল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের চূড়ান্ত অধ্যায়? মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের বহির্জগতে সরে যাওয়া?
মুম্বাইতে রাত্রি নেমে এলো, লিলেনের কেতাদুরস্ত শার্ট পরে প্রহরীরা তাদের যান্ত্রিক শব্দ করা ওয়াকিটাকি নিয়ে অ্যান্টিলার নিষিদ্ধ গেটগুলোর বাইরে আবির্ভূত হলো। সম্ভবত ভূতগুলোকে তাড়িয়ে দিতে আলো জ্বালানো হলো। প্রতিবেশীদের অভিযোগ, আন্টিলার তীব্র আলো তাদের রাত কেড়ে নিয়েছে।
সেই হারানো রাত ফিরিয়ে আনার জন্য হয়তো এটাই আমাদের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
(চলবে)
পঞ্চম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
গ্রন্থ: ক্যাপিটালিজম অ্যা গোস্ট স্টোরি
লেখক: অরুন্ধতী রায়
অনুবাদক: মূর্তালা রামাত ও শারমিন শিমুল
[বইটি বাংলা ভাষায় ধারাবাহিক প্রকাশ হতে থাকবে; প্রতি শুক্রবার।]