বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পেয়ে, এসব এনজিও সারা দুনিয়া চষে বেড়ায়। তারা সম্ভাবনাময় বিপ্লবীদেরকে আত্মপরিচয়ের রাজনীতি এবং মানবাধিকারের মতো শব্দমালা পরানো বহুসংস্কৃতিবাদ, জেন্ডার সমতা, কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টের দিকে এগিয়ে দেয়। এবং এভাবে তাদেরকে বেতনভুক কর্মী, তহবিলপুষ্ট শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও চলচ্চিত্র নির্মাতায় পরিণত করার মধ্য দিয়ে ভদ্রস্থ উপায়ে আমূল পরিবর্তনের সংঘাত থেকে দূরে থাকতে প্রলুব্ধ করে।
ন্যায়বিচারের ভাবনাকে মানবাধিকারের শিল্পে রূপান্তরিত করাটা একটি ধারণাগত ক্যু, যাতে এনজিও এবং ফাউন্ডেশনগুলো গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানবাধিকারকে সংকীর্ণ কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসার ফলে নৃশংসতা-ভিত্তিক বিশ্লেষণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এতে করে ঘটনার বৃহত্তর চিত্রটি বাধাগ্রস্থ হয় এবং সংঘাতে লিপ্ত উভয় পক্ষকেই- যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মাওবাদী ও ভারত সরকার কিংবা ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও হামাস- ‘মানবাধিকারের লঙ্ঘনকারী’ হিসেবে ধিক্কৃত করার প্রয়াস পাওয়া যায়। এতে করে ভূমি হাতানো খনি কর্পোরেশন বা ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরাইল রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের ইতিহাসটুকু আলোচনায় সামান্য গুরুত্ব বহনকারী ফুটনোটে পরিণত হয়। মানবাধিকারের কোন গুরুত্ব নেই- এমনটা কিন্তু বলা হচ্ছে না। এটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে আমরা যে বিশ্বে বসবাস করছি, সেখানকার মহা অবিচার দেখা বা সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে উপলব্ধি করার জন্য এটা যথেষ্ট ভালো মাধ্যম নয়।
নারীবাদী আন্দোলনগুলোর সাথে ফাউন্ডেশনগুলোর সম্পৃক্ততা আরেকটি ধারণাগত ক্যু। ভারতের বেশির ভাগ ‘ঘোষিত’ নারীবাদী ও নারী সংগঠনগুলো কেন অন্যান্য নারীবাদী সংগঠন, যেমন ৯০ হাজার সদস্যবিশিষ্ট ‘ক্রান্তিকারী আদিবাসী মহিলা সংগঠন’ (রেভ্যুলশনারি আদিবাসী ওম্যান্স এসোসিয়েশন)- থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে? ‘ক্রান্তিকারী আদিবাসী মহিলা সংগঠন’ একইসাথে তাদের নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে পিতৃতন্ত্র এবং দণ্ডাকারণ্য বনে খনি কোম্পানিগুলো যে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে- সেটাই কি এই দূরত্বের কারণ? লাখ লাখ নারী যেখানে নিজের মালিকানাধীন ভূমিতে কাজ করতো, মালিকানা কেড়ে নিয়ে তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করাকে কেন নারীবাদী সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হবে না, বলতে পারেন?
তৃণমূল পর্যায়ের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও পুঁজিবাদবিরোধী গণআন্দোলনগুলো থেকে উদার নারীবাদী আন্দোলনের সম্পর্ক ছিন্ন করাটা ফাউন্ডেশনের অশুভ কৌশলের মাধ্যমে শুরু হয়নি। বরং, ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে নারীদের মধ্যে দ্রুতগতিতে যে প্রগতির ধারণা বাড়ছিল, সেই ধারণার সাথে ঐসব আন্দোলনগুলো খাপ খাওয়াতে এবং মেনে নিতে না পারায় এই বিচ্ছেদের সূত্রপাত ঘটে।
নিজেদের ঐতিহ্যবাহী সমাজে, এমনকী বাম আন্দোলনগুলোর তথাকথিত প্রগতিশীল নেতাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতা ও পিতৃতান্ত্রিকতা- ফাউন্ডেশনগুলো অনেক আগেই চিহ্ণিত করতে পেরেছিল। এসব অনাচারের বিরুদ্ধে নারীদের ক্রমাগত ধৈর্য হারানোর বিষয়টিও তারা সঠিকভাবে বুঝেছিল। ফলে নারীদের প্রতি সমর্থন ও তহবিল জোগান দিয়ে ফাউন্ডেশনগুলো তাদের প্রতিভার পরিচয় দিতে দেরি করেনি। ভারতের মতো দেশে, গ্রাম ও নগরের মধ্যেও উপদলীয় বিভক্তি বিরাজ করে। গ্রামের দিকে যেখানে পুরষতন্ত্র তখনো বেশির ভাগ নারীর জীবন নিয়ন্ত্রণ করত, সেখানেই অধিকাংশ আমূল সংস্কারবাদী ও পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল। শহুরে যেসব নারী এ ধরনের আন্দোলনে (নকশালী আন্দোলনগুলোর মতো) যোগ দিয়েছিল, তারা পশ্চিমা নারীবাদী আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ও উদ্দীপ্ত ছিল। যেখানে তাদের পুরষ নেতারা “জনগণের” সাথে মিশে যাওয়া’কে একান্তই নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করতো, সেখানে স্বাধীনতার পথে নারীদের এই নিজস্ব যাত্রা প্রায়ই সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াতো। নারীরা তখন প্রতিনিয়ত নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হতো। এমনকি তাদের নিজস্ব কমরেডদের হাতেও তারা নিগৃহীত হতো। অনেক নারী কর্মীই “বিপ্লব” এর মাধ্যমে এসব নিপীড়নের অবসান ঘটানোর জন্য অপেক্ষা করতে আর ইচ্ছুক ছিল না। তারা চেয়েছিল, “লিঙ্গের সমতা ” কেবল বিপ্লব পরবর্তী প্রতিশ্রুতি হিসেবেই থাকবে না, বরং তা হবে বিপ্লবী প্রক্রিয়ার নিরঙ্কুশ, তাৎক্ষণিক, ও আপসহীন অংশ। তেমনটা না হওয়ায় বুদ্ধিমতী, ক্ষুব্ধ, ও মোহমুক্ত নারীরা এরপর ক্রমশঃ সরে যেতে থাকে। অতঃপর বেঁচে থাকার প্রয়োজনে এবং টিকে থাকার জন্য তারা অন্যান্য উপায়ের খোঁজ শুরু করলো। এর ফলে ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে যখন ভারতীয় বাজার খুলে দেওয়া হচ্ছিল, তখন ভারতের উদার নারীবাদী আন্দোলন অতিমাত্রায় এনজিও-আইজড হয়ে পড়ে। এসব এনজিও’র অনেকগুলো সমকামী অধিকার, পারিবারিক সহিংসতা, এইডস, এবং যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু করে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, যদিও নতুন নতুন অর্থনৈতিক-নীতির দ্বারা নারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, তথাপি উদার নারীবাদী আন্দোলনগুলো এসব নীতিকে চ্যালেঞ্জ করার ব্যাপারে সামনের কাতারে ছিল না। ফলে অনুদান-তহবিল বণ্টনকে কৌশলে কাজে লাগিয়ে ফাউন্ডেশনগুলো ‘রাজনৈতিক’ কার্যক্রমের পরিধি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাপকভাবে সফল হয়। এতে করে তারা এনজিওগুলোর তহবিল দেওয়ার নির্দেশিকার মধ্যে কোনটি নারীদের ‘ইস্যু’ এবং কোনটি নয়, তা চিহ্নিত করে দেয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
নারীদের আন্দোলন এনজিওকরণের ফলে পশ্চিমা উদার নারীবাদই (এতে সবচেয়ে বেশি তহবিল থাকার গুণে) নারীবাদের সংজ্ঞা নির্ধারণের আদর্শ মাপকাঠিতে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবে নারীদের দেহটাই হয়ে ওঠে লড়াইয়ের কেন্দ্র। যার একদিকে থাকে বোটোক্স ব্যবহার করে ত্বকে ভাঁজ পড়তে না দেওয়া এবং অন্যদিকে থাকে বোরকা। (আর অনেকে আছে যারা বোটোক্স এবং বোরকার দ্বিমুখী দুর্ভোগ পোহায়।) সম্প্রতি ফ্রান্সে নারীদের নিজেদের ‘পছন্দমতো বেছে নেয়ার’ পরিবেশ সৃষ্টির বদলে তাদের বোরকা থেকে বের হতে বাধ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এই উদ্যোগটির সাথে নারী মুক্তির কোন সম্পর্ক ছিল না বরং এটি ছিল নারীকে নগ্ন করার একটা প্রচেষ্টা। এই ঘটনা অবমাননাকর ও সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী কার্যক্রমের মধ্যে পড়ে। কোনো নারীকে বোরকা থেকে বলপূর্বক বের করাটা তাকে বলপূর্বক বোরকার ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়ার মতোই খারাপ। বিষয়টা বোরকার ব্যাপার নয়। এটা বলপ্রয়োগের ব্যাপার। সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিণ্ন করে জেন্ডারকে এভাবে বিবেচনা করাটা- পরিচয় নির্ধারণের ইস্যু তৈরি করে, প্রপস এবং কস্টিউমের যুদ্ধ শুরু করায়। আর এই ইস্যুটিই মার্কিন সরকারকে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে আক্রমণ চালানোর সময় নৈতিক ঢাল হিসেবে পশ্চিমা নারীবাদী গ্রুপগুলোকে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছিল। আফগান নারীরা তালেবান শাসনে মারাত্মক কঠিন অবস্থায় ছিল (এখনো আছে)। কিন্তু তাদের ওপর ডেইজি কাটার বোমা ফেলাটা কোনমতেই তাদের সমস্যার সমাধান ছিল না।
এনজিওদের দুনিয়া- যেখানে তারা নিজেদের মতো করে এক উদ্ভট বেদনানাশক ভাষা সৃষ্টি করেছে- সেখানে সবকিছুই একটি “বিষয়” যা একটি পৃথক পেশাদারিত্বের মোড়কে মোড়া বিশেষ স্বার্থান্বেষী ইস্যুতে পরিণত হয়। সমাজ উন্নয়ন, নেতৃত্ব বিকাশ, মানবাধিকার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বংশবিস্তারের অধিকার, এইডস, এইডস আক্রান্ত এতিম- সবই তাদের মনের মতো পূর্ণাঙ্গ ও নিঁখুত তহবিল নির্দেশনাসহ তাদেরই একান্ত গুদামঘরে তারা তুলে রাখে । নারীবাদের মতো দারিদ্র্যকেও প্রায়ই অভিন্ন সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানবিক ঐক্যকে আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে যেভাবে টুকরো টুকরো করা হয়েছে, কেবল নিপীড়ন চালিয়ে তা কখনোই সম্ভব হতো না।
দারিদ্রকেও নারীবাদের মতো একটি আইডেন্টিটির সমস্যা হিসেবে চিহ্ণিত করা হয়েছে। ব্যাপারটা এমন যেন, কোন অবিচারের কারণে গরিব মানুষের সৃষ্টি হয়নি। বরং তারা স্রেফ একটি হারানো গোত্র যারা এখনো টিকে আছে। তাই তাদেরকে স্বল্প মেয়াদে কষ্ট লাঘবকারী ব্যবস্থায় (এনজিও’র মাধ্যমে পৃথক পৃথক ভাবে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি অনুযায়ী) উদ্ধার করা সম্ভব এবং তাদের দীর্ঘ মেয়াদি উত্থানের জন্য প্রয়োজন হলো- ‘সুশাসন’। এবং কোন রকম বিরোধিতা ছাড়াই যদি বৈশ্বিক কর্পোরেট পুঁজিবাদী শাসন কায়েম করা যায় কেবল তাহলেই শুধু এই ‘সুশাসন’ আনা সম্ভব।
ভারতকে যখন “উজ্জ্বল” করে দেখানো হচ্ছিল তখন অল্প কিছু সময়ের জন্য ভারতীয় দারিদ্র নিঃসঙ্গতার মধ্যে ছিল। তারপর সে অদ্ভূত পরিচয় নিয়ে শিল্পের রাজ্যে ফিরে আসে। আর তার দারিদ্রকে ফিরিয়ে আনার কাজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয় স্লামডগ মিলিওনিয়ার এর মতো চলচ্চিত্র। গরিবদের নিয়ে এসব কাহিনীতে তাদের আশ্চর্য প্রাণশক্তি ও ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। তবে কাহিনীতে কোনো ভিলেন নেই। কেবল গল্পে উত্তেজনা এবং স্থানীয় রং ছড়ানোর জন্য ছোট ছোট কাউকে আনা হয়েছে। এসব কাহিনীর লেখকেরা আধুনিক বিশ্বে প্রাথমিক কালের নৃবিজ্ঞানীদের সমতুল্য বলে গণ্য হচ্ছেন। প্রকৃত নৃবিজ্ঞানীদের মতো সমান সাহস নিয়ে অজানা পথের দিকে সাহসী যাত্রায় ‘বাস্তব অবস্থা’ নিয়ে কাজের জন্য তাদের কপালে জুটছে প্রশংসা ও সম্মান। গরিবদের নিয়ে এতোসব কাঁটাছেঁড়া হলেও, ধনীদের নিয়ে যে একইভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে, তা কিন্তু খুব একটা চোখে পড়ে না!
সরকার, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন, আদালত, মিডিয়া, ও উদার জনমত নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে কাজ করার পর নব্য-উদারবাদী মহলের আরেকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা বাকি ছিল। আর তা হলো, ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা তথা ‘জনগণের শক্তি’র হুমকিকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়? এই শক্তিকে কীভাবে বশ মানানো যায়? কীভাবে এই শক্তির বলে বলীয়ান প্রতিবাদীদের পোষ্য করা যায়? কীভাবে জনগণের ক্রোধকে ঝেড়ে-পুছে অন্ধ গলির দিকে ঠেলে দেয়া যায়?
এখানেও ফাউন্ডেশন এবং তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর এক দীর্ঘ ও বর্ণিল ইতিহাস রয়েছে। চোখের সামনে এর উদাহরণ হলো: ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার আন্দোলনে ফাউন্ডেশনের ভূমিকা; ফাউন্ডেশন এই আন্দোলনকে প্রশমিত করে আমূল পরিবর্তনের পথ থেকে সরিয়ে এনেছিল। সেই সাথে কৃষ্ণাঙ্গ শক্তিকে সফলভাবে কৃষ্ণাঙ্গ পুঁজিতে রূপান্তর করতে সমর্থ হয়েছিল।
জে. ডি. রকফেলারের আদর্শ মাথায় রেখে রকফেলার ফাউন্ডেশন মার্টিন লুথার কিং সিনিয়রের (মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের পিতা) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিল। তবে স্টুডেন্ট নন-ভায়োলেন্ট কো-অর্ডিনেটিং কমিটি (এসএনসিসি) ও ব্ল্যাক প্যান্থার্স-এর মতো আরো জঙ্গি সংগঠনের উত্থানের ফলে মার্টিনের প্রভাব ম্লান হয়ে পড়তে থাকে। তখন এগিয়ে আসে ফোর্ড ও রকফেলার ফাউন্ডেশন। কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা ১৯৭০ সালে ‘মধ্যপন্থী’ কৃষ্ণাঙ্গ সংগঠনগুলোকে ১৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়। লোকজনকে আর্থিক সাহায্য, ফেলোশিপ দেয়া , স্কলারশিপ প্রদান , পড়াশোনার মাঝপথে ঝরে পড়াদের জন্য পেশাগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, এবং কৃষ্ণাঙ্গ মালিকানাধীন ব্যবসায়ে মূলধন জোগান দেয়ায় এই টাকা ব্যয় হয়। নিপীড়ন, অর্ন্তকলহ, এবং অনুদানের হানি ট্র্যাপে পড়ে সংস্কারপন্থী কৃষ্ণাঙ্গ সংগঠনগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ, ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের মধ্যে এক নিষিদ্ধ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছিলেন। ফলে তিনি নিহত হওয়ার পর টক্সিকে পরিণত হন। এমনকী তার স্মৃতি পর্যন্ত জন-শৃঙ্খলার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে ফাউন্ডেশন ও কর্পোরেশনগুলো কঠোর পরিশ্রম করে তার কৃতিত্বের ঐতিহ্যকে বাজার-বান্ধব অবয়বে নতুন করে তৈরি করে। এই লক্ষে প্রতিষ্ঠা করা হয় দ্য মার্টিন লুথার কিং জিুনিয়র সেন্টার ফর ননভায়োল্যান্ট সোস্যাল চেঞ্জ । ফোর্ড মোটর কোম্পানি, জেনারেল মোটরস, মোবিল, ওয়েস্টার্ন ইলেকট্রিক, প্রোকটর অ্যান্ড গ্যাম্বল, ইউএস স্টিল, মনসান্টো এবং আরো অনেকে মিলে ২ মিলিয়ন ডলার তহবিল দিয়ে এটি প্রতিষ্ঠা করে। এই সেন্টারই কিং লাইব্রেরি ও সিভিল রাইটস মুভমেন্টের আর্কাইভ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত আছে। কিং সেন্টার যেসব কর্মসূচী চালায় সেসব প্রকল্পের সাথে ‘‘মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর, সশস্ত্র বাহিনীর চ্যাপলিন বোর্ড, ও অন্যদের’’ ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে। আবার ‘‘দ্য ফ্রি এন্টারপ্রাইজ সিস্টেম: অ্যান এজেন্ট ফর নন-ভায়োলেন্ট সোস্যাল চেঞ্জ” নামে অভিহিত “মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র লেকচার সিরিজ”-এর সহ-পৃষ্ঠপোষকও হলো এই সেন্টার।
আমেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামেও একই ধরণের ক্যু পরিচালনা করা হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে রকফেলার ফাউন্ডেশন দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি-বিষয়ক একটি স্টাডি কমিশন গঠন করে। কমিশনের রিপোর্টে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এনএনসি) এর ওপর সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়, সব বর্ণের মানুষের মধ্যে সত্যিকারের রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগি করে দেয়া হলেই কেবল দক্ষিণ আফ্রিকায় মার্কিন কৌশলগত ও কর্পোরেট স্বার্থ (অর্থাৎ, দক্ষিণ আফ্রিকার খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার) সবচেয়ে ভালোভাবে রক্ষা করা যেতে পারে।
এই রিপোর্টের পর ফাউন্ডেশনগুলো এএনসিকে মদদ দিতে শুরু করে। অল্প দিনের মধ্যেই এএনসি স্টিভ বিকো’র ব্ল্যাক কনসাসনেস-এর মতো আন্দোলন- যেগুলো আরো বেশি সংস্কারবাদী- সেগুলোর দিকে নজর ফেরায় এবং তাদেরকে কমবেশি বিলীন করে দেয়। নেলসন ম্যান্ডেলা যখন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তাকে জীবন্ত সন্ন্যাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে কারাগারে ২৭ বছর অতিবাহিত করেছেন, এই স্বীকৃতি ঠিক সেজন্য নয়, বরং তিনি সম্পূর্ণভাবে ওয়াশিংটন নির্ভর ঐক্যের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন- সেই জন্য। এরপর এএনসি’র এজেন্ডা থেকে সমাজতন্ত্র অদৃশ্য হয়ে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার মহান “শান্তিপূর্ণ উত্তরণ”- যা খুবই প্রশংসা ও উৎফুল্লতার সঙ্গে গ্রহণ করা হয়- অতঃপর তার মানে হয়ে দাঁড়ায় কোনো ভূমি সংস্কার নয়, ক্ষতিপূরণের কোনো দাবী নয়, এবং দক্ষিণ আফ্রিকার খনিগুলোর কোন জাতীয়করণ নয়। এর বদলে সেখানে বেসরকারিকরণ এবং কাঠামোগত সমন্বয় সাধন করা হয়। ম্যান্ডেলা তার পুরনো সমর্থক ও বন্ধু জেনারেল সুহার্তো- যে কীনা ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্টদের হত্যাকারী, তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারে (দ্য অর্ডার অব গুড হোপ) ভূষিত করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় এখন, যারা একসময় আমূল সংস্কারের দাবী তুলেছিল তারা এবং ট্রেড ইউনিয়ন্সিট একটি দল মার্সিডিসে চড়ে দেশ শাসন করছে। কৃষ্ণাঙ্গ স্বাধীনতার মিথকে চিরস্থায়ী করার জন্য এইসব যথেষ্ঠরও বেশিই বটে!
যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ শক্তির উত্থান ভারতে আমূল সংস্কারপন্থী, প্রগতিশীল দলিত আন্দোলন উত্থানের জন্য উৎসাহ জাগানিয়া মুহূর্ত তৈরি করেছিল। ব্ল্যাক প্যান্থারের জঙ্গি রাজনীতির আদলে দলিত প্যান্থার্সের মতো সংগঠন গড়ে ওঠে। কিন্তু দলিত শক্তিও, ঠিক একইভাবে না হলেও একই ধরনের উপায়ে ভেঙে পড়ে। তাদেরকে ভেঙে দেয়ার এই কাজে সহায়তা করে ডানপন্থী হিন্দু সংগঠন ও ফোর্ড ফাউন্ডেশন। অতঃপর দলিত শক্তি পরিবর্তিত হয়ে ক্রমশ দলিত পুঁজির পথে হাঁটতে শুর করে।
গত বছরের ডিসেম্বরে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছিল, “জাতপাতের চেয়ে ব্যবসা বড়, দলিত ইনকর্পোরেট তা প্রমাণ করতে প্রস্তুত।” এতে দলিত ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিআইসিসিআই) এক পরামর্শদাতার উদ্ধৃতি দেওয়া হয়। তিনি বলেন, “আমাদের সমাজে দলিতদের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীকে পাওয়া কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু যখন টাটা ও গোদরেজের সঙ্গে দলিত উদ্যোক্তাদের মধ্যাহ্নভোজন বা চা পানের ছবি প্রকাশ হয়, তখন তা যথেষ্ঠ উদ্দীপনা সৃষ্টি করে বৈকি- এবং এতে প্রমাণ হয় যে তারা এসে গেছে।” আধুনিক ভারতে যে অবস্থা তাতে দলিত উদ্যোক্তারা সমাজের উঁচু আসনে বসার অধিকার রাখে না, এ ধরণের মন্তব্য করাটা চরম বর্ণবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল। তবে এমন করে বলাটাই যদি উৎসাহজাগানিয়া এবং দলিত রাজনীতির আদর্শগত রূপরেখা হয় তাহলে তা হবে খুবই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। এবং তা ১০ লাখ দলিত মানুষ যারা আজও মেথরের কাজ করেন, মাথায় করে মানুষের মল-মূত্র বহন করে জীবিকানির্বাহ করেন, তাদের কোন কাজে আসবে বলে মনে হয় না।
(চলবে)
গ্রন্থ: ক্যাপিটালিজম অ্যা গোস্ট স্টোরি
লেখক: অরুন্ধতী রায়
অনুবাদক: মূর্তালা রামাত ও শারমিন শিমুল
[বইটি বাংলা ভাষায় ধারাবাহিক প্রকাশ হতে থাকবে; প্রতি শুক্রবার।]