কার্টুনিস্ট দোপেয়াজা, আসল নাম কাজী আবুল কাশেম, তিনি ভারত উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম কার্টুনিস্ট। তিনি মারা যান ২০০৩ সালে, ৭ আগস্ট। মেহেদী হক ও অনিক খান তাঁর ইন্টারভিউ নেওয়ার এক বিরল সুযোগ পান, যা ইংরেজিতে প্রকাশ হয় নিউ এইজ পত্রিকায়। সেই সাক্ষাৎকারের বাংলা তর্জমা করা হলো। অনুবাদ করেছেন আরিফুল ইসলাম ইমন।

কার্টুন কোন পরিসংখ্যান না, এর সময়সীমা রয়েছে, এবং এই সময়সীমা তাকে ইতিহাসের অংশ করে। কার্টুন হচ্ছে সাহিত্যের মতো; এটা পুরাতন হবে না।
মেহেদী হক: আপনি এই ভারত উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম কার্টুনিস্ট। এরকম প্রতিকূল পরিবেশে কেন একজন কার্টুনিস্ট হতে চাইলেন?
কাজী আবুল কাশেম: ছোট কথায় এর জবাব দিলে হবে না। প্রতিটা মানব সন্তানের নিজস্ব পছন্দ রয়েছে এবং সে ছোটবেলা থেকেই তার পেছনে লেগে থাকে, যেখানে সে নিজেকে খুঁজে পায়। আমার ছোটবেলা থেকেই ড্রয়িং ভালো লাগতো, স্কুলের নোটবুকে প্রায়ই আঁকাআঁকি করতাম, আমি প্রথম যা আঁকি তা হচ্ছে একজন রোগা মানুষের ছবি, যে আগে অনেক মোটা ছিল, কিন্তু সিগারেট খেতে খেতে তার চামড়া গায়ে লেগে যায়। আর ক্যাপশন ছিলো – হঠাৎ বাবু হাড়গিলে। এই ছিল আমার প্রথম কার্টুনের বিষয়বস্তু।
মেহেদী: আপনার প্রথম কার্টুন কবে প্রকাশ পায়?
আবুল কাশেম: সেটা ছিল ১৯৩০ সাল। সওগত পত্রিকায়, মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন ছিলেন সেই পত্রিকার সম্পাদক। অনেকেই সেই কার্টুনের প্রশংসা করেছিল।
মেহেদী: আচ্ছা, সে সময় পলিটিক্যাল কার্টুন আঁকার কারণে কোন সমস্যায় পড়তে হয়েছিল?
আবুল কাশেম: না, ব্রিটিশ আমলে আমাকে এরকম কোন সমস্যায় পড়তে হয় নি। তবে পাকিস্তান শাসনকালে সমস্যায় পড়েছিলাম খুব। হুমকি পেয়েছিলাম। আমি এক গাভীর ছবি এঁকেছিলাম, যেটা পূর্ব পাকিস্তানের ঘাস খাচ্ছে কিন্তু দুধ দিচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। এটা প্রকাশ পাওয়ার পর আমার নতুন বাসা খুঁজতে হয়েছিল।
মেহেদী: আমরা শুনেছি তৎকালীন সময়ে কয়েকজন কার্টুনিস্ট মিলে দেয়ালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আঁকেন, আপনি তাদের সাথে ছিলেন?
আবুল কাশেম: না, এরকম কিছু করেছি বলে আমার মনে পড়ে না, আসলে আমার বয়সও হয়েছে, এই কারণে হয়তো সব মনে নেই।
মেহেদী: আপনার পরে আর কে কার্টুনিস্ট ছিল, পাকিস্তানি শাসনকালে?
আবুল কাশেম: সেই সময় অনেকেই কার্টুনিস্ট ছিল, আমার রফিকুন নবীর কথা মনে পড়ে। সে বলেছে, সে আমার দ্বারা অনেক অনুপ্রাণিত ছিল।
মেহেদী: তখন কার্টুন এঁকে রোজগার এর কোন সুবিধা পেতেন?
আবুল কাশেম: মোটেও না। অর্থনৈতিকভাবে কোন সাহায্যই হতো না। প্রেরণা দেবার লোকের অভাব হতো না ঠিকই, তবে রোজগার তেমন হতো না। মোটেও না।
মেহেদী: কার্টুনের কোন দিকটা আপনি বেশি গুরুত্ব দেন, ড্রয়িং না ডায়লগ?
আবুল কাশেম: ড্রয়িং। ড্রয়িংয়ের উদ্দেশ্যকে সহায়তা করার জন্য কখনো কখনো ডায়লগের দরকার হয়। কিন্তু কার্টুনের নিজস্ব বলার ভাষা আছে। আসলে সংলাপ এবং ড্রয়িং দুইটা জিনিস কার্টুনের কাঁচামাল।
মেহেদী: ক্রিটিকরা বলে থাকে, পলিটিক্যাল কার্টুন তেমন টিকে থাকে না, আজ যেটা দাম পাচ্ছে কাল বাদে তার দাম নাই, কিন্তু মন ভোলানো, কৌশলপূর্ণ কার্টুন টিকে থাকে! আপনার কি মনোভাব?
আবুল কাশেম: এইভাবে আপনি বিচার করতে পারেন না। দেখুন, পৃথিবীর সব কিছুই প্রতিনিয়ত পরির্বতিত হচ্ছে। কার্টুন কোন পরিসংখ্যান না, এর সময়সীমা রয়েছে, এবং এই সময়সীমা তাকে ইতিহাসের অংশ করে। কার্টুন হচ্ছে সাহিত্যের মতো; এটা পুরাতন হবে না।
মেহেদী: এখন তো কম্পিউটারের যুগ। বিভিন্ন টাইপের কার্টুন হচ্ছে এই মাধ্যমে। আপনি এটা কিভাবে দেখেন?
আবুল কাশেম: এটা ভাল, তবে হাতে আঁকা কার্টুন বেশি ভাল। আমাদের সেই সময় আমরা এনিমেশন নিয়ে কাজ করেছিলাম একবার!
মেহেদী: সেটা ঠিক কোন সময়?
আবুল কাশেম: সেটা ১৯৪৬ সালের কোন এক মাসে। আমি এন মিত্র কোম্পানির জন্য কাজ করতাম। নলীনি আমার কলিগ, আমার সাথে কাজ করতো। সে একবার বোম্বে গিয়েছিল। সেখানকার এক পরিচালক, আমার কথা জানতে পেয়ে কলকাতা চলে আসে। সে একটা এনিমেটেড ছবি বানাবে। ছবিটার নাম ছিল শাবাশ এবং মূল চরিত্র শেখ চিল্লি। তখন আমরা খুব মেহনত করেছিলাম। প্রতি সেকেন্ডে ২২ থেকে ২৪টা ড্রয়িং করতে হতো। সেই ইউনিটে আমিই একমাত্র মুসলিম কার্টুনিস্ট ছিলাম।
মেহেদী: সে সময় কি কি কার্টুন আঁকা হতো?
আবুল কাশেম: অনেক প্রকার কার্টুন আঁকাহতো। কিছু কিছু আমাদের বিনোদন দেবার জন্য, আবার কিছু কিছুতে সামাজিক ভণ্ডামি তুলে ধরা হতো, তবে আমি সামাজিক কার্টুনই পছন্দ করি। এটা খুব জরুরী।
মেহেদী: এই যুগের কার্টুন নিয়ে আপনার কি চিন্তা-ভাবনা?
আবুল কাশেম: কোয়ালিটি আছে এরকম কার্টুনের অভাব নাই। তবে বেশির ভাগেরই গভীরতা নাই। একটা ভালো বিষয়-বস্তু ভালো কার্টুনের বৈশিষ্ট্য।
মেহেদী: বিভিন্ন প্রকার তথ্য প্রকাশে কার্টুনকে কি রকম মাধ্যম মনে করেন?
আবুল কাশেম: এটা সবচেয়ে ভাল মাধ্যম। কেননা, দশ পাতার রচনার চেয়ে একটা কার্টুন বেশি তথ্য প্রকাশ এবং বহন করে।
মেহেদী: তরুণ কার্টুনিস্টদের জন্য আপনার কি বলবার আছে?
আবুল কাশেম: তাদের অবশ্যই রসিকতার সেন্স থাকতে হবে! বুঝতে হবে এটা এক প্যারোডি। আর হ্যাঁ, ভালো বিষয়বস্তু দরকার।
মেহেদী: আচ্ছা আপনার কি মনে হয়, আপনি এবং আপনার কাজ সঠিক মূল্যায়ন পায় নাই?
আবুল কাশেম: দেখুন, আমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি, চারটা গোল্ড মেডেল পেয়েছি। কিন্তু আমার বন্ধুরা আমাকে বলেছে, আমাকে একুশে পদক দেওয়া উচিৎ ছিল। কেননা, অনেক অযোগ্য লোক ঐ পুরস্কার পেয়ে নিজেকে আমার সাথে তুলনা করে।
মেহেদী: আপনার এই মূল্যবান সময় আমাদের দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আবুল কাশেম: আপনাদেরও ধন্যবাদ