এই লেখাগুলি লেখার পেছনে যে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিপ্রায় বা তুমুল কোনো উদ্দেশ্য আছে বিষয়টা সেরকম নয়, একটা গ্রন্থভুক্তির তাগিদ থেকে এদের শুরুটাও নয়, তবে তাগিদ কি কিছুই ছিলো না তাহলে?
যা ছিলো সত্যাসত্য, তা হলো অভিব্যক্তি, একটা যাপনসন্ধির ভিতর অভিব্যক্তিগুলি আসক্ত, কবিতার তাড়নাই সেই অনির্ণিত আসক্তি৷ টুকটাক লিখতে থাকা আর লিখে লিখে ফেলে রাখা, এভাবেই বোধের জানালায় এসে বসে কালের বিভ্রান্তি-অযুত বেদনাযশ-মনুষ্য লিপ্সার প্রতি দুরন্ত পক্ষপাত, লেখাগুলি ফেলে রেখে রোদে শুকাই, জলে ধুতে দেই, বসন্ত অভিমুখে ছুড়ে দেই পিং পং বলের মতো, নতুন লেখা আসে, পড়ে থাকে, থেকে থেকে আত্মসংবরণ করে তারাও, একসময় পক্ষপাতের মতো দেখি লেখাগুলি বিভ্রম-বেদনা-লিপ্সার টানেলে ঢুকে গিয়ে বসে থাকে, অনুভব আরকি৷
এভাবেই ‘কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা’র কবিতাগুলি আকৃতি পেয়ে যায়, যাপনের সাথে মনস্তত্ত্ব
কতটা যে ভেসে গেছে ভাবপ্রকৌশলে, একদম হঠাৎই ঘটে যাওয়া মনে হয় না এসব, যাপনে ক্লান্তি এসেছে, মৃত্যু এসেছে, গ্লানি-দ্বিধা-অসুখ এসে কেউ ফিরে যায়নি, কবিতায় এলিয়ে দিয়েছে গা, যীশুকে নিয়ে কিছু লেখা লিখেছি যারা একসময় পুরো একটা কাব্যসমষ্টির গতিবিধিই বদলে দিয়েছে, দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে অন্যসব কবিতার অন্তর৷ এইতো, এসবই গ্রন্থটির গুছিয়ে ওঠার গল্প৷
– সাজ্জাদ সাঈফ
বই: কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা
কবি: সাজ্জাদ সাঈফ
প্রকাশক: তিউড়ি প্রকাশন
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
পাঁচটি কবিতা
ভোরের কলধ্বনি শুনি, কোনও রূপকথা হতে পেতলের কলসে করে জনপদে ভেসে এলো সূর্য, সিন্ধুঘনিষ্ঠ এ মরু!
সমস্ত হাওয়ায় বারুদগন্ধের অভ্যর্থনাও টের পায় মানুষ, অজেয় রক্ষাকবচ বুঝি এইসব মারণব্যস্ততা এইসব অপঘাত; সকরুণ মেঘমালা ওড়ে, সকৌতুকে!
পাখি আর ডাকে না যেখানে, অন্তর্যামী আর তাশের রাজা দৃশ্যপটে পায়চারী করে গেল, সারাটি দিন;
কেমন অগ্নিদগ্ধ এই বেলা ক্রুশকল্পনার দেশ, বধির পাখি ডাকেও না যেনো তার পাখা ঝাপটানোই ভাষা!
প্যালেস্টাইন, উপদ্রুত নগরীর অরূপরতন- মানুষের স্বপ্ন থেকে সব কোলাহল, সব খেঁজুর বাগান, সব নহরের জলধারার ওপর শ্বাপদনখরের দাগ পাঠ্যবইয়ের মলাটে বেঁধে দিচ্ছেন মায়েরা; এরই পাশে রাস্তার ধারে মাইন পুঁতে রেখে যায় জায়নবাদীরা, শিশুরা স্কুলে যাবে এই সেই পথ৷
আর্তচিৎকারের মত আদিগন্ত সাইরেনে ধূসর আকাশ, পানশালা হতে চিমনীর ধোঁয়ায় ঈশ্বরও বেরিয়ে গেলেন, প্রাতঃভ্রমণে, এইমাত্রই!
বিরান তেপান্তরের দিকে ফিরিয়ে নিয়েছি মুখ, সংঘ থেকে দূরে, ছায়া তার ভিজে গেছে অবাধ শিশিরে৷
রূপমুগ্ধ মানুষের কাছে হেলে পড়ে চাঁদ, সে এক নিবিড় নিনাদ, লু হাওয়া চারিদিকে, চোখের কোটর ঢেকে নিদ্রা গিয়েছে গ্রাম, শুধু ধোঁয়া ছেড়ে হাই তোলে ভাটার চিমনীগুলা৷
আত্মপীড়ন শোভনীয় নয় বুঝি আর! তারুণ্যের প্রান্তে এসে, মাটিতে কনুই ঠেকিয়ে হামাগুড়ি দিতে শুরু করে মন, পুরনো ফটোর মতো ছত্রাকে খাওয়া দাগ নিয়ে বসে থাকে পথে, কুয়াশা জড়িয়ে ধরেছে তাকেও!
গান ছিলো, আজ সংঘবহির্ভূত; স্মৃতির দম্ভে শুধু খসখসে পাতা ঝরে পড়ে!
আমাকে রক্তাক্ত করে যে কাঁটার পত্রালি, আমি তার গাছ ঘরের কাছেই এনে লাগিয়েছি, দাঁড় ফেলে বহুদূর ঘুরিয়ে পরে এই রক্তপাতের চারা এনে দিয়েছে বিমল৷
এই গাছ ধরে দাঁড়িয়েছি কত, আর দেখেছি, আপনজনেরা নিজ নিজ মৃতদেহ নিয়ে ত্যাগ করছে বাড়ি, আমার রক্ত ঝরে সুফলা হয়েছে গাছ৷
আর তখন যে কি হয়, দাবানল থেকে ছুটে পালানো অরণ্যবকের মত, গ্রহদূরান্তগামী অদ্ভূত সব গান এসে বিষণ্ন মস্তিষ্ক তোলপাড় করে, এক নিমেষে৷
জিয়ল মাছের পাতিল দেখিয়ে মা’র বলা কথা কানে বাজে আমার—তোর বাপ আনছে তোর আওয়ার কথা হুইনা, কতদিন পর আইলি এইবার তুই, রোগা হৈয়া গেছত বাবা!
মা আমার শতমুখী ফুলের বাগান, মা আমার চেহারা ভেবে কত না আহত হন মনে, ধূসর বলাকা ডেকে ডেকে ক্লান্ত যেন তার সন্তানেরে সারা আসমানে; কত ফুল জলে ভেসে যায়, ঝড়ের আঘাত নিয়ে শতমুখী ফুলের বাগানে!
হৃদপিণ্ডে একটা চড়ের আঘাতে আমার মৃত্যু হবে- প্রচন্ড ভিড় ঠেলে হিন্দুপাড়ার বটগাছে এসে বসবে অচেনা জাতের পেঁচা, কিশোরেরা স্কুলমাঠে আগত শীতে কাতর!
আইল্যান্ডে, শহীদ মিনারে থাকবে না কোনও দ্বিজ পায়রা, পথিমধ্যে চেইন পড়ে গিয়ে ব্রেক কষবে রিকশা চালক!
আমি ব্যথার শরীরে ধীরক্রমে শিথিল হতে হতে সুনসান, প্লাবনের জলে টলমল আত্মজার চোখ;নিস্তব্ধ হাসনাহেনা ভুলে যাবে সুরভীস্বভাব, বাগানে আমার?