কবিতা কী করে চিনবো?-এই রকম একটা প্রশ্নকে ঘুরিয়ে বলা যায়, কবিতা লোকে কী করে চেনে? শর্টকার্টে উত্তর দেয়া যায়- লোকে লোকের রুচির মাপে কবিতা চিনে। কথাটারে ঘুরায়ে বলতে পারি, লোকের কবিতা পাঠ তার রুচি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অথবা নির্ধারিত। তাহলে ভাবতে পারি, রুচি কীভাবে তয়ের হয়? এটা কি কাল নিরপেক্ষ কোনো দৈবী ব্যাপার? আমাকে কেউ জিজ্ঞাস করলে বলবো মানুষের পাঠরুচি একটা সাংস্কৃতিক ব্যাপার। একটা সমাজে পাঠের পরিস্থিতি ও বিস্তৃতির পাটার উপরে গড়ে ওঠে ঐ সমাজের লোকের পাঠরুচি। যেহেতু আমরা মূলত আলাপ পাড়তেছি কবিতা নিয়া, সেহেতু আমাদের সমাজে লোকের কবিতারুচি কী কী উপায়ে গড়ে ওঠে তার তত্ত্বতালাশ নেয়ার চেষ্টা করবো।
চোখ বন্ধ করে যদি স্মরণ করি, আমরা প্রথম কবে কবিতা পড়লাম? প্রায় সকল শিক্ষিত জনেরাই বলবেন, ছড়া দিয়েই মূলত আমাদের প্রথম কবিতা পড়া। এবং যে কোনো প্রথম কিছুর মতো (যেমন: প্রথম প্রেম) তাদের মধ্য থেকে বিপুল লোকে ছড়াকেই কবিতা ঠাউরে জীবন পার করে, মরেও যায়। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠক-জনতা ছড়ার যে একটা বাঁধন বা গাঁথনি, মাত্রা-তাল-লয়, তাকেই কবিতার মৌল সত্য বলে বিশ্বাস করেন, প্রচার করেন এবং কেউ কেউ জীবন-শিশু সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। শৈশবের আরও বহু জিনিসের মতো এই কবিতার চেতনা মনের মধ্যে পাথর হয়ে বসে যায়। এই চেতনার মেইন পিলার হইলো ‘অন্ত্যমিল। তারা ‘অন্ত্যমিল’কেই কবিতার ব্রহ্মাস্ত্র মনে করে। এই পাঠকগোষ্ঠী সংখ্যায় বড় এবং স্কুল পাশ/ফেলের পর কবিতাকে চিরছুটি দিয়ে দেন। পরে তাদের ‘গোঁ’ আর সহজে কাটে না। এই না কাটার পিছনে আরেকটা বড় জ্বালানি যোগান দেয় জনপ্রিয় রাজনৈতিক স্লোগান কিংবা গান। কারণ এই দুই উপাদানের মধ্যে কবিতা কিছু মাত্রায় আছে এবং এগুলো সোসাইটিতে বেশ শক্তিশালী। আর ‘অন্ত্যমিল’ যেহেতু উভয়ে আছে, ফলে তাদের ‘অন্ত্যমিল-ই কবিতা— এই ধারণা হালে বেশ পানি পায় বটে।
যদিও ‘অন্ত্যমিল’ দিয়েও আমরা শক্তিশালী কবিত্বকে চিনতে পারি। সেও অবশ্য প্রথাগত অন্ত্যমিলকে আক্রমণ করতে পারার ক্ষমতার নিরিখে। এই কারণে ছেলে ভুলানো ছড়া আর অন্ত্যমিলকে অতিক্রম করতে পারাই একজন কবি কিংবা পাঠকের প্রথম চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।
আমাদের কবিতার মানে বাংলা কবিতার সবচেয়ে বড় সময়টাই শাসন করেছে ‘অন্ত্যমিল’অলা কবিরা। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন, কেবল অন্ত্যমিলের গুণেই সেসব কবিতা কালের প্রাচীর পার হইছে, তাহলে তার চেয়ে বড় অপলাপ আর কিছু হইতে পারে না। আমরা অনুপ্রাসকে অ্ন্ত্যমিলে সংকুচিত করে, রসকে নিংড়ে কষ বের করে দিয়ে, তাকেই কবিতা বলে চিনতে শিখিয়েছি। ফলে কবিতা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আয়োজন (ফেসবুক গ্রুপ, পাঠের আসর, পাড়াভিত্তিক সাহিত্য পরিসর, আবৃত্তি শালা) এই শুকনা অন্ত্যমিলেরই কারবারি।
এতক্ষণের আলাপে মনে হতে পারে, এই কারবারিদের খপ্পর থেকে মুক্তি পেলেই কেউ হয়তো কবিতার সদর রাস্তায় গিয়ে পড়বেন। ব্যাপারটা এত সোজা নয়। সামনে আছে আরও খানা-খন্দ। কারণ এই বর্তমানের কবি কিংবা পাঠক একই সাথে প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতার গ্রাহ্যতাকে যেমন অস্বীকার করতে পারবে না, তেমনি সে মুখামুখি হতে বাধ্য জটাজটিল আধুনিক কবিতার। কবিতার এই দীর্ঘ যাত্রা মনের রসে পরিপাক হয়ে রুচির বহু স্তর/ধরন তৈরি করেছে। সেই একেকটা স্তর/ধরন কবিতার একেকটা মাপকাঠি হয়ে সমাজে কবিতাকে চিহ্নিত করে চলেছে।
কবিতার সেই ধরনগুলি চেনার জন্য, শুধু কবিতা পাঠই করতে হবে তা নয়। সমাজে বহু পাঠের ভিতর দিয়ে কবিতার সংজ্ঞার্থ তয়ের হয়। বিভিন্ন যুগে যেমন বিভিন্ন সংজ্ঞার্থ তয়ের হয়। আবার একটা নির্দিষ্ট কালেও বহু রকমের সংজ্ঞার্থ সহাবস্থান করতে পারে। তবে লোকের মোটা চোখ যুগকে চিহ্নিত করে, কালের সবচেয়ে পাওয়ারফুল সংজ্ঞার্থের সাপেক্ষে। কিংবা সবচেয়ে শক্তিমান কবিটি কবিতা কী চোখে দেখতেছেন তার ওপর নির্ভর করে। বহু মানুষের শক্তিশালী চিন্তাকে যেমন প্রতিভাবান কবিটি ‘ক্যাশ’ করতে পারেন, তেমনি আবার বহু মানুষের ভিতরে গুঞ্জরিত বদলকে নিজের প্রতিভা ও চর্চা বলে কবিতায় রূপান্তর করে সমাজে ছড়ায়ে দিতে পারেন। দুয়ের এই বিবাহের ভিতর দিয়েই মূলত জন্ম নেয় কবিতার নতুন পথ।
সকল পথই কোনো না পথেরই অংশ। ফলে যাহা নতুন, তাহা পুরা নতুন নয়। এটা মাথায় রেখেই আগানো ভালো। ফলে বর্তমানকে চিনতে হলে তাকাতে হবে অতীতের দিকে। কবিতায় পুরানা জিনিস রত্ন বিশেষ। কিন্তু সেটাকে আনতে হয় নতুন উপায়ে চোলাই করে। পুরানাকে নতুন করে তোলার উপায় সন্ধানই হইতে পারে কবিতায় পৌঁছানোর কোনো রাস্তা। আমাদের ঐতিহ্য অনুরাগী কবিরা এই রাস্তায় হেঁটেই সাফল্যের ঝুড়ি ভরেছেন। কারো নামবিশেষ নিব না। ইশারাই কাফি। তাদের কাজের ধরন থেকে কবিতা চেনার সুযোগ ঘটতে পারে।
সময়কে কবিতার একটা বড় ক্যারেক্টার হিসাবে দেখতে পারি। লোকের বহু ক্রিয়াকলাপের ভিতর দিয়ে সময় নিজেকে সাজায়। সময়কে ‘রিড’ করতে পারার মধ্য দিয়ে কবিতা চেনা যেতে পারে। সময় বলতে কবিরা সাধারণত ত্রিকালকে বোঝেন। ফলে কারো কবিতায় সেই ত্রিকালের মাখামাখি যদি ঘটে, তবে সেটাকে কবিতা হিসাবে পাঠ করার সুযোগ থাকে। বর্তমানের চিন্তা-প্রবণতাকে অতীতের মায়ায় মাখিয়ে ভবিষ্যতের আসমানে মুক্ত করে দেয়ার ভাষা রপ্ত করাই কবির জন্য গুরুতর কাজ হতে পারে।
কবিতাকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করে কবির জীবনকালীন শাসকগোষ্ঠী কিংবা তাদের রাজনীতি চর্চার ধরন। এটা কেবল কবিতার বিষয়কেই প্রভাবিত করে না, কবির চৈতন্যকেও নিয়ন্ত্রণ করে। বদলে দেয়। শিল্প-সাহিত্যের ক্যানভাসে বড় জায়গা জুড়ে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দান আছে। জনতার রুচি তাদের চিন্তার অনুকূলে বা প্রতিরোধের চেতনায় সজ্জিত হয়, ফলে কবিতার বিষয় ও ফর্ম সে ভাবের উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠে। এই কারণে কোনো কোনো কবিতাকে চিনতে হয় ঐ কালের শাসন ব্যবস্থার নিরিখে।
এই ব্যবস্থারই কেন্দ্রে থাকে একটা শিক্ষিত শ্রেণি। তারা ঐ বিশেষ বিশেষ সময়ের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে থাকেন। স্বাক্ষর , নিরক্ষর এখানে ব্যাপার নয়। মূলত ব্যাপার হইলো এই শ্রেণিটাই কবিতা তথা সাহিত্য তথা শিল্পের শ্রোতা বা ভোক্তা। সমঝদারও বটে। ফলে তাদের রুচি তার কালের কবিতাকে অনেকখানি গড়েপিটে নেয়। এরা সমাজের অন্যান্য শ্রেণির রুচিকে ছেঁকে পরিস্রুত রুচি তৈরি করেন। কবিও যেহেতু ঐ শ্রেণিরই সদস্য, ফলে তিনিও ঐ প্রক্রিয়ায় নিজের রুচি গড়েন। একে অপরের মিলমিশে ব্যাপারটা তয়ের হয় বলে আমার ধারণা। কবি তার মৌল ক্ষমতা দিয়ে তাদের প্রভাবিত করেন। আবার তাদের সম্মিলিত গ্রহণ/বর্জন কবির সীমা নির্ধারণ করে।
প্রত্যেক কবিরই থাকে নিজস্ব ছন্দপথ। তাল, লয়, বাক্য ও শব্দ-বিন্যাসের এক বিশেষ ঘনীভূত রূপ। এ্ররই আরেক আদল সুর। বিষয় ও ফর্ম বিগলিত হয়ে যায় সেই বিশেষ ধ্বনিপ্রবাহের মধ্যে। কবিতার এটা একটা জরুরি গুণ। তরকারির নুনের মতো। সামান্য হেরফের হলেই যেমন স্বাদ নষ্ট হয়। তেমনি আবার পরিমাণের সুষমতা পরিপূর্ণতার আস্বাদ দেয়। সুর ছাড়া কবিতা হয় না। এমনকি কবিই হয় না। কবিতাকে/কবিকে চেনার সবচেয়ে সহজতম পথ সুর। একটা বিশেষ সুর আয়ত্ত করার জন্য কবিকে জীবন সাধনায় মগ্ন হতে হয়। আবিষ্কার করতে হয় নিজের ভিতরকার সুর। নিজেকে পুরে নিতে হয় বহির্জগতে নিত্য প্রবাহিত বিচিত্র সুরের ভিতর থেকে নিজের বাছাইকৃত সুরের খাপের ভিতরে। এর ফলে কবিতা শনাক্তযোগ্য হয়ে ওঠে। এখন প্রশ্ন হলো, সুর ছাড়া কি কবিতা হতে পারে না? কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারে যেহেতু গানই সুরের দাবি পূরণ করে বা প্রয়োজন মেটায়, কবিতা একে পরিত্যাগ করলেই পারে। কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার মনে রাখতে হবে, কবিতা এক ধরনের মিশ্র শিল্প মাধ্যম। ধ্বনিময়তা কবিতার আদি গুণ। শুধু কবিতা কেন, ভাষারই আদি গুণ। ফলে ভাষা সহজাতভাবে যে কোনো ফর্মে তার ধ্বনিগুণকে আহ্বান করে। এটা বীজের খোসার মতো। খোসা যেমন বীজকে সুরক্ষা দেয়/ দেহকে সুষমাময় করে, তেমনি সুর কবিতার ভাষাকে দেয় বিশেষ আব্রু ও উজ্জীবন। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ বাক্যের কোন বিন্যাসের ভিতর দিয়ে বসবে কিংবা কোন শব্দের পর কোন শব্দ বসবে সেটা ঠিক করে দেয় সুর। এই কারণে কবির কান হওয়া চাই বেশ পরিষ্কার ও তীক্ষ্ণ। আর দরকার লাগে শক্ত নিয়ন্ত্রণ, যাতে সুরের ওঠানামা-দৌড়াদৌড়ি কবির ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী হয়। বলতে ইচ্ছা হয়, সুরই কবিত্ব। কেননা সুরের সুষম প্রয়োগের ভিতর দিয়ে কবি সৃষ্টির সত্যকে, সৃষ্টজগতকে সবচেয়ে চারুরূপে প্রকাশ করতে পারেন।
স্রষ্টা নিজেকে প্রকাশ করার জন্য জগত সৃষ্টি করেন। সেই ধারণা থেকেই হয়তো সাহিত্যস্রষ্টার কাজে জগত খোঁজার চল আছে। ধর্মগ্রন্থ মতে, স্রষ্টা জগত সষ্টি করেন মাটি-বায়ু-পানি-আগুন দিয়ে। আর কবি/ শিল্পী জগত সৃষ্টি করেন স্রষ্টা নির্মিত জগতের বহু বিচিত্র দৃশ্য-সংবেদ ও কার্যকলাপের সারবস্তু নিয়ে। নিজের ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত বাছাই দিয়ে কবি তার জগতকে সাজান। এইটা দিয়ে কারও কাজ খুব দৃশ্যযোগ্য হয়ে ওঠে। খালি চোখে চেনা যায় কবি কিংবা কবিতাকে। ফলে এই বিশেষ জগত পড়ার ভিতর দিয়েও আমরা পড়তে পারি কোনো বিশেষ কবিকে।
সাহিত্যে পরিবেশ সৃষ্টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কোনো কবি পরিবেশ-প্রকৃতি পরিবেশনাকেই কাজের ক্ষেত্র করতে পারেন। কবির জগত সজ্জিত হয় পরিবেশের-ই নানা উপাদান সহযোগে। এ কারণে কবিতায় ভূগোল বা ল্যান্ডস্কেপ কখনো কখনো খুবই জরুরি বিষয়। কবিতার স্থানিক রূপকে ধরতে হলে পরিবেশ বা প্রকৃতি বড় অবলম্বন হতে পারে। কবির চিন্তা যে বস্তুবিশ্বের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করে, তার বেশিরভাগই ধারণ করে তার চারপাশের পরিবেশ বা প্রকৃতি। যদিও অন্য সকল বিষয়ের মতো কবিতার পরিবেশ রচিত হয় কবির মনোভঙ্গিরই আজ্ঞাবাহী হয়ে। ফলে কোনো কবি প্রকৃতিকে কীভাবে ডিল করেন, তার উপরে ঐ কবির কবিত্বের শক্তি বা লক্ষণ বোঝা যায়।
কবিতার আরেক বড় গুণ হইলো রস। শুকনা ফলের যেমন স্বাদ, রসহীন কবিতার ধরনও সেইরূপ। রস সৃষ্টি ঠিকভাবে না হইলে কবিতা পাইনসা হতে বাধ্য। শব্দের ভিতরকার সৌন্দর্যকে বার করে আনে রস। আর এটা পাঠকের মনের ভিতরকার রসের হাঁড়িটিকে উদাম করে দেয়। ফলে দুয়ের মধ্যে মাখামাখি অবস্থা তয়ের হয়। এ কারণে দেখবো, আমাদের বড় বড় কবিরা কেবল ভাবের তাঁবেদার নন, রসেরও কারবারি।
রসেরই আরেক দোকান উইট এবং হিউমার। ক্রেতাকে রসে তুষ্ট করার জন্য উইট আর হিউমার নামক দ্রব্যের চেয়ে খাসা জিনিস আর নাই। কবির ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা আর চাতুর্র রূপ ভাইসা ওঠে এই উপাদান প্রয়োগে। ফলে কবিতাকে আমরা এই উপাদান প্রয়োগের সাফল্যের আলোকেও বিচার করতে পারবো। পাঠক চিত্তবৃত্তিকে আরাম দিয়ে যদি তার চিন্তাকে উসকে দিতে পারে কবিতার কোনো উপাদান, তবে তা সবচেয়ে মোক্ষম পারে ‘উইট আর হিউমার’। ফলে এ দুইয়ের মাপেও আমরা কবিকে/ কবিতাকে মেপে নিতে পারবো কখনও কখনও।
কোনো কোনো কবির ঝোঁক থাকে নিজের অভিজ্ঞতাকে প্রফেটিক বাণীর আদলে প্রকাশ করার দিকে। যেটাকে অনেকে ‘আপ্তবাক্য’ ঠাউরে বাতিল বা পরিত্যাজ্য করতে চান, কেউ আবার চান মাথায় তুলে নাচতে। আমার আলাপ এই আন্দোলনবাদীতা নিয়ে নয়। মূলত আমি সম্ভাব্য প্রবণতাগুলাকে ধরতে চাইতেছি, যেগুলো কোনো না কোনোভাবে কবিতা হয়ে ওঠার কৌশল হিসাবে স্বীকৃত। এই ধরনের বাণী কবি কীভাবে দেন সেটা তার ব্যক্তিত্ব, রুচি, অভিজ্ঞতাসহ আরও নানান বিষয়ের ওপর নির্ভর করতে পারে। কিন্তু মানুষ তখনই সেটাকে আমলযোগ্য মনে করে যখন সে বাণী কাব্যগুণের সাথে প্রচল বাণীর সীমাকে অতিক্রম করে নতুনতর ধারণাকে ধারণ করতে সক্ষম হয়। এ কারণে এ ধরনটাকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। কারণ প্রফেট , ঋষিদের যুগ পার হওয়ার পর দার্শনিকরা মূলত বাণী দেওযার দায়িত্ব নিয়েছেন। কবি নিয়েছেন সৌন্দর্য সৃষ্টির দায়িত্ব। কবির ভাষা আর দার্শনিকের ভাষা যেহেতু এক নয়, ফলে কবিকে কবিত্বের তথা সৌন্দর্যের দাবি বা রসের দাবি মিটিয়েই দার্শনিকতার জায়গায় পৌঁছাইতে হয়। নাহলে আমার ধারণা, মানুষ বাণীর জন্য কেবল কবির কাছে আসবে না। কবির কাছে মানুষের দাবি বাণীকে বাঙ্ময় করে তোলার। ফলে কবিতার বাণী আর দার্শনিকের অনুসিদ্ধান্ত চেহারায় ভিন্ন। কাজে হয়তো কখনো কখনো তা সমান ভূমিকা ফলাইতে পারে।
কবি শব্দ নিয়ে কাজ করেন, এটা কে না জানে। আর শব্দসংখ্যা জগতে সীমিত। একই শব্দের সমার্থক শব্দ খুব বেশি যেমন নয়, আবার সমার্থক শব্দ থাকলেও সেটা কাজের উপযোগী নাও হতে পারে। ফলে ভাষার ভিতরে নতুন শব্দ সৃষ্টির সম্ভাবনাকে কবিরা কাজে লাগান। বাংলা ভাষায় এই ধরনের শব্দরে কয়- সাধিত শব্দ। এই শব্দ সাধনের মুন্সিগিরি করতে পারার ভিতর দিয়েও কবিকে চেনা যায়। প্রচল ভাষা ও বাক্যের ভিতরে নতুন কোনো স্বাদের যোগান আসতে পারে এই উপায়ে। শব্দের এই খেলা আরও ব্যঞ্জনা পায় বিশেষণ ও সর্বনাম ব্যবহারের পারদর্শিতার ওপর। বিশেষণ শব্দের চেনা চেহারাকে পাল্টে দেয়। কোনো শব্দকে যে অর্থে পেতে বা দেখতে অভ্যস্ত সেটাকে বদলে দেয়। আর সর্বনাম বাক্যের অর্থকে বহু খাতে ধাবিত করতে পারে। বাক্যবিন্যাসকে বিচিত্রমুখী করে তুলতে পারে। ফলে কবিতাভাষাও নতুনতর হয়ে ওঠে।
কবিতার আরেক জুররি ব্যাপার হইলো রচয়িতার যুগের ভাষা পরিস্থিতি। সব যুগেই সমাজে ভাষা নিয়ে একটা ক্রাইসিস থাকে। কারণ প্রতি জেনারেশনই নতুন ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। এই কারণে ভাষা নিয়ে আলাপ, ঝগড়া একটা চিরন্তন ব্যাপার। মুরব্বিরা জোয়ানদের ভাষা নিতে পারে না। আবার শ্রেণিও একটা ব্যাপার ভাষা বিবেচনায়। গরিব আর ধনীর ভাষার তফাত আছে। আছে গ্রাম আর শহরের ভাষার তফাত কিংবা প্রান্ত তথা কেন্দ্রের তফাত। এই বিচিত্র কাবজাবের ভিতর থেকে কবি তার নিজের ভাষা বেছে নেন। এই বেছে নেয়া থেকে আমরা কবির অবস্থান চিহ্নিত করতে পারবো। পাঠ করতে পারবো কবির কবিতাকে। ফলে কবিকে চেনার জন্য সমকালীন ভাষা-পরিস্থিতির নিরিখে চেনার তরিকাটা বেশ কাজের হতে পারে। কোন ভাষা আগুয়ান প্রজন্মের কাছে আদরনীয় হয়ে উঠতেছে , তার মানদণ্ডে কবির ব্যবহৃত ভাষা কতটা টেকসই তারও এক ধরনের আন্দাজ করতে পারবো ভাষা বিবেচনায়। এমনকি ঠাওরে নিতে পারবো নতুন কবিতার গতিপথ। আমার ধারণা, কবিতার ভাষা এক ধরনের কৃত্রিম ভাষা। কবি তার ভাষার ইতিহাসের লেখ্য ও কথ্যরূপ থেকে নিজের ভাষা নির্বাচন করেন। এই কাজে ভবিষ্যতের আওয়াজকে যে কবি সমকালের তটে দাঁড়িয়ে অনুভব করতে পারেন, তার ভাষা হয়তো হতে পারে সবচেয়ে বেশি টেকসই কিংবা স্থিতিস্থাপকতাগুণসম্পন্ন। কবিতার ভাষা অট্টালিকার সেই দেয়াল, যা ঝড়-তাপ-ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে বোধকে সুরক্ষা দিতে যেমন সক্ষম, তেমনি চোখ ও মনের আরামও নিশ্চিত করতে তৎপর।।
কবিতা তথা শিল্পে ‘ঘরানা’ বলে একটা ব্যাপার আছে। বহু শক্তিশালী স্রষ্টা নিজের সৃষ্টিকে এমন বিস্তৃত করতে পারেন, তার থেকে প্রেরণা নিয়ে- উপাদান নিয়ে নতুন পথ তৈরি হয় বা হতে পারে। এ কারণে দেখা যায়, সমাজে শক্তিশালী কবির কাব্যচিন্তা বা ভাষা কখনো কখনো বেশ প্রভাবসঞ্চারী হয়ে ওঠে। মূলকে দিয়ে যেমন ডাল চেনা যায়, তেমনি সেই শক্তিশালী কবিকে চেনার ভিতর দিয়ে ঐ ঘরানাকে চিহ্নিত করা যায়। বা পাঠ করা যায়। আবার কোনো কবির মধ্যে ঐ শক্তির টুকরা-টাকরা কীভাবে বিকিরণ ছড়ায়, তার নিরিখেও কবিতা পাঠ করা যায়। কারণ, কবিতা পরম্পরারও ব্যাপার । ফলে ঘরানাকে চেনার ক্ষেত্রে মূলকে ধরে সাম্প্রতিকে আসতে পারলে পাঠের শৃঙ্ক্ষলা তয়ের হয়। কে কার দ্বারা প্রভাবিত, অনুপ্রাণিত সেটা বোঝার সুযোগ ঘটে। আবার সমাজে চিন্তা কীভাবে প্রবাহিত সেটাও বোঝা যায়। এই প্রক্রিয়ায় কবিতার কোনো ধরনের সাথে লোকের আত্মীয়তা সাধিত হয়। আমরা যাকে বলি ‘সাইকি’, এসব ব্যাপার তা গড়ার ক্ষেত্রে বেশ ভূমিকা রাখে। ‘ঐতিহ্য’ ব্যাপারটাও সম্ভবত এভাবে তয়ের হয়। এদেরই আরেক নাম ‘ক্লাসিক’। কবি ও পাঠক উভয় পক্ষের রুচি তৈরিতে ক্লাসিক প্রধান শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। ফলে সমাজের বড় বড় কবিদের কাজকে বোঝার ভিতর দিয়ে আমরা কবিতাকে অনেকখানি চিনতে শিখবো।
ধর্মচিন্তা কি কবিতাকে গড়ে নিতে পারে? আজকাল অনেকে হয়তো বেশ চমকেই যাবেন। কিন্তু আমার একটা পাঠ হইলো, কবিতায় ধর্মচিন্তার উপস্থিতি বেশ জোরালো। ধর্ম যেমন বিশ্বাসের ব্যাপার, সংস্কৃতির ব্যাপার, দর্শনের ব্যাপার, ধর্ম সাহিত্যেরও ব্যাপার। বহু বড় বড় সাহিত্য ধর্মচিন্তারই চোলাই করা মাল। ফলে সাহিত্যে ধর্ম দেখলে পিলে চমকে যাবার কারণ নাই। যুগে যুগে যা গুণ থাকার কারণে ধর্মচিন্তা বা ধর্মের ব্যাপার সাহিত্য হয়ে উঠছে, সেই সাহিত্যগুণের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি বা বেশকম-এর আলোকে কবিতা পাঠ করা যায়। কবি ধর্মচিন্তাকে কী উপায়ে, কোন প্রয়োজনে কবিতায় প্রয়োগ করতেছেন তার নিরিখে চেনা যায় কবিকেও।
শিল্প বা সাহিত্যের ইতিহাসে শিল্প আন্দোলন বা সাহিত্য আন্দোলন মানুষের চিন্তা পদ্ধতিকে-দেখার চোখকে বদলে দেয়। আধুনিক যুগের সাহিত্য আন্দোলনমুখী সাহিত্য। পৃথিবীর প্রভাবশালী সাহিত্য আন্দোলন যেমন নানা দেশের সাহিত্যের মানকে বা সাহিত্যের ধরনকে নতুন করে সাজায়, তেমনি স্থানিক ধারণা, চিন্তা বা আন্দোলন ঐ অঞ্চলের সাহিত্যকে নতুন বিন্যাসের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। কবিতে কবিতে ভেদ, যুগে যুগে ভেদ রচনা করে সাহিত্য আন্দোলন। ফলে আধুনিক কবিতা পাঠ করতে হলে বা চিনতে হলে শিল্প আন্দোলনের ইতিহাস পাঠ না করার উপায় নাই। যখন জীবনান্দ বলেন , উপমাই কবিত্ব, তার মানে তিনি কবিতার নতুন একটা সংজ্ঞার্থ দিতে চান। বা উপমাকে কবিতা ভাবার যে চর্চা বিশ্বব্যাপী চলমান, তিনি নিজেকে সেই চর্চার-ই একজন বলে ঘোষণা করেন। আরেক বাঙালি কবি আল মাহমুদ বলেন, চিত্রকল্পই কবিতা। এই ঘোষণাও ইউরোপের ইমেজিস্ট মুভমেন্টের প্রতি অনুরাগের-ই প্রকাশ। ফলে কবিতা এসব ধ্যানধারণা দ্বারা কীভাবে প্রভাবিত তা বোঝারও ব্যাপার। কিংবা কবিতাকে কীভাবে গড়ে নেয় এইসব আন্দোলন, সেটা পাঠ করাও কবিতাকে চেনার বা ধরার এক কৌশল হতে পারে।
“ফ্যাশন হলো মুখোশ, স্টাইল হলো মুখশ্রী”- রবীন্দ্রনাথের এই বহুল প্রচলিত বয়ান ধার করেই বলি, কবির মুখশ্রীকে চিনতে হলে তার স্টাইলকে চেনা খুব জরুরি। ঘুরিয়ে বলা যায়, প্রত্যেক কবিরই থাকতে হয় ‘ব্যক্তিগত লিখন ভঙ্গিমা’। এটা গড়ে ওঠে কবির ভাষা দিয়ে, নিজস্ব বাক্যকলা দিয়ে। কোন ফর্মকে কবি বেছে নিচ্ছেন বা বাক্যকে কীভাবে বিন্যাস করছেন তার সাপেক্ষে গড়ে ওঠে কবির স্টাইল। কোনো কবি সারাজীবন একই স্টাইলে লিখে যেতে পারেন। কেউ নিজেকে ছড়িয়ে দেন বহু স্টাইলের ভিতরে। কেউ হয়তো সারা জীবন লিখে যান অন্যেরই স্টাইলে। ফলে এই স্টাইল পাঠ করার ভিতর দিয়ে কবি বা কবিতাকে পাঠ করা যায়। কবিতা চেনা যায়।
কবিতা চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে ফর্ম। কবিতার দেহকাঠামোর-ই আরেক নাম ফর্ম। কোন্ কবিতা সনেটে লেখা, কো্ন কবিতা মাত্রাবৃত্তে, কোন্ কবিতা স্বরবৃত্তে, কোন্ কবিতা টানা গদ্যে – এটা শাদা চোখেই বোঝা যায়। এই চেনা ফর্ম বা কাঠামোকে কবি নিজস্ব স্টাইল, চিন্তা বা ভাষা দিয়ে সাজান। মূলত, ‘আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী’র মতো কবিতার সাথে পাঠকের প্রথম পরিচয় ঘটে ফর্মের মাধ্যমে। ফলে ফর্ম পাঠ করা বা চেনা এক অর্থে কবিতা চেনা।
প্রতিটা ভাষারই নিজস্ব ইতিহাস আছে। আছে ব্যক্তি কবি বা পাঠকের নিজস্ব মনোভঙ্গি। তার আলোকে হাজারো রকমভাবেই নিশ্চয়ই কবিতা পাঠ করা যায়। আমার এই আলাপ হয়তো সহস্র সেসব আলাপের খসড়ামাত্র।
( চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রতীতি’ সাহিত্য আড্ডায় প্রদত্ত আলাপের পরিমার্জন)