যাত্রাঃ আত্মা অভিগমে, পেরিয়ে যাই অন্তর
জীবনযাত্রার কালে কষ্টদায়ী ও হতাশার অঙ্কুরোদগম ঘটানো বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ হয় না সর্বদা। এগুলোকে বদলানোর শক্তি আমাদের নাই বা থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের আচরণে এই সীমাবদ্ধতাগুলো সামাল দেয়ার কৌশল প্রয়োগের দিকগুলোকে অদল-বদল করাই যায়।
কনফুসিয়াসের ঠিক এই ব্যাপারটাই আমাদের জন্য মোক্ষম যে উনি আমাদের জানিয়ে দিতে পারেন কী করে জীবনের এসব অবধারিত অনুশোচনা ও দুর্দশা থেকে মুক্তি মেলাতে পারে আমাদের নির্মোহ প্রশান্ত মন।
কিন্তু সত্যই কি আড়াই হাজার বছর আগের প্রজ্ঞা আজকের মানুষের অন্তরের জটিল গিঁট ও ধন্দ তিরোহিত করতে পারে?
আমরা এই গ্রহে আমাদের পুরোটা জীবনের জন্যই আছি, কীভাবে আর এই জীবন হয়ে যাবে অনুশোচনারহিত? এই জীবনে মানুষেরা তাই পেয়ে থাকেন যা তারা হয়তো আশাও করেননি কখনো।
কনফুসিয়াসের ছিলো তিন হাজার শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে বাহাত্তর জন ছিলো অস্বাভাবিক মেধা ও গুণসম্পন্ন, এবং এদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু বিষয় ছিলো যা কনফুসিয়াসকে ব্যথাহত করেছিলো। তো তারা তাহলে কীভাবে দেখেছিলেন জীবনের যাতনাসমূহ?
একদিন তার ছাত্র Sima Niu ভারাক্রান্ত চিত্তে বলেনঃ ‘অন্য সবারই ভ্রাতা আছে, কেনো নাই শুধু আমারই?’
তার সহপাঠী তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলেঃ ‘ আমি শুনেছি জীবন ও মরণ নিয়তির ব্যাপার; প্রাচুর্য ও সম্মান স্রষ্টার হাতে। একজন Junzi অতীব সদয় এবং তিনি কোনো ভ্রান্তিবিলাসে নেই, অন্যকে যথাযথ সম্মান দেন তিনি এবং ধর্ম-নিয়ম মানেন, তাই Four Seas এর সবকিছুই তার ভ্রাতা। কোন কারণে তাহলে একজন Junzi কে ভ্রাতার জন্য আফসোস করতে হবে?
এইসব শব্দ ভিন্ন ভিন্ন স্তরে পাঠ্য। যেহেতু জীবন ও মরণ, প্রাচুর্য ও সম্মান এবং এ জাতীয় অন্যবিধ বিষয়গুলো নিয়তিনিয়ন্ত্রিত, তাই এরা আমাদের আওতার বাইরে। আমাদের শিখতে হবে কীভাবে এগুলোকে গ্রহণ করে নেয়া যায়, এবং আমাদের ভাগ্যের সাথে হাঁটা যায়।
কিন্তু আমাদের কথা ও কর্মের ভুল কমিয়ে আনতে আর অন্যকে সমাদর ও সম্মান জানিয়ে আচরণ করতে হলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে আমাদের পক্ষে সুবিনীত ও সম্ভ্রমপরায়ণ অন্তর জাগরূক রাখতে হবে। যদি আপনি নিজের মতোন হয়ে উঠতে পারেন তবে দুনিয়ার যেকোন প্রান্তের লোকেরাই আপনাকে ভ্রাতার সম্মান দেখাবে ভালোবেসেই।
অতএব, আপনি যদি একজন আসল ও পরীক্ষিত Junzi হন তবে ভাই থাকা না থাকা নিয়ে বিমর্ষ হবেন কেনো?
এই কথাগুলো যদিও কনফুসিয়াসের মুখ থেকে আসেনি তথাপি এগুলো তার দর্শনকেই বহন করে।
আপনাকে সোজাসুজিভাবে নিজের অনুশোচনাগুলোর মুখোমুখি হতে হবে এবং যত অল্প সময়ে সম্ভব তাদের মেনে নিতে হবে। আপনি অবশ্যই আপনার অনুশোচনার ও দুর্ভাগ্যের মাঝে লটকে থাকতে পারেন না আর বারবার কেনো এমন হয় তাও জানতে চাইতে পারেন না – এতে আপনার কষ্টই শুধু বাড়বে আর কিছু নয়।
দ্বিতীয়ত, আপনার উচিত হবে যতটা সম্ভব এই অনুশোচনাকে ও দুঃখবোধকে সারিয়ে তোলা। একটা ছোট দুঃখই অন্য সব কিছুকে ছাড়িয়ে যেতে পারে যেকোন মাত্রায়। তবে এর ফলাফল কী দাঁড়াবে? যেভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেনঃ
“রাতে যদি সূর্য শোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা”
একবার এক পুরানা ম্যাগাজিনে এক ব্রিটিশ টেনিস খেলোয়াড় Gem Gilbert কে নিয়ে একটি গল্প পড়ছিলাম-
যখন সে ছোটো, Gem একটি বিষাদী ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। একদিন তিনি তার মায়ের সাথে ডেন্টিস্টের কাছে রুটিন ভিজিটে যান। তিনি ভেবেছিলেন মাকে নিয়ে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু একটা অভাবনীয় দুর্ঘটনা ঘটে গেলো- তার প্রিয় মা তার চোখের সামনেই ডেন্টিস্টের চেয়ারেই মারা যান। এই গভীর দুঃখবোধ তার চেতনায় অনপনেয় হয়ে থাকে এবং তিনি এটা এড়াতে ডেন্টিস্টের কাছে আর যেতে চান না।
কয়েক বছর বাদে তিনি এক সম্পদশালী ও সফল টেনিস খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন।একদিন তার ভয়াবহ দাঁত ব্যথা উঠলে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয় এই বলে যে, ‘একজন ডেন্টিস্টকে শুধু বাড়িতে নিয়ে আসতে দাও, তোমায় তার কাছেও যেতে হবে না, আর আমরা তোমার পাশেই তো আছি পুরোটা সময়’ । কিন্তু আবার অপ্রত্যাশিত কিছুই ঘটে গেলো যেনো, ডেন্টিস্ট সার্জারি করার জন্য তার সরঞ্জামাদি গুছিয়ে নিয়ে পেছন ফিরেই আবিষ্কার করলেন Gem আর বেঁচে নেই।
এটাই হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক সাজেশনের শক্তি। একটা দুঃখের লালন পালন করলেই তা এতো বড় রূপ নিতে পারে যে তা আপনার সারাজীবনের উপর ছায়া ফেলতে পারে নেতিবাচকভাবে। আপনার জীবনে যদি এমন দুঃখমালা থাকে যা আপনি ছাড়তে বা যা থেকে মুক্ত হতে পারছেন না তবে তা আপনাকে শারীরিকভাবে ও আবেগিকভাবে যারপরনাই ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলবে।
উদাহরণ দিতে একটা গল্প বলা যাক-
কোনো এক ছোট্ট শহরে খুব দরিদ্র একটি মেয়ে থাকতো, যে অকালে বাবাকে হারিয়েছিলো। সে ও তার মা সবকিছুতেই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল ছিলো। তারা কুটিরশিল্পের মাধ্যমে সামান্য উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতো। সে খুবই হীনমন্যতায় ভুগতো, কারণ কক্ষনোই তার ছিলো না কোনো ভালো পোষাক কিংবা প্রসাধনী।
তার অষ্টাদশ ক্রিসমাসে তার মা তার হাতে একটি টাকার থলে দিয়ে তার জন্য একটা উপহার কিনে নিতে বললেন, যা তিনি আগে কখনোই করেননি।এই প্রেরণা তার জন্য ছিলো উদ্দাম স্বপ্নেরও অধিক ! সেইজন্য সে পথে একা চলতে ইতস্ততও বোধ করছিলো। সে দোকানের দিকে যাচ্ছিলো টাকার থলেটা মুঠো করে, সে ভিড় এড়িয়ে দেয়ালের পাশ ঘেঁষে ঘেঁষে চলছিলো। যেতে যেতে সে দেখছিলো সব মানুষেরই যেনো তার চেয়ে ঝকমারি জীবন। এই দেখে দেখে সে নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছিলো আর স্বগতোক্তি করছিলো- “আমাকে এইখানে সাজে না, আমি এই শহরের সবচেয়ে হীন ও বিবর্ণ মেয়ে!”
যখন সে দেখলো সেই যুবককে, যাকে সে কীনা মনে মনে ভালোবেসেছিলো সবচাইতে বেশি, তাকে দেখেই তার মনে বিষাদিত এস্রাজ যেনো বেজে বেজে আরো করুণ আর্তনাদ হয়ে গেলো, সে ভাবতে লাগলো- আজ রাতে এই প্রিয়ের সাথে কোন রমণীই না যেনো বড় অনুষ্ঠানে নৃত্যে অংশ নেবে হায়!
এই ভেবে ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সে কোনোমতে এক দোকানে গিয়ে পৌঁছুলো। দোকানের ভিতরে প্রবেশ করেই তার ভালো লেগে গেলো একখানা অতীব সুন্দর চুলের অলঙ্কার!
হতবিহবলের মতোন সে যখন সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবছিলো তখন দোকানের একজন বিক্রয়-সাহায্যকারী তাকে বললো- “কী সুন্দর নিপাট সোনারং চুল তোমার! এর সাথে একটা হালকা সবুজ ফুল খুব যেতো, তোমাকে অপূর্ব লাগবে এতে!”
সে অলঙ্কারটির দাম দেখে নিলো যা তার পুরো টাকাটাই ব্যয় করতে হবে এমন ভেবে সে জানালো- “আমি এটা কিনতে পারবো না, ভেবো না”। কিন্তু ততক্ষণে উক্ত বিক্রয়-সাহায্যকারী তার চুলে সেটা বসিয়ে দিয়েছিলো আর একটা আয়না এনে তাকে তার চুলের প্রতিফলন দেখালো। সে এতে খুব চমকে গেলো। নিজেকে সে এভাবে কখনোই আগে দেখেনি। তার মুখ ভরাট লাগছিলো ও সৌন্দর্যময়তায় জ্বলজ্বল করছিলো। তার এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো এই ফুলেল নকশাদার অলঙ্কারটি তাকে দেবীর মতো করে তুলেছিলো! এক মুহূর্ত দোনামোনা না করেই সে তা সাধ্যের পুরোটা ব্যয় করে সেটা কিনে নিলো। উত্তেজনা ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে ভাংতি পয়সা ফেরত নিয়েই ভোঁ দৌড়ে দোকান থেকে বেরোবার সময় দোকানে আগত এক বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তির সাথে ধাক্কা খায়। তার মনে হচ্ছিলো সেই বৃদ্ধ তাকে পিছু ডেকে ছিলো, কিন্তু হন্তদন্ত হয়ে সে প্রায় উড়েই বেরিয়ে যাচ্ছিলো সেসময়।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে শহরের প্রধান সড়কের মধ্যে এসে পড়ে। সে দেখতে পেলো সবাই কেমন হা বিস্ময়ে তার দিকেই চেয়ে আছে। তাদের সে নিজেকে নিয়ে বলতেও শুনলো- “এই শহরে এতো সুন্দর মেয়ে আছে আমরা আগে তো তা জানতাম না! কার মেয়ে এ?” যাকে মনে মনে সে পছন্দ করতো সেই যুবকের সাথে তার দেখা হয়ে গেলে তাকে অবাক করেই সে যুবক জানালো- “ তুমি কি দয়া করে আজ রাতে আমার সাথে জোড়নৃত্য করতে আগ্রহী? আমি এতে সম্মানিত বোধ করবো।”
মেয়েটি হর্ষে উদ্বেলিত হয়ে গেলো যেনো! সে ভাবলো আমি আরো একটু খরচ করবো আমার অবশিষ্ট সামান্য পয়সা দিয়েই। এই ভেবেই সে আবার শশগতিতে আবার সেই দোকানে ফিরে গেলো। দোকানে প্রবেশের মুখেই তার সেই বয়োবৃদ্ধের সাথে দেখা হয়ে গেলো। হাসিমাখা মুখে বৃদ্ধ লোকটি তাকে জানালো- “ আমি জানতাম তুমি ফিরবেই! যেইমাত্র তুমি আমার সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিলে তোমার চুলের অলঙ্কার খসে পড়েছিলো। আমি তা পেয়ে তোমাকে ফিরিয়ে দিতে সেই সে ক্ষণ থেকেই অপেক্ষা করে আছি। ”
এই জায়গায়ই গল্পটি শেষ হয়ে গেলো। মজার ব্যাপার হলো এই কেশালংকার তার জীবনের পুঞ্জিভূত দুঃখবোধ দূর করে দেয় নাই, তা ধুয়েমুছে দিয়েছিলো তার আত্মবিশ্বাসের রোশনাই।
এখন কথা হচ্ছে এই আত্মবিশ্বাস আসেই বা কোথা থেকে? এটা আসে মানুষের ভেতরস্থিত সুস্থির ও বাস্তবিকই প্রশান্তিতে ভরা অন্তর থেকে! আর এতো সত্যিকারের Junzi-দের সহজ ও শান্ত মানসেরই প্রোজ্জ্বল দিক।
কনফুসিয়াসের কাছে তাঁর এক শিষ্য Sima Niu জিগ্যেস করেছিলেন, কোন জাতীয় ব্যক্তিকে Junzi বলা যেতে পারে?
কনফুসিয়াস বলেছিলেন- “Junzi তিনিই যিনি ভয় ও উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত”
Sima Niu ভাবলেন এটা বোধহয় খুব অপর্যাপ্ত বৈশিষ্ট্য হয়ে গেলো তাই তিনি আবার জিগ্যেস করলেন, যদি কেউ ভয় ও উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত হন তবেই আমরা তাকে Junzi বলতে পারবো কি?
কনফুসিয়াস আবার উত্তর করলেন- “ যদি তিনি নিজের ভেতরে তাকান আর তাকে নিজেকে লজ্জিত বা অস্বস্তিতে ফেলবার মতোন কিছুই না পান তবে, এবং এমনই হতে হবে তাকে যার থাকবে না কোনো কিছুই উদ্বিগ্ন বা ভীত হবার মতোন। ”
আজকাল আমরা কনফুসিয়াসের এই কথার অর্থ বোঝাতে একটা প্রবাদ ব্যবহার করতেই পারি-
‘ তোমার বিবেক যদি পরিষ্কার থেকে থাকে হে,
মাঝরাত্তিরে সদর দরজায় কোনো টোকাও তোমাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলবে না ।’
………
(চলবে)