‘একদিন বৃষ্টি হবে/ ব্যথিতের রক্তক্ষরণের /গুঁড়ো গুঁড়ো দারিদ্র্যের শব্দে / সূর্যের লাল চোখরাঙানি ঝরিয়ে / শতাব্দী থেকে শতাব্দী দীর্ঘ আর্তনাদে / … একদিন বৃষ্টি হবে’- শহীদ কাদরীর নাগরিক ধাতব বৃষ্টির বিপরীতে এমন মানবিক কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির অভিলাষ নিয়ে বাংলা কবিতায় স্বকীয় অস্তিত্বের তীব্র উপস্থিতি ঘোষণা করেন কবি জুননু রাইন। শতাব্দীর লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষের মর্মবেদনা তিনি টের পান অস্থিমজ্জায়। অনুভব করেন ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের মর্মমূলে মানবীয় আর্তি। ব্যক্তির হার্দ্যকি হৃদ্যতায় তাকে ছড়িয়ে দেন অনুপম শব্দবিভায়-
‘সে রাতের সংঘর্ষে থিয়া রক্তাক্ত হয়েছিল, রক্তগুলো কয়েকশ আলোকবর্ষে বৃষ্টি,/ বৃষ্টিরা হাসছিল জোছনা, অথবা কাঁদছিল- ফ্যাকাশে বোবাকান্না’
গ্রিক পুরাণের চাঁদ ও নৈঃশব্দের দেবী থিয়া এখানে নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত। থিয়া তো মানবিক পৃথিবীরই প্রতীকী উদ্ভাস। মানুষের সীমাহীন অমানবিকতায় তার রক্তক্ষরণ যেন সমসাময়িক সমগ্র বিশ্বপরিস্থিতিকেই চকিতে আমাদের মনোদর্পণে দৃশ্যমান করে তোলে।
বৈরী সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বচিত্র কবির হৃদয়ে রক্তগোধূলির লাল ক্ষতচিহ্ন এঁকে দেয়। তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে ক্রমাগত একা হয়ে যান। নৈঃসঙ্গ্যের এক দীর্ঘ ছায়া জীবনের দীঘল উঠোনজুড়ে পড়ে থাকে-
‘আমি প্রথমেই বলেছিলাম আমি একা
সেই চিৎকারে বারবার বলেছি মানুষ একা
এরপরে খেলতে গিয়ে আমি যতবার জিতেছি হেরেছি
বা খেলতে পারিনি, ততবার জেনেছি আমি একা’
[আবুল হাসানের একাকিত্বকে]
আধুনিক মানুষের এক অনিবার্য নিয়তি নিঃসঙ্গতা। টি এস এলিয়টের জে. আলফ্রেড প্রুফ্রক তার জীবনকে কফির চামচে মেপেছিলেন-
I have measured out my life with coffee spoons
I knwo the voices dying with a dying fall
Beneath the music from a farther room.
[The Love Song Of J. Alfred Prufrock]
জুননু রাইনের ‘কাকতাড়ুয়া’ একা থাকার জন্য রক্তমাংসের জীবনের স্বাদ ছেড়ে দেয়- ‘একা থাকার জন্য সে ছেড়েছিল রক্তমাংসের জীবনের স্বাদ / কত রাত্রি তার ওপর বয়ে যায় ভয়াল অন্ধকার / তারপরেও সে ফসলের স্বপ্নে ভরিয়ে দেয় কৃষকের অন্তর’। স্বনির্মিত এই একাকী জীবনের পথে যেতে যেতে যেন কাকতাড়ুয়া অথবা সৃষ্টিশীল মানুষ বা কবিই যেনবা টের পান- ‘একা থাকতে থাকতে দেখে ফেলল কোনো এক রাতে- দাঁড়িয়ে আছে সে একারই সাথে’।
আসলে প্রকৃত কবি নিয়তই নিঃসঙ্গ। কাকতাড়ুয়া যেমন ফসলের ক্ষেতে একা দাঁড়িয়ে কৃষকের মুখে হাসি ফোটায়; একজন কবিও একাকী অনেক জীবনাকাঙ্ক্ষার ভার বয়ে সমাজ রাষ্ট্রের হলাহল নিজে পান করে সময়ের রুগ্ন ঠোঁটে তুলে দেন অমৃতধারা।
তিরিশের দশকের কবিদের কবিতায় হতাশা, ক্লান্তি, বিষাদ, বিবমিষা ও নৈঃসঙ্গ্যচেতনা তীব্রভাবে উঠে এসেছিল। জীবনানন্দ দাশ আর্তনাদ করে বলেছিলেন- ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘উটপাখি’ কবিতায় বললেন- ‘কোথায় লুকোবে ধুঁ ধুঁ করে মরুভুমি’। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ধস্ত পৃথিবীর ছায়া এই কবিদের কবিতায় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠেছিল। বর্তমান সময়ে যখন পৃথিবীতে চলছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া; যখন ভেঙে পড়ছে সমস্ত মানবিক সেতু, তখন জুননু রাইন এই অবিশ্বস্ত সময়-মোহনায় দাঁড়িয়ে বলেন-
‘নিজের রক্ত পান করতে করতে
বিস্তৃত হতে হয় ধৈর্যে সহ্যে…’
[জীবন]
২.
কাঙ্ক্ষিত স্বদেশের দূরত্বসীমা কবিকে হতাশ করে তোলে। চারপাশের অনাকাঙ্ক্ষিত নৈরাজ্য প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন তিনি-
‘তখন আমরা ভয়কে বিজয়ী ঘোষণা করব
প্রতিবাদকে বেঁধে দেব তনুর ওড়নায়
হযরত আলী আর আয়েশায়
জীবনকে পুঁতে রাখব, ট্রেনের নিচে’
তনু, হযরত আলী, আয়েশা কিংবা বিশ্বজিৎ সাম্প্রতিক সময়ে পত্রপত্রিকায় আলোচিত কিছু নাম। এই নামগুলো কবির চেতনায় অভিনবরূপে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। একটি মানবিক সমাজ ও স্বদেশের স্বপ্ন বাস্তবতার হাত ধরে বহুদূর পাড়ি দিতে উৎসুক জুননুর কাব্যবিশ্বে- ‘এরপর সন্তানের পিতা হারানোর হাহাকারে / পিতার সন্তানের বিকলাঙ্গতার চিৎকারে / বিশ্বজিৎরা কৃষ্ণচূড়ায় ফুটবে, ফুটতে ফুটতে / ঝরে পড়বে মহামান্যের অলস এবং বিষন্ন ফুলবাগানে’।
‘বিশ্বজিৎ’ কবিতায় কবির অন্তর্গত রক্তক্ষরণ বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি তাকিয়ে দেখেন- ‘আমার জানালার পাশে একটি রঙিন মৃত্যু হাসে’। দূষিত রাজনীতির শিকার নিরীহ বিশ্বজিৎ এখানে রক্তাক্ত জামাসহ যেন জেগে ওঠে পুনর্বার। ‘অনিহাকে অদৃশ্য হুমকি’ কবিতায় তিনি যখন বলেন-
‘আমি আজরাঈল দেখিনি প্রভু
ক্রসফায়ার দেখেছি’
তখন সাম্প্রতিক নাগরিক ভীতি চিত্ররূপময় অভিব্যক্তি পেয়ে যায়। মৃত্যুদূত আজরাঈলের মতোই যেন ক্রসফায়ারও ভীতিকর। আরেকটু অগ্রসর হয়ে তিনি বলেন- ‘প্রতিটি স্বপ্নকে আতঙ্ক জাপটে ধরে ঘুম পাড়ায় / প্রতিটি ঘুম বাতাসের পোড়া গন্ধ হয়ে উড়ে যায় / প্রতিটি পাখি মানুষকে অনিশ্চিত মৃত্যুর স্বাভাবিকতা শেখায়’। ‘অনিশ্চিত মৃত্যুর স্বাভাবিকতা’ মূলত ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়েরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
অপরাধীকে খুঁজে না পাওয়া সময়ের ক্ষত কবিকে কিছুটা ব্যঙ্গপ্রবণ করে তোলে- ‘অপরাধীকে খুঁজে না পেয়ে কোকিল ডাকা দুপুরকে / শাস্তি দেবেন ধর্ষকের শিশ্নে উত্থিত সমাজপতি’। এখানে ধর্ষক ও সমাজপতি যেন পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। সমসাময়িক বাস্তবতার নিপুণ রূপায়ণ এই কবিতাগুলোকে মহিমান্বিত করে তুলেছে। পড়তে পড়তে মনে হয় যেন মানবিক দর্পণে নতুনভাবে বিপর্যস্ত স্বদেশ ও বিশ্বচিত্র ফুটে উঠছে নিপুণরূপে।
৩.
আসিরীয়-ব্যবিলনীয় পুরাণের জ্ঞানের দেবতা ‘এয়া’ জুননু রাইনের কবিতায় নতুনরূপে উপস্থাপিত হয়েছে। এয়া মানবসমাজের শুভার্থী ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক। তাই এয়া সিরিজের কবিতাগুলো বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। কাব্যগ্রন্থের নামের ক্ষেত্রেও পৌরাণিক আবহের প্রাধান্য লক্ষণীয়।
এয়া একইসঙ্গে হয়ে উঠেছে জ্ঞানবিমুখ নগ্ন সভ্যতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। অন্যদিকে সূক্ষ্ম মানবীয় অনুভবের ধারক ও বাহক-
‘চলো হাটে যাই
তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে
পৃথিবীর হাতে মুখে ফসলের গন্ধ মাখাই’।
[এয়া-৩]
যেন ক্ষুধার্ত পৃথিবীর তাবৎ মুখ উপর্যুক্ত পংক্তিগুলোতে ফসলের সম্ভাবনায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্যের তীব্র সংকটের প্রেক্ষাপটে ‘ফসলের গন্ধ’ই পরম কাঙ্ক্ষিত। খাদ্যের মৌলিক সংকট দূর হলেই কেবল মানুষ জ্ঞানমুখী হওয়ার কথা ভাবতে পারে। এক্ষেত্রে এয়া প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
মানুষের নিষ্ঠুরতায় প্রকৃতির রক্তক্ষরণ যেন সর্বব্যাপী হয়ে ওঠে কবিতাগুলোতে- ‘দেখে নিও, মানুষের আঘাতে বৃক্ষের শরীরের রক্ত / এখনও নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে জীবনের অভিমান’। মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ গল্পের কিউরেটরদ্বয় মানুষকে বাদ দিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণীরূপে পিঁপড়াকে বেছে নেয়। কারণ মানুষের কারণে পৃথিবীতে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে। এরা নিউক্লিয়ার বোমা ফেলছে এবং প্রকৃতিকে দূষিত করে ফেলছে। ফলে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। জুননুর কবিতায়ও আমরা বৃক্ষের শরীরের রক্তক্ষরণ দেখে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে দ্বিধান্বিত হতে থাকি।
জীবনের পরিচিত দৃশ্যপট কিংবা বোধের প্রতিষ্ঠিত অভিব্যক্তি নতুনভাবে নাড়া খায় এয়া সিরিজের কবিতাগুলোতে। জীবনের পরিচিত গলি থেকে কিছুটা দূরে সরে এসে তিনি নির্মোহ ভঙ্গিতে নিজেকে খুলে দেখার প্রয়াস পান। কবির ভাষায়- ‘চোখের সমুদ্র চেয়ে থাকবে জীবনের অপেক্ষায়’। যেন চোখের দেখা থেকে জীবনের দূরত্ব একসমুদ্রপ্রতীম। কবি অন্ধকার সময় সভ্যতার অদ্ভুত জোছনার ছায়ায় নিজেকে লুকিয়ে রাখেন-
‘তোমার অন্ধকার এসে যে পাড়ায় আলো ফেলে, আমি
তার জোছনার ছায়ায় লুকোনো থাকি।’
বোহেমিয়ান এক নগরসভ্যতার চূড়ায় দাঁড়িয়ে কবি দেখেন- ‘মানুষের বিশ্বাসের ইমারত ভেঙে পড়ে’ আর ‘শুধু ফোঁটায় ফোঁটায় দীর্ঘ হয় শহরের ইতিহাস’। নগরের সর্বগ্রাসী বিস্তার তো নদীর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই সূচিত হয়। নদীর মর্মবেদনা এক নিদারুণ মানবিক হাহাকার নিয়ে জেগে ওঠে কবিতার ক্যানভাসে।
৪.
প্রেমের বৈচিত্র্যময় অনুভব আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে নতুনমাত্রা যোগ করেছে। দয়িতার সঙ্গসুখ তাকে শান্তি দেয়, দেয় জীবনের নতুন অভিধা।
ভালোবাসায়ও গেঁথে থাকে দূরত্বের কাঁটা, অপরিচয়ের আলোছায়া। কারো কারো অনুভবের বাইরেই থেকে যায় এই বিবেচনা। কবির সংবেদনশীল হৃদয় এই রহস্যের পরিসীমা খোঁজে-
‘শেষ রাতের বাতাসে ফিরে আসে তোমার ক’ফোঁটা অপরিচয়
দূর থেকে দূর হারিয়ে গেছে, এখন আমাদের দূরত্ব ঠিকানাহীন’।
তবু কবি ভালোবাসার কাছেই নিজেকে সমর্পণ করে শান্তি পান। ভালোবাসার চোখে নিজেকে রোপন করে করে যান। যেন এটাই তার নিয়তি- ‘ভালোবাসার চোখে নিজেকে রোপন করে করে যাই/ এ আমার গতি, আমারই নির্মিত নিয়তি।’
বোধের গভীরতায়, ভাষার নতুনতায় জুননু রাইনের ‘এয়া’ বাংলা কবিতায় নিঃসন্দেহে একটি নতুন চমক। আগামীর দিনগুলোতে জুননু আরও নব নবরূপে আবির্ভুত হবে, এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।