আম্মা আমারে দৌড়াইতেছেন, আমি দৌড়তেছি সামনে এলপাথাড়ি। পিছে পোলাপাইনের হৈ হল্লা। পোলাপাইন বলতে ছোট বড় সমবয়সী খালাতো ভাই-মামা আর নানুবাড়ির আশেপাশের অনাত্মীয় খেলার সাথীগণ। খালা মামীরা মা-ব্যাটার ইঁদুর বিড়াল দৌড় দেখে হাসতে হাসতে পিছন থেকে ডাক পারতেছিল, ও সাজু, আরে পুয়াগো দুখ ফাইয়ে ত! ( ও সাজু, ছেলেটা ব্যথা পেয়েছে তো!) সাজু আমার মায়ের নাম, সাজেদা বেগম। সামনে অতি অবশ্যই মোছাম্মাৎ। বোন-ভাবীদের ডাকে মা-ও দৌড়ানি বন্ধ করলেন, আমিও থামলাম। দুই একবার কান টেনে হাত-পায়ে হাত বুলায়ে দেখতেছিলেন কোথাও ব্যথা পাইছি কিনা। আমি যতই কই, দুখ ন ফাই! (ব্যথা পাই নি) আম্মা গজগজ করতেই থাকে। দোষটা কি ছিল সেটা তো কই নাই এতক্ষণও। শীতের দুপুরে ভাত খেয়ে বড়-ছোট সকলে যখন উঠোনে রোদ পোহাইতেছিল আমরা তখন গুটিকয়েক বরই গাছে উঠছিলাম চুপিসারে। ছোট্ট কচি বরই গাছ, কয়েকখান ডাল লম্বা হয়ে উপরের দিকে কই জানি গ্যাছে, পাতায় পাতায় বড়ই ঝুলতেছে। আমিও ডাল বরাবর উঠতে লাগলাম গাছে। বাকীরাও আমার পিছে পিছে অন্য দুই ডালে। কোন সময় আম্মা গাছের নিচে চলে আসলো খেয়াল করি নাই। উনার চিৎকারে সবাই নিচে নামলেও আমি উঠতে লাগলাম আরো উপরের। চিকন লম্বা বাঁশের ফালি দিয়ে খোঁচানোর ভয় লাগাইতেছিলেন। আমি ভয় পেয়ে আরো উপরের দিকে উঠতেছিলাম। আম্মার রাগ বেড়ে আরো টনটন। উপরের দিকেও যে শেষ একটা সীমা আছে সেটা আমার খেয়াল নাই। আমি দেখতেছিলাম সাদা আকাশ শুধু। একটা সময় ডাল ভেঙ্গে সোজা নিচে। ভাগ্যিস বাগানের ঐ জায়গায়টায় পাশের বিল থেকে পানি ঢুকে আর রোদ পড়ে না বলে সব সময় কাদাময় থাকে। ব্যথা পেলাম কি পেলাম না, ক্রোধান্বিত আম্মার হাত থেকে বাঁচতে একদিকে দিই ছুট। এই হইল মা-বেটার রেসখেলা।
শীতকাল আসলে আমাদের সেসময় সব ধরনের আনন্দগুলো একটা প্যাকেজ আকারে আসত। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, যাকে আমরা বলতাম ইস্কুলের বছরি পরীক্ষা (সেসময় বাংলা বইয়ে ‘ইস্কুল’ লেখা হইত, মনে আছে)। অতএব দীর্ঘ ছুটি, প্রায় একমাস। একইসাথে রমজানের সেহেরি ইফতারের মজা, ঈদের খুশি। আর হইল শীতকালের উলের লেপতোষকের রজাইমুড়ি, খেজুর রস পিঠার স্বাদ। এবং অতি অবশ্যই নানুবাড়ি আগমন। এ সময় পাড়া বেড়ানো ছাড়া কোন কাজই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না আমাদের কাছে। সেই সাথে যার তার বাড়ির সীমানায়, উঠোনের কোনায়, পুকুরের ধারে সব বড়ই গাছের একচ্ছত্র মালিকানা দাবি করতাম আমরা। আসলে গাছের না, পাতায় পাতায় কাঁটায় কাঁটায় ঝুলে থাকা টসটসে-টকটকে-কষকষে-মিষ্টি-পান্শা নানা স্বাদের বরইয়ের। একই কাজ দাদুবাড়ি মানে আমাদের বাড়িতেও। একেক জাতের বরই-র যেমন একেক স্বাদ, গাছের কাঁটার দর্শনও একেক প্রকৃতির। ভিন্ন ভিন্ন কাঁটা ফুটার ব্যথাও কি একেক অনুভূতির ছিল, মনে নাই। এ-দীর্ঘ ছুটিতে খেলা বলতে সিগারেটের ভিতর পাট্টির রেটে চারা খেলা, মার্বেল খেলা। খেলতে খেলতে মুখে পুরে দিতাম বরই। খাওয়া শেষে বিচি চুষতে থাকতাম দীর্ঘক্ষণ। চুষতে চুষতে বিচিটারে নরম করে ফেলার চেষ্টা আর কি! এটার কারণও আছে। আম্মা বরই খেয়ে বিচিটারে দাঁত দিয়ে চাবিয়ে কটমট কটমট করে মুখের ভিতর কয়েক টুকরো করে ফেলতেন আর হাসি হাসি ভাব নিয়ে আমাদের দেখাইতেন। ছোট ভাই তো দূরের কথা, আমি হাজার চেষ্টা করেও পারতাম না, আম্মারে হিংসা হইত তখন। তাই বরই খেয়ে আর ফেলতামই না মুখ থেকে, চুষতেই থাকতাম। কখনো যদি একটা ভাঙতে পারতাম দাঁত দিয়ে, বিরাট কিছু করে ফেলছি এরকম একটা ভাব আসতো মনে। কী রকম ভাব, সেটা এতদিন পর আসলে মনে নাই, মনে থাকার কথাও না।
অঘ্রাণের ধান উঠে গেলে গোলায় শূন্য মাঠ যেন উইল হয়ে যেত ডাংগুলি, বৌচি, হাডুডু খেলার জন্য। হা-ডুডু খেলা যে আমাদের জাতীয় খেলা কাবাডি সেটা জানছি আরো উপরের ক্লাসে উঠে। অহেতুক এদিক-সেদিক দৌঁড়ানোও যে কত উপভোগ্য ছিল, এখন ভেবে অবাক হই। খেলতে খেলতে মনমজা সাড়া হলে চরকির মতো ঘুরতাম আর রাস্তা থেকে বরই বিচি টোকাতাম। স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে হাঁটার চল ছিল না তখন। খালি পায়ে হাঁটতাম, আর কোন বরই বিচি পায়ের তলায় পড়লেই সাথে সাথে প্যান্টের পকেটে। ঈসা নামের সমবয়সী এক চাচা ছিল, ইস্কুলে দুই এক ক্লাস ডাব্বা মেরে আমার ক্লাসমেট হয়ে গেছিল। আপাদমস্তক রাখাল। তার ভবঘুরে কৈশর দিনলিপি আমারে এখনো টানে, তখন তো খুবই ঈর্ষা হইত তারে। তার পরনে সবসময় লুংঙ্গি থাকত। বড়ই বিচি নজরে আসলেই সে সাথে-সাথে পেটের সাথে লুঙ্গির কোছাতে পুরত। সেই সাথে সমবয়সী ফুফু হীরা, তাও একই ক্লাসে পড়তাম, সে ভরতো ফ্রকের কোনায় কানায়। একটা বরই বিচি নিয়ে তাদের সাথে কত কাড়াকাড়ি! সারাদিন মিলে অজস্র বরই বিচি টোকাতাম। বরই গাছের নিচে, উঠোনে, স্কুলের মাঠে, দোকানের আশেপাশে, পুকুরঘাটে সারাক্ষণ চোখ রাখতাম কোন বিচি দেখা যায় কি না। কাজ কি, বিচি নিয়ে মার্বেল খেলা? উহু, না । মার্বেল খেলার জন্য তো মার্বেল আছেই। চুরি করে দাদীর সুপারি আর মুরগীর ডিম এনে দিলে দোকানে মার্বেল পাইতেছি। দিনশেষে সব বরই বিচি দিতাম দাদীকে এনে। কয়েকদিনের বরই বিচি জমিয়ে দাদী এক সকালে বিচিগুলো ফেওন্না মানে বেতের চালুনিতে ভাল করে ধুয়ে রোদে শুকাতে দিতেন ঘরের চালে। সহজে অন্য কেউ যাতে নাগাল না পায়, পাখিও যাতে না ঠোকরায়। আমরাও ঘুরঘুর করতাম ঘরের আশেপাশে। পাহারা দিতাম বরই বিচি। উঠান ছেড়ে নড়তাম না, খেলাখেলি সব এখানে। দাদীও বুঝে যেতেন আমাদের কাহিনি। গোষ্ঠীর প্রথম নাতি হিসেবে আমারে নিয়াই তার সব সোহাগ-মুহাব্বাত। আমিও ছিলাম দাদী নেওটা।
দাদীই জিনিসটা শিখাইছিলেন। কী শিখাইছিলেন বলি। বরই বিচি শুকানোর পর উতা বা পান-সুপারি দুপুনী দিয়ে বিচিগুলো ভাঙতাম দাদী-নাতী মিলে। মা তো ব্যস্ত ছোটভাইয়ের লালনে-পালনে আর ঘরের অন্যান্য কাজে। বিচি ভেঙ্গে করতাম কি, বিচির ভেতরে কখনো গোলাকার কখনো লম্বাটে মাঝখানে কিছুটা ফোলা-পাতলা একটা বস্তু পাওয়া যাইত। বইয়ের ভাষায় কি বলে জানি না, বহুত পরে আয়োজন করে খাওয়ার সময় আমরা এটারে কইতাম ‘ফাক্কন’। বড় বিচির শক্ত বর্মসুলভ আবরণের ভিতর মূল বীজটা। মনে আছে, পোলাপাইন এটারে বরই বিচির ‘গোস্ত’ও কইত। আম্মা মুখের ভিতর বিচি ভেঙ্গে এটাই খাওয়ার লোভ দেখাইত আসলে। তো অনেক ফাক্কন একত্র করে বড় চামচে সরিষা তেলের সাথে মাটির চুলার আগুনে গরম করতে থাকত দাদী। আমি চুলার পাশে বসে থাকতাম। তেলের মধ্যে ফাক্কন ফুটে ফুটে উঠতো। তেল চিটচিটে ছোট ছোট একেক একেকটি ফাক্কন সিদ্ধ হয়ে চিতই পিঠার মতো ফুলে উঠতো। ও, এ-জন্যে বুঝি এটারে ফাক্কন বলে। ভুলেই গেছিলাম, আমাদের এদিকে পিঠাপুলিরেও ফাক্কন বলে। এতদিন ত এটা ভেবে দেখি নাই। যাক, লিখতে গিয়ে ফাক্কন রহস্য বাহির হয়ে গেল। আহা, ঠান্ডা হবার পর যখন মুখে পুরতাম, কী অমৃত স্বাদ! তখন কি অমৃত বলে কিছু বুঝতাম নাকি! ছোট্ট এ-জিনিস কী যে অদ্ভুত স্বাদ এনে দিত, এ-অনুভূতির ভাষা ক্যামনে বুঝাই! কত আগে খেয়েছি, প্রায় বিশ বাইশ বছরের কম হবে না। বড়ই নিয়ে দাদী আরেকটা কাজ করতেন। শীতের সময় মিঠা পাওয়া যাইত, তরল গুড়, খেজুরের রসের। দীর্ঘদিন কাঁচা বড়ই রোদে শুকিয়ে সেই মিঠা দিয়ে রান্না করে খাওয়াইতেন। গরম-গরম রান্না করা নরম নরম সেই টক-মিষ্টি শুকনো বরই বিদেশ থেকে মামার পাঠানো দামী চকলেটের মতো কী দারুণ আবেশে গালের ভিতর মিইয়ে যেত। একালের ছেলেপুলেরা ফাক্কন খাবে কী, বরইর স্বাদই নিতে জানে না। পকেটে লবন-মরিচ রেখে কাঁটাবিদ্ধ হয়ে বরই পাড়ার দৃশ্য কীভাবে বলি তাদের।
কী করে বোঝাই, এতদিন পর এখনো সেই বরই ফাক্কন মিঠাই-বরইর স্বাদ জিহবাতে লেগে আছে। আচ্ছা এটা কীভাবে হয়। জিহবার স্বাদও কী করে মানুষ স্মৃতিতে বয়ে বেড়ায়। দাদীও বুড়ো বয়সে দুই একটা মুখে দিয়ে এমন ভাব করতেন যেন স্মৃতিবাড়ির উঠোনে দৌঁড়তেছেন খেলার সাথীদের নিয়ে। আমাদের ফাক্কন বানিয়ে খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে দাদীও হাতড়াইতেন তার পুরনো দিনের নকশা। এখন যেমন আমি হাতড়াইতাছি, দাদীর রেখে যাওয়া তাসবীহ দানা, মোটা ফ্রেমের চশমা আর একখন্ড উর্দু অক্ষরের বেহেশতী জিউরে (বাংলায়-বেহেশতের পুঞ্জি, মওলানা আশরফ আলী থানবি রচিত) রেখে যাওয়া স্পর্শরে; স্বাদের বড়ই ফাক্কনের কত কথা কইয়া ভাবতেছি তাঁর কথা। নানীজানও বিদায় নিয়েছেন কতক বছর হলো। বরই কিংবা ফাক্কন স্মৃতির উছিলায় এতদিন পর কত কথা উথলে উঠল আজ ভিতর আঙ্গিনায়, হৃদয়পুরের। কত সকাল হল, সন্ধ্যা ঘনালো। আহা, নিরবধি সময় বয়ে যায় রোদ-ছায়ার নামতা গুণে।
galibrafsan@gmail.com