‘‘আমি প্রচার করি একটি জিনিস, খুব সচেতনভাবে করি। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ হয়ে এ পৃথিবীতে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি, এর চেয়ে বড়, এর চেয়ে বেশি আনন্দের আর কিছু নেই । মানুষ যে কী পরিমাণ ক্ষমতা রাখে! সীমাহীন ক্ষমতা এই অর্থে যে, তার চিন্তা করার ক্ষমতা, প্রচণ্ড মানসিক গুণ এগুলো নিয়ে বারবার মানুষকে বলতে চাই যে, তোমরা মানুষেরা এই রকম প্রাণী’’ । – হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল প্রথমে কোথাও কেউ নেই নাটকের মধ্য দিয়ে। তখন আমি বেশ ছোট। বাকের ভাইয়ের জন্য বড়দের সাথে কেঁদেছিলাম। নিজেদের বাড়িতে টিভি ছিলো না, স্কুলের হোমওর্য়াক শেষ করে, অন্যের বাড়ি আসন পেতে বসার জন্য আগে-ভাগে চলে যাওয়া। তখন বুঝিনি এই সেই হুমায়ূন আহমেদ যিনি আমার কৈশোর আর তরুণী বয়সের একটি বড় সময়ের ফেসিনেশন হবেন। গোগ্রাসে তখন কেবল পড়ছি, আর কৈশোরানন্দে ভাসছি। অনেকে বলতো হুমায়ূনের ছাইপাশ পড়ে মেয়েটি পাগল হয়ে যাবে। তাই তো! একজন উন্মাদ লেখকের বই পড়লে তো পাগল হতেই হবে।
সেই মানুষটি, যিনি ২৪ ঘণ্টার লেখকবৃত্তি বেছে নিয়েছিলেন।১৯৮৬ সালে ‘দিশা’ পত্রিকায় দেয়া তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকারে শাকুর মজিদের একটি প্রশ্ন ছিল, ‘নিজের কাছে আপনার পরিচয়, একজন লেখক, নাকি শিক্ষক?’ তাঁর সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল, ‘লেখক।’ তিনি প্রায় ৩২২টি (তিনশত বাইশটি) মতান্তরে ৩৬৮টি (তিনশত আটষট্টিটি) বই লিখেছেন। তিনি প্রায় প্রতিদিন গড়ে ২০ (কুড়ি) পৃষ্ঠা করে লিখতেন। প্রতিদিন গড়ে কুড়ি পৃষ্ঠা মানে হাতের লেখায় বোধ করি কম করে হলেও ১০ হাজার শব্দ লিখতেন। তিনি নিজেই বলেছেন- ‘অল থ্রু মাই লাইফ আই ওয়াজ স্পনটিনিয়াস রাইটার’। সকালে ঘুম থেকে উঠে পরপর দু’তিন কাপ চা খেয়ে বসে যেতেন লিখতে। এবং তাঁর স্ত্রীর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য ছিল ঘুম থেকে উঠে লিখে যাওয়া একজন মানুষের মুখ দেখতে পাওয়া।
হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়ামাত্রই চেনা যায়। বর্ণনাভঙ্গি, চরিত্র নির্মাণ, পরিস্থিতি নির্মাণ, সংলাপে তিনি এমন এক শৈলীর উদ্ভাবনকারী যা বোধ করি বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয়। মজার ব্যাপার হলো, এসব তিনি নিয়েছেন তিনি যে অঞ্চলের মানুষ সেই নেত্রকোনা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের কথনভঙ্গি থেকে। ‘তার মতো মানুষ আল্লাহর আলমে নাই’, ‘শইলডা ভালা’, ‘মনডা ভালো’-র মতো সংলাপ এমনভাবে হাজির করেন, তা একই সঙ্গে আনন্দের ও অনাকাঙ্খিত। ফলে, কোনো বইয়ের মলাট ছিঁড়ে ফেলে, প্রিন্টার্স লাইনের উল্লিখিত পাতাগুলো বাদ দিয়েও কাউকে তার বই পড়তে দিলে সে বই যে হুমায়ূন আহমেদের লেখা সেটি বুঝে নিতে কষ্ট হবে না। রূপা, নীলু, মন্টু, মিসির আলী, হিমু, শুভ্রর মতো চরিত্রগুলোকে এমন জীবন্ত করে দিয়েছেন যেন আমাদের সামনে রোজ দেখতে পাই। হুমায়ূন আহমেদের মেয়ে চরিত্রগুলো খল, কদর্য, কলুষ, গ্লানি থেকে দুরে থাকে। কিছুটা বঙ্কিম বা সুনীলের মেয়েদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। মেয়ে চরিত্রগুলো প্রায়শঃ শুভ্র ও পবিত্র টাইপের। দোষ-ত্রুটি থাকলেও তা যেন দ্রুত কোন কথার ভেতর দিয়ে স্বীকার করে বেরিয়ে আসা অন্য ঘটনায়, লেখক যেন কোনভাবেই সেই ঘটনাকে বলতে চান না, তাড়াহুড়ো করে এড়িয়ে যান অনাকাঙ্ক্ষিত কুৎসিত বিষয়। যেমন কোনো একটা উপন্যাসে এরকম বলা আছে যে, একদিন ভোরবেলায় মেয়েটি রাস্তায় যায়। মেয়েটির জীবনে এরকম ভোরবেলায় যা ঘটেছিল, তা আনন্দের নয়। কিন্তু কী ঘটেছিল, সেটা বলা হয় না।
আবার পাঠকের ওপর অভাবের চাপ না দিয়ে অভাবকে প্রকাশের অভিনব পদ্ধতি দেখা যায় তাঁর উপন্যাসে- ‘সবাই খেতে বসেছে, সে সময় বাচ্চা ছেলেটি বলল, মা আজকে আমি গোটা ডিম খাবো’ এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, সে কখনও গোটা ডিম খেতে পায় না। এই লাইনটা দিয়ে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা অনায়াসে বোঝা যাচ্ছে। এভাবে বলার প্রয়োজন নাই- টাকা নাই, বাজার নাই।
তিনি আগে সাহিত্যিক, পরে তিনি নাটক-রচয়িতা এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগারের মতো উপন্যাস যা পড়তে গেলে নিজের অজান্তে চোখ ভিজে ওঠে। এরকম মাত্র চারটি উপন্যাস লিখে অতিঅল্প বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন জীবনমুখী লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি যখন টিভি-নাটক রচনা ও চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন সেগুলোকে তাঁর লেখারই আরেক-রকমের সম্প্রসারণ বলেই মনে হলো। সেখানে তাঁর কাহিনীর ছক, সংলাপের প্রতি-সংলাপ (অ্যান্টি-ডায়ালগ) একইভাবে বিদ্যমান। একটি নাটকে আলী জাকের মামার ভূমিকায়, তিনি ভালোবাসা নিয়ে গবেষণা করছেন, বিভিন্নজনকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করছেন যে, সেই ব্যক্তি ভালোবাসা বলতে কী বোঝেন। এরকম এক পর্যায়ে তিনি বাড়ির কাজের লোক কাদেরকেও জিজ্ঞাসা করেন, ‘আচ্ছা কাদের বল তো তুই ভালোবাসা বলতে কী বুঝিস?’ কাদের একটু চিন্তা করে বলে, ‘মামা, ভালোবাসা একটা শরমের ব্যাপার মামা।’ হুমায়ূন আহমেদের লেখায় দর্শন নেই, জীবন সম্পর্কে মন্তব্য নেই, অনেকেই এমন অভিযোগ করেন, কিন্তু তাঁর লেখায় একটি দর্শন ভীষণভাবে দীপ্যমান তা হলো ‘মানুষকে ভালোবাসা’। তাঁর লেখার ভেতরে যে গাঁথুনি, পড়ামাত্র বোঝা যায় যে, এটি তাঁর লেখা; তিনি তাঁর নাটকে ও চলচ্চিত্রে এমন কিছু চরিত্র ও তাতে রূপদানকারীদের বেছে নিয়েছিলেন, যে তার ছবির যেকোন অংশ দেখেই বলে দিতে কষ্ট হয় না যে এটা তাঁর চলচ্চিত্র।
হিমু ও মিসির আলী তাঁর সৃষ্টির অনবদ্য চরিত্র। যা তরুণ সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে আছে আজও। তাই তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে দেখা যায় হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে তরুণরা নুহাশ পল্লীতে তাঁকে স্মরণ করছেন তাঁর প্রিয় কদম হাতে। এই চরিত্রগুলো বাস্তবে হাঁটাহাঁটি করছে, কল্পনার যে রিয়েলস্টিক রূপ হতে পারে তার প্রমাণ হুমায়ূন। প্রতিটি মানুষের ভেতরে ইমোশনাল এবং লজিক্যাল একটা মানুষ থাকে। তারই দুই রূপ যথাক্রমে হিমু ও মিসির আলী। এরা আর কেউ নন, স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদ নিজেই।
প্রতিটি লেখক এক অর্থে ধর্মপ্রচারক। অবচেতন মনে তাঁরা নিজেদের স্বরূপ তুলে আনেন। নিজের সময় ও নিজের চিন্তাকে শব্দ, কল্পনা, ভাষা দিয়ে ছবি এঁকে চিত্রায়িত করেন। যেমন বিভূতিভুষণ বন্দোপাধ্যায়। কী অপার ক্ষমতা আর পরম মমতায় লিখেছেন পথের পাঁচালী। সেই উপন্যাস থেকে শুরু করে যতগুলো উপন্যাস লিখেছেন তার প্রত্যেকটির নায়ক আসেল অপু। একজন লেখক যখন লিখতে শুরু করেন, তিনি নিজেকে নিয়ে লেখেন। অপু আসলে বিভূতিভূষণ নিজে। যখন তিনি লিখছেন, ঘুরেফিরে অপু আসছে। এভাবে তিনি ধর্মপ্রচারক হয়ে ওঠেন। ঠিক তেমনি হুমায়ূন আহমেদ।
কোন একটি সাক্ষাতকারে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ‘আমিই ধর্মপ্রচারক, অবচেতনে বারবার চোখের সামনে নিজেকেই তুলে আনছি, এবং মানুষের ধর্ম প্রচার করাই আমার কাজ’ । তিনি আরও বলেছেন- ‘আরেকটা ভুল কথা আমার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে। আমি নাকি বইয়ের পাঠক বাড়িয়েছি। আমি কিন্তু পাঠক বাড়াইনি। পাঠক বাড়ালে তো সবার বই-ই বেশি বেশি বিক্রি হতো। আমি শুধু আমার নিজের পাঠক বাড়িয়েছি। পাঠক যদি বাড়াতাম , তাহলে তো সবার বই বিক্রি হতো’।
জীবনমুগ্ধ, রূপমুগ্ধ একজন হুমায়ূন আহমেদ চলে যেতে পারেন না । তিনি তাঁর না থাকার ভেতর দিয়ে এমন এক পথ নির্মাণ করে গেছেন, যে পথে নতুন লেখকরা অনেক বেশি সাহস পাবেন, সাহিত্যচর্চায় ও জীবনচর্চায় সাবধান হবেন।