মাটি থেকে উড়ে যাচ্ছে আরো কিছু ধুলোর রসদ। এমন মরু ধূলোয় অজানা কোনও গন্তব্যে রওনা দিয়েছে সাত যুবক। কোথায় যাচ্ছে তারা কেউ জানে না। কেবল জানে পালাতে হবে। রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পালানোর এ নিয়ম যেন আদিমতম। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। নিরুদ্দেশ এই পলায়নপরতা। তবু এই পালানোর হাত থেকে কেউ পালাতে পারে না, তাকে পালাতেই হবে। এদেরও নিস্তার নেই। কিন্তু কোথায় পালাবে? সবখানে বাদশাহ’র রাজকীয় ফরমান। ‘ধরে আনো, হত্যা করো।’
এই এলোমেলো সময়ে হঠাৎ পিছু নিয়েছে একটা হলুদ কুকুর। আসলে কি হলুদ? নাকি মরুভূমির মরীচিকায় ধূসর কুকুরটি আরো বেশি হলুদ হয়ে উঠেছে। সম্ভবত তার রঙ ধূসরও না। রঙহীন! বারবার তাড়ানোর চেষ্টা করেও তাকে সরানো গেলো না। একসময় সে-ও হয়ে উঠে অবিচ্ছ্বেদ্য যাত্রাসঙ্গী। তবে অত্যাচারী বাদশাহ দাকিয়ানুসের সাথে কুকুরটির কী শত্রুতা? আপাতত তা জানার সুযোগ নেই। যেতে হবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। আরো একজনের সঙ্গ ইতিবাচকভাবে নিয়ে সামনের দিকে মনোযোগ দেওয়া যাক। সে-ও মহানন্দে পিছু নিলো। আর বাদশাহ’র সঙ্গে তার শত্রুতা নির্ণয় রহস্যাবৃতই থেকে গেলো।
মূলত মূর্তিপূঁজার বিরোধিতা করায় বাদশাহ’র রোষে পড়েছে এই যুবকদল। ক্ষমতা সব সময় সর্বগ্রাসী। সে তার নিজের ছাঁয়াকেও আস্ত খেয়ে ফেলে। সাত যুবক তো রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহী, রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান। রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষোভ এখন তাদের ওপর। অন্যদিকে, কুকুরও সব সময় ক্ষমতা কাঠামোর বাইরের প্রাণী। বলা যায়, প্রাণীদের মধ্যে সাব-অল্টার্ন। বেহেস্তে তার জায়গা নেই, জঙ্গল থেকেও সে বিতাড়িত, মনুষ্য সমাজে বরাবরই ব্রাত্য। তাই ক্ষমতার কেন্দ্রে যাওয়ার চেষ্টার করে তার লাভ নেই। বরং এই প্রান্তিক যুবকদলের সাথেই যাওয়া ভালো।
এক সময় ক্লান্ত যুবকদল একটা গুহায় আশ্রয় নেয়। ভ্রমণের ক্লান্তি গায়ে জড়িয়ে গুহার মধ্যে তারা সকলেই ঘুমিয়ে পড়ে। এ ঘুম নিশ্চিত ভাবেই নিষ্প্রভ ঘুণপোকা। এমন ঘুম যা কেবল নিজেকে দীর্ঘায়িত করে। বলা হয়, ‘যুবকেরা এমন ভাবে ঘুমিয়েছিল যেন তাদের চোখগুলো খোলা, দেখে মনে হবে তারা জেগেই আছে। আর কুকুরটি গুহার বাইরে দুই পা প্রসারিত করে বসে থেকে তাদের পাহারা দিচ্ছিলো। এমন অবস্থায় যে কেউ দেখলে তাদের হিংস্র শিকারীর দল মনে করে ভয়ে পালিয়ে যাবে।’
ঠিক এভাবে তারা ঘুমালো টানা তিনশ’ নয় বছর। সময়ের পিঠে সময় ভাঁজ হয়ে বসে গেছে। অসংখ্যবার চন্দ্র-সূর্য্য গতি পাল্টেছে। মাটির হিংস্রতা থেকে বাঁচাতে তাদের পাশ ফেরানোর দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং পরম। এই ঘুম থামিয়ে দিয়েছিল সময় এবং শব্দের রহস্যময়তাকে। যে ঘুম একসময় ঘুমের পথ পাড়ি দিয়ে কেবল স্বপ্নেই দীর্ঘায়িত হচ্ছিলো। কিন্তু কুকুরটি? মানুষ স্বপ্নের ঘোরে বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু একটি প্রাণী? নিচের দিককার একটি প্রাণী মানুষের সংস্পর্শে এসে নিজ গুণেই তিনশ’ নয় বছরের অমরত্ব লাভ করেছে। যেখানে সে অন্য মানুষের অর্থাৎ সেই সাত যুবক ব্যতীত সময়ের বাকিদের চেয়ে নিজেকে আলাদা করে নিচ্ছে। যে কিনা পাহারা দিয়েই কাটিয়ে দিলো তিনশ’ বছর। কিন্তু সেতো প্রাণীদের মধ্যে সাব-অল্টার্ন। এখানেই হয়তো অবচেতনে সে জিতে যাচ্ছে, তার মতো আরো কয়েকজন সাব-অল্টার্ন মানুষকে সাথে নিয়ে। যদিও তাদের সাথে কুকুরের সম্পর্কে হায়ারার্কির ধারণা মিথ্যে হয়ে যায় না। এই যুবকদের পাহারা দিতে গিয়ে একটা কুকুরের এতোটা বছর বেঁচে থাকা কথার কথা নয়। সে কি আদৌ কুকুর তবে? যুবকেরা কি আসলেই মানুষ? এসব ভাবনা নিশ্চয় অবান্তর। তারা অলৌকিকতার আলোয় নিজেদের আলোকিত করে নিয়েছে। এই অতিলৌকিক গুণেই হয়তো কিতমির নামধারী কুকুরটি স্বজাতির মধ্যে হয়ে উঠেছে মহত্তম।
শেষ পর্যন্ত ঘুমভাঙা যুবকদের একজন বাজারে গিয়ে বুঝতে পারে ঘুমের ভেতরেই তারা কাটিয়েছে এতোটা বছর। অত্যাচারী বাদশাহ ততোদিনে তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। অচল হয়ে পড়েছে যুবকদলের পকেট থেকে বেরুনো মুদ্রা। সব জানার পর সবাই তাদের ফিরে আসতে বলে। কিন্তু এই পৃথিবী তাদের চেয়ে তিনশ’ বছরের বেশি এগিয়ে। এটা তাদের না ফেরার জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত কারণ।
আবারো তারা ফিরে আসে গুহায়। প্রত্যাখ্যান হয় ঐসময়ের রাজার আমন্ত্রণও। তারপর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাদের আরো এক ঘুমপর্ব। নিশ্চয় কুকুরটিও তাদের সেই নির্লিপ্ত ঘুমপর্বের সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তাদের পথ বেছে নেয়। এখনও হয়তো কোনও এক অজানা গুহার রহস্যে ঘোরগ্রস্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে আসহাবে কাহাফের সেই সাত যুবক। আর গুহার দুয়ারে দু’পা প্রশস্ত করে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে কিতমির।