আমার পড়ালেখা । ভিএস নাইপল ।। অষ্টম পর্ব ।। ভাষান্তর: মূর্তালা রামাত ও শারমিন শিমুল

                                                  পর্ব-৮

স্কুল চত্বরের শামান গাছের নিচে যে যায়গাটায় দাঁড়িয়ে ওয়র্ম স্যারের ক্লাসের জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম, কে বলতে পারে  হয়তো সেখানেই ১৮০৩ সালে ডমিনিক ডার্ট-এর বেল এয়ার নামের জমিদারী ছিল। কে বলতে পারে, হয়তো ওখানেই দাসদের দলপতি তার মনিবের প্রতি অস্বাভাবিক ভালোবাসা প্রমাণের জন্য অন্য দাসদের বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা করেছিল।

 

দাসদের ইতিহাসের চেয়েও আমাকে বেশি প্রভাবিত করেছিল বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আদিবাসীদের কাহিনী। এই দেশ তো আসলে আদিবাসীদেরই, তাদের আত্মারাই তো আমাদের ঘিরে আছে। যে মফস্বল শহরে আমার জন্ম অথবা আখের ক্ষেতের মাঝখানের যে এক টুকরো ফাঁকা মাঠে রামলীলা দেখেছি, আদিবাসীরাই সেগুলোর নামকরণ করেছিল। বৃটিশ মিউজিয়ামে দলিলপত্র নিয়ে গবেষণা করার এক পর্যায়ে আমি একটি চিঠির খোঁজ পাই। ১৬২৫ সালে স্পেনের রাজা চিঠিটা দ্বীপের তৎকালীন গভর্নরকে লিখেছিলেন।  চিঠি থেকে জানা যায়, শহরের আদি নামটি আসলে ওখানে বসবাসকারী আদিবাসীদের এক ছোট্ট গোষ্ঠীর নামানুসারে ছিল। ১৬১৭ সালে এই গোষ্ঠীর লোকজন ইংরেজ আক্রমণকারীদেরকে নদীপথে স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে এগুতে সাহায্য করেছিল। আট বছর পর স্পেনের শাসকেরা এই ঘটনার প্রতিশোধ নেয়। স্পেনের গভর্নরের নেতৃত্বে একদল স্প্যানিশ সেই গোষ্ঠীটির ওপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। বিচারে তাদের কঠিনতর শাস্তি দেয়া হয়। শাস্তিটা কী ছিল সে সম্বন্ধে চিঠিতে পরিষ্কার ভাবে কিছু বলা না হলেও, সেটা যে ভয়ানক কিছু ছিল তা আন্দাজ করতে কষ্ট হয় না। কারণ শাস্তি দেবার পর ঐ গোষ্ঠীর কাউকে আর ঐ অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকী পুরনো নথিপত্র রাখার রেকর্ড বিভাগ থেকেও প্রচণ্ড আক্রোশে তাদের নাম মুছে ফেলা হয়েছিল।

 

এই কাহিনী আমাকে আদিবাসীদের সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়। ছেলেবেলায় দেখা রামলীলাকে আমি কিছুতেই আর জীবনের প্রথম স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে ভাবতে পারছিলাম না। রামলীলার সেই মাঠে অন্য একদল আদিবাসী মানুষ আমার কল্পনার ভেতরে ঘোরাফেরা শুরু করে দিল। এর আগে কেবল গল্প-উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতা দিয়ে এতো বড় সত্যকে আমি কখনোই এভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি।

 

কেবলই নথিপত্র ঘেঁটে সম্পূর্ণ একটি বই লেখার এটাই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। কিন্তু এই বইটি লিখতে গিয়েই আমি কীভাবে বিভিন্ন উপায়ে এবং বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত কাহিনী বা ঘটনাবলীকে মানবিক উপায়ে বর্ণনা করা যায় তা শিখলাম। এই কষ্টার্জিত জ্ঞান বা দক্ষতা আমাকে পরবর্তী ত্রিশ বছর যাবত আরো অনেকগুলো ভ্রমণ কাহিনী বা গবেষণামূলক রচনায় সাহায্য করেছে। এভাবেই আমার ভাবনার জগত প্রসারিত হলো, সেই সাথে আমার উপন্যাস সৃষ্টিকারী ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রও বিস্তৃতি লাভ করলো। জ্ঞানের প্রসারের সাথে সাথে লেখার যে সব ধারা আমি চর্চা করছিলাম সেগুলোও একইভাবে আরো বিকশিত হল। যেহেতু লেখার গঠন মূলত বিষয়বস্তু বা উপাদানের ওপর নির্ভর করে, তাই আমার কোন ধারার লেখা বিশেষভাবে উন্নত হলো সেটা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারবো না। সব বই-ই আমার অনুধাবন ক্ষমতার একটি অংশ। লেখালেখি পেশাটাই আমাকে এই অনুধাবন ক্ষমতা লাভে উজ্জীবিত করেছে। ছেলেবেলায় লেখক হবার যে ইচ্ছা ছিল নিতান্তই ছেলেমানুষী পর্যায়ের একটা শখ, সেটিই পরে গল্পের পর গল্প তৈরি করতে আমাকে মরিয়া করে তোলে।

 

উপন্যাসের ধারাটা আমার নিজস্ব সৃষ্টি নয়। এটি অন্যদের কাছ থেকে এসেছে। বিখ্যাত শহুরে লেখকদের ক্ষেত্রে উপন্যাস হল স্ব-অর্জিত জ্ঞানের একটি কাঠামো যার সাথে অন্যান্য নিয়ম-কানুন, কল্পনা নির্ভর নানা সাহিত্যধারা আর শিক্ষণীয় ব্যাপার-স্যাপার সংশ্লিষ্ট। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে শুরুর দিকে স্ব-অর্জিত জ্ঞানবিহীন উপন্যাসই ছিল একমাত্র সম্বল। শহুরে লেখকদের যা ছিলো আমার তা অবশ্যই ছিলো না। আমি যে সমাজে বড় হয়েছি সেখানকার অনেকেরই গোষ্ঠীগতভাবে অতীত সামাজিক জীবনের জ্ঞান বলতে দাদার আমল পর্যন্ত জানা ছিল। এর বেশি পেছনের ইতিহাস আমরা জানতাম না। অন্যদিকে হাস্যকর সব স্থানীয় গাইড বইগুলোতে বলা হয়েছে দাস যুগের ফসল আবাদী জায়গাগুলোতে উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটেনি! ফলে চারপাশের পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের সমাজের লেখকেরা যে গল্প উপন্যাস লিখেছে সেগুলো হয়ে গেছে ভিত্তিহীন, অন্তঃসার শূন্য এবং প্রসঙ্গ বহির্ভূত। আর এ কারণেই শহুরে লেখকদের উপন্যাসে স্ব-অর্জিত জ্ঞানের যে মাধুরি মেশানো থাকে আমার উপন্যাসে তা একবারেই ছিলো না।

 

ছেলেবেলায় স্কুলের পাঠ্যবই আর পাঠাগারের গল্পের বইগুলো পড়তে গিয়ে দুটো ভিন্ন জগত আমার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াত। এর মধ্যে একটি জগত হলো একদম ছেলেবেলার জগত; যেখানে ভারতবর্ষ থেকে আগত মানুষেরা তাদের স্মৃতি থেকে এমন এক সমাজ গড়ে তুলেছে যা ভারতের প্রতিচ্ছবি এঁকে দেয়। আরেকটি জগত হল দ্বীপের ঔপনিবেশিক শহুরে সমাজ। তবে আমার ধারণা ছিলো যে, ছোটবেলায় অনুভূত সামাজিক এবং মানসিক অস্বস্তির কারণেই বই পড়ে বোঝটা আমার জন্য কঠিন ছিল।  ছেলেবেলার সেই পরিচিত অনুভূতি (কাহিনী শুরু হয়ে যাবার পরে সিনেমা হলে ঢুকে সিনেমার কাহিনী বুঝতে না পারা) এই সমস্যার জন্য দায়ী। আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিলো যে, বয়সের সাথে সাথে এই অস্বস্তিটুকুও চলে যাবে। প্রথম দিককার লেখা উপন্যাসগুলোতে আমি কেবল গল্পের শুরু, শেষ, চরিত্র গঠন আর হাস্যরসের কাঠামো এগিয়ে নিয়ে যাবার কাজে ব্যস্ত ছিলাম বলে সত্যটাকে ধরতে পারিনি। কিন্তু লেখালেখি চালিয়ে যেতে গিয়ে ধীরে ধীরে সত্যটা আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর সেই সত্যটা হচ্ছে, নিজের শৈশবের দুই অজানা জগতের অন্ধকার বলয়ই আমার লেখালেখির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ।

 

ফিকশন এক রহস্যময় পদ্ধতিতে কাজ করে আমাকে এক অজানা পথের দিশা খুঁজে দিয়েছে, যেখানে আমার লেখার বিষয়বস্তুগুলো থরে থরে সাজানো। কিন্তু এই পদ্ধতি যে আমাকে সারা জীবন পথ দেখাতে পারবে না- এই উপলব্ধিটুকুও আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।(চলবে)



সপ্তম পর্ব

শেয়ার