বারো বছর বয়সের আগেই আমার ইংরেজি সাহিত্য সংকলনে কিছু টুকরো টুকরো সাহিত্য ঠাঁই করে নিলো। এর মধ্যে ছিলো জুলিয়াস সিজার এর কিছু বক্তৃতা, নিকোলাস নিকলবি, অলিভার টুইস্ট আর ডেভিড কপারফিল্ড এর প্রথম অংশের কয়েকটা পৃষ্ঠা, চার্লস কিংসলের লেখা হিরোস থেকে পেরসিউসের গল্প, দ্য মিল অন দ্য ফ্লস এর কয়েকটা পাতা, জোসেফ কনরাডের প্রেম ও মৃত্যু নিয়ে লেখা রোমান্টিক মালয় গল্প, ল্যাম্বস টেইল অব শেক্সপীয়র থেকে নেয়া দু’একটা গল্প, গঙ্গা আর ধর্মীয় উৎসব নিয়ে লেখা একটা ব্যাঙ্গাত্মক রচনার কয়েকটি পাতা, এলডোজ হাক্সলির জেসটিং পিলেট, জে. আর. একারলির হিন্দু হলিডে, সমারসেট মমের লেখা গল্পের গোটাতক পৃষ্ঠা।
ল্যাম্ব এবং কিংসলের রচনা আমার কাছে একটু পুরনো ধাঁচের লাগার কথা। কিন্তু বাবার উৎসাহের কারণেই ওসব জটিল লেখা আমি পানির মতো সহজভাবে বুঝতে পারতাম। আমার কাছে সব কিছুই (এমনকি জুলিয়াস সিজার পর্যন্ত) রূপকথার গল্পের রূপ ধারণ করতো। সব রচনাই যেন অ্যান্ডারসনের লেখা দূরাগত কালের স্রোতে ভাসমান সময়হারা গল্প, যা নিয়ে আপন মনে খেলা যায়।
অথচ টুকরো টুকরো লেখা না পড়ে সম্পূর্ণ বই পড়তে গেলেই আমার কাছে সবকিছু দুর্বোধ্য বলে মনে হতো। যে অংশটুকু বাবা পড়ে শোনাতেন তার বাইরে আর কিছু পড়াটা রীতিমতো কঠিন মনে হত। যেটুকু আমি বাবার কাছ থেকে শুনতাম শুধু সেটুকুই যেন ছিল জাদুময়ী; নিজে নিজে যেটুকু পড়তে চেষ্টা করতাম তা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনটা হবার অনেকগুলো কারণের একটি হলো বইয়ের ভাষা আমার জন্য বেশ কঠিন ছিল আর অন্যটি হলো সামাজিক বা ঐতিহাসিক বর্ণনা পড়তে গিয়ে আমাকে প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলতে হতো। কনরাডের গল্পে যে প্রাকৃতিক বর্ণনা পড়তাম তা আমার চারপাশের পরিবেশের সাথে মানানসই ছিলো। কিন্তু মালয় দ্বীপকে যেভাবে তিনি বর্ণনা করেছেন তাতে মনে হতো জায়গাটি কল্পনার সীমানার বাইরের অবাস্তব কোনো পরিবেশে অবস্থিত, যেটি বোঝার সাধ্য আমার নেই। অন্যদিকে আধুনিক সাহিত্যে লেখকদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের জোরালো উপস্থিতি আমাকে সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে বাঁধা দিত। গল্পের চরিত্রদের জায়গায় নিজেকে বসাতে পারতাম না। ফলে কিছুতেই আমি লন্ডনের মম কিংবা ভারতের হাক্সলি বা একেরলি হিসেবে নিজেকে ভাবতে পারতাম না।
লেখক হবার ইচ্ছাটা আমার বরাবরই ছিলো। কিন্তু এই ইচ্ছাটার সাথে সাথে আরেকটা সত্যও আমি বুঝতে শিখলাম। সেটা হলো, লেখক হবার ইচ্ছা যোগানো এই সাহিত্য এসেছে এমন এক জগৎ থেকে যা আমার জীবনের চারদিককার পৃথিবী থেকে একেবারেই আলাদা।
২.
আমার পরিবার এশিয়া থেকে অভিবাসন নিয়ে নতুন পৃথিবীর ত্রিনিদাদ দীপাঞ্চলের ছোট্ট এক ফসল আবাদী জমিতে বসবাস করতে শুরু করে। আমাদের বর্ধিত পরিবারটির বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে ভারত ছেড়ে চলে এসেছে। তারপরও আমার কাছে ভারত এক দূরাগত, পৌরানিক কাহিনীর দেশ। আমাদের মন-মানসিকতা গঙ্গা পাড়ের মানুষদের মতো থেকে গেলেও বছরের পর বছর ধরে চারপাশের ঔপনিবেশিক পরিবেশ আমাদের একটু একটু করে কাছে টেনে নিচ্ছিলো। ওর্য়ম স্যারের ‘মেধা প্রদর্শনী’ পরীক্ষার বিশেষ প্রস্তুতির ক্লাসে আমার সুযোগ পাওয়াটা এই পরিবর্তনেরই একটা অংশ। আমাদের বংশের আর কোনো সদস্যই এত অল্প বয়সে এই শ্রেণীতে ভর্তি হবার সুযোগ পায়নি। পরবর্তীতে পরিবারের অন্যরা আমাকে অনুসরণ করে প্রদর্শনী ক্লাসে ভর্তি হতে পেরেছিল কিন্তু আমিই ছিলাম বংশের প্রথম জন।
উনিশ শতকের প্রাচীন ভারতের গ্রাম্য আচার-আচরণ তখনও আমার ভেতরে ছিল। এই প্রাচীনত্ব যে কেবল আমার আত্মীয়-স্বজন আর পরিবারের গণ্ডির ভেতরেই বিদ্যমান ছিল তা নয়। বরং কখনো কখনো চারপাশের সামাজিক ক্ষেত্রেও আমার এই ভারতীয় প্রাচীন মনোভাব জেগে উঠতো।
জীবনের প্রথম যে বড়সড় সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা হল রামলীলা’র পালা। সনাতন ধর্মের পবিত্র হিন্দু বীর রামের বনবাস আর পরবর্তীকালে লঙ্কা বিজয়ের কাহিনী নিয়ে রচিত মহাকাব্য রামায়নের উপর ভিত্তি করে যে গ্রাম্য পালা আমাদের ছোট্ট মফস্বল শহরে অভিনীত হত তারই নাম রামলীলা। আমাদের শহরের এক প্রান্ত জুড়ে থাকা আখের ক্ষেতের মাঝখানে একটি মাঠ ছিল। সেই মাঠেই এই পালা অনুষ্ঠিত হতো। রামায়ন এর চরিত্রদের অনুকরণ করে পুরুষ অভিনেতারা খালি গায়ে অভিনয় করতো। তাদের কারো কারো পিঠে থাকতো লম্বা ধণুক। তারা পায়ের পাতার উপর ভর করে মঞ্চের উপরে ধীর ছন্দে শিহরিত পদক্ষেপে হেঁটে বেড়াতো। মঞ্চ থেকে প্রস্থানের জন্য তারা মাটি খুঁড়ে বানানো ঢালু একটা পথ ধরে অদৃশ্য হয়ে যেত। এই ঐতিহাসিক ঘটনার জমকালো অনুষ্ঠানটি শেষ হতো লঙ্কার দুষ্ট রাজা রাবনের কালো রঙয়ের বিশাল কুশপুত্তলিকা দাহের মধ্য দিয়ে। রাবনের প্রতিমূর্তি পোড়ানোটা এই অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল। বহু লোক শুধু এই অংশটা দেখতেই অনেক দূর থেকে আমাদের শহরে আসতো। বাঁশের ফ্রেমে আলকাতরা মাখানো কালো কাগজ বসিয়ে কাচাঁ হাতে বানানো সেই কুশপুত্তলিকা খোলা মাঠে রেখে দেয়া হতো। প্রতি বছর আগুন জ্বালিয়ে রামলীলা উদযাপনের অঙ্গীকার বহন করতো ঐ কুশপুত্তলিকা।
রামলীলা’র সবকিছুই ভারতীয় অভিবাসীদের স্মৃতি থেকে তৈরি করা হতো। শিল্পগুণের বিচারে এই পালা ছিল অজস্র ত্রুটিতে ভরা। তারপরও স্থানীয় সিনেমাহলে প্রিন্স অ্যান্ড দ্য পপার অথবা সিক্সটি গ্লোরিয়াস ডে’র মতো পশ্চিমা চলচ্চিত্র দেখার সময় যতটুকু বুঝতাম তার চাইতে রামলীলা আমার কাছে অনেক বেশি অর্থবহ ছিল। উপরে উল্লেখিত চলচ্চিত্র দুটি আমার দেখা প্রথম চলচ্চিত্র। ওসব চলচ্চিত্র দেখার সময় কাহিনী সম্পর্কে আমার কোনো রকম ধারণা ছিল না। অন্যদিকে রামায়ন এর কাহিনী জানা থাকায় রামলীলা আমার কাছে অনেক বাস্তব আর উত্তেজনাপূর্ণ ছিল।
হিন্দু জাতির জন্য রামায়ন একটি অতি প্রয়োজনীয় গল্প। আমাদের দুইটি মহাকাব্যের মধ্যে এটিই তুলনামূলকভাবে সহজবোধ্য। তাই, মহাকাব্যের যেভাবে অমর হয়ে থাকার কথা, রামায়ন সেভাবেই আমাদের মাঝে বেঁচে ছিল। রামায়ন এর কাহিনীর বর্ণনা শক্তিশালী, মনোমুগ্ধকর আর দ্রুত। এমনকি দৈব ঘটনাবলীও অনেকটাই মানবিক। চরিত্রগুলোর বৈশিষ্ট্য আর মনোভাব সবসময় সহজেই আলোচনা করা যেত; সকলকে নীতিকথা শেখানোর জন্য রামায়ন ছিল আদর্শ। আমার পরিচিত সব ভারতীয়রাই রামায়নের মূল কাহিনি জানতো। কেউ কেউ আবার মূল পংক্তিগুলোও বলতে পারত। আমাকে রামায়ন শেখানোর প্রয়োজন পড়েনি। রামের প্রতি অবিচার আর ঐ বিপদসংকুল স্থানে তার বনবাসের কাহিনী আমার এমনিতেই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আমার সামনে উন্মোচিত হওয়া সকল সাহিত্যের পেছনেই লুকিয়ে ছিল রামায়ন এর এই কাহিনী। পরবর্তীকালে শহরের অন্যান্য লেখকের লেখা, অ্যান্ডারসন আর ঈশপের গল্প, সর্বোপরি বাবার কাছ থেকে শোনা সমস্ত সাহিত্য বোঝার পেছনে রামায়নের এই জ্ঞান আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছে।
চলবে
প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আমার পড়ালেখা
মূল: ভিএস নাইপল
ভাষান্তর: মূর্তালা রামাত ও শারমিন শিমুল