উৎসর্গ
উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠা লেখার মতো ধীরগতিসম্পন্ন এ সময়।
তার মতো বিষাদজনিত আর কে, কবে!
প্রস্তাবনা
[গোয়েন্দা বা রহস্যোপন্যাস নয়, বরং ডাকতে চাইব অপরাধ সাহিত্য, এই নামে। কারণ, সাব-ডম বায়নারিতে অপরাধী ও গোয়েন্দা, উভয়েই এখানে সাবর্ডিনেট। প্রধান চরিত্র, অপরাধ নিজে। তথাকথিত গোয়েন্দা/রহস্যোপন্যাস বহুস্তরীয়, বহুমাত্রিক এবং ওপেন এন্ডেড নয়। অর্থাৎ একমাত্রিক। একমুখী। এবং ক্লোজ এন্ডেড। ক্রিসপি অধিকাংশই। একধরনের গোগ্রাস সাহিত্য। যা চিন্তাশীল নয়। মনস্তত্ত্ব ও দর্শন বিকটভাবে অনুপস্থিত, প্রায়। ফলে, তাদের একাধিক পাঠ ভিন্ন-ভিন্ন অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিকোণ থেকে দূরবর্তী। আমি চেয়েছিলাম এরকম একটি লেখা লিখতে, যেখানে মূল চালিকা শক্তি বিবরণধর্মী ঘটনা নয়, ‘ভাষা’। যা জটিল। যেহেতু মনস্তাত্ত্বিক। যে উপন্যাস একমাত্র ভাষায় সংঘটিত হবে। অনিবার্য ভাষাটিকে বাদ দিলে তার ডিএনএতে কিছুই থাকে না। মূল কাহিনিটি হয়তো সাড়ে তিন লাইনে বলে ফেলা সম্ভব। কিন্তু একমাত্র ভাষাই তাকে বিশেষ করে তোলে। —লেখক]
বলা হয় এমন অনেক বিজেতা আছে যারা বিজয়ে কোনও আনন্দ পায় না যদি তাদের প্রতিপক্ষ বাঘ অথবা ঈগলের মতো হিংস্র না হয়; তাদের প্রতিপক্ষ যদি ভেড়া বা মুরগীর মতো নিরীহ হয় তাহলে বিজয়টা তাদের কাছে শূন্য মনে হয়। অনেক বিজেতা আছে যারা সব শেষ হয়ে গেলে, শত্রু নিহত অথবা আত্মসমর্পণ করলে, উপলব্ধি করে কোনও শত্রু বা মিত্র অবশিষ্ট নেই — শুধু তারাই আছে, সার্বভৌম, নিঃসঙ্গ, পরিত্যক্ত এবং অভাগা।
—লুস্যুন
কী হল? ওরম হাঁ করে তাকিয়ে আছেন কেন?
… স্রষ্টা চলে যায়। সৃষ্টি থাকে। অপরাধীও চলে যায়। কারাগারে। দ্বীপান্তরে। ফাঁসিতে। এনকাউন্টারে। ফ্রেমের ভেতর আউট অফ দ্য ফ্রেম হয়ে, কাহিনি হয়ে, মিথ হয়ে, গুজব হয়ে, যা বলবেন স্যার, যদি কিছু পড়ে থাকে, তা অপরাধ। অপরাধ যদি একটা সভ্যতা, অপরাধী তার হতভাগ্য ইঞ্জিনিয়ার।
…দেখুন, আমরা গোয়েন্দারা, আসলে আধা নিরপরাধ, কেননা আপনাদের সঙ্গে মিশতে মিশতে আধা অপরাধী।
…আমাদের সঙ্গে আর মিশলেন কোথায় গোয়েন্দাবাবু! কিছু মনে করবেন না, মজা করলুম। দাঁড়ান একটু, পায়জামার ফিতেটা কোথায় গেল…দেখি ও ঘরে। …আসলে কী জানেন তো, গোয়েন্দা গল্পে সবকিছু, সমস্ত কথা, সমস্ত ঘটনাই হয় একটি নির্দিষ্ট ঘটনা, তার সমাধান ও পরিণতির জন্য নিবেদিত। সেখানে অহৈতুকী বা অন্য প্রয়োজন সমাধানের জন্য কিছুই ঘটে না। এই যে আমি পায়জামার দড়িটা খুঁজতে এ ঘরে এলাম, এটা যদি আর পাঁচটা গোয়েন্দা গল্পের ঘটনা হত তবে দেখা যেত সেখানে পায়জামার দড়ি দিয়ে একটা বিশেষ কিছু ঘটানো হচ্ছে, বা পায়জামার দড়ি আনবে বলে লোকটা পাশের ঘরে একটা রিভলভার বা চাকু আনতে গেছে। মানে, পায়জামার দড়ি সেখানে একটা অত্যন্ত জরুরি ভূমিকা নিচ্ছে। অথচ সাধারণভাবে এটা তো এমনি এমনিই হতে পারতো। তাই না?
…হ্যাঁ, যা বলেছেন, সবসময় একটা চোখ -কান খোলা রাখা শিকারী কুকুরটাইপ ব্যাপার।
…শুধু চোখ -কান? নাক? আর বাদবাকি ফুটোগুলোতেও বায়নাকুলার ফিট করা থাকে বোধহয়
…আচ্ছা, আমি গোয়েন্দা হলেও তো অতিথি। অতিথিকে দাঁড় করিয়ে এভাবে ক্যারেক্টার অ্যানালিসিস… ব্যাপারটা কি ভালো?
…হাঃ হাঃ… রসিক লোক… আপনি কি সত্যিই এরকম হাম্বল? নাকি আদতে হারামি?
…অ্যাঁ?
…মানে যা বললাম তা -ই। আচ্ছা আপনারা গোয়েন্দারা তো চট করে সব দেখেটেখে নিতে পারেন, মানে ওভারকোটে কটা বোতাম ছেঁড়া, হাতার কাছে কোনও কালির দাগ, আঙুলের কোন নখটা উঠে যাওয়া, পায়ের জুতোতে কী লেগে, দাঁতের ফাঁকে চিকেন না পালং শাক… কী হল? ওরম হাঁ করে তাকিয়ে আছেন কেন?
…হ্যাঁ… ম্ম্মানে…
…হ্যাঁ মানে? আপনিও পারেন? দেখুন, ওসব ডাহা আজগুবি কান্ডকারখানা যদি আপনি এখানে করতে চান তো প্লিজ, হাতজোড় করে বলছি, আসুন। আপনি এই কাজের উপযুক্ত নন।
…আচ্ছা, আমাকে কী করতে হবে?
…বছর খানেক আগে, কাগজে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। যাদবপুর এলাকার একজন বয়স্কা মহিলা বিজ্ঞাপনটা দিয়েছিলেন। চারতলার ছাদে কাপড় মেলতে সক্ষম দুজন মেয়ে চাই। আমি নিশ্চয়ই এরকম কোনও বিজ্ঞাপন দিইনি। বাই দ্য ওয়ে, আপনি কাগজের বিজ্ঞাপনটা দেখেই এসেছেন তো?
…হ্যাঁ, ওই যে কাল…
…তো, ডিটেইলস তো সেখানে লেখাই ছিল। আমার একজন গোয়েন্দা চাই। সুস্থ মস্তিষ্কের।
…এগ্জ্যাক্টলি কাজটা কী? কেউ নিখোঁজ? মার্ডার হয়েছে? কিছু চুরি গেছে?
…সুস্থ মস্তিষ্ক কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা বিগড়ে গেল, না? আপনারা গোয়েন্দারা না, কী যে ভাবেন নিজেদের। করেন তো মশাই ওই পর্দা সরানোর কাজ…
…পর্দা?
…আজ্ঞে হ্যাঁ, পর্দা। থিয়েটার দেখতে গেছেন কখনও? ওই পর্দা সরানেওয়ালার সঙ্গে থিয়েটারটার যতটুকু সম্পর্ক, আপনাদের সঙ্গে অপরাধেরও, তা-ই। যাক্গে শুনুন, কোনও অপরাধ করার বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে?
…ন্না না… সে কি!
…দেখুন, একজন লেখক থাকেন প্রকাশকের খোঁজে। একজন ফিল্মমেকার প্রযোজকের। একজন অপরাধী গোয়েন্দার খোঁজে। সেজন্যে আমাকে যেমন জানতে হবে আপনি গোয়েন্দা হিসেবে কেমন, তেমনি আপনারও জানা দরকার আমি কেমন অপরাধী? তাই না?
Crime is a protest against the abnormality of the social organization and nothing more, and nothing more; no other causes admitted!
Fyodor Dostoevsky, Crime and Punishment
…ক্রাইমটা কি হয়ে গেছে?
…উইথ দ্য ফিনিশিং টাচ, হয়ে গেছে।
মাঝারি মাপের একটা গুমটি ঘরে, বর্ষার দুপুরে অপরাধী এবং তাঁর গোয়েন্দা মুখোমুখি বসে থাকেন। দীর্ঘ সময় যায়। তাঁরা মুখ নীচু করে বসেই থাকেন। কোলের কাছে জড়ো করা গোয়েন্দার দুহাতের করকুর্চাস্থিতে একটা মাছি উড়তে উড়তে বসে, বসে থাকতে থাকতে একঘেয়ে হলে উড়ে যায়। আবার ফিরে আসে। টেবিল ফ্যানের ঘূর্ণায়মান ব্লেডের ওপারে জাঁ জেনের আওয়ার লেডি অব দ্য ফ্লাওয়ার্সের ওপর বসে একটা টিকটিকি প্রতীক্ষমান চোখে দেখছে। টিকটিকি বাঙলা জানে না। জানলে জানতো, মানুষও টিকটিকি হয়। এখন যেমন তার সামনে একজন টিকটিকি বসে আছে। টিকটিকি তা জানে না। জীবনে যে মুহূর্তে মানুষ তার কৃতকর্মের ওজন বুঝতে পারে এবং যে মুহূর্তে সে তার কর্তব্যের ওজনও বোঝে; বুঝে, একচুল নড়ার ক্ষমতালুপ্ত হয়ে স্থাণু বসে থাকে, তখন তাদের সাথে সেই কৃতকর্ম ও কর্তব্যের ওজনও কি বসে থাকে? যে জন্মগ্রহণ করে না, সে কি জানে আমি জন্মাব না? অপরাধ, যার বহিরাবরণে হয়তো একটা চাকু বা পিস্তল কিংবা দড়ি; বাইরে থেকে তো এটুকুই। আর হয়তো আশেপাশের বাড়িগুলোর খোলা জানলা দিয়ে ঢুকে যাওয়া অবাঞ্ছিত কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক কিছু চিৎকার, চেঁচামেচি। দেয়ালের কোণে রক্তের কালচে। ড্রেসিং টেবিলের ভাঙা কাচ। কিন্তু গোটা চিত্রনাট্য, সংলাপ -স্বগতোক্তি থেকে নামতালিকা, ঋণস্বীকার সমেত একটি মস্তিষ্কে পূর্বে অনুষ্ঠিত, ইতোমধ্যে। উইলিয়াম গ্লাসারের একটা থিওরি আছে, র্যাশনাল চয়েস থিওরি। এতে বলা হয় অপরাধটি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় একজন অপরাধী সম্পূর্ণ বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন এবং বাস্তবোচিত স্থির মস্তিষ্কে থাকেন। অর্থাৎ, মস্তিষ্ক সেই মূল মহড়াকক্ষ যেখানে পর্দা কখনও টাঙানো হয় না, আর সাধারণত গোয়েন্দার প্রবেশ ঘটে মহড়ার সফল মঞ্চায়নের পর। কিন্তু এখানে একটু পরে ওঁরা চেয়ার বদল করলেন। গোয়েন্দার চেয়ারে গিয়ে বসলেন অপরাধী, অপরাধীর চেয়ারে গোয়েন্দা। তারপরে বদল হল জামা, প্যান্ট, অন্তর্বাস, হাতঘড়ি, স্মার্টফোন, সিমকার্ড। সবশেষে হৃদয়। ওঁদের দুজনের দুজনকে যে আজ প্রগাঢ়ভাবে জানা প্রয়োজন। রেলের চাকায় জড়িয়ে যাওয়া শাড়ি বা জামার অংশ, তারপরে কিন্তু আর কিচ্ছু করতে হয় না, অপ্রতিরোধ্য চাকা পৌর্বাপর্ব তাকে ঘোরাতে ঘোরাতে নিয়ে যায় এবং নিয়ে যায়; নিয়তির মতো নয়, স্বয়ং নিয়তি হয়ে। কিন্তু বেড়ালের চোয়ালে গিয়েও কিছুক্ষণ প্রাণ থাকে ইঁদুরের, তখনও সে যুধ্যমান নাকি পোতাশ্রয়ের নির্বিঘ্ন শান্তি পেয়ে গেছে সেখানে? আর যদি তাদের মহাবল দাঁতের নীচে যাবার আগে চাকা কিংবা বেড়ালকে জানার অনেকটা সুযোগ পাওয়া যায়? জানার যন্ত্রণা অনেক বেশি। অপ্রত্যাশিতর বিহ্বলতা তো তার থাকে না। তাকে ধীরে সুস্থে শান্ত বুদ্ধিতে ফাঁসির দড়িটা নিজের গলায় পরতে হয়। জীবনের যন্ত্রণা কি আরও মূলচ্ছেদী আর মৃত্যু কি আরও আঁট হয় না তবে? সিস্টেম সম্পর্কে আমাদের সমষ্টিগত জ্ঞানের যে নাট এবং বল্টু সেগুলো যখন একটা বড়োসর ‘আন্নোওন’ -এর সামনে এসে পড়ে তখন সেই জ্ঞান দ্বারা লব্ধ অ্যান্টিসিপেটেড থট তার সমাজ স্বীকৃত অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্য ডিফেন্স মেকানিজমের যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করে, তার ফলে সেই ‘আন্নোওন’ নামক নতুনকে বা তার স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ও সমষ্টিগত জ্ঞানের রেফারেন্সে যা অপ্রতিসম তাকে প্রায়শই সে ডিসকার্ড করে বসে। পৃথিবীতে এমন কোনও সিস্টেম নেই যার অপরাধ -নিরপেক্ষ ট্রুথ আছে। ক্রাইম ইন্ডিপেন্ডেন্ট ট্রুথ বলে কিচ্ছু হয় না। প্রত্যেকটা সিস্টেমেরই রয়েছে মাল্টিপল্ ক্রাইম -ডিপেন্ডেন্ট সত্য। ইডিওসিন্ক্র্যাসি শব্দটাতে বোঝানো হয় কোনও মানুষের তার নিজের চিন্তা প্রকাশের যে বৈশিষ্ট্য, তাকে। অপরাধ নিজেই চিন্তা প্রকাশের একটা প্রকার। যখন কোনও অপরাধের আলোচনা হয় তখন অপরাধীর ইডিওসিন্ক্র্যাসির থেকে গোয়েন্দার ইডিওসিন্ক্র্যাসি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনেক দূরবর্তী। ফলে বস্তু এবং তার জ্ঞানের মধ্যে একটা বড় রকমের ফাঁক থেকেই যায়। মানুষ হিসেবে বস্তুর প্রকৃতির ওপর আমাদের পর্যবেক্ষণ শক্তি একটা পর্যায়ের পর সীমাবদ্ধ। একটা পর্যায়ের পর আমরা জানি না এরপর কী হবে; তখন এমন অনেক জিনিসই থাকে যা আমরা দেখতে পাই না। এমন শব্দ হয়, আমরা শুনতে পাই না। এমন ঘটনা ঘটে, যার কোনও রেকর্ড আমাদের কাছে নেই। আমাদের জ্ঞানের মাঝে যে ফাঁক আসলে সেটাই তখন রয়ে যায়, নেপথ্য, কিন্তু কেন্দ্রীয় চরিত্রে। বিলীশা বেকন নামের জিনিসটা জাহাজ এবং বিমানে দেখা যায়। জাহাজ বা বিমানকে ঠিকভাবে চালাবার জন্য এ একধরনের বেতার-সংকেত যন্ত্র। বলা হয় জীবজগতের মধ্যেও এটা আছে। মানুষের মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুর মধ্যে যে ইলেক্ট্রিক্যাল বার্তা সেটা বিলীশা বেকন ছাড়া আর কী। এবারে, এই কোডগুলোকে ভাঙা বৈজ্ঞানিকের যেমন কাজ, শিল্পীরও কাজ। অপরাধীরও। আমাদের মনের প্রকৃতি দ্বারা আরোপিত যে প্রকৃতিকে (গাছপালা, নদনদীর কথা বলছি না) আমরা দেখি, শুনি, গন্ধ পাই, অনুভব করি — তাকে বুঝবার ক্ষমতায় আমাদের সীমা নেই, তবে সীমাবদ্ধতা আছে। একজন শিল্পী তথা অপরাধী এই সীমাবদ্ধতাকে একইসাথে স্বীকার করেন এবং করেন না। আমের ভেতরে থাকা পোকা যেমন আমকে কখনও বুঝে উঠতে পারে না; অনুসন্ধানী অপরাধীরা সেজন্য একটা সমান্তরাল ব্যবস্থা নির্মাণে নিয়োজিত হন, যা মূল ব্যবস্থার ব্যাখ্যায় কার্যকরী হতে পারে।
বস্তুর গ্রন্থনা থেকে বস্তুকেই মুক্তি পেতে হবে— একদিন।
শক্তি চট্টোপধ্যায়
…একজন অপরাধী হিসেবে অপরাধকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
…একটা বই যেভাবে তার বিবলিওগ্রাফিকে ব্যাখ্যা করে। একজন মানুষ যেভাবে তার সম্পর্কগুলোকে। আচ্ছা, ইয়ে, বিবলিওগ্রাফির ব্যাপারে আপনার কী মত?
…এ ব্যাপারেও কোনও অভিমত থাকা জরুরি বুঝি?
…বলুন না, যা মনে হচ্ছে বলুন…
…আ….আ…ম্… কী বলি…
…সাহিত্যে হোক, শিল্পে হোক, কি দর্শনে, অর্থনীতিতে, যেকোনও বিষয়েই যদি ঐতিহাসিক তাৎপর্য পেতে পারে এমন কোনও প্রসঙ্গমূলক বইয়ের শেষ পাতাগুলো আমরা উলটে দেখি, তো দেখব তার সমৃদ্ধ বিবলিওগ্রাফি। অনেক সময়েই তা সংশ্লিষ্ট বইটির থেকেও অনেক অনেক বেশি বিস্তৃত, ব্যাপ্ত, গভীর। আমার নিজের মনে হয়, এরকম কোনও বইয়ের ওই শেষ পাতাগুলো আসলে একটা বিরাট বাড়ির ঘুলঘুলি, জানলা, দরজা, কার্নিশ, রেলিং, সিঁড়ি, ফটক, বিপদকালীন দরজা, নিকাশী পথ। যেখান দিয়ে আলো এসে ঢুকছে। ঝড়ও। বাইরের ইতিহাস ঝাপ্টা মারছে তাকে। যেখান দিয়ে অচিন মায়ারা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে, আয় আয়। যেখানে দাঁড়িয়ে অল্প ঝুঁকে নীচে তাকানো যায়। আকাশে চোখ রাখা যায়। বেরিয়ে হেঁটে আসা যায় বাগানে। চলে যাওয়া যায় বাইরে রাস্তায়, ট্রেন বাস ধরে অন্য শহরে। সেখান থেকে ফিরে আবার এসে ঢোকা যায় এই বিরাট বাড়িটিতে। যে বাড়িটি আমাকে আটকে রাখে না। বেঁধে রাখে না। যদি এই ঘুলঘুলি, দরজা, জানলাগুলো বাড়িটায় না থাকতো তবে সে হত অন্ধকূপ। যেখানে প্রাণ গুমরে মরে। একজন মানুষের জীবনে তার বিবলিওগ্রাফি বোধয় তার সম্পর্ক আর অপরাধগুলো।
…প্রায় সমস্তকিছু তার বিরুদ্ধে থাকার পরেও একজন অপরাধী তার শক্তিটা পায় কোত্থেকে?
…দ্য স্ট্রেংথ অফ ক্রিমিনাল বিহেভিঅর ইজ আ ডায়রেক্ট ফাঙ্কশান অফ দ্য অ্যামাউন্ট, ফ্রিকুয়েন্সি অ্যান্ড প্রোব্যাবিলিটি অফ ইটস রিইনফোর্সমেন্ট। আচ্ছা, আপনি নিজে অপরাধী হলে অপরাধকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন শুনি?
… দেখুন, অপরাধী -গোয়েন্দা এই বায়নারিতে আমি বিশ্বাস রাখি না। শাদায় কালোয় মন্দ ভালোয় মেলামেশাহীন ছবি তো আর হয় না। হওয়া সম্ভব নয়। কারণ একাল আমাদের আবেগ অনুভূতিগুলোকে পায়রার প্রকোষ্ঠের মতো মিশ্রণবিহীন করে রাখেনি। যে গোয়েন্দা সেও কিছুটা অপরাধী; যে অপরাধী সেও কিছুদূর সত্যান্বেষী। আমি শুধু এটুকু জানি যে, রাধা শব্দটা এসেছে রাধ্ ধাতু থেকে। যার অর্থ, যে আরাধনা করে। আর কৃষ্ণ, কৃষ্ ধাতু। যে আকৃষ্ট করে। বাংলায় অপ উপসর্গটি অপকৃষ্ট, অধম, অনাদর, অপকর্ষ, কুৎসিত, বর্জন, বিচ্ছেদ, বিকৃতি, বিহীন, বিপরীত, বৈপরীত্য ইত্যাদি প্রকার পেজর্যাটিভ অর্থনির্দেশ করলেও, অপ অর্থে হর্ষও হয়। অর্থাৎ এবং সুতরাং, অপরাধ -এর রাধ্ -এ যদি আরাধনা হয়, তবে, অপ -তে হর্ষই কাম্য, যা অবশ্যই দত্ত নয়।
…বাঃ, বেশ ভালো বললেন তো। একটা জিনিস আমার মনে হয়, সৃষ্টির দিকে তাকালে, সবখানেই বিস্তার। জালের পরে জাল গেঁথে সে ক্রমেই বিস্তৃতি নিচ্ছে। কবিতা আর অপরাধের ধর্ম সৃষ্টির ধর্মের বিপরীত। এ যেন এক এনক্যাপসুলেশন। সে শুধু সংকেত। ইশারা। ইঙ্গিত। একটা পলকমাত্র। একটা কোড। দেখতে দেখতে মিলিয়ে যাওয়া হাসি। মিলিয়ে যেতে যেতে এবং মিলিয়ে যাওয়ার পরেও স্মৃতিতে থেকে যাওয়া তার স্পষ্ট কিছু আবছা রেখা। কবি সতত গোয়েন্দাপ্রবণ। দুজনেই সত্যান্বেষী। কিন্তু একজন চাইছে রহস্যকে বাঁচিয়ে রাখতে। আরেকজন রহস্যকে ভেদ করে খুলে দিচ্ছে গোটানো মাদুর। এইদিক থেকে গোয়েন্দাকে কবি বলে মনে হয় না। অপরাধীই কবি। কবিতাকে ছেড়ে কবি আর প্রকাশককে নিয়ে বেশি মাতামাতি করলে যা হয়, অপরাধ সাহিত্যে অপরাধী ও গোয়েন্দাকে নিয়ে লাফানোটা সেরকম। অপরাধই কবিতা। গোয়েন্দা তার প্রথম পাঠক।
…আপনি তো শুনেছি লেখেন -টেখেন? তা গপ্পো উপন্যাস লেখার ফর্মূলাটা কীরম আপনার কাছে? বা, এই যে কোট -আনকোট দুজন ঘোষিত অপরাধী -গোয়েন্দা এখানে মিট করেছে, এটা নিয়ে যদি একটা গপ্পো লেখেন, কেমন হবে সেটা?
… গল্প, উপন্যাস দুটো লেখার ক্ষেত্রেই আমার নিজের কাছে নিয়ম একটাই। লেখার ভেতর শুধু গল্পটা গুঁজলেই হবে না, তার সাথে গুজবটাও লিখতে হবে। অত্যন্ত যত্নে, ওটাই মূল, সবিশেষ। শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো গল্প তো তৈরি হয়েই চলেছে। তাহলে এত গল্প যাচ্ছে কোথায়? সেসব লিখে ফেলছি না কেন? কারণ সব ক্ষেত্রে আমি গুজবটা খুঁজে পাচ্ছি না। গুজব দিয়ে চাই গল্পটাকে আক্রমণ করতে। একেবারে সন্ত্রাসবাদী হানা। অন্তর্ঘাত। তারপর আক্রমণস্থলে ছড়ানো স্প্লিন্টার, বারুদ আর ধ্বংসস্তূপের স্ল্যাবের তলা থেকে পোড়া হাত তুলে যখন দাঁড়াবে গল্পটা, ততক্ষণে রেস্কিউ টীম ফিরে গেছে। ফলে কেউ তাকে উদ্ধার করবে না। শেষমেশ আমি তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার দেব। তবে এমন একটা গল্প আমার লেখা উচিত যে গল্পের শেষে একটা বিজ্ঞাপন থাকবে নিখোঁজ গল্পের সন্ধানে। গুজবকে এক-একজন এক-এক নামে ডাকে। কেউ একে বলে ভাষা। কেউ বলে ফর্ম। কেউ বলে কথন। কেউ বলে শৈলী। কেউ বলে স্টাইল। কেউ বলে কাঠামো। কেউ বলে বিন্যাস। কেউ বলে বিষয়। আমি বলি গুজব। আমি শুনেছি কোনও এক ভাষায় ‘গল্পগুজব’ বলে একটা শব্দ আছে।
ইতিহাসের বরফমাখা চোখের পাতার নীচে যে জল তা কখনো খুন ও খুনী দুজনকেই ঢেকে দেয়।
নজওয়ান দরবিশ
১
যেকোনও আপরাধকেই বলা চলে, একটি নির্মীয়মাণ অপরাধের কিয়দংশ। কোনও অবস্থাতেই তাকে নির্মীয়মাণ এবং তার কিয়দংশ ছাড়া আর কিছু বলা যায় কি? অপরাধ সততই একটি নির্মীয়মাণ অপরাধের কিয়দংশ। তত্রাচ, এই শহরকে আমি গুডবাই বলে দিয়েছি অনেক আগেই। তীরে দাঁড়ানো লোক যেভাবে নৌকো ঠেলে দেয়। গাছের পাকা ফল মাটিতে পড়ে ফেটে গেলে, তার বিচি যেমন বাইরে বেরিয়ে আসে; পেটের ভেতর L শেপে ঘুরে যাওয়া খুনীর চাকু যেমন বাইরে, প্রকাশ্যে এনে ফেলে নাড়িভুঁড়ি, আমি সেইভাবে এই শহরের ভেতর তৈরি হলেও, আজ, বেরিয়ে এসেছি তার পেট থেকে। বেরিয়ে, পড়ে আছি, তারই মৃতদেহের পাশে। যেভাবে গাছ থেকে পড়ে ফেটে যাওয়া পাকা ফলের বিচি ফলকে দ্যাখে, যেভাবে মৃত লোকটির বেরিয়ে পড়া নাড়িভুঁড়ি সেই লোকটাকে দ্যাখে। আমি দেখছি, এই শহরটাকে। তবুও, বলা দরকার, অপরাধ সততই একটি নির্মীয়মাণ অপরাধের কিয়দংশ। যেভাবে, একটি ইঁট, একটি নির্মীয়মাণ গৃহের। আর ইতিহাস কখনও এক বিপর্যয়, স্বয়ং। এমন এক বিস্রংসী ধারা যা থেকে মুক্তি নেই। পুনঃপ্রাপ্তি, নেই। সে নিজেই অনুবর্তী অস্থায়ীত্বের বিলয়। যেখানে দাঁড়িয়ে একজন মনোবিশ্লেষক বর্তমান এবং ভবিষ্যতের প্রেক্ষিতে ব্যক্তির সত্ত্বার বা/ও আমির গঠন ও নির্মাণ প্রক্রিয়া নিরীক্ষা করে। কিন্তু অনুসন্ধানী উত্তর খোঁজে দূরের এবং সাম্প্রতিকতম অতীতেরও; যে উত্তর শুধু একজন মানুষের নয়, গোটা জাতির সভ্যতার এবং অসভ্যতারও। যে গল্প কখনও বলা হয় নি। কখনও বলা হবেও না। কোনও স্মৃতি যাকে খুঁজে এনে পুনরুদ্ধার করতে পারবে না। ছেঁড়া এক দিক্চক্রবাল যেখানে শুধু ঝাপসা দেখা যায়। অপরাধীই হল সেই কবি যে বিনাশ পেরিয়ে আসার পর শূন্যকায় এক প্রতিমূর্তির কবলে পড়া ইতিহাস থেকে ক্রমাগত এই বিষাদজনিত শোকস্মৃতি দিয়ে পুনর্গঠন করতে চায় তার ইতিহাস আর পরিচয়ের সম্পূর্ণ হারিয়ে যাওয়া, ধ্বংস হয়ে যাওয়া সত্ত্বাকে। আসলে নিজেকেই। তার স্মৃতিকে সে নিয়োজিত করে সে কী হারিয়েছে মনে করার জন্য। গোটা এক অপরাধজীবন ধরে স্মৃতির অনুসন্ধানই যেন তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেখানে তার ক্রম নির্মীয়মাণ চিন্তার ভাবগর্ভ নির্যাস ও জটিলতা বেড়ে ওঠে এই ভাবনায়, যে, অপরাধের ঐতিহ্য কখনও বানানো যায় না, তাকে তৈরি করা যায় না, প্রস্তুত করা যায় না। তা শুধু বিবর্তিত হয়। তার অন্তর্গত অবসেশনে গড়া স্মৃতি একটা ‘তৃতীয় পর্যায়’ থেকে অন্য একটা কারুর সাথে অলীক সংলাপ নির্মাণে নিয়োজিত। সংযুক্তি এবং অনিবার্য বিচ্ছিন্নতার মধ্যে প্রবাহিত টেনশনের করোগেটেড সমুদ্রের জলে তার পা। বয়ে আসা ঢেউয়ে পা ডুবিয়ে সে জানে, মানে জানতে পারে, অপরাধহীনতা আর কিছুই নয়, তা উচ্চাভিলাষী প্রতিভার অবসেশন মাত্র। তার রক্তের ভেতরে শোনা সমস্ত স্বর, শব্দ ও ধ্বনির সংকলন হল তার অপরাধ। যা তার সত্ত্বাকে নতুন করে রিক্রিয়েট নয়, রিনকন্সট্রাক্ট করতে চাইছে। যেখানে সে নিজেই ক্রমশ এক অপরাধ সংগ্রহ। ইতিহাসের এমন এক কাঠামো রয়েছে যার নির্মাণভূমি কখনওই সমরূপতা-সম্পন্ন সমজাতীয় নয়। সময় শুধু পূর্ণ হয় বর্তমানের উপস্থিতিতে। সেই প্রত্যেকটি বর্তমানে অন্তত চিরকাল বহ্নুৎসবের জন্য এক অপরাধী একা সমুদ্রতীরে বসে জড়ো করেছে মড়া ডাল, শুকনো পাতা, স্তূপাকার ঝোপ। আর আগুনে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে তার বাতিল পরিকল্পনা।
২
একজন সচেতন শিল্পী যা করেন, অপরাধীও সেটাই। সূত্র রেখে রেখে যান, সর্বত্র না হলেও কোথাও। যাতে ভবিষ্যৎ চাইলে সেই সূত্র ধরে ধরে ইতিহাস নিরীক্ষা করতে পারে। খুঁজে বের করতে পারে তাদের মধ্যে থাকা সংলাপগুলো। এ এক ডায়লগ মেকিং। টীকা ভাষ্য। যেখানে একটা বিষয়ের পিছু পিছু তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক আরও কিছু বিষয়, কথন, ভাষ্য, বিচার, অনুমান, তর্ক, প্রতর্ক, অ্যান্টিসিপেশন এবং কনসিকুয়েন্স থাকে। এবং থাকে বলেই, তাদের নিজেদের মধ্যেও কিছু অন্তর্গত সংলাপ ও দ্বন্দ্বও থাকে। যা চতুর্দিকে ঘিরে থাকা এই দোদুল্যমানতাকে লুজ হতে দেয় না। এবং যখনই এই এতোগুলো জিনিস যুগপৎ মূর্তিমান, তখনই ক্রমশ চ্যাপ্টা হতে থাকা ব্যক্তিমানুষের সঙ্কটাপন্ন সংশয়বহুল দ্বিধাময় দীর্ণ অবস্থাটা ঠাস বুনটে। এবং তখনই ব্যক্তির উচ্চারণ আর ব্যক্তিগত নয়। তা রাজনৈতিক। তা সমষ্টিরও। যেকোনও সমষ্টিগত স্মৃতিহীনতার কালে, অবলিভিয়ন অবস্থার মধ্যে অপরাধগাথাগুলো, যা একেকটা সেলফ পোর্ট্রেট, তা যত ব্যক্তিগত, যত আত্মজৈবনিক, তত সেগুলো পৃথিবী এবং সভ্যতার জলবায়ু ও ভূগোলের চেয়েও প্রাচীন; এবং সামাজিক পালটা। অপরাধী এবং এই জগৎ, এ দুটো যদি দুটো ডাইমেনশন হয়, তাহলে অপরাধ তখন তৃতীয় ডাইমেনশন। এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটাকে এত অনায়াসে ধারণ করে থাকে বলেই অপরাধ জিনিসটাই ইটসেলফ অস্বাভাবিক। অপরাধীর দক্ষতায় তাকে স্বাভাবিক দেখায়। মনে হয় সে নিজের লোক। আসলে নয়। এখানে যারা কষ্ট করে অস্বাভাবিক হতে চায়, সেটা প্রিটেনশন। অপরাধ কিন্তু যা কিছুকে ইন্টিমেট করে, ইনক্লুড করে — ব্যতিক্রমহীনভাবে তাকে অপরাধের প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয়। ইন্টারোগেশনের সূত্রপাত এখানেই। এখান থেকেই শুরু অপরাধের ঝুঁকির জায়গা। একপায়ে নূপুর পরে এক প্রেতিনী প্রায় নিশ্চুপে চলে যায় কুয়োতলা দিয়ে, আমরা টের পাই শুধু এক ছায়া গেল। কে যায়? ওই যে অপরাধ যায়। এরকম একটা ভূতুড়ে কান্ড যে করতে পারে, সে অস্বাভাবিক নয় তো কে? চূড়ান্ত বোকা সেই অপরাধী, যে এই অস্বাভাবিকতা -পটিয়সী দেবীর সাথে অস্বাভাবিক কিছু করতে যাবে। এ যেন সরস্বতীকে লেখাপড়া শেখানোর মতো হাস্যকর। অপরাধ, সীতার মতো আকাশপথে মেদালঙ্কার ফেলতে ফেলতে সূক্ষ্ম থেকে তম যোগে এগোচ্ছে। আর গোয়েন্দা যেন নীচে, মাটিতে হনুমানের মতো সেই মেদ বস্তায় বস্তায় কুড়োতে কুড়োতে চলেছে ঘটনাবহুল বর্ণনা আর বিবৃতিধর্মী স্থূলযোগে।
৩/ক
নিজের জন্মমূহূর্তের কথা ভাবলে মনে হয়, অন্ধকারে একটা মিছিলের ভেতর জন্মেছিলাম, আমি। সন্ধের পর মিছিল শুরু হতেই লোডশেডিং হয়ে যায়। গরমে হাঁসফাঁস করা পুং স্ত্রী শিশু হাতপাখা সান্নিধ্যে বাইরে, রোয়াকে এসে দাঁড়ায়। তখনই অন্ধকারের ভেতর ফুঁড়ে মিছিলটা আসে। এবং অন্ধকার বাজিয়ে চলে যায়। সেই অন্ধকারের ভেতর জন্মাই, আমি। আমার অস্তিত্বের ভেতর শূন্যতার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে বিরাট এক কৃমি। ‘আমি’ এই শূন্যতার উৎস নয়, শূন্যতাই আমার সবরকম অস্তিত্বের এবং অস্তিত্বগুলির মধ্যে থাকা সম্পর্ক ও দ্বন্দ্বের ভিত্তি। সার্ত্র -এর ‘লা নোজে’ উপন্যাসের আঁতোয়ান রকাঁত্যাঁ-র মতো আমার আমির পেছনে লাগাতার লাথ মারছি আমিই। আমার নির্বাচনের বাধ্যতা ও স্বাধীনতাবোধ হল সেই পা যা আমির পেছনে বীভৎস উপগ্রহ চিত্রের মতো লাথ হয়ে উঠেছে। ছোটবেলায় মাঠে খেলতে যেতাম যখন, কেউই চাইত না আমাকে দলে নিতে। খেলতে পারতাম না ভালো। রাবারের বল চলে যেত পায়ের ফাঁক দিয়ে। সবার শেষে নিতান্ত অনিচ্ছায় তার দল আমাকে নিত যার ডাক বাকি থাকত। মনে মনে কল্পনায় কিন্তু প্রতিদিন আমি দারুণ খেলতাম। নিখুঁত ফুটওয়ার্ক। দারুণ একটা ঝাঁপ দিয়ে ক্যাচ লুফে নিতাম কল্পনায়। কল্পনায় বন্ধুরা এসে পিঠ চাপড়ে যেত। যাদের আমি কল্পনায় বন্ধু ভাবতাম। সেরকম খেলা আমার কখনও খেলা হল না।
৩/খ
রিলকেই কি বলেছিল কথাটা? ঠিক মনে নেই, সে-ই শক্তিশালী কবি, যার শৈশব সমৃদ্ধ। মনে পড়ছে না এটা কার কথা, এই মনে না পড়াটা কোটেশন থেকে মুক্তি দিল কথাটাকে, উদ্ধৃতি চিহ্নের কাছে ব্যক্তিসম্পত্তি হয়ে থাকার দায় মুক্ত হল বলেই হয়ে উঠতে পারল আপন। যেভাবে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে না সন কি তারিখ, আবছা দাগ থেকে যায় কেটে যাওয়ার ছড়ে যাওয়ার। সময়ের গায়ে ক্যালেন্ডারের দাগগুলো অনেক মুছে গেলেও, তারিখের ভেতরে যে সময়, আর সময়ের ভেতরে যে আঁচড় রেখে যায় মানুষ, মানুষের মন, মানুষের মনই আবার ফিরে দ্যাখে তাকে, ফিরে শোনে, ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে শোয় মানুষের মন। সকালে উঠে দ্যাখে কতকাল আগের আঁচড় লেগে আছে ঘুমের ভেতর। আমার ছেলেবেলার দিকে ফিরতে থাকলে দেখি চুর্ণি নদীর ধারে একটা গ্রাম। বাড়ির কাছেই রেলস্টেশন। ঘাসের নীচু প্ল্যাটফর্ম। বাড়িতে আম জাম লিচু নারকেল কাঁঠাল খেজুর সুপুরি সেগুন শাল আর কত রকমেরই না ফুলের গাছ। আর ছিল টম্যাটো ক্ষেত আর করলা ক্ষেত মটরশুঁটি ক্ষেত। কিন্তু এই সবুজে আমার মন যত না ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল বাড়ি থেকে বেরিয়েই বাইরে কাদের যেন রাখা লাল কালো পাথর সুড়কির ঢিপিগুলোর ওপর। ছেলেবেলার কল্পনায় ঐ ঢিপিগুলো ছিল আমার পাহাড়। আর কোন খেয়ালে কে জানে মনের ভেতরে বাসা বেঁধেছিল এক বাদামি ঘোড়ার সাধ। মাঘ মাসে খেজুরের গাছে গাছে হাঁড়ি বেঁধে রাখা হত। অতি ভোর ভোর মা ডেকে তুলত। উঠোনে বাটিতে চুমুক দিয়ে আমি খেজুর রস খেতাম। আর সেই রসে আমার মুখের ছায়া পড়ত হালকা। সেই মুখটা দেখতে পাই আমি আমার ছেলেবেলার রঙে। একবারই চেষ্টা করেছিলাম সবুজের কাছে আসতে। আর খুব আঘাত পেয়েছিলাম মনে। স্বপ্নভঙ্গের আঘাত। বিছানার চাদর দিয়ে তাঁবু পেতেছিলাম। একাই। একটা শিউলি গাছের নীচে। আর গাছ থেকে ঝুর ঝুর করে বেয়ে বেয়ে নেমে আসা কালো চুলের মতো শুঁয়োপোকার ঝাঁক আমাকে ছেয়ে ফেলেছিল। আমি দুঃখে পাগল হয়ে গেছিলাম। তবে, শাদা-কালোই আমাকে টানে বেশি। টানে তার বিষণ্ণতার সর মাখা ছায়া। ছোটবেলায় আমার বন্ধুরা যখন সূর্যের রঙ লাল আকাশের রঙ নীল আর গাছের রঙ সবুজ করছে, আমি তখনও পেন্সিল স্কেচই করছি। বাড়ির পাশে বাঁশবাগান পেরুলেই ছিল কুমোরটুলি। প্রতিমায় রঙ করা কোনওদিন দাঁড়িয়ে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। দেখতাম, কী করে মাটি ছানে। খড় আর মাটি মিশিয়ে কাঠের কাঠামোয় মৃন্ময়ী মূর্তির সংস্থাপন। কালো এঁটেল মাটি শুকিয়ে ধূসর হয়ে যেত কিভাবে, সন্ধে নামার আগে যাই যাই করতে থাকা বিকেলের থেমে থাকা আলোয় এক স্কুল ফেরৎ বালক দেখত সেই ধূসর প্রতিমার শরীর। তার টানটান চামড়া শুকিয়ে অল্প অল্প ফেটে গেছে এখানে সেখানে। তার কম্পাস আঁকা গোল স্তন, প্রাক্সন্ধ্যার আলোয় কৃতাঞ্জলি ভরে নিতাম আমি সে স্তনের আলো। প্রকৃতপ্রস্তাবে আমি তখন সেই মানবজন্তু যে তার উৎস মুহূর্তেই এমন কিছু দীপ্তি ও অভিলাস টের পেয়েছিল যা আদিম এবং বন্য।
মানুষ এককেন্দ্রবিশিষ্ট একটি বৃত্ত নয়; সে একটি উপবৃত্ত বিশেষ, যার দুটি কেন্দ্রস্থল।
যার একটি হল বাস্তবতা, আরেকটি ভাবনা।
ভিক্তর উগো, লা মিজারেবল
…বৈশাখের দুপুরে, দুটো কাঠপিঁপড়ে কামড়ায় আমার বাঁ পায়ের চেটোতে। এবং তারা বাসাও বানিয়ে ফ্যালে আমার পায়ে। আমি যেখানে যেখানে যাই, আমার পেছন পেছন কাঠপিঁপড়ের লম্বা লাইন। দীর্ঘ মিছিল। মুখে করে নিয়ে আসছে, মরা আরশোলা, গঙ্গাফড়িং, মশা, চিনির বড়ো দানা, মরা টিকটিকির মাথা। সব ঢুকিয়ে দিচ্ছে, আমার পায়ে। রসদ। এই যে বাইরে আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি পড়ছে, এই বরষায় নবশ্যামের আগমনের কালে, চরম রাতটাকে আমরা কি কেউ কল্পনা করতে পারছি?
…গোয়েন্দামশাই, আপনাকে এখানে বৃষ্টি দেখার জন্য ডেকে আনা হয়নি।
…আমাকে ডেকে আনা হয়েছে এরকম কেন মনে হচ্ছে আপনার?
…গোয়েন্দা চাই বলে কাগজে বিজ্ঞাপনটা তো আমিই দিয়েছিলাম। এবং সেটা একমাত্র আপনার জন্যেই। আপনার হদিশ আমি জানতাম না। কিন্তু আপনাকে আমার চাই। সেজন্যেই আপনি আসার আগে যে ছ’জন আসল গোয়েন্দা এসেছিল আমার কাছে, তাদের বিদায় জানাতে হয়েছে। আমি জানতাম আপনিও আমাকেই খুঁজছিলেন। কিন্তু ঠিকানাটা জানতেন না।
…তাহলে…
…তাহলে একটা গান ধরুন না। মায়ের কাছে আপনার গানের গলার তো অনেক প্রশংসা শুনেছি। ওহ্ হো, আমিও যেমন বোকা, যার নাম শ্যামল মিত্র, তার গলায় তো কোকিলের আলজিভ।
…সৌরভ, তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছি আমি। পাঁচ ছ বছর আগে হলে আমি হয়তো দেখামাত্র তোমাকে খুন করতাম। কিন্তু আজ আমি জানতে চাই, রমলাকে মারলে কেন তুমি? এভাবে?
…সময়, শুধু সময় এসে এই খোলাবাজার লুঠ করে নিয়ে চলে যাবে, অনেকেই তা মেনে নিলেও কেউ কেউ তা মানবে কেন? যে মাতৃস্তন্যে শৈশবে আমার বল্গাহীন অধিকার, শুধু কিছু বছর অতিক্রান্ত বলেই আজ সেই স্তনে আমি হাত রাখলে তা বলাৎকার? আপনি ভাববেন না মিস্টার মিত্র যে আমরা হঠাৎ কোনও বিস্ফোরণে কি ভূমিকম্পে কি বন্যায় ঘুমের মধ্যে পুট করে মরে যাব সবাই। আমরা মরব শোকে। নিদারুণ বেদনায় বিষাদে বিলাপ করতে করতে। আওয়ার স্টোরি উইল এন্ড ওয়ান ডে, নট উইথ আ ব্যাং বাট উইথ আ হুইম্পার।
…আমরা কীভাবে মরব সে কথা ছাড়ো সৌরভ। নিজের কথা ভাবো। কে তোমাকে বাঁচাবে? এই দেশের আইনের হাত থেকে তো তুমি পালিয়ে গেছ যাবেও, পাগলের সার্টিফিকেট দেখিয়ে। কিন্তু আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে তোমাকে?
…নিজের পেছন সামলান ছদ্মবেশী গোয়েন্দা। অনেক বছর আগে, তখন আমি নেহাতই স্কুলছাত্র, আপনাকে একবার পাব্লিক বুথ থেকে ফোন করে বলেছিলাম, বিচি দুটো কেটে কানের দুল বানিয়ে দোব, ভুলে যাননি নিশ্চয়ই?…যাই হোক, মারামারির জন্য সারারাত পড়ে আছে। আপনাকে একটা গান ধরতে বলেছিলাম অনেকক্ষণ আগে। কী সুন্দর বৃষ্টি পড়ছে। বড্ড বেরসিক তো আপনি। মা কী দেখে প্রেমে পড়ল আপনার? তাও আমি থাকতে?
…তুমি তখন থেকে আমাকে আপনি আপনি বলছ কেন? ছেলেবেলায় কি আমাকে আপনিই বলতে?
…বেলা যে গড়িয়ে গেছে মিস্টার মিত্র। আর তুই নয়, তুমি নয়, আপনিই তো আপনের সবচেয়ে কাছের, তাই না?
…তুমি তো আমাকে মারতে চাও। আমি তোমার আপন হলাম কীভাবে!
…আমরা দুজনেই যে একই নারীর প্রেমিক, আমাদের কামনা যে একই বিন্দুতে, এটাই কি যথেষ্ট নয়?
…মিতাকে কেন মারলে তবে? সে তো তোমাকে সত্যিই ভালোবাসতো। বিয়ে করতে চেয়েছিল তোমার মতো একটা উন্মাদকে।
…জানেন, আমাদের বাড়িতে দ্রষ্টব্য জিনিস বোধহয় একটাই। দাদুর চাকরিজীবনের মাঝসকালে কেনা ব্রিটিশ উত্তর যুগের টেলিফোন। ডার্ক ব্ল্যাক। ডাম্বলের মতো ভারী তার রিসিভার। পুরুষ্টু শ্বেতকেন্নোর মতো গোল কুণ্ডলী ডায়াল। যার খাঁজে খাঁজে অনেকটা এখনকার এরিয়াল ব্ল্যাক ফন্টের মতোই ডিজিটগুলো তাকিয়ে আছে। কাঁসার থালা আছড়ে পড়ার মতো ব্যাপ্ত তার আওয়াজ। বাড়ির সবথেকে বয়োজ্যেষ্ঠ এই সভ্যটিকে পূর্ণ মর্যাদায় একটা উঁচু টুল দেয়া হয়েছিল। জালের ঝাঁঝরিকাটা নকশা হেম -সেলাইয়ের ধূসর মাখনের মতো ঢাকনা। মোবাইলে ব্যালেন্স ফুরিয়ে গেলে আমি এটা থেকে ফোন করি এখন। বাইরের কোনও ফোন আর আসে না বলে রিং শোনা যায় না। আমি তাও মাঝেমাঝে ফাঁকা বাড়িতে নিজেই মোবাইল থেকে ওই নাম্বারে ফোন করি। খাটে শুয়ে শুয়ে শার্সি কাঁপানো ডাক শুনি ক্ষুধিত পাষাণের। একদিন মিতাকেও নিয়ে আসি। এখানে। মিতা নিয়ে আসে কামিনী ফুল। কামনার এমন স্ত্রীলিঙ্গ হয়ত বাঙলাতেই আছে। দিনেদুপুরে জানলা বন্ধ করলেও ঘুলঘুলি দিয়ে দিনের কিছুটা এসে ঘরের কৃত্রিম রাতটাকে কিছুটা দিন করে দেয়। এটা আমাদের রবি ঠাকুরের দুপুরবেলার রাতের মতো। একে একে কামিজ, সালোয়ার, ব্রা খুলে মিতা যখন দাঁড়াল, আমার খুব মনে হল অন্ধকারের একটা জোরালো সভ্যতা আছে। ঘাটের শেষ সিঁড়ি থেকে জলে নেমে যাওয়া শরীরের মতো বিছানায় উঠে এল মিতা। আর অন্তত প্রত্যেকবার, তারপরই, সেই ঘটনাটা ঘটে। ভর দুপুরে, ফাঁকা বাড়িতে আমাদের সঙ্গমকালীন হাইরাইজারের ছাদ থেকে আমরা শুনি ফোন বাজছে। উঁচু টুলের ওপর বসে থাকা ডার্ক ব্ল্যাক ফোনের শ্বেতকেন্নোর মতো গোল কুণ্ডলী থেকে যেন খুব জরুরি একটা ফোন বাজছে। আমরা ধরি না। খাট তখন তার চারটে পায়া সমেত মেঝে থেকে অনেকটা উঠে গেছে। আরও দ্রুত গহনবিলাসী সব সিঁড়িগুলো টপকাচ্ছি আমরা। ঝনঝন করে ধাতব আওয়াজে ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। যেন শ খানেক ঝিঁঝিঁপোকার ডাক অ্যাম্পলিফায়ারে বাজল। যেন শান বাঁধানো মেঝেতে আছড়ে পড়ল ভারতীয় কয়েন। আমাদের কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই। ফেরার সময় মিতা যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলছে, ‘ব্রায়ের হুকটা লাগিয়ে দাও না’, আমি তখনও পায়জামাটা পরিনি, ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই নাকে ঝাপটা দিল চুলের গন্ধটা; ও তখন বলছে প্রথম আদরের সময় কোনও প্রেমিক তার প্রেমিকার ঠোঁট নয়, বুক স্পর্শ করে এটা দেখে ও অবাক হয়েছে। আমি ওকে কী করে বোঝাই বলুন তো মিস্টার মিত্র, শিশু কেন প্রথমেই তার মায়ের স্তনে হাত রাখে। একটা বোঁটায় মুখ রেখে দুধ খেতে খেতে আরেকটা স্তন কেন সে আগলে রাখে হাতে। কেন সে ওই দুই পৃথিবীর উপগ্রহ হয়ে ঘুরে যায় সারাটা শিশুকাল। এরপর থেকে যখনই কাছে গেছি ওর, আদর করতে গেছি, ব্রা খুলে সোজা দাঁড়িয়ে যেত সামনে। বলত, ‘নাও, আর কিছু তো করবে না, এ দুটোই চাই তোমার। নাও।’ বলুন তো, এভাবে তো বেশ্যাপাড়ায় হয়। অথচ মেয়েরা নাকি মায়ের জাত।
…আর মায়েরা কি প্রেমিকার জাত, বাঞ্চোৎ?
…শাস ভি তো কভি বহু থি
…যে ছেলেটাকে টেনে গারদে পোরার কথা, এ্যাদ্দিনে যার ফাঁসিতে লটকে যাবার কথা, সে দিব্যি ছ বছর হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে; এখানে ঘরে বসে লেকচার দিচ্ছে।
…কেউ কিস্যু করতে পারবে না আমার, আমি ছাড়া। আচ্ছা, আপনার বাড়িতে একটা মেরুন আর স্কাই ব্লু মেশানো বেডকাভার ছিল না? আছে সেটা এখনও?
…তুমি কখনও আমার বাড়িতে গেছ নাকি?
…বলুন না, আছে ওটা?
…হঠাৎ এ কথা?
…আপনার মনে থাকার কথাও নয়। মায়ের বালিশের নীচে দুটো ছবি পেয়েছিলাম আমি। অনেকদিন আগে। তখন কত বয়েস আমার? এগারো বারো হবে। মা শুয়ে আছে বিছানায়। ওই বেডকাভারটা পাতা। গায়ে একটা সুতোও নেই মায়ের। শ্যামলা শরীর জুড়ে শিশিরের মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখ বোঁজা। কী যে তৃপ্তি লেগে ছিল মায়ের মুখে। সেদিন খুব আদর করেছিলেন, না? কী কী করেছিলেন মনে আছে? কিম্বা অন্য কোনও দিনের আদরের কথা? আমি মিতাকেও খুব জিগ্যেস করতাম, বলো না, তোমার পুরনো বয়ফ্রেন্ডকে তুমি কী কী ভাবে আদর করেছ। এভাবেই শীৎকার করেছ? এরকমই জোরে জোরে? উত্তেজনায় খামচে ধরেছ তার শক্ত টাটানো বাঁড়াটা? তার চুলের মুঠি ধরে মুখ চেপে ধরেছ বুকের মাঝখানে? সে যখন তোমার নীচের খাঁজে জিভ বোলাতো, জিভ দিয়েছে সে কখনও ওখানে? তখন দু পা ফাঁক করে চোখ বুঁজে মুখটা অল্প হাঁ হয়ে ছিল তোমার? তারপর যখন সে মুখ তুলে চাইত হঠাৎ তোমার দিকে, তুমিও তার চোখে চোখ রাখতে কয়েক পলকের জন্য? …কী? অবাক হচ্ছেন?
…শুনছি
…মিস্টার মিত্র, আমরা সবাই নিজেদের পূর্ণ স্বাধীন বলেই ভাবি। আসলে কি জানেন তো, আমাদের সবাইকে বড়োজোর পাঁচরকমের বিষ থেকে যেকোনও একটা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। আর সিস্টেম আমাকে বোঝাচ্ছে এটাই ফ্রিডম। আমিও ফ্রিডম বলতে এটাকেই বুঝছি। আর এই যে বেছে নেওয়ার একটা অপশন সিস্টেম আমাদের দিচ্ছে, সেটাই আমাদের করাপশনে সক্ষম করছে। কিন্তু আমি তো করাপ্টেড নই। সে তো আপনারা। যারা আমের ভেতরে বসে আমটাকেই জগৎ বলছেন। আমি হলাম পাগল। যে সিস্টেমের বাইরে একটা কিছু এগজিস্ট করে বলে ভাবছি। তাই আমি অবাস্তব। অযৌক্তিক। বাস্তবতা এবং যুক্তি শুধু আমের ভেতরেই আছে। তার ভেতরে থাকা পোকা কি আমগাছের পাতা, ডাল, কান্ড, শেকড় সম্পর্কে কোনও ধারণা রাখে? না তার সঙ্গী পোকাদের সেরকম কোনও ধারণা জন্মাতে উস্কানি দেয়?
…আমাকে এসব দার্শনিক কথা শুনিয়ে লাভ নেই সৌরভ। আমার যেটা জানতে কৌতূহল হচ্ছে, তুমি তো জানতে আমি তোমাকে খুঁজছি। এবং পেলে তোমার নিস্তার নেই। তাহলে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে আমার হাতে তোমার ঠিকানা তুলে দিলে কেন? উদ্দেশ্যটা কী তোমার?
…দাঁড়ান, দাঁড়ান, রজনী এখনও বাকি। তার আগে আপনি আমায় বলুন তো, এতোই যদি মায়ের প্রতি প্রেম ছিল আপনার তো বিয়ে করলেন না কেন?
…সেটা আমার নিজের ব্যাপার। তার কৈফিয়ৎ তোমাকে দেব কেন? তোমাকে যেটা জিগ্যেস করলাম তার উত্তর দাও।
…দেখুন মিস্টার মিত্র, মাকে আর মিতাকে আমি কীভাবে মেরেছি তার বাইরের অংশটুকুই আপনি জানেন। যেমন বাকিরা সবাই জানে। কাগজে যা ছেপেছিল। পুলিশ যতটুকু জানতে বুঝতে পেরেছিল, যতটুকু চার্জশিটে লিখেছিল আর যতটুকু সাংবাদিকরা জেনে বুঝে উঠতে পেরেছিল। কিন্তু আপনারা সবাই অডিয়েন্স। প্রেক্ষাগৃহের চেয়ারটুকুই আপনাদের। মঞ্চ নয়। গ্রিনরুম তো নয়ই। তবে আপনি দুঃখ করবেন না। আপনি সৌভাগ্যবান যে এই প্রেক্ষাগৃহের গ্রিনরুমে ঢোকার সুযোগ আপনার হয়েছে। একটু পরে মঞ্চেও উঠবেন। হলেনই বা ছদ্মবেশী গোয়েন্দা। তবু গোয়েন্দা তো। ইতিহাসে কজন গোয়েন্দারই বা এ সুযোগ হয়েছে বলুন? আপনাকে তখন বলছিলাম না, মিতাকে খুব জিগ্যেস করতাম তোমার পুরনো বয়ফ্রেন্ডকে তুমি কী কী ভাবে আদর করেছ? কেন করতাম বলুন তো? ওটা ভেবেই আমি মাস্টারবেট করি। তখন কল্পনায় কিন্তু আমি আদর করছি না মিতাকে। আদর করছে তার ছেড়ে যাওয়া পুরনো প্রেমিক। আর মিতার জায়গায় শুয়ে আছি আমি। আমার ওপরে সে। মিতার বলা আদরগুলো আমি তাকে করছি। আমার মুখ দিয়ে মিতার শীৎকার। ঠিক মিতার মতোই আমি তার চুলের মুঠি ধরে তার মুখ টেনে আনছি আমার বুকে। এখন আপনি আমায় বলবেন, না, শুধু বলবেনই না, সেইভাবে পারফর্ম করবেন যেভাবে আপনার রমলাকে আনন্দ দিয়েছেন। আপনার কাছে আসার এটাই উদ্দেশ্য।
…তুমি পাগল হলেও এবারে তোমার বোঝা উচিত সৌরভ, আমার হাতে ধরা দিয়ে তুমি কিন্তু খুব বিপদে পড়ে গেছ।
…কোনও পদেরই তো হল না জীবনটা, বিপদেরই হোক।
…‘‘বেশ, তুমি নিজেই যখন চাইছ। এতোটাও সদয় হবে, ভাবিনি। যে কারণেই হও’’, বলতে বলতে নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলতে থাকেন; খুলে, ট্রাউজার্স নামিয়ে বাঁ হাত রাখেন আমার ডান ঊরুতে। মাংসের ওপরে অল্প চাপ, যাতে ইঞ্জিনের গীয়ার পরিবর্তনের সহজ তৎপরতা; ‘‘জানো তো, পুরুষের কাম কখনও মরে না। এবিলিটি হয়তো কমে যায়। রিরংসা থাকে।’’
In my time there’ll be no one else
Crime, it’s the way I fly to you
Norihiko Hibino,
Metal Gear Solid 3: Snake Eater
খাতার যে শাদা পৃষ্ঠা তার আগের পাতার লেখার ছাপ নিয়ে বসে থাকে; সে শূন্য, সে ফাঁকা; সে নবীন অথবা রিক্ত; যা তার নয়, কোনওভাবেই যাকে ধারণের অধিকার, ইচ্ছা কোনওটাই তার নেই, পূর্ব পৃষ্ঠার সেই দাগ নিয়ে তাকে বসে থাকতেই হচ্ছে যাকে বলা হয় উত্তরাধিকার। একেও সে নেগেট করে চলে যাবে, যেমন তার শূন্যতাকেও; যখন সে শব্দ দিয়ে মারবে তাকে, রেখা দিয়ে মারবে। ভাষা দিয়ে ভাসাবে তাকে, চিরকাল ছাড়বে। কিন্তু শব্দের ফাঁক থেকে উঁকি কি দেবে না দাগ? যেভাবে পাতার আড়াল থেকে হরিণ। যেভাবে আরও দুর্লঙ্ঘ্য আড়াল থেকে তাকে দেখছে গুলবাঘ। সেই বাঘ তো আমারই ভেতরে, যার সাথে ওই উঁকি দেওয়া দাগের হাইড এ্যান্ড সিক। লুকোনো এবং খুঁজে বের করা। ওই যে, প্রকৃতপ্রস্তাবে আমি তখন সেই মানবজন্তু যে তার উৎস মুহূর্তেই এমন কিছু দীপ্তি ও অভিলাস টের পেয়েছিল যা আদিম এবং বন্য। এই গোটা আমি; মূর্ত -জগৎস্থিত মূর্ত -আত্মসচেতন আমির স্ব – হেতু -সত্তা। শব্দের আড়াল থেকে দাগকে টেনে, লেখার ওপরে আছড়ে ফেলার মতো আমাকেও তাই মায়ের প্রেমিকের ওপর ঝাঁপাতেই হয়। এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক ও মসৃণ গতিশীলতায় যুগপৎ তিনিও আমার ওপর। মানুষ তো বেসিক্যালি হিংস্র প্রজাতির। নেকড়ে, ব্ল্যাক মাম্বা কিংবা হাঙরদের হিংস্রতার জন্য কোনও জাস্টিফিকেশন প্রয়োজন নেই। কিন্তু মানুষ তার নৃশংসতাকে জাস্টিফাই করতে পারে। তাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। কীসের নীচে কী ঢাকা দিতে, একমাত্র মানুষই পারে। এখানে যেমন, কামের নীচে প্রতিশোধ; তার তিরতির আড়ালের পরিপ্রেক্ষণিকায় মানুষই তো দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের চরমতম প্রতিপক্ষ হওয়ার সর্বোচ্চ যোগ্যতা নিয়ে। অফ অল দ্য বিস্টস্ দ্য ম্যান -বিস্ট ইজ দ্য ওয়র্স্ট, টু আদার্স অ্যান্ড হিমসেলফ দ্য ক্রুয়েলেস্ট ফো। খুন না করেও আমি খুন করার প্লেজার নিতে পারি। বাইরে কোনও রক্তের চিহ্নমাত্রও না রেখে আমি মাথার ভেতরে একের পর এক খুন করে যেতে পারি। এবং সেটা সেন্সরবোর্ড, পুলিশ, আইন, রাষ্ট্র, সিসিটিভি সবার আওতার বাইরে। আর শার্টের অন্তিম বোতামের নীচে বিভাজিকার ফাঁক দিয়ে বাইরে আড়ভাঙা উন্মুখ মায়ের প্রেমিকের পীনোন্নত ফণা। ছলনা আর যেখানে থাক, এই জেগে ওঠা তো অখল। একে কে বলবে ভান? খপ্ করে ধরি। জল থেকে মুখ বের করা শুশুকের মতো লাগে তার অগ্রভাগ। আহা, লক্ষ্মীর ভাঁড়ের মতো আড়াআড়ি চেরা এক বিয়োগান্তক চিহ্ন তার মুখে। কিন্তু না হে মায়াবী দণ্ড, এ শুধু কাম নয়, শুধু প্রতিশোধ নয় যে আমার ঈপ্সিত নারীকে একদিন তুমি পাগল করেছিলে বলে আজ তোমাকেও দ্যাখো কেমন বেঁধে ফেললাম আমার দুহাতে; এ নয় ভ্যঈয়্যারিজমের কোনও অন্য পাঠ যে মায়ের প্রেমিকের সাথে শুয়ে তাদের দুজনের আদরে নেহাৎ সিঁদেল চোর হব আমি। নাহ। বরং দ্যাখো, তোমার প্রেমিকার হন্তারক আমি, তার সামনেও তোমার অশ্রু নয়, বরং শুক্র সমাগত। ক্রোধে ঋজু নয় কন্ঠ, বরং পুরুষাঙ্গ। প্রতিশোধে হিসহিস নয় স্বর, বরং কামে। কিন্তু এতে কোনও বিজয় নেই আমার। তোমার দাঁত নখ জিভ এখনও রিরংসায় তীক্ষ্ণ। হননেচ্ছায় নয়। তোমার সামনে হন্তব্য পড়ে, তুমি চিনতে পারছ না। তোমার হাতের কাছেই আদিমতম অস্ত্র, মানবিক হিংস্রতায় তুমি তুলে নিচ্ছ না চরমতম প্রতিপক্ষকে চিনে নিয়ে। বরং আহ, ওহ, আমার কোমরের দু পাশে দু হাত রেখে কোথায় উড়িয়ে দিয়েছ তোমার প্রৌঢ়ত্বের জং। আমার ধরা দেওয়ার কারণ তোমাকে যদি বলতে পারতাম, কখনও বলে ফেললেও সত্যিই যদি কোনও উপায়ে বোঝাতে পারতাম তোমাকে। জঙ্গলে, কিয়ৎ ঝোপ ও ফাঁকায়, যেভাবে হা হা করে পড়ে থাকে নেকড়ের শিকার; উদোম; যেন কোনও জন্মেই তার জন্ম ছিল না, মৃত্যু বলেও কিছু নেই তার, এখন; যে পূর্ণ সমর্পিত তোমার শুধু তোমার ক্ষমাহীন ক্ষুধার কাছে; এই চাঁদের আলোর নীচে তার পঞ্জরাস্থি হাট খোলা, তাতে কুলকুল করে এসে ঢুকছে শেষরাতের পূর্ণিমার আলো; সেই তো আমার ভালো। ‘রমলাকে, কতবার বলেছি’, হাঁপাতে হাঁপাতে শ্যামল বলতে থাকে, ‘একবার, পেছন থেকে করতে দাও, কিছুতেই রাজি হয়নি।’ খাড়া লিঙ্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যামলকে দেখে মনে হয়, শাখাহীন এক কান্ডের বৃক্ষ থেকে তুলনায় ছোট, কিন্তু স্থূল ও আবলুশ একমাত্র ডাল তেরছা বেরিয়ে রয়েছে। ডালের গোড়ায় পাখির বাসার মতো জট পাকিয়ে জড়ো হওয়া কাচা পাকা লোম। আমি প্রণামের ভঙ্গিতে উপুড় হয়ে থাকি, যখন শ্যামল তার কান্ড থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা ভল্ল গেঁথে দিচ্ছে আমার পায়ুগিরিখাতে। আমাদের সামনে কোনও আয়না নেই, থাকলে দেখতাম আয়না নির্মাণ করে মানুষ নিজেকে দেখার এক অভিসন্ধিই রচনা করেছে। যেন পাহাড়কে জানার জন্য এসেছে সুড়ঙ্গের কাছে। প্রকৃতপ্রস্তাবে, সে তো রাতের উদ্ভূত সন্তান। অথচ শুধু সকালের অপেক্ষায় থাকার কী এক বালখিল্য ভান তার। তবু, চরমরাতের দিকেই তার চিরকালীন যাত্রা। আর যে ফেরায় তাকে ফেরাক, রাত্রি তাকে ফেরাবে না। মানুষের আদিমতম কামনাতেই রয়েছে তার আদিমতম শ্রম, স্বেদ। যাকে সে কোনওদিনও পাবে না সেদিকেই তার নাছোড় অভিমুখ আর যেদিকে তাকে যেতেই হবে সেদিকে সে ফিরেও চাইবে না; এই বস্তুমূলক দ্বন্দ্ববাদে আমি ও শ্যামল পুনঃগ্রেপ্তার হই, প্রায় ঝুলে থাকি ছাদ থেকে; জলের নীচে সবুজ শ্যাওলার মতো বমি ঢেকে দেয় আমাদের বৃক্ক, নেফ্রন, যকৃৎ, ফুসফুস ও পিত্তথলি। হৃদয় পর্যন্ত ডোবা সেই বমির ওপরে যখন আমি উঠে দাঁড়ালাম, আমার পশ্চাৎদেশ তখন মায়ের প্রেমিকের বীর্যে ভেজা। আরও কিছু বীর্য সবুজ বমিতে ছ্যাঁৎলা পড়া ছত্রাকের মতো থকথকে, ভাসছে। শ্যামলও উঠে দাঁড়িয়েছে, বৃষস্কন্ধ। তার ডানহাতের মুঠিতে লৌহকীলকের মতো চেপে ধরা নিজের লিঙ্গ। এহেন বিষাদজনিত প্রতিহিংসার ছবি মানবসভ্যতায় চিরকাল বারদুয়েক। গাঢ় বমির নীচে ডুবে থাকা পায়ে যেন তার শেকল বাঁধা আছে; দু পায়ে তা ঠেলে ঠেলে এগিয়ে আসে আমার দিকে; বাঁ হাতে আমার ঘাড়ে আলতো চাপ দেয়, আমি হাঁটু ভেঙে বসে পড়ি আর তার লিঙ্গ প্রকান্ড এক চাবির মতো ঢুকে যায় আমার মুখে। বোধহয় মৃত্যুর হাত থেকে পালাবার সময়েই মানুষ জীবনের শেষ দরজা খুলতে এভাবে চাবি ঘোরায় অন্ধকারে, তালার ভেতরে এবং আপ্রাণ। আর কে না জানে তালা যদি না
খোলে, মানুষ তালা ভেঙে ফ্যালে। একমাত্র আমরা দুজনেই জানি, যতক্ষণ এই যৌনশ্রম, ততদূর আয়ুরেখা আমাদের। যত নিকটবর্তী এই যৌনতার অন্তিম পর্ব, ততো দ্রুততায় নিকট হচ্ছে আমাদের অশ্রুধারা। ‘যে বিচি দুটো কেটে কানের দুল বানিয়ে দিবি বলেছিলি’, বাঁ হাতের মুঠিতে আমার চুল ধরে শ্যামল বলে, ‘চোষ শালা সেই বিচি দুটো। চোষ।’ কামনায়, শোকে, ক্রোধে, প্রতিশোধে ব্যাকরণের বাইরে এমন এক জটিল রিপুর উৎস হয়ে যায় শ্যামলের স্বরযন্ত্র, আমি তাকে চেনার খুব কাছে গিয়েও চিনি না। একবার, মুখ তুলে ওর চোখের দিকে তাকাই, মাকড়শার জালে আটকে পড়া পোকা যেভাবে তার নিয়তিকে দ্যাখে। কাফকার মেটামরফোসিস নিয়ে একটা নাটকের পরিকল্পনা আমার অনেকদিনের। মাকে বলা হয়নি কখনও। মিতাকেও না। এখন, এই অবস্থায় শ্যামলকে বলি সেটা? আমার ঠোঁটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ওর উত্থিত লিঙ্গকে বলি? যেখানে গ্রেগর স্যামসাকে কোনও পোকার মেকাপ বা পোশাক দেওয়া হবে না। মঞ্চে তাকে দেখতে একেবারে মানুষেরই মতো। শুধু সে মনে মনে ভাবছে যে সে পোকা হয়ে গেছে। তার আচরণ, চলাফেরা একটা পোকার মতো। তার স্ট্রাগল একটা পোকামানুষের স্ট্রাগল। কাফকার গল্পের মতো এখানে এক সকালে গ্রেগর ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ করে নিজেকে পোকামানুষ দেখবে না। এখানে প্রত্যেক দিন সে একটু একটু করে পোকা হয়ে যাচ্ছে, একটু একটু করে রোজ ঘাড়, পিঠ, সিনা ঝুঁকে মাটিতে আসছে তার। তার চিন্তা ভাবনাগুলো ক্রমশ মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর হাত থেকে চলে যাচ্ছে গন্ধ আর শরীরের রাসায়নিকগুলোর হাতে। একটু একটু করে রোজ সে হাতের ব্যবহার ভুলে যাচ্ছে। রোজ সে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে কামিনী ফুলের গন্ধ, ঘামের গন্ধ, পুরনো বইয়ের লাল পাতার গন্ধ, ফুটন্ত ভাতের গন্ধ, জ্বাল দেয়া দুধের গন্ধ থেকে দূরে। রোজ একটু একটু করে তার মাথায় এসে আছড়ে পড়ছে সিলিং-এর খাঁজে থাকা টিকটিকিগুলোর গন্ধ, ঘুলঘুলির জালে প্রসবিনী মাকড়শাটার গন্ধ, ট্রাঙ্কের পেছনে ইঁদুরের গন্ধ। তার বাড়ির সবাই তাকে দেখছে, দর্শক দেখছে, দেখেই যাচ্ছে। কিছুই করার নেই। পলক ফেলার আগে অবধি দেখতে পাই আমার থেমে থাকা চোখের দিকে শ্যামলও দেখছে। অজানা রোগের মতো সে চোখ আমাকে মুড়ে ফ্যালে। শুধু যে মুহূর্তে তার বাঁ হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের মাঝের অর্ধচাঁদ আমার কন্ঠনালীতে চেপে বসল, মনে হল, মানুষের পিঠের যে জায়গাটায় ডানা নেই, থাকলে ভালো হত, কিন্তু তার নিয়তির মধ্যেই হয়তো এমন কিছু ছিল বা/এবং আছে যা তার ডানাকে নয়, হাতকে লম্বা করল। অপরাধ সেই ডানা হতে পারে। যে আমি জঙ্গলে, কিয়ৎ ঝোপ ও ফাঁকায়, চাঁদের আলোর নীচে হা হা করে উদোম পড়ে থাকতে চেয়েছিলাম নেকড়ের শিকার হয়ে, সে আমি এখন মুরগীর মতো কক্ কক্ করছি শেয়ালের হাতে। শাদা শাদা পালক উড়ে উড়ে পড়ছে ঘরে। রোজ রাতে এইভাবে মুরগী ধরতে ধরতে শেয়ালেরা নেকড়ে হয়ে যায়। মুরগী উড়তে পারে না। বাঁ হাতে টুঁটি চেপে শ্যামল বিজয়পতাকার মতো যতো তুলে ধরছে আমাকে, আমি দু হাত শূন্যে সাঁতরে এই শূন্যতাকে প্রতিকূল করতে করতে ততোই ভাবছি নিজেকে অভ্যস্ত করছি শূন্যে। তলপেটে তখনই মোক্ষম লাথটা মেরে শ্যামল বলে, ‘রমলাকে এভাবেই মেরেছিলি না রে?’ গোলপোস্টের ভেতরে ছিটকে যাওয়া কিপারের মতো ভেসে থাকা অবস্থায় শুনি, ‘ওর পেটে আমার বাচ্চা ছিল রে শুয়ার।’ প্রতিটি যুদ্ধের শেষে স্ত্রীপর্ব আবশ্যিক। যেখানে শ্মশানশূন্য নিস্তব্ধতা বিলাপে হাহাকারে বেত্রাঘাত করে সব অশান্তকে। যেখানে দৃষ্টি যতদূর যায়, পরাক্রান্ত কিন্তু নির্বাপিত যুদ্ধের প্রতত দলন পাঁজর খুলে থাকে। গোপনীয়তা এক কারাগার, তার মতো একাকী নিঃসঙ্গ আর কে করতে পেরেছে মানুষকে। জেল থেকে বেরিয়ে মানুষ যেমন নির্ভার, শূন্য, অননুমেয় হতাশ; ধূর্ত শেয়াল থেকে প্রতিহিংসাপরায়ণ নেকড়ে হয়েও শ্যামল সেই হতাশ মানুষে এসে পৌঁছয় কয়েদ করে রাখা গোপনীয়তার হঠাৎ মুক্তিতে; প্রহরী আর কয়েদীতে ফারাক এটুকুই, একজন ঘরের ভেতরে, আরেকজন বাইরের ভেতরে। জেলখানায় তো দুজনেই। সেই প্রহরীর হাত ছেড়ে কয়েদী ছুটে গেলে যে আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তা তার দিকে অনিমিখে চেয়ে থাকে, সেই দৃষ্টি এড়াতে শ্যামলও পারে না। পিছিয়ে, দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়ে। উলটো দিকের দেয়ালে, আমি। মাঝের এই নামমাত্র শূন্যতা মহাশূন্যের ব্যাদানের কাছেও বপুষ্মান। যেন, এই মাঝখানটায়, এই মুহূর্তে, কোনও মাধ্যাকর্ষণ সূত্রাদি কাজ করছে না। বিনবিনে এক কান্না শুধু পালকের মতো, ভবঘুরে হয়ে ঘুরছে, শেকলের মতো ভারী। তাকে টেনে চলার ভার বইতে হচ্ছে ঠায় বসে। বসে বসে পেরোতে হচ্ছে ক্রোশ ক্রোশ পথ। এই ক্লান্ত, দুর্বলতম সময়েই শ্যামলকে আক্রমণ করা যায়, চলন্ত টেবিল ফ্যানটা রথের চাকার মতো চেপে ধরা যায় তার মুখে, মুখের চামড়া মাংস হাড় থেঁৎলে পিষে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় ওই তিনটে ব্লেড; এই সেই সময়; কিন্তু জীবন তারপরে পরিত্যক্ত, নিঃসঙ্গ। তাই প্রতিদ্বন্দ্বীকে চিরকাল নতজানু দেখার মোহও মানুষেরই এলাকায়। প্রতিশোধের এই সেই কেন্দ্রস্থল, যেখানে স্থিতিস্থাপক অচঞ্চল স্পৃহা চোখে চোখ রাখে, পলক ফেলার আবেদনপত্রে যার সই পাওয়া যায় না। জালে বাঁধা পতঙ্গকে তো মাকড়শা খেয়ে ফ্যালে, নিঃসঙ্গতার অর্থ তার কাছে বহমান নয়। মানুষ উপায় বের করেছে অন্য।
অগাস্ট, ২০১৭