“সৌন্দর্য সম্পর্কে বিশুদ্ধ ভাববাদ এই কথা বলে যে, সৌন্দর্য বস্তুতে নেই, চেতনার রঙেই সবকিছু রঙিন হয়ে ওঠে এবং এই দৃষ্টিতেই কবি বলতে পারছেন “গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম সুন্দর/সুন্দর হোল সে” এর উল্টো পিঠের কথা হোল সৌন্দর্য বস্তুর বিশেষ কোন গুণ বা বৈশিষ্টের উপর নির্ভর করে। সৌন্দর্য রসিকের উপর নয়। প্রথমটিকে আমরা বলি ভাববাদ। দ্বিতীয়টিকে বলি বস্তুবাদ”— প্লেটো ও এরিস্টটল, হিরেন চট্টোপাধ্যায়।
এই যে সুন্দর, আপাত নিরীক্ষিত সৌন্দর্য, তা মূলত তিনটি উপাদানে (এরিস্টটল) গঠিত। সঠিক পারস্পর্য, সামঞ্জস্য এবং স্পষ্টতা। আমি তৃতীয় উপাদানটা নিয়েই কিছু বলতে চাইছি। এবং কিছুটা ঘুরিয়ে। তা অবশ্য আমার মতোই। সুন্দর বা সৌন্দর্য রচনার উপাদানগুলো যখন দর্শকের সাথে কম্যুনিকেট করতে পারে, ঠিক তখনই আমরা তাকে স্পষ্ট বলতে পারি। সে কবিতা বা যে কোন শিল্পকর্মই হোক না কেন- তা রচনার সূত্রাবলিকে কিছুটা হলেও পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা জরুরী বলে আমি মনে করি। মনে করি যে, সৌন্দর্যের অন্তর্লোকে যে প্রাণের প্রবাহ, সেই অমিয়ধারার কিছু কিছু ছিটেফোঁটা পাঠক বা রসগ্রহীতার প্রাপ্য। “কবির কাজ নয় কবিত্বপূর্ণ পরিস্তিতে অবস্থান; সেটা নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপার। তার দায়িত্ব, সেটা অন্যদের জন্য নির্মাণ করা। পাঠককে তিনি কীভাবে ‘অনুপ্রাণিতে’ রূপান্তরিত করতে পারছেন, তারই উপরে কবির পরিচয় নির্ভর করে”— পল ভালেরি।
“মানুষের ফেলে দেয়া প্রেমের জাজিমে বৃষ্টি পড়ছে”
(আধা বাস্তবের কবুতর)
মেসবা আলম অর্ঘ্যের কবিতা পড়ছিলাম। এবার আসলো তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ। কবিতা যদি মানবচরিত্র এবং দৃশ্যত ঘটনাবলীর মধ্যে যে সামগ্রিক সত্য তার প্রচ্ছন্ন প্রকাশই হয়ে থাকে (এরিস্টটল) তবে উপর্যুক্ত লাইনটির শিল্পমূল্য পাঠক বিচার করুণ।
“রাত দেড়টায়
লিখতে গিয়ে আমার এক-পেয়ে স্টুল মেঝেতে পড়ে গেল
সুন্দর শব্দ হলো—
পাশের ফ্লাটের মিষ্টি মেয়েটা নালিশ করেছে গতকাল”
(রাত দেড়টায়)
এইরকম সোজাসাপ্টা অনুভূতির চিত্রণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো বইয়ে। যে গল্প এইভাবে শুরু হয়েছে তার সমাপ্তিটাও ঘটেছে আশ্চর্য সরলভাবেঃ
“আমি খুব সম্ভব
রাত দেড়টায়
না লিখলেও
অসুবিধা নাই- যতক্ষণ পর্যন্ত শব্দ হচ্ছে”
আসলে নতুন শব্দের সৃষ্টি নয়, পুরনো শব্দের দ্বারা নতুন রূপের সৃষ্টি করতে চেয়েছেন অর্ঘ্য। আমাদের দৈনন্দিন ঘটনাবলির টুকরো-টাকরা উঠে এসেছে তার কবিতায়। পুরো বইয়ে হয়তো এই সত্য খাটে। কাব্য যদি জীবনের অনুকরণ হয়, তবে এই অনুকরণে অর্ঘ্য এক ধ্যানী, দৈনন্দিন ভাষাকে অলঙ্কার সহযোগে নবায়িত করে, মিথ্যা ভাবাবেগ বর্জন করে এক মহৎ সৃষ্টির উপযোগী বাক্য প্রতিমা তৈরি করেছেন। আমাদের প্রতিফলিত জগতের যে রূপ, তারই সন্ধান করে চলেছেন তিনি।
“রবিবার রোদ থাকায়
বারান্দায় রবিবার
আমারা পুরুষ ভাড়াইট্টারা মদ খাই
আলাপ করি- পৃথিবীটা কেন সরল হলো না”
(রবিবার রোদ থাকায়)
এই আলাপটা ধরে কিছুদূর এগোলেই একটা সুরের আভাস টের পাওয়া যায়ঃ
“মরে যাওয়া কোন খুলিতে
সেই সুর এসেছিলো”
(ঝিলমিল)
এ রকম গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য। সুন্দরের একটি সর্বজনগ্রাহ্য রূপ এই কবি ধরতে পেরেছেন। তার কবিতায় গল্পগুলো আমাদের বাস্তব মনে হচ্ছে। আমরা যেন তার কবিতার “অ্যাশ ট্রে” ভাঙার শব্দটি পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছি।
“মধ্যে মধ্যে স্বচ্ছ লহরী
মধ্যে মধ্যে সব তারা ঢেকে গিয়ে বৃষ্টি নেমেছে
কারো কেউ মারা গেছে”
(ফর এলিস)
সকলের কাছে জীবন ও জগতের এই আশ্চর্য, সরল প্রকৃত ধরা পড়ে না। অর্ঘ্য ধরতে পেরেছেন। এক আশ্চর্য মমতায় এঁকেছেন যে চড়ুই দুপুরবেলা ডাকে। শহর ভরা মানুষ। আর এক স্তূপ বইয়ের ভেতর ভাঁজ হয়ে বসে থাকা ন্যাতানো কাগজটিকে।
“মেলাংকলিয়া হলো অর্থ
জ্বরের ভিতর আইসক্রিম খাও
আরেকটু মদ বেশি খাও”
(মেলাংকলিয়া)
“শিল্প এমন একটি জিনিশ, যাতে madness থাকলেও একটি method of madness আছে” –নন্দনতত্ত্ব; সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। এই madness অর্ঘ্যের কবিতার রন্ধ্রে মিশে আছে।
“কাশো
বমি করো
কিছুক্ষণ ঘুমোও
উঠে আবার লেখো”
(ঐ)
আরো উদাহারণ দেওয়া যাবে। ‘শহরে একটি গাছ’, ‘পিরামিড’ ইত্যাদি কবিতাগুলো।
‘জাদুঘরে মমি’ কবিতায় এক পুরনো মস্তকের গল্প অথবা ‘নিমরুদের বাঘ’ কবিতায় সেই বিশ্বাসহীন বাঘের গল্প আমাদের সত্যি মনে হয়। আমরা অর্ঘ্যের এই আপাত তন্ময় কবিতার সড়কে হুট করে ঢুকে পড়তে পারি। তার কবিতায়, ‘চিপা গলির’ যে বাতাস ঘুরছে, আমরা তার কম্পন টের পাই যেন। টের পাই ছেঁড়া কার্পেটের নিচে গোপন দাগগুলো পর্যন্ত।
“আমার বারান্দা
একটা জীবিত গাছের পাপড়ি
তুমি ওদের সাথে বেশিদিন থাকতে পারবেনা”
(মরাল)
জীবনের জটিলতা বাড়লে উপলব্ধির সারল্য আর থাকেনা। প্রকাশের সারল্যও তখন তিরোহিত হয়। এই সত্য অর্ঘ্যের কবিতায় খাটেনা।
“বেনামি চিঠি খুলে পড়লে খুব পাপ হবে কি?”
(কোথাও ক্ষত চিহ্ন নেই)
এই জিজ্ঞাস্য-
বা ‘চৌদ্দই ডিসেম্বর’ কবিতায় প্রেমের গল্প ফাঁদা, প্রথাগতভাবে এই যে দ্যাখার প্রচেষ্টা, তা ভিন্ন। এই ভাঙচুড়, চিন্তার বিবর্তন, ক্ষুদ্রের সাথে বৃহতের, একের সাথে বহুর যোগসূত্র রচনা করেছে। কল্পনায় যা সহজ ও সুলভ তার উপর নির্ভর করে এক দুরূহ ও দুর্লভের দিকে যাত্রা করেছে তার কবিতা।
“সুন্দরের সাধনায় কবিকে তিনটি স্তর পার হতে হয়। প্রথমত সৌন্দর্যের আভাসটি উপলব্ধি করা। দ্বিতীয় পর্যায়ে তাকে ধ্যানের বস্তুতে পরিণত কোরে অভিজ্ঞতার পর্যায়ে নিয়ে আসা এবং শেষতক তাকে form এ বিন্যস্ত করা”— নন্দনতত্ত্ব; সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। তবে অর্ঘ্য এই পরমের সন্ধান করেছেন ‘সেন্ট্রাল রোডের তীর্থযাত্রায়’। মাথার ভেতর অন্ধকার নিয়ে। একটা ধুলোয় মোড়া আমগাছের মতোই মানুষের উল্টোদিকে যেতে যেতে। তার কাব্যকীর্তির অভ্যন্তরে যে রহস্যের আভাস খেলা করে, তার সবটুকুই তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন।
“যে শব্দরাজি কোন কিছু প্রকাশ করেনা তা ভাষা নয়” (ক্রোচ)।
অর্ঘ্যের কবিতায় রংগুলো তার প্রকাশময়তাকে যতোটা সম্ভব সফল করেছে।
তবুঃ
“গাছগুলি রুপার খোলস পরেছে বরফ পাতের পর”
(খসড়া)
বা,
“তোমার জানালা দিয়ে
মাথা বার করে অপেক্ষা করতে চাই- কখন আসবে সেই অপ্রত্যাশিত বাঁক?”
এই নির্মাণের সতর্কতা ভেঙে যেতে দেখি কোথাও কোথাও। ‘ডিমপোচ’ বা ‘ফৃ স্কুলে ভোরবেলা’ ইত্যাদি কবিতাগুলোকে সরলতার দোষে দুষ্ট করা যায়। যদিও কবিতার লাইন সরল হওয়াটা অন্যায় নয়, তবে তাকে জাগতিক সীমা অতিক্রম করে অনন্ত লোকের দিকে যাওয়ার পথে যে রসের সৃষ্টি করতে হয়, তা এরা করতে পারছে না। ‘খসড়া’-র অল্প কিছু কবিতার মধ্যেও এই ভাব প্রবল। লৌকিক ঘরকন্নার জগত পর্যন্তই তাদের অস্তিত্ব। যথার্থ ভাব তারা জাগিয়ে তুলতে পারছেনা। বা পারলেও তারা আনন্দদানে ব্যর্থ হচ্ছে।
লেখক:
অনুপম মণ্ডল
কবি