মোসআব আবু তোহা
মোসআব আবু তোহা গাজার একজন ফিলিস্তিনি কবি, ছোটগল্প লেখক, প্রবন্ধকার ও লাইব্রেরিয়ান। থিংস ইউ মে ফান্ড হিডেন ইন মাই ইয়ার: পোয়েমস ফ্রম গাজা (২০২২, সিটি লাইটস) এর লেখক। বইটা ২০২২ সালের প্যালেস্টাইন বুক অ্যাওয়ার্ড, আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড এবং ডেরেক ওয়ালকট কবিতা পুরস্কার জিতছে। আবু তোহা হইলেন গাজায় এডওয়ার্ড সাঈদ লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা।বর্তমান সময়ে আমেরিকায় একজন ডায়াসপোরা প্যালেস্টাইন কবি হিসেবে জনপ্রিয়তা পাইছেন। ৭ অক্টোবরের পর গাজায় ইসরায়েলি বর্বর আক্রমণের ভিতর উনি রাফা ক্রসিং-এর কাছে আইডিএফ তারে আটক করে, যদিও পরে ছাড়া পায়। তাঁর কবিতায় ফিলিস্তিনি মানুষের আত্মার ক্রন্দন, বাঁচার চির আকাঙ্ক্ষা, প্রতিদিন গৃহহীন হবার গল্প উঠি আসে। এককথায় ফিলিস্তিনের ভূমি ও মানুষের প্রতিনিধিত্ব করি চলতেছে তাঁর কবিতার ভাষা, কল্পনা, ইমেজ, পুরা কাব্যবীজ।
গাজায় বর্তমানে যে বর্বর গণহত্যা চলতেছে তার বিরুদ্ধে সে লিখি চলছেন একের পর এক কবিতা। ব্যক্তিগত ভাবে তার ফেইসবুক ফলোয়ার আমি। গাজার প্রতিদিনের রক্তমাখা ইসরাইলের নারকীয় গণহত্যার চিত্র, হতভাগ্য মানুষের আশ্রয়, গাজার মানুষের ঘরভাঙার দৃশ্য, দুর্ভিক্ষ ও আশা-আশংকার হালনাগাদ খবর রাখি তার ফেবুর পাতা থাকি। গাজার প্রতিদিনের ডাইরি যেন সে লিখি চলতেছে। আল জাজিরা ছাড়া বিশ্বমিডিয়া যখন গাজার থাকি মুখ ফিরাই নিছে তাজা ও বিশ্বাসযোগ্য খবরের জন্য মোসআবের পাতায় আমার ভরসা। তার কবিতায় ফুল-পাখি-শিশির যেন সদাই ফিলিস্তিনি মানুষের রক্তে ভিজা। ফিলিস্তিন সভ্যতার মুখোশ টানি ছিড়ি ফেলছে। মানবিকতার ফাকা আওয়াজ আজ দস্যুতার কাছে পরাজিত। ইউরোপ-আমেরিকার সেটেলার কলোনিয়াল প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে গিয়া ইসরায়েল, আমেরিকা ও ইউরোপ মিলি ফিলিস্তিনিদেরকে হিউম্যান এনিম্যাল সাজায়ে গণহত্যা ও এথনিক ক্লিনজিং এর মতো পথ বাছি লওয়ায় আজ তাদের নৈতিকভাবে ও যুদ্ধক্ষেত্রেও পরাজয় আমরা দেখতেছি। জায়োনিস্টরা আজ সারা পৃথিবীর কাছে নিজেই এনিম্যাল তথা ঘৃণ্য দানব রূপে আত্মপরিচয় দাড় করাইছে। পৃথিবীর কাছে তারা নিজেরা আজ পশু ছাড়া কোনোভাবেই মানুষ রইল না!
মোসআব আবু তোহার পঁচিশটা কবিতা অনুবাদ এইখানে পাঠকের জন্য বাঙলায় নিবেদিত হইল। নিশ্চিত আমি, পাঠক, দেখবেন তাঁর প্রতিটি কবিতা যেন ফিলিস্তিনের গাজা জীবনের আয়না।
মোসআব আবু তোহা’র ২৫ কবিতা
যুদ্ধের সময়: তুমি ও তোমার বাড়ি
যুদ্ধ কর।
তুমি মর।
তুমি কখনই জানবা না কে জিতছে বা হারছে,
বা যুদ্ধ কভু শেষ হইছে কি না।
তোমারে গোবর দেয়ার মতো
কোনো জায়গা তারা পায় নাই।
তারা তাদেরে কান্ধের পর তোমারে বহন করতেছ
এপাড়া ও পাড়া ঘুরতেছে,
তোমার ছোটকালের স্কুলের সামানেও তারা একটু থামে
তারা পুরানা পার্কের কাছে থামছিল।
বাড়িগুলি তোমারে কভু দেখল না।
তারা ত্বরাই তাদের ব্যাগট্যাগ ঘুছাই লয়।
বাড়ির এক কোনায় তাবুর মতো উচা জমছে ময়লা।
জ্বরাজীর্ণ কাপড়ে জমছে মরিচা ট্যাপের গায়
চামচগুলায়।
কাপড়গুলা স্লাইডে পানি চুপেচাপে চুষি নেয়
যখন তুমি,
তুমি সরি যাওয়া বালির পর ঘুমায় আছো।
কঠিন ব্যায়াম
গাজাতে
শ্বাস নেয়া একটা কাজ,
হাসা হইতেছে
কারও মুখে করা প্লাস্টিক সার্জারি
আর বিহান বেলা ঘুম থাকি উঠা
মানে
আরেকটা দিন টিকে থাকার চেষ্টা
মৃতের জাগি উঠার ঘটনা।
তোমার স্বপ্নরে মনে করার চেষ্টা কর
চোখ বুজো
আর
হাঁটা দাও দরিয়ার দিকে
তোমার দু’হাত
পানিতে চুবাও
আর
ধরার চেষ্টা কর কবিতার শব্দ
তারপর সেই শব্দে লিখ
মেঘের উপর
চিন্তা কইরো না, তারা ঠিকই
খুজি নিবে তাদের ভূমি
চোখ খুলো।
রাতের বেলা
দরিয়া আর তেমন নীল নও।
তাকাও চারদিকে আর উপর
হইতে পড়া বৃষ্টি ফোটা
ধর, ঐটাই তোমার কবিতার
বিরামচিহ্ন।
তোমার সাতারের কাপড়-চোপড় পরো
অনেক গভীরে ডুব দাও
তোমার মহাকাব্যের
একটা শিরোনাম খুঁজি পাওয়ার জন্য।
খুঁজি লও
তোমার নতুন স্বদেশ
তোমার নৌকা।
বিছানায় যাও
আর তোমার ঘুমের মধ্যে
তোমার স্বপ্নরে মনে করার
চেষ্টা কর।
বাস্তুচ্যুত
(এডওয়ার্ড সাঈদের স্মৃতির লাগি)
আমি না আছি ভিতরে না বাইরে।
আমি ঠিক এই দুইয়ের ভিতরে।
আমি কোনো কিছুরই অংশ ন।
আমি কিছুর একটা ছায়ামাত্র।
বড় জোর
আমি একটা বস্তু
যে আসলে
অবস্থান নেয় না।
আমি ভারহীন
গাজায় আমি এক
লহমার ফুটকি
কিন্তু আমি রইবো
যেইখানে আমি আছি।
জেনিনে সংবাদিক
(শিরিন আবু আখলেহ এর স্মৃতির উদ্দেশ্যে)
তার হাতে যে জিনিসটা তা গোটানো ছাতা ন:
ঐটা হইতেছে মাইক্রোফোন
যা দিয়া পাখির ডাক, বাতাসের সুর, গুলির শব্দ
যুদ্ধের উড়াজাহাজ আর
মায়েদের কান্দন
রেকর্ড করা হয়।
যে নোট বইটা তার প্যান্টের পকেটতে পড়ি গেছিল
তার নিজের না কুকুরের লাগি
কোনো শপিংলিস্ট ছিল না:
ঐটার মধ্যে যেসব লোকজন রিফিউজি ক্যাম্প
ভিজিট বা সাক্ষাৎকার নিতে আসবেন তাদের
ঠিকানা লিখা ছিল।
যে গাছটা নিচে তার দেহ কয়েক মিনিটের জন্য রাখা হইছে:
ঐ গাছটা তারে বৃষ্টি বা তুষার থাকি
রক্ষা করতেছে না
তার কানের কাছে যে ফাকাটা ঠিক হেলমেটের নিচে
তার কোনো কানপাশার জন্য না:
এইটা যেই জায়গা যেহান থাকি রক্ত
গড়াই পড়ছিল শিশির ভিজা মাটিতে,
গাছগুলারে পানি ঢালছিল।
সেইখান হইতে তার আত্মা ক্যাম্পরে
মেঘাচ্ছন্ন করি ফেলছিল,
ড্রোনগুলারে অন্ধ করি দিছে
আর শিশুদের চোখ উথলাই উঠছে অশ্রুতে
আর তাই প্যালেস্টাইনে চিরকাল বৃষ্টি নামে।
হামাস
বাড়িগুলা তো হামাস ছিল না।
বাচ্চাগুলিন হামাস ছিল না।
অদের কাপড়চোপড়
অদের খেলনাগুলিন তো হামাস ছিল না
পাড়া-প্রতিবেশিরা হামাস ছিল না
বাতাস তো হামাস ছিল না
আমাদের যত কান হামাস ছিল না
আমাদের চোখগুলিন হামাস ছিল না।
যে হত্যার নির্দেশ দিছিল,
যে বোতাম টিপছিল
সেই শুধুই হামাসের কথাই ভাবছিল।
আমরা একটা ভালা মওত পাওনের দাবিদার
আমরা একটি ভালা মওত পাওনের দাবিদার
আমাদের শরীরগুলা বিকৃত মোচড়ানো,
বুলেট আর গোলা দিয়া এমব্রয়ডারি করা।
রেডিয়ো-টিভিতে আমাদের নামগুলির ভুলভাল উচ্চারণ করা হয়।
আমাদের ঘরের দেয়ালে প্লাস্টার করা
আমাদের ছবিগুলিন,
বিবর্ণ ফ্যাকাশে।
আমাদের কবরের শিলালিপি উধাও হতেছে,
পাখি সরীসৃপের বিষ্ঠা জড়ানো।
আমাদের গোরে ছায়া দেয় এমন গাছে কেউ পানি দেয় না।
গনগনে সুরুজের আমাদের পচনশীল শরীররে মাত করি রাখছে।
গাজার কইতর
আমার ছোট্ট পাখি আমার বাম উরুর পর বসি আছে
ইউটিউবে গান শুনতেছে আমার লগে।
ও গাইতে গিয়া চুপ মাইরা যায়
যেন অর গলা অবস মারে, ডানা দুইডা পালক খসি পড়তেছে।
রাস্তায়
আমার বাড়ির পাশে একটা শিশু
তার বাপের অপেক্ষায় বহুদিন।
পোলা
কয়মাস ধরি
বাপের ছবি
খুজতেছিল অ্যালবামে
পোলা তার ছোট
পোষা শিকারী কইতরের পায়
বাইন্ধে দিতেছে
তার বাপের কাছে পৌঁছায় দিতে
তার হাতে লিখা কিছু কথা—
বাপ তার থাকে বহুদূর
নেগেভ কারাগারে!
আমার দাদা আছিলেন একজন সন্ত্রাসী
আমার দাদা আছিলেন একজন সন্ত্রাসী—
উনি উনার খেত-খামার দেখিটেকি রাখতেন,
উডানের গোলাবগাছে পানি দিতেন,
সিগারেট টানতেন দাদির লগে হইদলা সমুদ্রতীরে,
শুই থাকতেন
পড়ি থাকা নামাজের মাদুরের মতো।
আমার দাদা আছিলেন একজন সন্ত্রাসী—
উনি কমলা আর লেবু তুলতেন,
দুপারতক ভাইগো লগে মাছ ধরতে যাইতেন ,
মনের সুখে সুর ধরি গীত গাইতেন
তাঁর সাদাকালারঙা ঘোড়ার খুরের জোতা বানা্ন্নার
কাছে যাইবার পথে।
আমার দাদা আছিলেন একজন সন্ত্রাসী—
তিনি দুধ মিশাইয়া চা বানাইতেন,
সিল্কের মতো নরম তুলতুলা নরম
সবুজ জমিতে বসি থাকতেন।
আমার দাদা আছিলেন একজন সন্ত্রাসী—
উনি নিজের বাড়ি ছাড়ি গেলেন,
আইবেন যে মেহমান তাদের লাগি ছাড়ি গেলেন,
টেবিলের উপ্রে পানি রাখি গেলেন, উনার সেরা উপহার,
যেন মেহমানরা পিপাসায় না মরে
হেগো বিজয়ের পরে।
আমার দাদা আছিলেন একজন সন্ত্রাসী—
উনি চলি গেলেন সবচাইতে কাছের নিরাপদ শহরে,
তা ছিল যেন
খালি পড়ি থাকা আকাশের মতো ফাঁকা,
পরিত্যক্ত তাঁবু,
তারা-শূন্য রাতের আন্ধারের মতো।
আমার দাদা আছিলেন একজন সন্ত্রাসী—
আমার দাদা আছিলেন একজন মানুষ,
দশ জনের জন্য একজন রুটিরোজগারকারী,
যার বিলাসিতা বলতে ছিল একখান তাঁবু,
যেইখানে জাতিসংঘের একখান নীলপতাকা
জংধরা খুঁটিতে উড়ত,
সৈকতে গোরস্থানের পাশে।
ফিলিস্তিনের রাস্তাগুলিন
আমার শহরের রাস্তাগুলির নাম নাই।
কোনো ফিলিস্তিনি
দ্রোনে বা স্নাইপার কেউরে হত্যা করলে
আমরা তার নামে রাস্তার নাম রাখি।
শিশুরা সংখ্যা পরিচিতি শিখে এইখানে সবচাইতে সুন্দরভাবে
যখন তারা গুনে কতগুলি বাড়ি, স্কুল ধবংস করা হইছে
কতজন বাপ কতজন মা আহত হইছেন
কতজনরে জেলে ভরছে।
বয়স্করা ফিলিস্তিনে তাদের আইডিগুলি
খুলি খুলি দেখে তারা কারা
পাছে তারা ভুলি না যায়!
আমার দাদাজান ও বাড়ি
১.
আমার দাদাজান তার হাতের করে গুনতেন
সুদিন আর কয়দিন পর আসবে
উনি পরে দেখতাম পাথর দিয়া গুনতে শুরু করেন
অমা তাতেও উনার হয় না
উনি মেগ
পাখি লোক দিয়া গুনতেন
সুদিন আসার আর কত বাকি
ছত্রিশ বছর উনার মওততক
আর আমাদেরও
সত্তর বছর গুজার হই গেল
দাদা তার মনের পাতার সব রং মুছি গেছে
উনি সংখ্যা গোনা ভুলি গেছেন
উনি উনার বাড়ি আর চিনেন না!
২.
ইস, দাদাজান, আমি যদি তোমার সেসময়ে থাকতাম
নিজেরে লিখা শিখাইতাম
এইসব নিয়া কাব্য লিখতাম
তোমার লাগি আমাদের ঘরবাড়ি রংচং করতাম
আমি তোমারে সেলাই করি গড়তাম
তোমারই লাগানো গাছে সজ্জিত কাপড়ে
আমি তোমারে তৈয়ার করতাম
কমলার সুগন্ধি হইতে
আসমানের আমোদ অশ্রুতে
বানাইতাম সাবান
এর চাইতে খাটি কিছু কি আর হইতে পারে!
৩.
আমি গোরস্থানে যাই প্রতিদিন
আমি তাকাই রই তোমার গোরের দিকে হুদাই
সত্যি কি ওরা তোমারে কবর দিছিল
না কি তুমি গাছ হই গেছিলা
না কি না-কোথাও তুমি পাখির লগে উড়াল দিছিলা
৪.
মাটির ঠিল্লার ভিতর তোমার ছবি আমি রাখছি
আমি প্রতি মঙ্গল আর বিষ্যুদবারে এইটাতে পানি ঢালি
আমারে কে যেন কইছিল তুমি রোজা রাখতা
রমজানে আমি ত্রিশ রোজাতে পানি ঢালি কম বেশি
ঐ ঠিল্লাতে!
৫.
আমাদের বাড়ি কত বড় হোক দাদাজান তুমি চাও
আমি আমার কবিতা লেখার কাজ চালাই যাবো
যতক্ষণ না মিটে তোমার তিয়াস
৬.
এ বাড়ির লাগি রাখিব না কোনো সীমানা
কোনো যতিচিহ্ন
খুঁজলে আমার কানের মধ্যে যা যা পাইবা
১.
আমার কানখান খুললে এইটারে নরম পরশে খুইলো
এর ভিতরে কোনোখানে আম্মার কণ্ঠস্বর থামি আছে
তার গলার স্বরে প্রতিধ্বনি আমার স্থবিরতারে ফিরায়ে দেয়
আমার চেতনকালে আমি বিহ্বল হই পড়ি
আমার কানের ভিতর তুমি আরবি গানগুলি পাইবা
আমার নিজের লাগি যে ইংরাজি কবিতাগুলি
আওড়াই তাদেরে পাইবা
কিংবা যেই গানডা আমি গাই বগবগ করা
আমাদের উঠানের পাখিগুলার উদ্দেশ্যে
যখন তুমি আমার কাটা কান সেলাই করবা
ঐসব কিছুরে আমার কানের ভিতর ফিরাই দিতে ভুইলো না
তোমরা তোমাদের বইগুলারে সেল্ফে যেভাবে সাজাই রাখো
আমার কানের ভিতর ফের
সেগুলারে ফের ফিরাই দিও
২.
ড্রোনের গুঞ্জন, এফ-১৬ এর তান্ডবগর্জানি
আমাদের বাড়িগুলার উপর ফেলা বোমার চিৎকার
আমাদের মাঠগুলা, আমাগো শরিলের
উপ্রে দিই ফালাইফুলাই উড়ি চলি যায়
আমার কানের ছোট গলিতে থাকা
ঐসব গানগুলিরে খেদায়ে ছাড়ে
তোমার হাসির সুগন্ধ ছিটাই দাও আমার আমার গানের ক্ষতে
জীবনের গান আমার ভিতর পুরো যাতে আমার শিরা জাগি উঠে
আস্তে আস্তে ড্রাম বাজাও যাতে আমার মন নাচি উঠে তোমার নাচে
আমার ডাক্তার তুমি আমার দিন-রাত
শিরোনামহীন
একজন পিতার রাইতে ঘুম ভাঙি যায়,
দেখে সে চোখ মেলি
তার চার বছুরে বাচ্চার আকা
দেয়ালে হিজিবিজি রং।
কিন্তু সে তো বিমান হামলায় মারা গেছে।
রংগুলি চার ফুট লাম্বা প্রায়।
পরের বছর তা পাচ বা ছয় ফুট হবে।
কিন্তু শিল্পী তো মৃত
জাদুঘরে আর কোনো নতুন পেইন্টিং নাই
প্রদর্শনীর মতো।
স্মৃতিগুলিন ফুল
স্মৃতিগুলিন ফুল
আমরা ওদের উপ্রে পানি ঢালি
অদেরে বর্ণনা করি
অদেরে বানাই কবিতা, নাটক
আর গল্প।
অদেরে সাজাই তুলি আলোর বাতিতে
কত কত রঙের রূপকে
কতনা ঘরানায়।
কিছু স্মৃতি আছে পচা।
তাদের আছে গন্ধ,
তারা খসখসে, কাটাঅলা ডুমা চামড়ার।
গোরের যতই গভীরে স্মৃতির হাড়গুলিরে পুতো
ব্যাপার না, মিষ্টি স্মৃতিরা ঠিকই বার হই আসবে।
গোলাপ তুমি রুখি দাও
হইও অবাক তুমি
একখান ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির এলোমেলোর মধ্যে
একটা গোলাপ
জাগি উঠছে।
এইভাবেই আমরা
টিকি থাকি।
নিঃশব্দে ফোঁপাই ফোঁপাই কান্দো
ঘুম থাকি জাগি যদি সারাদিন বিদ্যুৎ পাইতাম।
যদি পাখিগের গান ফের শুনতাম
গুলির শব্দ আর
ড্রোনের ভন ভন যদি নাই শুনতাম।
আমার লিখার টেবিল আমারে কলম ধরতে
ডাকত আরোবার,
কিংবা দোসরা কোনো কোনো কবিতা, নাটক পড়া,
কষ্টেসৃষ্টে একটা নভেলের পাতা উল্টাইতে পারতাম।
আমার চারদিকে নীরব দেয়াল ছাড়া আর কিছু না
আর লোকজন নিঃশব্দে ফোঁপাই ফোঁপাই কান্দে।
বাড়ি কারে কয়
বাড়ি কারে কয়:
উল্টায়ে ফালানোর আগে
এইটা হইলো আমার স্কুলে যাওনের
পথের গাছের ছায়া
দেয়ালডা চূর্ণবিচূর্ণ করার আগে
এইটা হইল
আমার দাদা-দাদির বিয়ার সাদাকালো ছবি।
লুট করি
জাদুঘরে রাখার আগে
এইটা হইলো
আমার চাচার জায়নামাজ
যেইখানে ডজনে ডজনে পিপড়ায়
শীত রাইতে ঘুমাইত।
আমাদের ঘরটা বোমায় শ্যাষ হওনের আগে
এইটা হইলো আমার মার
আর মুরগির রোস্ট আর
রুটি সেকার চুলা।
এইটা হইলো গিয়া সেই ক্যাফে
যেইখানে আমি ফুটবল ম্যাচগুলা দেখতাম,
আর খেলাইতাম যেইখানে
আমার পোলাডা আমারে
থামায়ে জিগায়:
এত বগবগ করলা তা কি
চার অক্ষরে কোনো শব্দে তুমি
বুঝাইতে পারবা?
গাজার নোট বই
দুইটা চোখ আমার,
যখন চোখ দুইটা বুজি
দুইচোখে দুরকম দেখি:
শান্তিতে গাজারে রাইখা যাইতেছি
আমি একচোখে দেখি।
আরেক চোখে দেখি
আমি ক্রসিং পয়েন্টের ইরেজ জেলে আটকা পড়ছি।
আমার মাথা হইলো
একটা দিশাহারা পুরানা টিভি চ্যানেল
যে ক্রস সিগনাল পাইতেছে!
***
আমি যখন পঞ্চম শ্রেণি
আমি লাইব্রেরিতে প্রথম বেড়াইতে যাই
দরজার ওপারে একটা দেয়ালে একটা পোস্টারে লিখা ছিল:
‘যদি তুমি বই পড়, একটা জীবনের চাইতে যেন বেশি বাঁচো।’
এখন আমি আমার ত্রিশ বছর
আমার চারপাশে তাকাই আমি
দেখি যদি কোনো বুড়া বা যুবক
অদের কপালে লিখা থাকে, আমি পড়ি:
যদি তুমি গাজায় বাইচা থাকো
তুমি মরো শতবার।
***
বোমা যেই সমুদ্রকে আঘাত করল,
সেইখানে বালির তলায় লগে লগে
একটি অক্ষিকোটর তৈয়ার হই যায়।
মাছগুলি মনে করতে থাকলো
সমুদ্রটি চিরকাল বুঝি কাঁদতেই আছে।
***
যখন বৃষ্টি হয়,
কৃষকরা ভাবে,
আকাশ তাদেরে ভালোবাসে।
অরা ভুল।
বৃষ্টি হয় বা মেগগুলিন জলকণাগুলিরে যহন
আর টানি নিতে না পারে!
কিংবা একটা চড়াই পাখি হাত তুলি মোনাজাত করে
যেই দেখছে কোনো তৃণমূল তৃষ্ণায় কাতর হই
জল চাই জল চাই করতেছে
গাজায় বোমাবৃষ্টি হইতেছে
কারণ মওত এইখানে জন্ম লইছিল।
এইটা কখনোইই আমাদের প্রতিবেশিদের ছাড়ি যায় নাই।
একজন শিশু হিসাবে আমার স্বপ্ন
একজন শিশু হিসাবে আমার স্বপ্ন
আমি এখনো খোয়াব দেখি
খেলনায় ভরা রইবে একটা ঘর
আম্মা সবসমে কবুল করি নিতেন
আমাদেরও থাকতে পারত
যদি আমরা দৌলতদার হইতাম।
প্লেনের জানালা থাকি
শরণার্থী শিবির দেখতে দেখতে
আমার এখনো স্বপ্ন আছে।
আমার এখনো স্বপ্ন আছে
প্রাণীগেরে দেখনের
আমি তৃতীয় শ্রেণীতে শিখছি:
হাতি, জিরাফ, ক্যাঙ্গারু,
আর নেকড়ে
আমি এখনো খোয়াব দেখি:
মাইলের পর মাইল দৌড়াইতেছি
সীমান্ত অবরোধ ছাড়াই
আমার পাগুলিন,
কোনো না-ফোটা বোমা
আমারে ভয় দেখায় না আর।
আমার এখনো স্বপ্ন আছে
চোখ বুজি দেখি
আমার প্রিয় দল
সৈকতে ফুটবল খেলতেছে,
আমি দাড়াই রইছি
বলের অপেক্ষায়
আমার দিকে গড়ায়ে আসবে
আর ঐটা নিয়া দিব দৌড়।
আমি এখনো খোয়াব দেখি:
আমার দাদার লগে ইয়াফায়
কমলাগাছ থাকি কত কত
পাকনা কমলা ছিড়তেছি।
কিন্তু আমার দাদাজান ইন্তেকাল করছেন,
ইয়াফা দখল হই গেছে,
তার কান্নাকাটির কারণে
কমলা আর ধরে না
গাছগুলির ঝোপে।
ইসরায়েলি বিমান হামলার সময় গাজার মায়ের কী করা উচিত
বিছানার চারদিকে থাকা
সে তার সব বালবাচ্চাদেরে জড়ো করে
যেমনি কেউ একজন জড়ো করে বা প্যাক করে
তার বই জামাকাপড় হোটেল ছাড়ার আগে।
প্রতি সেকেন্ডে সে তার বাচ্চাদের গুণে
আর তাদের চোখের দিকে তাকায়। আর সে হাসে।
সে বোমার শব্দ মাটিতে কবর দিতে
মেঘের মধ্যে ড্রোনের ঘূর্ণিঝড় মাটিতে কবর দিতে
রাতের একটা গান গায়
প্রতিটি বোমাফাটার পরপর সে তার বাচ্চাদের জড়ায়ে ধরে।
সে যেই বুঝে
আসমান
আর ঘর একটা বোমার আলোর ঝিলিকে ফর্সা হই উঠে,
সে তার বাচ্চাদের চোখ ঢাকি রাখে
জোরে জোরে বাচ্চাদের জিজ্ঞাস করে,
‘চোখ বন্ধ করলে কী দেখতে পাস?’
আশা করি তার কম্পমান কণ্ঠ লুকায়
বোমার বধিরকারী শব্দরে।
আমার ছেলে আমার মেয়ের উপর কম্বল ছোড়াছুড়ি করতেছে
রাতে, বাড়িতে, আমরা মেঝেতে বসি থাকি,
একে অপরের কাছাকাছি
জানালা আর বোমার লাল আলো থাকি দূরে
আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকাই যেই
ঘর কাপি উঠে।
আমরা এ ওর মুখের দিকে তাকাই,
ভীত, তবুও খুশি যে আমরা ভাগ্যঅলা
যে আমাদের জীবন এবারের মতো রক্ষা করা হইছে।
দেয়ালগুলা ওদের বেচারা ঘুম থাকি জাগি ওঠে।
কেবল একটু উষ্ণতার লাগি শীত রাতে ঝাড়বাতির
চারপাশে মাছি জড়ো হয়
যহন ক্ষেপনাস্ত্র হামলা করা হয়
গরম হই উঠে ঘর রাস্তা গাছ
কাছের পাড়াপ্রতিবেশিরে ঝলসাই ছাড়ে।
যতবারই আমরা এফ -১৬ বা এফ-৩৫ থাকি পড়া
বোমার শব্দ শুনি
আমাদের জীবন আতঙ্ক। আমাদের জীবন জমি যায়
কোথাও না কোথাও, বিভ্রান্ত
পরে কোনখানে যাইতে হবে:
একটা গোরস্থানে, একটা হাসপাতালে,
না কি কোনো দুঃস্বপ্নের কোলে।
আমাদের জীবন তাদের কম্পমান হাত
তাদের হাতঘড়িতে রাখে,
আঙ্গুল ব্যাটারি খুলতে রেডি
ঠিক যেই প্রয়োজন হয়।
গোলাপী পোশাকপরা আমার চার বছরের মেয়ে ইয়াফা,
একটা বোমা ফাটার শব্দ শুনতে পায়
গভীর শ্বাস নেয় মেয়ে,
তার পোশাকের ভাজ দিই মুখ ঢাকি রাখে
ইয়াজান, তার সাড়ে পাঁচ বছরের ভাই,
তার ঘুমন্ত শরীরে উষ্ণ একটি কম্বল আঁকড়াই ধরে।
সে তার বোনের গায়ে কম্বল পাইড়া দেয়।
‘তুই এখন লুকাই থাকতে পারিস’, সে তারে আশ্বাস দেয়।
আমি এবং আমার স্ত্রী মারাম-এর জন্য, আমরা প্রার্থনা করি
যে একটি যাদুর কম্বল যদি সব বাড়িঘররে আড়াল করত
বোমা থাকি
আর আমাদেরে নিরাপদ কোথাও নিয়া যাইত।
আমাদের যা যা আছে আমরা ভালোবাসি
আমরা ভালোবাসি আমাদের যা যা আছে
সে যতই ছোট হোক, কারণ আমরা, আমরা যদি
না ভালোবাসি সবকিছুই চলি যাবে।
আমরা না ভালোবাসিলে
আমাদের অস্তিত্বই রইবে না
যেহেতু আমাদের জন্য এইখানে কিছুই রইবে না।
যা কিছুই আছে তা দিয়াই আমরা
গড়তে থাকবোনে।
যা কিছু আমাদের দেখার বাইরে
আমরা তারও অংশ বটে।
কিছুদিনের মইধ্যেই এই বাড়িগুলি নিজের
থাকি উঠে দাড়াবেনে, যখন আমরা,
আমরাই হইবো বৃক্ষ
ক্ষেপাটে বাতাস থাকি রক্ষা করবো,
বৃক্ষগুলি ছায়া দিবে
শিশুদের, যারা ঐ বাড়িগুলির ভিতরে ঘুমাইতে থাকব
কিংবা দোলনায় খেলতে থাকবেনে।
গাজার সমুদ্রতীরে
আমি নিজেরে নিশ্চিত করি যে একটা খেজুর গাছ কখনো বাকে না,
তার খেজুরও পচে না।
আমার কল্পনায় আসমান কেবল পাখি
আর ফুলানো মেঘে দখল করা হইছে।
আমি সৈকত বরাবর একা হাটতেছি
আর ঠান্ডা, নীরব ঢেউয়ে ভিজতে ডরাই না।
তুমি যদি আমারে ঘুমাইতে দেখতে পাও,
নিশ্চিত হইও আমি হয় গোলাপ
ও ঘুঘুর স্বপ্ন দেখতেছি
বা আমার নিচে শূন্যতার দিকে তাকাই রইছি।
আমি আমার গোলাপী স্যুট পরি বন্দরে হাটি যাব,
যদিও আমি জানি কোনো জাহাজই আসতেছে না।
আমার আশা তুমি তোমার মোক্ষম ডানায়
উড়ি আমার কাছে আসবা।
তুমি না আসা অবধি আমি সমুদ্র সৈকতে
আমাদের লাগি একটা বাড়ি তৈয়ারে শামুক আর নুড়ি কুড়াইব।
আমি জানি না
তুমি আসার আগে আমি কতগুলা বাড়ি তৈয়ার করতে পারব।
তবে হয়ত দেখবা ততক্ষণে আমি গাজারে আবার বানাই ফেলছি।
আমার লাইব্রেরি
গত বছর আমি যেমনে রাখছিলাম তাকে
আমার বইগুলিন সেমনেই আছে
কিন্তু বইয়ের সব শব্দেরা মরি গেছে।
‘আউট অব প্লেস’
আমার প্রিয় পুস্তকখানিরে খুজি।
দেখি কী ফটো অ্যালবাম আর
আমার পুরানা নোকিয়া সেটের পাশে
বড় একা পড়ি সে আছে ড্রয়ারের এক কোণায়।
বইটার মধ্যে রাখা কলমটা এখনও
সেই রকমই আছে, শুধু কয়টা কালির ফোটা লিক
হই ছড়াই ছিটাই পড়ছে।
কিছু কিছু শব্দ
ঐটার কালি শ্বাস হিসাবে টানি নিছে।
যেন কলমটা একটা ভেন্টিলেটর
ডজনখানেক রোগীর কাছে:
বাড়ি, জেরুজালেম, সাগর, হাইফা,
পাত্থর, কমলা, বালি, কইতর, কায়রো, আমার আম্মা,
বৈরুত, রইরাশি, পাত্থর, সাগর, সাগর।
বিমান হামলার পা বিমান হামলা
এই খুনীরা আমাগেরে না খুন করি
কোনোকালেই থামবে না!
বিমার হামলার পর বিমান হামলা
একটা পরিবারের পর আরেকটা পরিবার,
একটা শিশুর পর আরেকটা শিশু,
একটা ঘরের পর আরেকটা ঘর,
একটা গাছের পর আরেকটা গাছ,
একটা রাস্তার পর আরেকটা রাস্তা,
একটা মেঘের পর আরেকটা মেঘ,
একটা বাতির পর আরেকটা বাতি,
একটা নগরের পর আরেকটা নগর,
একটা খেলনার পর আরেকটা খেলনা,
একটা তাবুর পর আরেকটা তাবু,
একটা কবিতার পর আরেকটা কবিতায়।
জহির হাসান
কবি ও চিত্রশিল্পী
জন্ম ২১ নভেম্বর ১৯৬৯, যশোর জেলার পাইকদিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে যশোর ও ঝিনাইদহের গ্রামে। লেখালেখির শুরু ৬ষ্ঠ শ্রেণি। প্রথম কবিতা প্রকাশ ১৯৮৪ সালে যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্ফুলিঙ্গ পত্রিকায়। আগ্রহ ধর্ম, ভাষা, দর্শন ও চিত্রকলায়। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে।
প্রকাশিত কবিতার বই
- পাখিগুলো মারো নিজ হৃদয়ের টানে (২০০৩)
- গোস্তের দোকানে (২০০৭)
- ওশে ভেজা পেঁচা (২০১০)
- পাতাবাহারের বৃষ্টিদিন (২০১২)
- খড়কুটো পাশে (২০১৪)
- আয়না বিষয়ে মুখবন্ধ (২০১৬)
- আম্মার হাঁসগুলি (২০১৭)
- বউ কয় দেখি দেখি (২০১৮)
- বকুলগাছের নিচে তুমি হাসছিলা (২০১৯)
- আম্মার আরও হাঁস (২০২০)
- আমি ও জহির (২০২১)
- রইদের ডাইরি (২০২৩)
- মেঘ শিশিরের জমানা(২০২৪)
অনুবাদ :
- গাজার কবিতা (২০২৪)
- এমে সেজেরের সাক্ষাৎকার ও আধিপত্যবাদ বিরোধী রচনাসংগ্রহ (২০১১)
- সাক্ষাৎকার পুস্তিকা (কবি উৎপলকুমার বসুর সাক্ষাৎকার) : কথাবার্তা (সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৬)
গদ্যগ্রন্থ:
- জলপাই গাছের রব (২০২১)
- বিম্ব যেটুকু দেখায় (২০২২)