স্লাভয় জিজেক
জিজেক-বিশেষজ্ঞ যুবকেরা ঘুরছে, ওদের কাছে যেতে ভয় হয়।
কিছুদিন হল সব ধরনের বিশেষজ্ঞ থেকে দূরে গ্রামের বাড়িতে
বেড়াতে এসেছি। বেশ আছি! বনমোরগেরা নির্ভয়ে এমনভাবে
দানা খুঁটে খেল, আমি যে আমিষাশী দৃষ্টি নিয়ে ওদের দেখছি,
পাত্তাই দিল না। একটা গুইসাপ আজ যথেষ্ট ভদ্রলোকের মতো
আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বাড়ির পেছনে চলে গেল।
এমন অবকাশ বহুদিন মেলে নি, যে-কোনো মুহূর্তে হয়ত লিখব
ভেসে-বেড়ানো পাথরের গল্প, যে-কোনো রাতে অনুভব করব
জঙ্গলে ক্যামোফ্লেজ করে থাকা একটা জাগুয়ারের বিষাদ।
জিজেক-বিশেষজ্ঞ মেয়ে একবার আমায় হেসে জিজ্ঞেস করেছিল,
‘একদিন আমি কি যাব না দৈত্যদের বাগানে?’ বেঁটেখাটো এক
দৈত্যের সঙ্গে শে ঘুমাতে চায়, যে-ঘরে কবিতার বই নাই
বাদ্যযন্ত্র নাই টিকটিকি নাই, শুধু জেগে ওঠে কথার মহেঞ্জোদারো,
তার জিজেকের বইয়ের পাশে পড়ে থাকে রক্তমাখা বেল্ট ও চাকু।
ঘরের বাইরে কবিতা-বিরুদ্ধ হাওয়ায় বুড়ো সজনে গাছ থেকে
টুপটাপ পাতা ঝরে পড়ার মতো অহিংস কিছু মুহূর্ত শে চেয়েছিল,
কিম্বা রঙ পাল্টে ঘুরে বেড়ানো একটা প্যান্থার গিরগিটির সঙ্গ।
অ্যাক্সিস মুন্ডি
কোনো এক বিকেলবেলা দূরগামী এক স্বর্ণস্রোতের পাশে
একটুখানি বসেছিলাম। সেটাই কি ছিল অ্যাক্সিস মুন্ডি?
তেমন বাণীমুখর নই যে সেই গল্প তোমাকে শোনাতে পারি।
সুরহারা এক ভাষাবেহালা আমি। ছন্দভ্রষ্ট।
ডালিমগাছে শ্যামাপাখিটিকে দেখি। একটা খঞ্জনা এলে
শ্যামাটি উড়ে গেল। কে থাকে, কী উড়ে যায়, তুমি কোন
স্রোতের মধ্যে লুক্কায়িত বুদবুদ, সেই সমস্ত কাহিনি
একটি রশ্মির মধ্যে একবার বিধৃত হতে দাও।
স্বর
প্রত্যেক গায়ক পাখির আত্মহারা এক ধ্বনিপৃথিবী থাকে,
যেমন কবির থাকে নিজস্ব এক ফিলহারমোনিক ভাষা ও উদাসীনতা।
সময়োত্তর সেই পাখির চেয়ে হরবোলার ভূমিকা আজ বড়!
ঝরে পড়া পাতার শব্দ শুনে চোখ মেলেছ পুনর্বার, এই তো শালবন!
ঝরে পড়া স্মৃতির ধ্বনি শুনে চোখ মুদেছ পুনর্বার, এই তো স্বপ্নের গুহা!
উৎসর্গের রাতে জঙ্গল থেকে উড়ে এসেছিল রাশি রাশি অগ্নিপতঙ্গ,
মৃত্যুর মুহূর্তে একটা গায়ক পাখির সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল,
তুমিও দেখতে এসেছিলে কবিতার ফার্নেস কীভাবে জ্বলে ওঠে—
তোমার জীবন ছিল না শিউলি কুড়ানো, বস্তুত তোমার জন্যে
একটা মোটরদানার মধ্যে অপেক্ষা করেছিল গেঁয়োভূত, তুমি ছিলে
মধ্যরাতে হঠাৎ বেজে ওঠা গ্রামোফোন, না-পৌঁছা চিঠির বান্ডিল
আর ক্রমাগত গড়িয়ে যাওয়া কমলা রঙের ববিন। কোনো শিউলি
ব্যক্তিগত নয় যতখানি ভেস্টিবিউল হয় পাখির তাকানো,
কোনো কবিতাও নয় সুগন্ধি ঘাসফুল, যাকে খেয়ে নেবে
ধ্বংসের কিনার ধরে হেঁটে আসা সময়হরিণ—
বুনো স্ট্রবেরি
জঙ্গলে ঘোরার ছলে, বুনো স্ট্রবেরির লোভে এই এতদূর এসেছি।
আমার অন্য কথাবার্তা, তুমি সন্দেহ করো—
শুধুই কিছু স্ট্রবেরি, শুনেছি যা ফুটে থাকে অনাবিষ্কৃত ধূসরতায়,
পেতে চাই করতলে। এই তো, কিছুক্ষণ আগে আমিও
একটা স্বর্ণইগলকে সন্দেহ করলাম সংসারত্যাগী বুদ্ধ বলে।
দৃশ্য থেকে যে ক্রমাগত মুছে যেতে চায়, যে-কোনো শিকারি,
তান্ত্রিক, অথবা আগ্রাসী আয়না থেকে যে অন্তর্ধান করে।
এক অসুখী জম্বির মতো আমি সারাদিন ঘুরি এই জঙ্গলে
আর আমার মন বুনো স্ট্রবেরির মায়ায় জড়ায়। এবার বাড়ি ফিরে
তোমাদের আমি এক সুন্দর ব্যর্থতার গল্প শোনাব।
হতে পারে তা কাঠকুড়ানির, অথবা রাক্ষস-বধের।
শুধু বুনো স্ট্রবেরির গাছ মৃত্যুর মতো অচেনা ও দূরে।
দিব্যোন্মাদ শিকারি
পরিত্যক্ত এই দুর্গের বাসিন্দা বলতে এখন একঝাঁক কবুতর, বিচ্ছুরিত আলোয় মৃত্যুর পরবর্তী অধ্যায় থেকে আসা আগন্তুক মনে হচ্ছে তাদের! কিছুক্ষণ পর, খুব ধীর পায়ে, টলতে টলতে এখানে ঢুকে পড়লেন পরিচয় হারানো সেই দিব্যোন্মাদ শিকারি, যার হাতে নষ্ট বন্দুক। এরা, মৃত্যু-চিহ্নিত! স্বপ্ন আর অন্ধত্ব নিয়ে কেঁপে উঠছে কখনো। মাতাল যেমন করে হাসে, তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী সেই হাসি যা আজ উপহার দিতে এসেছে কটাক্ষ হিসেবে, কাকে? ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সে হয়ে উঠবে ডাকাবুকো। কিম্বা হয়ে উঠবে শেষে শুধুই একটা ‘মিউ’। যে সূর্য-সাফল্য দিগন্ত থেকে টেনে হিঁচড়ে তাকে এখানে এনেছে, তা একটা দানব-চোখ ছাড়া কিছু নয়। তার এই প্রত্যাবর্তন, বড়ই আতুর, পেকে ওঠা আপেলের গন্ধের মতো মৃদু। এইমাত্র আরো একজন ছিটকে পড়লেন দুর্গের বিশাল দরজার সামনে, উনি চাঁদের পাথর, শিকারি তার নাম রাখল, ‘ঘুম’। ওদিকে, কবুতরগুলো স্বপ্নতাড়িত, ভূতে-পাওয়া কুমারীর আত্মা যেন শাসন করছে তাদের। এই দুর্গের দেয়াল জুড়ে ১৯টি ডিম্বাকৃতি আয়না বসানো আছে, কী এর অর্থ? ১৯জন মৃত কুমারীর পোশাক, মুখোশ, পমেটম, জুতো, কত শান্তভাবেই না গ্রহণ করছে শতাব্দীর ধুলো। শিকারি যে গোয়েন্দা কবুতরটিকে এখানে আসার আগে পাঠিয়েছিল, তাকে এখন কোনোভাবেই চিনতে পাচ্ছে না। তার মনে হতে থাকে, অশরীরী কেউ অফুরন্ত ব্যাখ্যা হয়ে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে, আর, মরিচা-রঙ হ্রদের কিনারে, মৃতের জাহাজ থেকে ক্রন্দনধ্বনির মতো বেজে উঠছে, ‘ভো’, দুর্গের শীর্ষে প্রায়ান্ধ ইগল এসে বসল, তার ডানাদুটো মলিন হয়েছে নোনাহাওয়ার বিষণ্ণ থাবায়। শিকারি একটু একটু করে বুঝতে পাচ্ছে, ফুরিয়ে আসছে রঙের অভিনয়, ক্রমে নিভে যাচ্ছে ফ্লুরোসেন্ট শব্দেরা, পাথরের তৈরি একটা ঘুমন্ত বই সেই পাঠকের জন্যে অপেক্ষা করছে, যে দরবেশ অথবা প্রেত।
মজনু শাহ
জন্ম ২৬ মার্চ ১৯৭০
প্রকাশিত গ্রন্থ
আনকা মেঘের জীবনী (১৯৯৯)
লীলাচূর্ণ (২০০৫)
মধু ও মশলার বনে (২০০৬)
জেব্রামাস্টার (২০১১)
ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়না (২০১৪)
আমি এক ড্রপআউট ঘোড়া (২০১৫)
বাল্মীকির কুটির (২০১৮)
সাহিত্যে পুরস্কার প্রথার বিরোধী।