তারাদের ঘরবাড়ি ১২
বাইরে মেঘ করে আসায় হলঘর অন্ধকার, ল্যাপটপ কোলে চুপ করে বসে আছে ইন্দিরা। তার আবীর মাখানো ঘামে ভেজা মুখে ল্যাপটপের আলো এসে পড়ছে।
হঠাৎ অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলে ঢুকে আসে হিরণ, “তুমি এখানে!”
ইন্দিরা মুখ তুলে তাকায়।
“আমরা পাগলের মতো খুঁজে বেরাচ্ছি তোমাকে! কি অবস্থা! চলো উপরে! ভয়ে নেশা কেটে গেছে আমাদের, আনন্দী উপরের ছাদ থেকে নিচে নামতে পারছে না, ভয় পাচ্ছে, উলটে বলছে ওর বাবার বাইক চালাবে! ভাবো কি আবস্থা! কিছুতেই নামতে চাইছে না। ওর ভার্টিগো আছে, তুমি তো জানোই। আচ্ছা তোমার ফোনটা কোথায়? এতবার কল করছি আমরা! বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে…” একটানা কথাগুলো বলে হিরণ উত্তরের আশায় ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে থাকে।
হলঘরের টেবিলে রাখা ফোনটা তখনই ভাইব্রেট করে ওঠে, হিরণ এসে ফোনটা রিসিভ করে, “হ্যাঁ, ও ঘরে এসে বসে আছে, আমরা আসছি”, ফোন রেখে সে বলে, “রুবাঈয়ের ফোন ছিল, এসো উপরে,”
“তুমি যাও, আমার একটা কাজ আছে”
“কাজ মানে! আজকে হোলি, সব কাজ বন্ধ। আর আনন্দীর তোমাকে দরকার, এসো”
“কাজটা আর্জেন্ট আর পার্সোনাল, প্লিজ যাও”, যন্ত্রের মতো কথাগুলো বলে ইন্দিরা স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে হিরণের দিকে।
হিরণের মুখ নিমেষে কঠিন হয়ে যায়। “how selfish one can be!”, শব্দগুলো আছড়ে ফেলে হিরণ ঘর ছেড়ে চলে যায়।
ইন্দিরা স্থির চোখে ল্যাপটপের পর্দায় চেয়ে থাকে। তার চোখের সামনে এয়ারলাইন্সের ওয়েবসাইট খোলা। আর তাতে পরপর সাজানো রয়েছে দুর্মূল্য সব টিকিট, – রঞ্জনার কাছে পৌঁছতে হলে এই মুহূর্তে আকাশছোঁয়া দাম চোকাতে হবে ইন্দিরাকে। হঠাৎ ইন্দিরার খেয়াল হয়, গত সপ্তাহে যেদিন সে মাইনে পেয়েছিল, সেদিন সকালের দিকে রঞ্জনা একটা ব্ল্যাঙ্ক মেসেজ পাঠিয়েছিল, তার উত্তরে কি যেন লিখেছিল ইন্দিরা… যথারীতি ভুলে গিয়েছে সে, নিজের উপর হতাশ হয়ে ইন্দিরা ল্যাপটপ রেখে উঠে আসে টেবিলের দিকে। সেলফোনটা তুলে নিয়ে চোখের সামনে ব্ল্যাঙ্ক মেসেজটা খুলে ধরে।
একফালি সাদা জায়গা, শূন্যতা। কিন্তু ইন্দিরাকে তা ছুঁতে পারে না। মনে মনে ইন্দিরা বলে ওঠে, “শূন্যতা দিতে জানতে হয়, শূন্যতা দিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা সবার থাকে না…” বলেই চুপ হয়ে যায় ইন্দিরা। সে কি দিনের পর দিন স্বার্থপর হয়ে উঠছে, নাহলে রঞ্জনার সম্পর্কে এমন কথা অকপটে সে কি করে ভাবতে পারল?! অবাক হয়ে যায় ইন্দিরা। মোবাইল ফোন হাতে সে ফিরে আসে সোফায়। ল্যাপটপের পর্দায় দেখে ফ্লাইটের টিকিটের দাম পাল্লা দিয়ে আরো খানিকটা বেড়ে গেছে, ধীরে ধীরে ইন্দিরার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে ফ্লাইটের দাম, আর একই সাথে রঞ্জনাও। তার কি ফিরে যাওয়া উচিৎ, কোলকাতায়? রঞ্জনার কাছে?
কি মনে হতে একটা নম্বর ডায়াল করে ইন্দিরা,
“হ্যালো,” ওপার থেকে কাবেরীর গলা শোনা যায়।
ইন্দিরার গলা থেকে আওয়াজ বেরোয় না কোনো।
“হ্যালো, কে?”
মামণি কি ভুলে গেলেন ইন্দিরাকে? এত দ্রুত? কি করে সম্ভব?!
“কে বলচো? হ্যালো…”
রঞ্জনা কি তাহলে কাবেরীর ফোন থেকে তার নম্বর ডিলিট করে দিয়েছে… যার ফলে স্ক্রিনে কোনো নাম ওঠেনি?
“হ্যালো, শোনা যাচ্চে না কিচু, কেটে করুন”
“মামণি…”
ফোন কেটে গেছে। দপ দপ আওয়াজে ইন্দিরার কান ভরে যায়।
দপদপ আওয়াজ ইন্দিরার মাথা ছেয়ে ফেলে। দপদপ আওয়াজের মধ্যেই ঘরে ঢুকে আসে রুবাঈ, ইন্দিরাকে কিছু জিজ্ঞেস করে, কোনো জবাব পায় না। ওই আওয়াজের মধ্যেই ইন্দিরা দেখে হিরণ আনন্দীকে ধরে ধরে তার ঘরে রেখে এলো। ইন্দিরার কাঁধে হাত রেখে রুবাঈ কিছু বলে, ইন্দিরা বুঝতে পারে না। রুবাঈ আর হিরণ দপদপ আওয়াজের মধ্যেই বেরিয়ে চলে যায়। ইন্দিরা স্থির হয়ে বসে থাকে। সে জানতে পেরেছে, রঞ্জনার জীবন থেকে তাকে ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে। সে জানে না রঞ্জনা নিজে হাতে তাকে মুছে দিয়েছে না অন্য কেউ… কি যেন নাম তার… নামটা ভুলে গেছে ইন্দিরা। এবার আর সে নিজের উপর হতাশ হয় না, নিজেকে নিজের হাত থেকে বাঁচাতে ইন্দিরা এরকম অনেক কিছু ভুলে গিয়েছে। তা নিয়ে ইন্দিরার কোনো ক্ষোভ বা হতাশা নেই।
কাবেরীর নম্বরটা দেখতে থাকে সে ফোনের স্ক্রিনে, রঞ্জনা কেমন আছে, জানা হয় না ইন্দিরার। নিজের উপর ঘৃণা হয়। ভয়ানক ঘৃণা। ঘামে ভেজা আবীর মাখা অবস্থায় ইন্দিরা অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। হাওয়াশহরে আজ হঠাৎ করে কোনো হাওয়া নেই। বৃষ্টি আসবে বলে আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকিয়ে আছে কিছু দেবদারু গাছ। তারা কেউ ইন্দিরার দিকে তাকাচ্ছে না। যেন রাস্তায় ইন্দিরা নেই, এমনভাবে সবাই তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। সবাই কি তার মতই তাকে ঘৃণা করছে? অসুস্থ দাদা, জ্যেঠিকে জ্যেঠু আর বাবার উপর ফেলে দিয়ে শুধু নিজের প্রয়োজনে ইন্দিরা পালিয়ে এসেছে কোলকাতা ছেড়ে। লড়তে পারেনি, লড়াই করার শক্তি ছিল না তার কোনোদিনই। সম্ভব হলে নিজের গায়ে থুতু দিত ইন্দিরা। নিজেকে বাঁচাতে দিনের পর দিন স্বার্থপর হয়ে উঠেছে। আনন্দী? কে আনন্দী… আজ সকালেই হিরণ বলে গেছে,- দু’দিনের অতিথি। তার কাছে ইন্দিরা নিজেকে মেলে ধরছে?! নিজের উপর প্রবল ঘৃণায় পা মাটিতে আটকে যায় ইন্দিরার। সে কাঁপতে থাকে। হয়তো রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে ফেলতে পারলে মুক্তি পেতো সে, কিন্তু সবার সামনে কি করে কাঁদতে হয় ইন্দিরা ভুলে গেছে বহুদিন। হঠাৎ জোরে ঘন্টা বেজে ওঠে কোথাও। ইন্দিরা দেখে, রাস্তার উলটো দিকেই একটা মন্দির। কোনোকিছু না ভেবে ইন্দিরা ঢুকে পড়ে মন্দিরে। সামনে কে আছেন সে দেখে না। মেঝেতে পা ভাঁজ করে সোজা হয়ে বসে চোখ বুজে ফেলে ইন্দিরা চৌধুরী।
সে দেখে, তার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছে শান্ত একটা চোখ, যাতে কোনো ঘৃণা নেই, শোক নেই, উত্তাপ নেই, মোহ নেই, করুণা নেই। শুধু তাকিয়ে থাকা আছে। শান্ত নিবিড় সেই চোখের দিকে চোখ বুজে তাকিয়ে থাকে ইন্দিরা। তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা কম্পন উঠে মাথার মধ্যে চলে যায়। দুটো চোখের মাঝ বরাবর শান্ত সেই চোখটার দিকে তাকিয়ে ইন্দিরা মৃদু দুলে ওঠে। দেহের তুলনায় মাথার ওজন যেন শতগুণ হয়ে যায়। শ্বাসের গতি প্রায় স্থির হয়ে আসে। আরো একটু কমে গেলেই যেন ইন্দিরা মরে যাবে।
হঠাৎ করে পৃথিবীতে সব কিছু থেমে যায়।
হঠাৎ করে যেন কিছু নেই।
নিজের শরীর আর টের পায় না ইন্দিরা। যেন শ্বাস চলছে না আর। শুধু বোধ আছে একটা। থেকে যাওয়ার বোধ।
মন্দিরের বাইরে ইন্দিরা যখন এসে দাঁড়াল, বৃষ্টি শেষে শহরে তখন সন্ধ্যে নেমেছে। মুখে মাথায় লেপ্টে থাকা আবীর নিয়ে ধীর পায়ে ইন্দিরা অ্যাপার্টমেন্টের দিকে হাঁটতে শুরু করে। রাস্তা নয়, একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যায় ইন্দিরা। না রঞ্জনা, না আনন্দী, না পিকলু, না হাওয়াশহর, এমনকি রুবাঈও নয়, একটা ফাঁকা, শূন্য মাথা নিয়ে ইন্দিরা ফিরে আসে। নিজেকে হাল্কা লাগে অনেক।
“তুমি এখনও ফ্রেশ হওনি!”
সমীকের কথায় চমকে উঠে ইন্দিরা দেখে সে অ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়িতে এসে পৌঁছেছে।
“একটু কাজ ছিল… আর্জেন্ট, তাই সময় পাইনি…”
“সবকিছু ঠিক আছে তো, বাড়ির সবাই?”
“হ্যাঁ”, সমীকের প্রতি একটা হাসি রেখে ইন্দিরা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে।
অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খোলা। অন্যত্র হলে এতক্ষণে ইন্দিরার ল্যাপটপ, ফোন সব চুরি হয়ে যেত। হাওয়াশহরের এই অঞ্চলে সে ভয় নেই। নিজের ঘরে এসে ইন্দিরা দেখে পিকলু ঘুমিয়ে পড়েছে, তার বুকের ওপর রাখা “দ্য প্রফেট”। ইন্দিরা স্নানে ঢোকে। শাওয়ার চালিয়ে দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। ঠান্ডা জলে আবীরের রঙ ধুয়ে যেতে থাকে। আনন্দীর ছোঁয়া তার সাথে সাথে ধুয়ে যায়। চোখ বুজে জলের তলায় পড়ে থাকে ইন্দিরা, অনেকক্ষণ।
স্নান সেরে বাইরে এসে দেখে পিকলু উঠে পড়েছে। মাথা মুছে তোয়ালেটা জানালার সামনে মেলে দেয় ইন্দিরা। তারপর মোবাইল ফোন হাতে পিকলুর পাশে এসে শোয়।
পিকলু বলে, “জানতে চাইবি না?”
“কি?”
“ও… রঞ্জনা… ও… কেমন… আছে?”
“না”
“কেন? অনুতাপ… তোর অনুতাপ হয় না?”
“না, হয় না। হচ্ছে না আর। আমি জানি ও ভালো আছে।”
“নিজেকে বুঝিয়ে রাখছিস? নিজে… ভালো, ভালো থাকার জন্য?”
“না, আমি জানি। তাই অনুতাপ হয় না”
“কি জানিস? কি? কি জানিস তুই?”
“জানি যে ওর যেখানে থাকার কথা ও সেখানেই আছে। আমারও হয়তো এখানেই থাকার কথা। এর অন্যথা হতো না কখনো, সবকিছু বদলে গেলেও শেষে এটাই হতো। এই হওয়াটাকে আমাদের সম্মান জানানো উচিৎ। মেনে নেওয়া উচিৎ। এর সাথে লড়ে জেতার চেষ্টা করাটা ভুল।”
পিকলু স্থির দৃষ্টিতে ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
“তুই কেন এসেছিলি দাদা?”
ছাদের সিলিঙের দিকে তাকিয়ে পিকলু বলে, “ভুল, ভেবেছিলাম তুই ভুল করছিস…”
“আমাকে আমার ভুলের মুখোমুখি বসাতে তুই এতদূর এসেছিস?”
পিকলু মুখে কিছু বলে না। মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়।
“আমি তো আমার ভুলের মুখোমুখি বসেই আছি দাদা, সেই কবে থেকে…”
“কবে… কবে থেকে?”
“যেদিন বাপিকাকুর গাড়িতে করে বাবা-মা আমায় নিয়ে এসেছিল…”
পিকলু চুপ করে তাকিয়ে থাকে ইন্দিরার দিকে। ইন্দিরার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। পিকলু হাত রাখে ইন্দিরার মাথায়, “কাঁদে না, কাঁদতে নেই… সব… দেখিস… সব ঠিক হয়ে যাবে।”
পিকলু এক হাতে ইন্দিরার চোখ মুছিয়ে দেয়।
“রঞ্জনা ভালো আছে এখন” ইন্দিরা বলে।
“তুই… তুই জানলি… কি করে?!”
“আমি জানি, যেমনভাবে ও জানে যে আমিও ভালো আছি…”
“অভিমান? করেছিস?”
“অভিমান খুব খুব দামী জিনিস দাদা, সবার উপর হতে নেই”
“ও… তোর মেসেজ পড়তে পড়তে রাস্তা পার হচ্ছিল…”
“আমার মেসেজ?!” ইন্দিরা অবাক হয়। সাথে সাথে তার খেয়াল হয়, মাইনে পাওয়ার পর রঞ্জনার ব্ল্যাঙ্ক মেসেজের উত্তরে সে এই মেসেজটাই পাঠিয়েছিল। কি যে লিখেছিল তার এখনও মনে পড়ে না।
“এটা দিয়েছে…” পিকলু উঠে গিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে এনে ইন্দিরার হাতে দেয়।
ইন্দিরা দেখে একজোড়া সাদা মোজা। রঞ্জনা তার জন্য পাঠিয়েছে।
পিকলু বলে চলে, “ওর মা এসেছিলেন… পরদিন… দিলেন… এটা… ফোন করতে… বারণ… বলেছেন যেন ফোন না করিস, রঞ্জনা… ও চায় না…”
ইন্দিরা সাদা মোজা দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে পড়ে মেসেজে সে মোজা কেনার কথাই লিখেছিল।
“ও ফেরত চেয়েছে…” পিকলু বলে।
“কি?” ইন্দিরা মোজার দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে।
“ওই… ওইটা”
ইন্দিরা মুখ তুলে দেখে পিকলু টেবিলের উপর রাখা একটা বইয়ের দিকে আঙুল তুলে আছে…
টেবিলের উপর পড়ে আছে মেটে রঙের বইটা… শেষের কবিতা।
পাঁচ মিনিট হল ইন্দিরা দাঁড়িয়ে আছে সাদা দরজার সামনে। দরজাটা আজও ভিতর থেকে বন্ধ। ইন্দিরা একটা হাত রাখে দরজাটার উপরে, রাখা মাত্রই ছিটকে সে সরিয়ে নেয় হাতটা। দরজাটা অল্প ফাঁক হয়ে গেছে। দরজাটা আজ খোলা! আস্তে আস্তে ইন্দিরা ঘরে ঢুকে আসে। আর দুম করে তার নাকে একটা গন্ধ ঝাপটা মারে। ইন্দিরার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। অপূর্ব সেই গন্ধে ইন্দিরা চেয়ে থাকতে পারে না। অস্ফুটে সে বলে, “আনন্দী…”
অপূর্ব সেই গন্ধের উৎসের দিকে তার নজর চলে যায়। মেয়েটা বিছানায় পড়ে আছে। এলো চুল ছড়িয়ে আছে চারদিকে। বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায় ইন্দিরা। বসতে গিয়েও বসতে পারে না। একটা দূরত্ব… কিসের যেন দূরত্ব।
হঠাৎই আনন্দী জেগে যায়।
অপ্রস্তুত ইন্দিরা বলে, “সরি…”
আনন্দী চুপ করে তাকিয়ে থাকে ইন্দিরার দিকে।
ইন্দিরার সারা গায়ে কেমন যেন একটা অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে। অস্বস্তি দূর করতেই যেন সে বলে, “আমার খুব কাছের একজন মানুষ হসপিটালাইজড, দাদা আমাকে সেটা আজকে জানিয়েছে, আমার মাথার ঠিক ছিল না তখন…”
“সে কেমন আছে এখন?” ঘুমভাঙা গলায় জানতে চায় আনন্দী।
“স্থিতিশীল…” থেমে গিয়েও ইন্দিরা বলে, “সম্ভবত…”
“ইনিই কি তোমায় ওই গানটা শিখিয়েছেন?”
অবাক হয়ে ইন্দিরা জবাব দেয়, “হ্যাঁ”
“তুমি বসতে পারো…”
কিছু না বলে ইন্দিরা আনন্দীর বিছানায় বসে পড়ে। অবাক হয়ে সে ভাবে, কি অদ্ভুতভাবে, ঠিক যেমন রুবাঈ বলেছিল, আনন্দীকে পথ না দেখাতেও সে ইন্দিরার মধ্যে চলে এসেছে অনেকখানি।
“এখন কেমন লাগছে তোমার?”
আনন্দী কোনো জবাব দেয় না। মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
ইন্দিরার বুকের ভিতরটা ধক্ করে ওঠে… অভিমান! মেয়েটা অভিমান করে আছে তার উপরে। এত কাছে সে কখন এসে পড়ল ইন্দিরার!
কিছুক্ষণ আনন্দীর দিকে তাকিয়ে থেকে ইন্দিরা বলে, “চলো”
“এখন?! কোথায়?”
“একটা জ্যাকেট পরো আর চলো”, বহুদিন পর অনুরোধ নয়, কাউকে আদেশ করে সে। নিজের গলার স্বর নিজের কানে অচেনা ঠেকে ইন্দিরার। তাকে অবাক করে দিয়ে আনন্দীও উঠে পড়ে।
অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরনোর আগে নিজের ঘরে উঁকি দিয়ে ইন্দিরা দেখে পিকলু আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।
বাইরে যাওয়ার জন্য আনন্দী তৈরি হচ্ছে বুঝে দৌড়ে নিচে চলে আসে ইন্দিরা। সমীকের অ্যাপার্টমেন্টের দরজার বেল বাজায়। সমীক দরজা খুললে ইন্দিরা বলে, “Can you please do me a favor?”
মিনিট পনেরো পরে আনন্দী সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসতে ইন্দিরা বলে, “এটা নাও…”
আনন্দীর হাতে একটা হেলমেট তুলে দেয় ইন্দিরা। নিজেও মাথায় একটা হেলমেট গলাতে গলাতে সে বলে, “হিরণ সকালে কি যেন বলছিল… তোমার বাবার বাইকের ব্যাপারে…” হেলমেটের বেল্ট আটকাতে গিয়ে ইন্দিরা থেমে যায়, “বাই দা ওয়ে, তুমি বাইক চালাতে জানো তো?”
আনন্দী দেখে বিল্ডিংয়ের সামনে সমীকের বাইকটা দাঁড় করিয়ে রাখা।
ইন্দিরা দেখে আনন্দীর মুখে হাসি ফুটে উঠছে। চুপচাপ গিয়ে বাইকে উঠে বসে আনন্দী। দুটো কিকে বাইক চালু হয়ে যায়।
জ্যাকেটের চেইন আটকাতে আটকাতে ইন্দিরা তার পিছনে উঠে বসে। যথাযথ দূরত্ব বজায় রেখে বসে ইন্দিরা বলে, “একটু আস্তে চালিও।”
বাইকের চাকা ঘুরতে শুরু করে। ইন্দিরা শক্ত করে বাইকের পিছনের হাতল ধরে বসে থাকে। নিজেকে ছাড়া ইদানিং আর কারোর উপর ভরসা হয় না তার। তবু কিসের টানে যেন বাইকটা রিং রোডে এসে পড়তেই তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। রাত নটার ফাঁকা হাইওয়ে দিয়ে প্রচন্ড গতিতে ঘন ভারি ট্রাকের ফাঁক গলে গলে যেতে থাকে বাইকটা। ইন্দিরার দুই কান ভরে যায় হাওয়াশহরের হাওয়ার ঝাপটে। হঠাৎ মুখে যেন ছোবল এসে পড়ে তার। চোখ খুলে সে দেখে অজস্র সাপের মতো আনন্দীর খোলা চুল তার গালে সপাটে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। আর সাথে সেই মোহময় গন্ধ। ইন্দিরা ভাবে, কাউকে না জানিয়ে তার প্রতি মুগ্ধ হওয়া কি অপরাধ? না বলে আনন্দীর ঘ্রাণ নেওয়াটা কি একপ্রকার চুরি করা? ইন্দিরা ভেবে পায় না, তবু সে বুক ভরে নেশার মত সেই গন্ধ অনুভব করে, ছোবলগুলো অগ্রাহ্য করে সে সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে দেখে। আনন্দীর ঘন চুল, আর চুলের পিছনের চওড়া কাঁধে তার চোখ আটকে যায়। কোথাও কোনো বারণ নেই, তবু অপরাধবোধের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ইন্দিরার মনে হয় আর এক মুহূর্তও খোলা সাপগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে যেন সে পাথর হয়ে যাবে।
আবেশে চোখ বন্ধ করতে করতে নিজের মনে ইন্দিরা বলে, “দফতন। দিল গিরা কহি পর, দফতন”
…………….
(চলবে)