আমাদের স্ক্রিনময়ী জীবন অনর্গল ডিজি-ছবির বন্যায় চিন্ময়। এই নেটেড দর্শনের গ্লোবাল রাজত্ব শুধু আমাদের অবসরকেই শাসন করে না, কোন ছবির ঝাঁক কিভাবে ইন্টারনেট আর স্ক্রিন বেয়ে আমাদের চোখ ধাঁধায় আর মন মাতায়, তা দিয়ে গড়ে ওঠে আমাদের রোজওয়ারি গণদর্শন আর রাজনীতি। ভিসুয়ালের সেই সাইবারশাহীর নানা ঝাঁকিদর্শন নিয়েই এই কলামের নানান কিস্তি।
ট্রলফেস : আপুনার মুখ আপুনি দেখো-র এক বিশ্বইমোজি
নিচের এই বিকট আনন বোধহয় নেটদুরস্ত পাঠকের পরিচিত। এই কীর্তিমুখ বড় সামান্য নয়।

২০০৮-এর ১৯শে সেপ্টেম্বর কার্লোস রামিরেজের ১৮ বছরের ছাত্রাবস্থায় মাইক্রোসফট পেন্ট-এ করা আঁকিবুঁকি থেকে এই ট্রলফেস কমিকবুক চরিত্র, আদিমতম ও অতিদীর্ঘমেয়াদী ভাইরাল মিম, বিশ্বব্যাপী ডানপন্থী হাতিয়ার, এবং এখন সর্বশেষে একটি মহার্ঘ নন ফাঞ্জিবল টোকেন ছবি হয়েছে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে এই ছবি ট্রলিং এর খিল্লি করে আঁকা হয়েছিলো, ট্রলিং ব্যাপারটা কত খেলো আর হাস্যকর তা বোঝানোর জন্য।

ট্রলিং বা ভেংচিবাজি তখনো বেশ নতুন ছিলো। কিন্তু এখন ট্রলিং সোশাল মিডিয়া ও ইন্টারনেট অভিব্যক্তির প্রধান ও প্রাথমিক রুপমাধ্যম। একে যতই বালখিল্য মনে করি না কেন আমরা, ‘ভেংচি কেটে দ্যাখ / লেংচে হেঁটে দেখ / একটা ডিগবাজি, পাচ্ছে হাসি খ্যাক’-এর power সার্বজনীন, অনাদি ও অনন্ত।

চরিত্রগতভাবে Invective-এর সবচেয়ে কাছাকাছি, ট্রলিং যে নেহাত নিরামিষ মজাক নয়, তা আমরা হাড়েমজ্জায় জানি, তার আমিষত্ব আদমখোর হয়ে ওঠে মাঝে মাঝেই, নানা দেশে, নানা বেশে, নানা পরিস্থিতিতে।
উইকি অনুসারে “ট্রলফেসে একজন ট্রলকে দেখানো হয়েছে, যে ইন্টারনেটে নিজের বিনোদনের জন্য অন্যদের বিরক্ত করে। রামিরেজের মূল কমিকটিতে ট্রলদের উপহাস করা হয়েছে; তবে, ছবিটি ট্রলরাও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। ট্রলফেসকে শিশুদের কটূক্তি “ন্যা ন্যা ন্যা ন্যা ন্যা ন্যা” বা জিভ বের করে ভেঙ্গানোর ইন্টারনেট সংস্করণ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ছবিটির সাথে প্রায়শই “কোন সমস্যা?” বা “রাগ করলে, ভাই?” এর মতো বাক্যাংশ থাকে।” বাংলায় থাকে “কার বেশী ফাটছে?” বা “কার কার ফাট6?”

ট্রলিং-এর ভাবাবেগ schadenfreude-পরশ্রীকাতর-পচানো- তা কি আসলেই সার্বজনীন না কি তা শুধু ইন্টারনেটেড আবেগমাত্র? রামিরেজ প্রথম থেকেই ট্রলফেসের কপিরাইট নিয়ে খুব সচেতন তাই তা ইমোজির মত সার্বজনীন এক মুখভঙ্গি হ’তে পারেনি। চালু ইমোজির মধ্যে থেকে যদি তার সমতুল্য কিছু খুঁজতে হয়, তা হ’লে এই তিনটি যোগ ক’রে একটি rebus গড়লে তা ট্রলফেসের খানিক কাছাকাছি পৌছায়, খানিক খানিক।
কিন্তু এই ট্রলফেস আসলে কি বস্তু? শুধুই কি পটে লিখা এক ছবি তা কাকতালে, কালে কালে এক মহাবস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে? শুধু Internet Icon বলে ডেকেই কি এর নামকাম সমাধা হয়? শুধু ভাইরাল জনপ্রিয়তার নিরিখে কি একে বুঝে সাল্টানো যায়? Olga Goriunova-র ভাষায় জিজ্ঞেস করলে- “How does something that has a primarily aesthetic sensibility exhibit the capacity to propel a political voice, an idea, problem, discontent, a genre?”

Olga-র উত্তর খুব সাদাসিধে না হ’লেও খুবই চিন্তাকর্ষক ও চিত্তাকর্ষক। শুধু ট্রলফেস না, সমস্ত ভাইরাল নেট-জ কুসুম ও কাঁটা (ছবি, ভিডিও, অডিও, লব্জ)-কে একধরণের ‘জঞ্জালি পোক’ হিসাবে দেখতে নারাজ তিনি। মানে সচরাচর আমরা যেভাবে দেখে থাকি – এক ধরণের নিম্নরুচি ও নিম্নমানের শিল্পবস্তু যার ঋদ্ধতার একমাত্র অভিজ্ঞান তার জনপ্রিয়তা ও ভাইরাসের মত তার ছাপিয়ে ওঠার, ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা যা নেটো মাঠের হেটো দর্শকের লঘিষ্ঠ সাধারণ আবেগুনিতকে চিমটি-শুড়শুড়ি দিয়ে তাকে মাতিয়ে-চেতিয়ে তোলে। কিন্ত তার মানে এই নয় তিনি এগুলিকে কোনো নান্দনিক মহাবস্তু বা বৈপ্লবিক চন্নামেত্ত বলে ভাবেন। তাঁর মতে এগুলি ব্যক্ত (individuation) করার প্রক্রিয়াংশ যা মাধ্যমিক (mediatized) উপায়ে ব্যষ্টিক ভাবে ব্যক্তিগত নান্দনিক রসনিষ্পত্তি করে। এর আত্মা মূলত নান্দনিক যা এক মানুষ-মেশিন-জালিক পার্ফম্যান্স যা গণ-এর উদ্দেশ্যে নির্মিত কিন্তু একত্ব-বোধের মাপসই। জনমানসের ব্যক্ততা (individuation), অনুশাসন সে রাষ্ট্রিক হোক বা সামাজিক বা মার্কেটিকটিকি, সবই উত্তরোত্তর নান্দনিক (aesthetic)mode-এ হয়ে থাকে অতএব ট্রলফেস বা ট্রলফেস-এর মত অন্যান্য জিনিসপাতি icon, symbol বা index কোনটাই নয় আর এর প্রভাব ইন্টারনেট নামক কোন প্যারালাল universe-এ সীমিত নয়, কারণ ইন্টারনেট ইজ রিয়েল ওয়ার্ল্ড টু, বেইবি অ্যান্ড বাবেশ!

ট্রলফেস দীর্ঘজীবী এবং বহুজীবী হ’বার কারণে তার এস্থেটিক এবং রস-প্রকরণ কালে কালে বেশ খোলতাই হয়েছে। যেমন উপরের এই এ আই পরিকল্পনা অতিআধুনিক হলেও (ইঞ্চিপাড় ল্যাপটপ, সোফার ডিজাইন ইত্যাদি) এর আত্মা ২০০৮-এর। খুলে ক’ই। ইন্টারনেটের অতিব্যবহার সেই সময় সংখ্যালঘু একটি ব্যাপার ছিল। কাজে কাজেই ট্রলিং-ও ছিলো কিছুকিছু নেটিজেনের পাসটাইম। নেটকালচার আছিল সাবকালচার। নেট-ইয়াররা নাকি ছিল অন্তেবাসী, ‘রিয়াল’ লাইফ-বিবিক্ত, আমেরিকান স্টিরিওটাইপে বাপের হোটেলে খায়, বাড়ির বেসমেন্টে থাকে এবং সেই হতাশা থেকেই করে ট্রলবাজি – অনন্ত অবকাশে অজানা মানুষদের অকারণ উত্যক্ত করা। সেই আদত স্টিরিওটাইপের এস্থেটিক কিন্তু এই এআই ছবির মধ্যেও রয়েছে। কারণ এ.আই পুঞ্জীভূত সংখ্যাগুরু ডাটা গিলে, সেই বমির বারোইয়ারি পরোটা বানায়। কিন্তু আজ যখন সব্বাই ট্রলার, নেটব্যবহার অবকাশমূলক বা নেহাত আলগা বিনোদনমুলক না, তখন ট্রলফেসের মুখ কি আরও সাধারণ হয়ে উঠবে না আরও অসাধারণ?

ছবিবাজির সোশাল মিডিয়া সাইট Pinterest-এর একটি ট্রলফেস বিষয়ক বোর্ডে দেখি ট্রলফেসের মুখকান্তি সময়ের সাথে সাথে আরো ঘনান্ধকার আরও বিকৃত হচ্ছে, তা আস্তে আস্তে অমানুষিক এক মানসিক মুখের ছবি হচ্ছে।

আরও পড়তে চাইলে:
https://en.wikipedia.org/wiki/Trollface
Goriunova, Olga. “The force of digital aesthetics. On memes, hacking, and individuation.” The Nordic Journal of Aesthetics 24, no. 47 (2016).

সৌরভ রায়
লেখক, সম্পাদক, অনুবাদক ও চিত্রগবেষক
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের LGBTIQ+-সংক্রান্ত অনলাইন ভিসুয়াল কন্টেন্ট নিয়ে গবেষণা করছেন।