কনফুসিয়াস ফ্রম দ্য হার্ট । ইউ ড্যান ।। বাংলায়ন: নাঈম ফিরোজ ।। প্রথম অধ্যায়, প্রথম পর্ব

                                  প্রথম অধ্যায়

                                           যাত্রাঃ পৃথিবীর পথে, এরপর আরো বহুদূর


বস্তুত এটা আমরা ভাবলে ভুল ভাববো যে কনফুসিয়াসের প্রজ্ঞাপ্রসূত শিক্ষা আকাশচুম্বী এবং তার দর্শন মানুষের চেনা নিয়মের বাইরে। আবার ‘উচ্চমার্গ’ ধরে নিয়ে তাঁর শিক্ষাগুলো শুধু সযত্নে যাপিত দিনের অন্তরালে পুষে রাখার জন্যও নয়। সরল সুগম্য এ পৃথিবীর যে সত্য পূব আকাশে সূর্য ওঠার কথা জানান দেয়, বলে বসন্ত তুমি হে বপনের কাল হয়ে এলে আর শরত শুধুই ঘরে ফসল নিয়ে ওঠো; সেই সত্য আমাদের নাগালস্পর্শ এবং প্রতিফলিত হয় কনফুসিয়াসের সহজিয়া দর্শনের অমূল্য আখ্যানজুড়ে।

 

কনফুসিয়াসের শিক্ষা আমাদের আধ্যাত্মিক শান্তির খোঁজ দিতে পারে যুগের এই আধুনিকতায়ও। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনাচরণ এবং জগতের কোলাহলে নিজেদের সত্যিকারের অবস্থানটা বুঝে নিতেও তা আমাদের আলো দেখাতে পারে। তাঁকে পড়তে গিয়ে আমরা মাঝেমাঝে ভেবে উঠতে পারি যে এখানে তো আহামরি কিছু নেই। তাঁর দর্শনের বেশিরভাগ অংশই ছোট ছোট পরিসরে একক কোনো বিষয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে চলে। তাঁর উপদেশমূলক কাজগুলোর খুব সামান্যই আছে যা কলেবরে বড়, ছোট ছোট জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষায় ঠাঁসা তাঁর গোটা দর্শনের শরীর। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে আমরা তাঁকে পড়তে পড়তে এই ‘অনন্য’ অভিজ্ঞতাটাকেও ছুঁয়ে যাবো যে তাঁর বাণীগুলোর মধ্যে উহ্যও যে কত শিক্ষা দেদীপ্যমান, এবং তা কত অসাধারণভাবেই না বলা আর না বলা কথার মিশেলে হয়ে আছে এক ‘টোটাল’ ফিলসফি।

 

তিনি যখন বলেনঃ ‘স্বর্গ আমাদের কখনো কি কিছু বলেছে? দেখো তারপরও হাওয়াঘুরে বারবার ঋতুরা আসে, শতেক বস্তুর জন্ম হয় না নিয়ত? আমাদের কখনো কি কিছু বলেছে স্বর্গ?’ (Analects XVII)

আমরা শুনি তিনি তখন বলছেনঃ চেয়ে দেখো স্বর্গ ওপরেই আমাদের, শান্ত ও শাশ্বত, নির্বাক চিরদিন যেন। তারপরও হাওয়াঘুরে বারবার ঋতুরা আসে, প্রকৃতি আমাদের সামনে বিনাবাক্যেই মেলে দেয় অযুত বিস্ময় তার। ওভাবেই দিন চলে যায় আমাদের, স্বর্গ কি তাও ভাঙে তার নীরবতা?

 

এভাবেই কনফুসিয়াসে চিন্তার একটা সহজ কিন্তু প্রেরণাপ্রণালী যেন খুঁজে পেয়ে যাই আমরা। এই প্রেরণা অতি সাধারণভাবেই আসে আর আমাদের অন্তস্থল জ্ঞানের উষ্ণ নরম আলোয় ভরিয়ে তোলে। ঠিক এই আকিদায়ই কনফুসিয়াস তাঁর শিষ্যদেরকে করেছিলেন ঋদ্ধ ও প্রভাবান্বিত- যাঁদের বাহাত্তর জনই কালের বিচারে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন উঁচুস্তরের গুণী ও প্রজ্ঞায়। এরাই যেন জ্ঞানবীজের মতো বিস্তারণ করে গেছেন কনফুসিয়াসের শিক্ষা দূর থেকে দূরান্তে। সে কারণে চীন ও তার জনগণ কনফুসিয়াসকে একজন সন্ত হিসেবেই শ্রদ্ধা করে। সন্তেরা বেঁচে থাকাকালে দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী সে সব মনিষ্যি যারা নিজেদের সময়ে সবচেয়ে এগিয়ে থাকেন চিন্তায়, কর্মে, সক্ষমতায় আর ত্যাগে। তারা আমাদের জন্য বহন করেন অনন্ত জ্ঞানের উৎস আর তা সঞ্চার করেন মুক্তমনের মানুষের হদয়ে, বিশ্বাস বাসা বাঁধে সেখানে আর পরম্পরায় অগ্রবর্তী হতে থাকে- আলোর অবিরল স্রোতের নিয়মে। এই মানুষেরা স্বর্গ থেকে আসেন না। তাঁরা স্বাভাবিক নিয়মেই আমাদের মধ্যেই জন্ম নেন ও বেড়ে ওঠেন। এই বই এর লেখকের সাথে সাথে প্রাকৃতিক জন্ম ও বেড়ে ওঠার বিষয় বুঝে উঠতে চলুন এবার একটু চৈনিক মিথের দিকে চোখ ফেরানো যাক। আমরা চৈনিক মিথোলজিতে ঢুকলে দুনিয়া ও স্বর্গ তৈরির প্রক্রিয়ার একটা তত্ত্ব পাই যার সাথে জড়িয়ে আছে Pan Gu নামে এক অতিমানবীয় আদিমতম সত্তার গল্প। কথিত আছে Pan Gu-ই ধীরে ধীরে আলাদা করেছিলেন দুনিয়া ও স্বর্গ। এই গল্পে আমরা তাকে ওয়েস্টার্ন মিথোলজির পরম শক্তিধর কারো মতো কুঠারের এক আঘাতে চারদিকে সোনালি আলোর এক ঝলকানি ছড়িয়ে চকিতেই দুনিয়া ও স্বর্গ আলাদা করতে দেখবো না। আমরা এও দেখবো না যে  স্বর্গ ও দুনিয়ার তাবৎ বস্তুই এক লহমায় আবির্ভূত হয়ে যাচ্ছে। বরং ক্রমশ এক ধীরলয়ে শান্ত প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে Pan Gu  এর হস্তক্ষেপেই তারা হাজির হবে। এটাই চিন্তার ক্ষেত্রে চৈনিক আকিদার একটা নমুনা। অতিপ্রাচীন চৈনিক ইতিহাসের সংকলন San Wu Li Ji  তে পাওয়া যায় দুনিয়া ও স্বর্গ তৈরির প্রক্রিয়ার এ তত্ত্ব। সেখানে আমরা পাবো যে সৃষ্টি মূলত এক দীঘল প্রণালীঃ শান্ত, সুশীল এবং বিস্ময়ের আবহে রহস্যাতীত এক ঘূর্ণি। আমরা জানতে পারি একটা কসমিক ডিম্বের মধ্যে কিভাবে আঠারো হাজার বছর মিলেমিশে থাকার পর আলাদা হয়েছিলো স্বর্গ ও দুনিয়া। সেই ডিম্বে Pan Gu-ও ছিলেন। তিনি জন্মালেন তা থেকে আলাদা হলো স্বর্গ (আকাশ) ও দুনিয়া ঢিমেতালে। সেই ডিম্বের পয়মন্ত নির্যাস (Yang essence) থেকে স্বর্গ ও ভারী নির্যাস (Yin essence ) থেকে উদ্ভব হয় আমাদের এই দুনিয়ার। সেই সৃষ্টির দিনগুলোর প্রতিদিনে নয়টি করে পরিবর্তন ঘটতে থাকে আর প্রতিদিন স্বর্গ একটু একটু করে দূরে সরে যেতে থাকে দুনিয়ার, রয়ে যায় এক সন্ত দুনিয়াতে আর এক ঈশ্বর স্বর্গে। প্রতিদিন স্বর্গ উপরে যেতে থাকে দশ ফুট, দুনিয়া গভীর হতে থাকে দশ ফুট আর দুনিয়া ও স্বর্গের মাঝে দন্ডায়মান বাড়তে থাকে Pan Gu  দশ ফুট করে করেই। তার বয়স আঠারো হাজারে পৌঁছুলে সে খুব লম্বা হয়ে যায়, দুনিয়া হয়ে যায় সুগভীর আর স্বর্গ চলে যায় অনেক ওপরে। তারপরই স্বর্গবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দুনিয়া- ‘মড়াত’ শব্দে দুটো ভাগে বিভক্ত হওয়া কোনো কঠিন পাতের মতোন না, বরং দুটি মিশ্রিত নির্যাসের ধীরে ধীরে আলাদা হওয়ার ব্যাকরণে কসমিক ডিম্বের পয়মন্ত নির্যাস (Yang essence) থেকে স্বর্গ ও ভারী নির্যাস (Yin essence ) থেকে উদ্ভব হয় আমাদের এই দুনিয়ার। কিন্তু আলাদা হবার প্রণালী এখানে শেষ হয়ে যায় না। আমরা এক্ষণে জানতে পারি যে আসলে তা কেবল শুরুই হয় তখন।

 

দেখুন কিভাবে চীনদেশীয়রা পরিবর্তনে কত বেশি এবং কত নিবিড় দৃষ্টি দেয় । সেই Pan Gu এর কথাটি ভাবুন তো- যে দুনিয়া ও স্বর্গের সাথে সাথেই তাদের অভ্যন্তরীণ সংযোগসত্তা হিসেবে দিনে নয়টি করে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে যা ছিলো ধীর, সূক্ষ্ণ ও গভীর সব পরিবর্তন। এই আখ্যানটির মধ্যে Pan Gu এর পরিবর্তনের একটি স্তর দেখতে পাওয়া যাবে  এবং তাকে দুনিয়া ও স্বর্গে যুগপৎ আলোকিত সত্তারুপে গণ্য করবে মিথোলজি এবং যাকে আদিম টেক্সটে ‘দুনিয়ার সন্ত, স্বর্গের বিধাতা’ (‘a god in the heavens, a sage on earth’) বলা হবে ।  প্রচলিত চীনা ধ্যানধারণায় উভয় জাহানে এই পসারই হচ্ছে আদর্শ জীবন-যাপনের প্রেরণামূল। এবং তারা বিশ্বাস করতে ভালোবাসে যে সবারই উচিত এরকম একটি মার্গ অনুসন্ধান যাতে জীবন স্বর্গের আস্বাদ পায়- নির্বাধ পাখা মেলে দেয়ার নিশ্চিন্ত জীবন যেখানে হাতছানি দেয় । আর যেখানে নিয়মের বেড়াজাল চোখ রাঙায় না নির্নিমেষ । তারা এও বিশ্বাস করতে ভালোবাসে যে স্বর্গ সন্ধানীর শেকড় দুনিয়ার মাটিতেও প্রোথিত হবে অর্থপূর্ণ এবং দুনিয়ার পথে হেঁটে যেতে যেতে পথের সরাবে জঞ্জাল।

যাদের কাছে শুধু খোয়াবই  আছে বাস্তবতাবোধ নাই তারা খোয়াবি, আদর্শিক না, আর যাদের কাছে দুনিয়াটাই শেষ কথা তারাই পতিত, বাস্তবতা-প্রতিবন্ধী। আদর্শ ও বাস্তবতা আমাদের দুনিয়া ও স্বর্গ । যদিও তারা মনে করেন যে পরিবর্তনের দেখা পেয়েছিলেন Pan Gu, তা এখনো চলমান। আমরা আঠারো হাজার বছরের লম্বা মিথগল্পে শুনি – প্রতিদিন স্বর্গ উপরে যেতে থাকে দশ ফুট, দুনিয়া গভীর হতে থাকে দশ ফুট আর দুনিয়া ও স্বর্গের মাঝে দণ্ডায়মান বাড়তে থাকে Pan Gu – দশ ফুট করে করেই। তার বয়স আঠারো হাজারে পৌঁছুলে সে খুব লম্বা হয়ে যায়, দুনিয়া হয়ে যায় সুগভীর আর স্বর্গ চলে যায় অনেক ওপরে।

 

অন্য ভাষ্যে মানুষই স্বর্গ ও দুনিয়ার সমান; মানুষ, দুনিয়া ও স্বর্গ তিনটি ভুবন হিসেবেই চিহ্নিত হয়- আলাদা আলাদাভাবে সমান মর্যাদার তিন ভুবন, একত্রেই যা মহাজগত এর জন্ম দেয়।

 

কনফুসিয়াস এভাবেই দুনিয়া দেখেন যেখানে মানুষ শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য  নিজেদের মধ্যে এবং নিজের কাছে নিজেও!

(চলবে)



ভূমিকাপর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading