নবাবের কবিতা নিয়া কয়েক নোক্তা | রাবিয়া সাহিন হক

মানজুরের কবিতা নিয়ে লেখার মতন দম আমার নাই। খালি মনে হয়, এত লম্বা দম নিয়ে কবিতা লেখা সহজ না। সহজ না এই কবিতা তাঁর কলমে উঠে আসার জার্নিটাও। তাঁর কবিতার সাথে আমার পরিচয় “আল্লাহ গো” কবিতার ভিতর দিয়ে, যা হাসান রোবায়েত ভাই শেয়ার করছিলেন তাঁর জন্মদিনে। এরপর যত দিন গেছে তাঁর কবিতার দরদে ডুবে থাকছি। মুহাম্মদপুর নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভুগি এখনো। যদিও তাঁর পয়লা কবিতার বই “নবাবের কবিতা”  হাতে আসার আগেই ম্যাক্সিমাম কবিতা অনলাইনে পড়া ছিল। তারপরও এই বই নিয়ে এত উচ্ছ্বাস কাজ করছে ভিতরে, মেলায় গিয়ে পয়লা এই বইটাই নিছি। অথচ বই হাতে নেয়ার পর আমি আর লিখতে পারতেছি না বইটা নিয়ে। যতবার হাতে নিছি, ততবারই খালি দাগ টেনে গেছি।

যদিও প্রথম দুইটা কবিতা একদমই ভালো লাগে নাই।

“বাবা” দিয়েই পড়া শুরু করছি। বাবা নিয়ে কোন কবিতা এতটা টালমাটাল করতে পারে নাই আমারে, এত সুন্দর কবিতা লেখাও হয় নাই হয়ত আর। বাবা না হারালেও বাবা হারানোর যন্ত্রণা কতটা কাতর করতে পারে, তা টের পাইতে শুরু করি এই কবিতা পড়ে। বারবারই আওড়াই এই লাইন,

“বাবা হারালে সন্তানেরা হারায় এক সৌর শরীর”

মউতের সময়টা এত গাঢ় হয়ে মাথায় আঘাত করতে পারে, এই লাইনটা পড়েন,

“ঘড়িতে এগারোটা,

তোমার মউতের দিনের মতো থকথকা হয়ে আছে”

এই কবিতা পড়ার পর থেকেই মউত নিয়ে আমার কনসার্ন বেড়ে যায়। জানাজার আজান বলে কিছু না থাকলেও বুঁদ হয়ে থাকি এ লাইনে, কবিতা যেন শেষ হয় না…

“কখনো এমন আফিমবোধে ঢুকে যাই

হার লহমার ভিতর যেন তোমার জানাজার আজান হতে থাকে”

“ফেব্রুয়ারী ২০” কবিতায় কবি বইমেলার আমেজে মাতায়ে রাখেন আমাদের। বইমেলায় কখনো না গিয়ে থাকলে বইমেলায় যাওয়ার বাসনা জাগবে এই কবিতা পড়ে। বইমেলা পাগল এই কবি লেখছেন,

“কোন বসন্ত নাই কোন ফাল্গুন নাই

খালি বইমেলা বইমেলা লাগে”

“জুলাই ২০” কবিতায় আরেক মানজুর এসে হাজির। যে কিনা ভুল ধরতে ওস্তাদ। প্রচুর হাস্যরসের ভিতর দিয়ে সে এই কাজ করে। এখানে যেমন,

“তোমাদের কবিতা শিখাব

আভাগা ও মননশীল সোনামনিরা,

যাও কায়দা নিয়ে আসো

আজ তোমাদের আলিফ-বা পড়াব”

অথচ আরেক জায়গায় সে এ-ও বলতেছে,

“এক সবুজ স্পর্ধার মতো হয়ে আছি তোমাকে সম্বোধনে

অথচ ভাষার দিক থেকে সবচেয়ে নোংরা হয়ে আছি

তোমাকে সম্বোধনে সবচেয়ে নিরবতা ভালো লাগে।”

আর এই লাইনটা আপনার কদম থামায়ে দিবে, যদিও একটা পাকা টসটসে টমেটোর লাল আপনার চোখে ইশারা তৈয়ার করবে,

“কী কদম দাও, সোনা

প্রতি কদমের ভিতর টমেটোর লাল ভিজে যায়”

কবি কখনো এতটা প্রেমিক যে, প্রিয়তমার পর্দা ঠিক রাখা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন,

“আমি কারো খিমার ঠিক করে দিই সারাটা জীবন ধরে”

“কুকুর” কবিতার এই লাইনে এসে মনে হইছে, কুকুরকে এত আদর করে কুত্তা ডাকা যায় জানলে কেউ কাউকে কুত্তা বলে গালি দিতো না,

“ওগো জান্নাতি কুত্তা আমার

তোমার ভাগ্যকে আজ লাভ বাইট দিয়ে যাই”

তাঁর কবিতার বিশেষ দিক মনে হইছে সম্বোধন, যেকোনভাবে যেকোন আঙ্গিকে বিভিন্ন কবিতায় এইটা বেশ চোখে পড়ার মতো, যেমন “নভেম্বর ২০” কবিতায়,

 

“ও হাওয়া, ওগো পতাকার পতপত

যেন বেলুনের সুন্দর বুঝতে আমাকে শিশু হতে হবে”

…..

“আমার সোনা মানিক আল্লাহ,

আমার যাদুবাবু আল্লাহ,

আমার ময়নাটিয়া আল্লাহ

আল্লাহবাবু, তোমার কাছে পাপ কইরা কইরা আসলে আমি কি তোমারে বেজিকির হইছি কখনো! “

তবে যেভাবেই তিনি সম্বোধন করেন, সেভাবেই সুন্দর লাগতেছে। তাঁর নিজেরও একটা লাইন পাইলাম এমন,

“পাখি যেভাবেই ডাকে সেভাবেই গুঞ্জরণ হয়”

কবি তো পাখিই।

“সবুজ বিষয়ে” কবিতায় কবি এতটাই প্রেমকাতরতা দেখান, যেকোন প্রেমিকই নিজেরে এই কাতরতায় সামিল করতে পারেন,

“তোমাকে সবুজ ভেবে বাজেয়াপ্ত করে ফেলি

আমি ছাড়া অন্য কোথাও তোমার আনন্দ হলে আমার দুঃখ লাগে”

কিছু জায়গায় কবির শিশুসুলভতা এতটা চোখে পড়ে, মুখ ফসকে হাসি আসবেই,

“এমন দুপুর ফেলে এমন বিকালে এসেছি

ম্যাও ম্যাও ডেকে এক বিলাইকে গ্যাঞ্জামে ফেলেছি

আমার ব্যর্থতাগুলা এতটা বিভিন্ন,

যেন চুমু খেতে গিয়ে সর্দি টেনেছি”

আবার কখনো পড়তে পড়তে মনখারাপের মেঘে মেঘে বেলা ভুলে বসে থাকি কবির মতন,

” কতটুকু বিকাল হলো কতটুকু মনখারাপ হলো

মেঘের জন্য কিছুই বোঝা ত যাবে না”

“অক্টোবর ২০” কবিতায় কবি প্রেমিকারে আলাদা পরিচয় দিতে চান, চান নিজের পরিচয়টারেও আলাদা রাখতে। অথবা এমনও হতে পারে, এই লাইন দ্বারা মানুষের ভাবাভাবি দিয়ে কবি প্রেমিকার লগে তাঁর যে একাত্মতা তা বুঝাইতে চান প্রেমিকারে,

“আমি আমার পরিচয় গারিয়েছি এমন পারদে

তোমাকে উচ্চারণ করলেও লোকে আমার কথা ভাবে”

কখনো দেখা যায়, ঢাকাবাসীর নিরস জীবনের একটা বাস্তব চিত্র আঁকি কবি বসি থাকছেন,

“জীবনে তেমন কিছু নাই, মাঝে মাঝে জ্যামে বসে থাকি”

আরবি কবিতা পড়ার মত আবহাওয়া দ্বারা কবি কী বুঝাইতে চাইছেন জানি না, খালি মনে হয়, একটা ডুকরে ওঠা বিলাপ বা একটা কান্দন সারাক্ষণ বইতেছে চারপাশে, যেরকম কবির দীর্ঘ কবিতাগুলা,

“আরবি কবিতা পড়ার মত আবহাওয়া লেগে আছে পিথিবীতে”

এই লাইনগুলা কবিতা আর স্মৃতির সুন্দর একটা ধারণা দেয় আমাদের,

“কিছু হলেই কবিতা লিখা যায় না

কবিতা প্রিয়ত্বের সম্ভাবনা থেকে জারিত

কবিতা পাহাড় ও সমুদ্রকে রাস্তার দুইপাশে নিয়ে আসে”

….

“স্মৃতি মানে বহু বহু তারার আইশটা গন্ধ

কল্পনা, অনেকগুলা পোকার এক ইমেজ হয়ে ওঠা”

পরিচয় নিয়ে বাংলাদেশীদের যে সংকট রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে, শুধু পরিচয় না, নাগরিক হিসাবেও যেই দুর্দশা অতিবাহিত করতে হইতেছে বর্তমান আমলে তা থেকে উত্তরণের আকুতি থেকে কবি খোদারে বলতেছেন,

“হায় জান তৈয়ারকারী,

এ কোন মাতা দিলে আমাদের পিতা থেকে!

আমাদের পিতা কেন নিবীর্য হলো না!

..

এমন আশ্চর্য পিতামাতা পেয়েছি গো,

কেবল এতিম হওয়ার বাসনা উথলে উঠে।”

খোদার লগে তাঁর বান্দার সরাসরি যে মোলাকাত হওয়ার কথা তা মানজুরের কবিতায় খুব সুন্দরভাবে হাজির হইছে। যার মাঝখানে আর কেউ নাই, না কোন পীর না কোন মৌলভী। সমসাময়িক না খালি এ যাবত আর কোন বাংলা কবিতার বইয়ে এত সরাসরি খোদার সামনে বান্দার উপস্থিতি আমরা পাই না। এইটা একটা মাইলফলকই বলতে হবে।

“আগস্ট ২১” কবিতায় সামান্য পানিও যে বেশি দামে কিনে খাওয়া লাগতেছে তা নিয়ে কবি আক্ষেপ প্রকাশ করেন নিজের অপরাগতার ভিতর দিয়ে। মিঠা পানির দেশের মানুষ হয়েও, নদীর দেশের মানুষ হয়েও আমরা আমাদের খাওয়ার পানির উৎসগুলা হারাইতেছি । একদিকে বোতলজাত পানির রমরমা বাজার, অন্যদিকে মরতে থাকা পানির উৎসগুলা, তার উপর আছে ভারতীয় বাঁধ উপচে আসা পানির কারণে সৃষ্ট বন্যাপ্লাবিত জনজীবনের দুর্দশা। অথচ নাই কোন রাজনৈতিক ফয়সালা,

“যেখানেই যাই গরীব পানি খুঁজি

বোতলের পানি মেলা দাম, কিনতে পারি না”

মুহাম্মদপুর নিয়ে কবির এই লাইনটা পড়লে মনে হয়, প্রকৃতঅর্থে কোন মোহাম্মদপুর যদি নাও থাকে একটা মুহাম্মদপুর আছে, যেখানে আমাদের নবীজী মুহাম্মদ (স) বিরাজমান। ফলে মুহাম্মদপুর এখানে স্থানিক পরিচয় অতিক্রম করে রূহানি পরিচয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আর পাঠকেরও বাসনা জাগে এমন মুহাম্মদপুরের বাসিন্দা হওয়ার। শুধু তাই না, কবির মা আর মাশুকাও এই মুহাম্মদপুরেই থাকেন। ফলে মুহাম্মদপুর রূহানি জগত ছেড়ে আবার ঢাকার মুহাম্মদপুর হয়ে উঠে,

“থাকি মুহাম্মদপুরে,

জোহর কুবায় পড়লে আছর পড়া যায় মদিনা মসজিদে।

.

বৃহস্পতিবার তুমি আসো না যে,

আমি মুহাম্মদপুরের কাছে যাব

যেখানে আমার মা আর মাশুকার বাতাস ঘেমে আছে”

“শিয়াদের নিয়ে” কবিতাটা পড়ে শিয়াদের প্রতি অন্তর ঘেমে যাওয়া টের পাই, যা ইতোপূর্বে ফিল হয় নাই আমার। হয়ত আরো অনেকের ভিতরেই একটা দরদ কবি জাগাইতে পারছেন শিয়াদের ব্যাপারে। কবি নিজের পরিচয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে শেষমেষ মজলুমের দিকেই নিজেরে পাইছেন। একজন কবির জন্য যেকোন পরিচয় ছাপিয়ে এই পরিচয়টাই যথেষ্ট মনে হইছে, যে কি না মজলুমের হয়ে কথা বলে,

“কখনো নিজেকে শিয়া মনে হওয়ার ভাবাবেশ তৈরি হয়,

আর চারপাশে সুন্নিদের পলিটিক্যাল আছর অবশ করে ফেলে

আমি যেই হই, কিভাবে জুলুমের পক্ষে বলি!

মজলুমের পক্ষে আমি ঝুকেই কি যাব না!”

আরেকটা কবিতায় কবি একজোড়া চুড়ির খোঁজে বিহারী ক্যাম্পে হাঁটছেন, যেই দেশে বিহারীরা যুগের পর যুগ বাস করলেও শরণার্থীর মতন জীবন কাটায়, সেই বিহারীদের ক্যাম্পে কবি যেন একজোড়া চুড়ি নয়, একটু খুশির আমেজ খুঁজতে গেছেন৷ এই বিহারী ক্যাম্প যেকোন শরণার্থী ক্যাম্পের প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে উঠছে মনে হইলো। বর্তমান বিশ্বে বাড়তে থাকা শরণার্থী সংকট যারা তৈয়ার করে ফায়দা নিতেছে তাদেরকেই কি কবি বলতেছেন,

“বিহারী ক্যাম্পে হাটি, আমাকে কে দিবে একজোড়া কাচের চুড়ি”

ওনার বিশেষ কবিতা “মুহাম্মদ আপনাকে ” আর “আল্লাহ গো”— এই দুইটা কবিতা বাকিসব কবিতারে ছাপায়ে হাজির থাকবে সবসময়। ফলে ভালো কবিতা অনেকগুলা থাকলেও, বা কিছু কম ভালো কবিতা থাকাসত্ত্বেও ” নবাবের কবিতা” নিয়ে আগামীতে আলোচনা সমালোচনা জারি থাকবে আরো দীর্ঘকাল।

এত এত প্রশংসা জারি রেখেও “নবাবের কবিতা” নিয়ে বলার মত এমন অনেক কিছুই আছে যা আসলে এস্থেটিকতার চাইতে কিছুটা এনার্কি আর কুষ্ঠকাঠিন্যতাও তৈয়ার করছে। ব্যাকরণিক জায়গা থেকে কবি শব্দের নানান ধরনের চেহারা তৈয়ারের চেষ্টা করছেন। যেমন চন্দ্রবিন্দুকে একেবারে নাই করে দিছেন। প্রেমিকার খিমার ঠিক করে দিতে থাকা কবি কি একটা টিকলি বা টিপের সৌন্দর্য বুঝেন? যে শব্দে চন্দ্রবিন্দু আবশ্যক সেখানে তা নাই করে দেয়া একটু দৃষ্টিকটু তো বটেই শ্রুতিকটুও মনে হইছে। যেমন “বাবা” কবিতায় কবি লেখছেন, 

 

“আমার তেলোয়াতরত কোরানের আয়াত ছাড়া কিছুই ছুবে না তোমাকে”

“শিয়াদের নিয়ে” কবিতায় লেখছেন,

 

“চারদিকে বাতাস কাপে যেন আব্বাসি ইউটোপিয়া”

“মজলুমের পক্ষে আমি ঝুকেই কি যাব না!”

ছোয়া, কাপা, হাটা, খোজা, বাশ, চাদ শব্দের মতন এরকম আরো আরো যা উনি ব্যবহার করছেন, সবই চন্দ্রবিন্দুহীন। তিনি কবি হিসাবে নিজের কবিতায় যা ইচ্ছা করতে পারেন, কিন্তু সেইটারে এস্থেটিকতা বলার যে চর্চা সেইটা কেমন লাগে আপনাদের চোখে?

কিছু শব্দের গঠন এমন- পড়ে মনে হয় আরবি বা উর্দু শব্দ। এমনিতে আরবি, উর্দু শব্দ তো যথেষ্ট রকমের ব্যবহার তিনি করছেনও। সরাসরি কুরানের আয়াতও উনি ব্যবহার করছেন। এসব যে ব্যবহার করা যাবে না তা না, ওনার সংস্কৃত বর্জনের চিন্তার দিকে যদি আমরা খেয়াল করি, উনি কি শেষমেষ সংস্কৃতের বেড়াজাল ডিঙ্গাতে গিয়ে আরো আরো বেড়াজালে আটকা পড়লেন! ওনার কবিতার পাঠক কারা? শব্দ বাছাইয়ে উনি কাদেরকে গুরুত্ব দিছেন? শব্দকে সহজ করতে গিয়ে শব্দের যে রূপ উনি দাঁড় করাইছেন সেই শব্দগুলা (যেমন- গারানো, পিথিবি, রিদয়, পুন্নিমা, পকরিতি) রে এমন না যে উনি একটা রুলসে ফেলে এমন উচ্চারণ-ভঙ্গিতে লেখছেন। না, সেরকম হলে পকরিতির মতন আমরা আরো আরো র-ফলাযুক্ত শব্দকে র-ফলাহীনভাবে পাইতাম। কিন্তু পাইতেছি- প্রসিদ্ধ, গ্রাম, মিস্ট্রি, ক্রিম, প্রিয়, প্রভু এমন অনেক। তো, যেটা হইতেছে, উনি মূলত যেইটা যেরকম উচ্চারণ করতে ইচ্ছা হইছে করছেন, কোন কিছুর তোয়াক্কা করেন নাই। এইটাই কি ওনার এস্থেটিকতা? কিন্তু, খেয়াল করলে দেখবেন, রকমনু ভাষা নিয়ে যেই কারবার করেন, নিজে একটা রুলস তৈয়ার করে সেইটা ফলো করে লেখেন। মানজুর নিজের মতো তা করে উঠতে পারেন নাই সে অর্থে। রকমনুর ভঙ্গিতে বানান লেখার প্রবণতা অবশ্য ওনার ভিতরে কিছুটা হাজির আছে। এইটা সাধারণের উচ্চারণভঙ্গিরে কিছুটা ভ্যাংচি কাটার মতন লাগলো। যেহেতু ওনার উচ্চারণভঙ্গি সাধারণের মতন না। এছাড়াও সাধারণের ডিকশনারির বাইরের প্রচুর কষা শব্দ আছে ওনার লেখায়। যেমন শাক্কে সদর, স্ফুটনোন্মুখ, ফ্লুয়েন্ট পজিশন, বেহদ, উহিব্বুকা, হ্যালুসিনেটারী, কাজ্জাব, খুশু-খুজু, ঝঞ্ঝিয়, ফানাত্ব, আবদিয়্যাত, এতমিনান, তাজাল্লি, গোলামিয়্যাত, মাশকুক, নদিভূত, বেচাইনিয়্যাত, ইশকিয়্যাত, ভস্মীভূততা এরকম আরো অনেক শব্দ।

কবিতার অতিকথনও কিছু কিছু জায়গায় চোখে পড়ার মত। শুধু অতিকথন না, কিছু কিছু জায়গায় ভাবের পুনরাবৃত্তিও ঘটতে দেখা যায়।

ধর্মীয়বোধের জায়গা থেকেও উনি যে উচ্চমার্গীয় অবস্থানে নিজেরে নিয়ে গেছেন, সেখানে আল্লার প্রতি নিজের দিলদরিয়া হওয়ারে জোড়ালো রূপ দিতে গিয়ে তিনি মাহবুবা, মাশুকা এমন কিছু সম্বোধন করছেন। খোদারে লৈঙ্গিকভাবে সম্বোধন করার যে স্পর্ধা উনি দেখাইছেন, এটা রীতিমত অবাকই করছে। “আল্লাহ গো” কবিতা শেয়ারের মাধ্যমে জানতে পারছি অনেক সাধারণ মুসলিম পাঠক বিষয়টারে সমীচীন মনে করেন নাই।

ওনার কবিতার প্রবণতা যতটা না গদ্যধর্মী তার চাইতে বেশি বক্তব্যধর্মী মনে হইছে, যেখানে বিচ্ছিন্ন লাইনগুলা থরে থরে সাজানো, কবিতার নামগুলাও খেয়াল করলে বুঝবেন যে, তিনি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়ে নামকরণ করেন নাই তেমন, সময় দিয়ে শিরোনাম করছেন, এটা অবশ্যই কবির খুশি। ফলে লাইনগুলা কিছু কিছু খুব মনে ধরে যায়। যেন একটার লগে আরেকটা মালাগাঁথার মতন করে জোড়া দিছেন আলাদা আলাদা লিখে। উনি নিজেও সেটা বলতেছেন,

“আজ দু লাইন লেখলাম

কাল দুলাইন লেখব

সাপ্তাহখানেক গেলে নতুন কবিতা পোস্ট করব।”

এমন করা যাবে না তা না, আসলে “মুহাম্মদ আপনাকে” বা “আল্লাহ গো” কবিতার যে গীতলতা তা অনন্য।

ওনার চারপাশ থেকে, বিশেষ করে ইসলামের ইতিহাস থেকে, নানান উপকরণ নিলেও মূলত তা বক্তৃতারে লম্বাই করছে, অনেক ক্ষেত্রে চকমকি তৈয়ারের কাজ করছে।

এছাড়াও অন্যকে প্রভাবিত করার ব্যাপক প্রবণতা নিয়ে “নবাবের কবিতা” বইয়ে মীর হাবিব আল মানজুরকে হাজির দেখা যায় দরাজ কণ্ঠে।

তারপরও মনে হয় যে, মানজুরের বই নিয়ে এসব আলোচনা-সমালোচনা সব উপেক্ষা করেই কিছু কবিতায় তাঁর দরদবিগলিত স্বরে ঝরতে থাকা আত্মার বিলাপ যে কাউকেই বইয়ের শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবে।


নবাবের কবিতা

প্রচ্ছদশিল্পী : ধ্রুব এষ

প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০২১

প্রকাশক: বৈভব

মূল্য: ২০০ টাকা

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading