কলকাতার বাতাসেই নাকি ধর্মনিরপেক্ষতার উপাদান আছে। কলকাতায় মুসলমানরা দেদারসে গরুর মাংস খায়। অনেক হিন্দুকেও গরু খাইতে দেখছে নুরুল।
মারকুইস স্ট্রিটের উদ্দেশে রওনা দিয়া দমদম স্টেশন থেকে মেট্রোতে চড়ছে মুফতি নুরুল ইসলাম। দরজার কাছে একটা হাতল ধইরা দাঁড়ায়া আছে। নামবে পার্ক স্ট্রিট। যাচ্ছে মূলত গরুর কালা ভুনা খাইতে। মারকুইস স্ট্রিটে বেশকিছু হোটেল আছে যারা বাংলাদেশি স্টাইলে গরুর মাংস রান্না করে। এদের মূল টার্গেট বাংলাদেশি কাস্টমার। অথেনটিক টেস্ট। আগেও কয়েকবার খাইছে। হোটেলের খোঁজ পাইছিল ইউটিউবে। কে এক বাংলাদেশি রিভিউ দিছিল। গরুর মাংসের দাম এইখানে ভালোই কম। বাংলাদেশের তুলনায় অর্ধেক দাম। ভারতের অন্যান্য শহরের চাইতে কলকাতা সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য অনেকটাই নিরাপদ। কিন্তু কলকাতাতেও কট্টরপন্থীরা আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালায়া যাচ্ছে। যদিও সফল হইতে পারতেছে না। কলকাতার বাতাসেই নাকি ধর্মনিরপেক্ষতার উপাদান আছে। কলকাতায় মুসলমানরা দেদারসে গরুর মাংস খায়। অনেক হিন্দুকেও গরু খাইতে দেখছে নুরুল। আজ আবার স্বাদটা নিতে চাচ্ছে।
নুরুল থাকে দমদম মেট্রোস্টেশনের খুব কাছেই। এমন এলাকায় নুরুলের পক্ষে থাকা কঠিন। ভাড়া একটু বেশি। কিন্তু সামহাউ একটা কমদামি ১ রুমের ফ্ল্যাট পাইছে তাও মাত্র ৩ হাজার টাকায়। ভাগ্যের জোরেই কেবল এমন বাসা পাওয়া সম্ভব। যদিও ভাগ্যে বিশ্বাস করে না নুরুল। ধর্মেই বিশ্বাস নাই আর ভাগ্য। কিন্তু ভাগ্য শব্দটা সে ব্যবহার করে। সে মনে করে ধর্মের সাথে এর কোনো লেনাদেনা নাই। থাকলে থাকবে। সে ভাগ্য শব্দ ব্যবহার করবে।
শ্যামবাজারে ট্রেন থামার মুহূর্তে প্ল্যাটফর্মে কাঠগোলাপ রঙের জামা গায়ে হালকা গড়নের একটা মেয়ে মেট্রোর জন্য দাঁড়ায়া থাকতে দেখে নুরুল। মেয়েটা তার দিকে আর সেও নাম না-জানা মেয়েটার দিকে তাকায়। ট্রেন থামতেই সবাই ওঠার জন্য হুড়াহুড়ি লাগায়া দেয়। লম্বামতন একটা ছেলে মেয়েটার গা ঘেঁইষা উঠতে ধরলে মেয়েটা একটু ধাক্কা খায়, কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করে না; দ্রুতই অপ্রস্তুত অবস্থা কাটায়া নিয়া মেট্রোতে উইঠা পড়ে। ধাক্কা খাওয়ার সময় মেয়েটা চোখ সরায়া নিছিল। ছেলেটার ওপর রাগ হয় নুরুলের। দেইখা চলতে পারে না? কানা নাকি?
মেট্রোতে উইঠাও মেয়েটা নুরুলের দিকে ফাঁকে ফাঁকে তাকায়। নুরুল মেয়েটার দিকে। নুরুলের মুখে মাস্ক। মাস্কের কারণে নুরুলের দাড়ি তেমন বোঝা যায় না। মেয়েটার মুখেও মাস্ক। যতবার মেয়েটার মায়াবী চোখ নুরুলের চোখের দিকে পড়ে ততবারই নুরুলের হার্টবিট বাইড়া যায়। মেয়েটার যায় কিনা বোঝা যায় না।
নুরুলের ক্লান্ত হতাশ চেহারা, নিরুত্তাপ চাউনি। মেয়েটারও তাই। নির্লিপ্ত চোখে মেট্রোর গ্লাস ভেদ কইরা দেখতে থাকে রাস্তার দৃশ্যসকল। চোখে আবারও চোখ পড়তেই সরায়া নেয় নুরুল। অস্বস্তিতে না। ভয়ে। এই চোখে বেশিক্ষণ তাকায়া থাকা যাবে না, থাকলে ফানা হয়া যাবে।
মেয়েটাকে ঘিরে নুরুলের ভাবনার জমিন ফুলে ফলে ভরে উঠতে থাকে। নুরুলের মনে হয় ওই তাকানোতে কোথাও একটুখানি মায়া রহিয়াছে। ক্লিশে হইলেও নাটোরের বনলতা সেনের উপমার কথাই মনে পড়ল। পাখির নীড়ের মতো চোখ তুইলা তাকাইছিল মেয়েটা।
গলায় ভার্সিটির আইডেন্টিটি কার্ডের ফিতা। কোন ভার্সিটিতে যে পড়ে। নীল রঙের ফিতায় লেখা ভার্সিটির নাম পড়তে মন চায় নুরুলের। কিন্তু তাকাইতে গিয়া চোখ চলে যায় বুকে। নুরুল চোখ সরায়া নেয়। যদি ধরা পড়ে তার চোখ, তাইলে কী না কী মনে কইরা বসে কে জানে!
তার মায়াবী চোখটা শুধু দেখছে নুরুল। ফর্সা আর হালকা লোমে ভরা কপাল। সিল্কি চুল বারবার মুখের ওপর পড়তেছিল। নুরুলের ইচ্ছা করতেছিল চুলগুলা নিজ হাতে সরায়া দেয়।
নুরুলের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো দাম নাই। ক্ষণিকের এইসব প্রেমিকারা সামান্য আনন্দ আর দ্বিগুণ দুঃখ দিয়া চইলা যায়। সেও যাবে। কিন্তু ইচ্ছা তো করতেই পারে। ইচ্ছার নাও ভাসায় নুরুল। নুরুলের সাধ জাগে মাস্কের আড়ালের ওই নিরুত্তাপ চোখের মুখশ্রী দেখতে। দেখতে পায় না নুরুল। তাতে হতাশও হয় না। যদি বলতে পারত, আপনার চাঁদমুখখানা কি একটু দেখতে পারি? উত্তরে কি বলত মেয়েটা? সম্ভাব্য উত্তর ভাবে নুরুল। ১. না, কেন? আপনি কি আমায় চেনেন? না আমি আপনাকে চিনি? ২. কিছুই বলবে না। মুখোশের আড়ালে হাসবে হয়তো নুরুলের কাতরতা দেইখা। ৩. থাপ্পড় একটা বসায়া দিতে পারে মেজাজ গরম হইলে। ৪. আর কী?
চেহারা দেখতে না পাইলেও এই ক্ষণিকের দেখায় যে অনুভূতি তৈরি হইছে তাই অনেক মনে হয়। তবু নুরুলের সাধ জাগে। জাগতেই থাকে। নুরুলের মন চায় মেয়েটার চোখের পাপড়িতে চুমু খাবে। নুরুলের ধারণা পৃথিবীর সবথেকে প্রেমময় দৃশ্য হচ্ছে, প্রেমিক-প্রেমিকার চোখের পাপড়িতে চুমা খাওয়ার দৃশ্য। নুরুল কখনো প্রেম করে নাই। কিন্তু প্রেম করলে নুরুল অবশ্যই এই সুন্দর দৃশ্যের নায়ক হতে চায়।
খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না অচেনা দুই হৃদয়ের চোখাচোখি। গিরিশ পার্কেই নাইমা পড়ে নাম না জানা মেয়েটা। নামার আগে শেষবারের মতো তাকায়। কী বিপদ! নুরুল যদি পাগল হয়া যায়! মেয়েটার চইলা যাওয়া পথে তাকায়া থাকে নুরুল। যতক্ষণ না চোখের আড়াল হয়।
পেছনের এক সিটের এক মধ্যবয়সী মহিলা নুরুল আর মেয়েটার চোখাচোখি দেইখা ফেলে। মেয়েটার চইলা যাওয়ার পথে নুরুলের তাকায়া থাকার দৃশ্যে পানি ঢেলে দেয় মধ্যবয়সী ধবধবে কিন্তু বেঢপ শ্রীহীন সেই মহিলা। বইলা বসে, হুজুর দেখি ভালোই রোমান্টিক। ডিজিটাল হুজুর। সহযাত্রীকে বলতে থাকে, তাই বলেই রাস্তাঘাটে মেয়েদের দিকে কেমন হ্যাবলার মতো তাকায়া থাকে কেউ! নুরুলের দিকে তাকায়া আবারও বলে, প্রেম করতে ইচ্ছা করে হুজুর?
নুরুল হতভম্ব হয়া যায়। কী সমস্যা এই মহিলার! অপরিচিত মানুষকে এইভাবে কেউ বলে নাকি?
নিজের মুসলমানিত্ব দূর করার পদ্ধতি হিসাবে নুরুল নাস্তিক হইছিল, এখন নুরুলের মনে হয় সে নিজ জাতির সঙ্গে বেইমানি করছে। কারণ সে ইসলামের যে ভুল ধরত তা মুসলমানদের সংশোধনের জন্য না, মঙ্গলের জন্যও না; বরং নিজে খুব স্মার্ট তা বুঝাইতে।
২
কলকাতার মারকুইস স্ট্রিট—পুরোনো দিনের দালানকোঠা, সংকীর্ণ গলি, রাস্তার ধারে ফুটপাতের দোকান, আর হোটেলের সাইনবোর্ডের জঞ্জাল। সন্ধ্যার দিকে জায়গাটা আরও ঘোলাটে হয়া যায়। রাস্তার ধুলো, খাবারের ধোঁয়া আর হুইস্কির গন্ধ মিশে একটা অদ্ভুত ঘোর তৈরি করে। গরুর কালাভুনা খাওয়া শেষে চা খাইতে খোকনদার স্টলে যায়। খোকনের চায়ের দোকানে বসে থাকে মুফতি নুরুল। বয়স উনত্রিশের মতো। ভারতে আসছে কয়েক বছর হইলো। এসাইলাম নিছে, কিন্তু নিজের বেশ পাল্টায় নাই।
খোকনদা পুদিনা পাতার চা দিয়া যায়। চা খাইতে খাইতে নুরুল ইসলাম অন্যদের আলাপচারিতা শোনে। অপরিচিত লোকজনের আড্ডায় নাক গলানোর স্বভাব নাই নুরুলের। চুপচাপ শুনতে পছন্দ করে। যুতসই কোনো টপিক পাইলে বলে। তবে অবশ্যই সেইটা এমন তথ্য হইতে হবে যাতে চোখ ঘুরায়া দেওয়া যায। না হইলে চুপই থাকে।
নুরুল একসময় মাদ্রাসার ছাত্র ছিল। আলেম হইছিল। ইসলামের ওপর সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়া মুফতি হইছিল। তার আলেম বাপ চাইছিল সে হাফেজ হবে, ফতোয়া দেবে, সমাজ বদলাবে। কিন্তু সে নিজেই বদলে গেছিল। এমন বদল যেইটা কেউ মাইনা নিতে পারে নাই।
বাপ আলেম হওয়ায় জন্মের পর থেকেই সে মাদ্রাসার গণ্ডির ভেতরেই বড় হইছে। মাদ্রাসার পরিবেশ আর নিজের অমানবিক জীবন, হুজুরদের ভণ্ডামি আর তারই ক্লাসমেটদের ইসলামের প্রতি অনুভূতিহীন আচরণ আর ডাবল-স্ট্যান্ডার্ড তাকে নাস্তিকতার পথে ঠেইলা দেয়। গল্প উপন্যাস পড়ার নেশা ছিল নুরুলের। নুরুলের পাঠে ধরা পড়ে বাংলাদেশের যত বড় বড় লেখক আছে সবাই প্রায় নাস্তিক। নাস্তিক না হইলেও সেকুলার। কলকাতার দাদাদের হারানো জমিদারি ফিরায়া দেওয়ার সিপাহসালার। তারা ধর্মকে রাষ্ট্রে যেমন গল্প উপন্যাসেও মেশাতে নারাজ। প্রিয় লেখকদের মতো হইতে চায়া নুরুল নাস্তিক হয়া ওঠে। খালি নাস্তিক হইলে সমস্যা ছিল না, সে যে নাস্তিক সেইটা প্রমাণ দেওয়ার জন্য নানানকিছু করে। আজ নবীকে গাইল দেয় তো, কাল কোরানের ভুল ধরে, পরশু মুসলমানদের জঙ্গি বলে, তরশু কোরানের উপর জুতা রাখে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের তৌহিদি জনতা খেইপা যায় আর নাস্তিক মুফতি নুরুল ইসলামেরও পালাইতে হয়। পালায়া ভারত যায়। তারপর তার এসাইলাম হয়। নানাভাবে চেষ্টা করার পরেও তাকে উন্নত বিশ্বের কোনো দেশ আশ্রয় দেয় নাই। বিভিন্নজনের হুমকির কমেন্ট, ইনবক্সে খুনের থ্রেট, থানায় করা জিডির খবর নিয়া অ্যাম্বেসিতে জমা দিছে, তাও না। এইদিকে উত্তেজিত জনতার চাপ বাইড়া গেলে উপায় না পায়া পালায়া ভারত যায় এবং রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। ভারতে আসছিল মূলত মুক্ত চিন্তার বাতাসে ভাইসা যাওয়ার জন্য। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সে বুইঝা গেছিল, মুক্ত ও মুক্তি সংক্রান্ত অর্থহীন শব্দগুলা কেবল ডিকশনারিতেই শোভা পায়। বাস্তবে এর অস্তিত্ব নাই। এইখানে তার আশ্রয়দাতারা শুধু মুসলমানদের না, নিজেদের মধ্যেও একটা কঠোর অনুশাসনের রাজনীতি তৈরি কইরা ফেলছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মোড়কে তাদের সংকীর্ণতা ঢাইকা রাখলেও, সেইটা ঠিকই চোখে পড়ে নুরুলের।
নুরুল সত্যকে দাবড়ায়া ধরতে গিয়া নিজেই সত্যের দাবড়ানির ভেতর পইড়া গেছে। বাংলাদেশে থাকার সময়ে নিজের ধর্মের বিরুদ্ধে বলতে পারত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলতে পারত। সত্য উচ্চারণ করতে পারত। এখন পরবাসে আইসা পরের ওপর নির্ভরশীল হয়া নুরুলের সত্যান্বেষণ ছিকায় উঠছে।
ভারতে আসার পর তার মূল সমস্যা ছিল চেহারা। দাড়ি কাইটা ফেলতে চাইছিল, কিন্তু আশ্রয়দাতারা মানে নাই। বলছিল, “তোমার এই হুজুর লুকটাই দরকার আমাদের। এইটা নিয়াই মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। তাইলে লড়াইটা জমবে ভালো।”
এই দিকে, বাইরে বাইর হইলে উল্টা বিপদ। বিজেপি সমর্থক বা চরমপন্থী গোষ্ঠীর চোখে সে মুসলমান। সে ‘দেশের বোঝা’, ‘অনুপ্রবেশকারী’। মুখের উপরেই বইলা বসে। পারে না খালি গায়ে হাত তুলতে। কবে যে তুইলাও ফেলবে সেই ভয়ে আছে। সারা ভারতেই গরুর মাংস খাওয়া বা রাখা সন্দেহে মুসলমানদের পিটায়া মাইরা ফেলার ঘটনা ঘটতেছে। তাও পুলিশের উপস্থিতিতে। সেগুলোর কোনো বিচারও নাই। মব মারছে বইলা চালায়া দেয়। মবের তো মাও বাপ নাই। পরিচয় নাই। কুল্লু খালাস।
নুরুল বুঝতে পারে, সে যত বড় অসাম্প্রদায়িক আর নাস্তিকই হোক না কেন, মুসলমানের ঘরে জন্ম নেওয়ায়, এবং মুসলমানের নাম থাকায়, পৃথিবীর ইহুদি জাতির কাছে মুসলমানই থাকবে, এবং তার শত্রু হিসাবেই গণ্য হবে, পৃথিবীর হিন্দু জাতির কাছে নুরুল মুসলমানের বাচ্চা আর তার শত্রু হিসাবেই জন্ম নিয়া ফেলছে, পৃথিবীর খ্রিস্টান জাতির কাছে নুরুল মুসলমানই থাকবে, এমনকি পৃথিবীর একটা পিঁপড়া মারার দায়ও নুরুলের না থাকলে কী হবে, জাত হিসাবে মুসলমান হওয়ায় পৃথিবীর যৌথ জাতিদের কাছে নুরুল পটেনশিয়াল টেরোরিস্ট।
নিজের মুসলমানিত্ব দূর করার পদ্ধতি হিসাবে নুরুল নাস্তিক হইছিল, এখন নুরুলের মনে হয় সে নিজ জাতির সঙ্গে বেইমানি করছে। কারণ সে ইসলামের যে ভুল ধরত তা মুসলমানদের সংশোধনের জন্য না, মঙ্গলের জন্যও না; বরং নিজে খুব স্মার্ট তা বুঝাইতে। নিজের স্মার্টনেস প্রকাশ করতে যা করছে তার পুরাটাই নিজ জাতির সর্বনাশ।
খোকনদা আরেকটা চা দিয়েন।
খোকনদা শুনতে পায়নি মনে হইলো। নুরুল আবার ডাক দেয়, খোকনদা আরেকটা চা দিয়েন।
চা দিয়া গেলে আড্ডার কথা ভেদ কইরা নুরুল আবার ভাবনায় ডুব দেয়।
হ্যাঁ, নুরুলের আলোকপ্রাপ্তিতে বহু লোক প্রশংসা করছে। সে নিজেও বহু উপকার পাইছে। এখন তো ইনকামও করা লাগে না। ভারত সরকার মাসে মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেয়। যা দিয়া নুরুলের একা জীবন চইলা যায়। পাশাপাশি ইউটিউবে একটা চ্যানেল খুলছে। সেইখানে নানান বিতর্কিত কথাবার্তা বইলা ভিউ কামায়। ভিউ মানেই পয়সা। মাঝে মাঝে মৌলবাদীরা চ্যানেলে রিপোর্ট মারলে পয়সায় টান পড়ে। মৌলবীদের জ্বালায় বিদাশ গিয়াও শান্তি হারাম।
আশ্চর্যের বিষয় হইলো, নুরুলের নিজেকে ভণ্ড মনে হয় না। যদিও নিজেই আবার নিজের কাছে ধরা খায়। কেমনে কেমনে তার মনে হয় সে ভণ্ড না। তার কাছে যখন যেইটা মনে হইছে সে সেইটার দিকেই ঝুঁকছে। তবে মুহূর্তেই পাল্টায় নাই নিজেকে। বহু চিন্তা ভাবনা কইরা, যদি সত্য মনে হয়, তাইলেই কেবল আস্তে আস্তে সেইটার পক্ষে গেছে। নিজের যুক্তি সাজায়া নিছে। নিজেকে টোটালি সেই চিন্তার জন্য প্রস্তুত কইরা নিছে। যেন সে যুদ্ধে ঝাঁপায়া পড়বে। খালি আক্রমণই করবে না, তার প্রতি আক্রমণ হইলে যেন তা প্রতিহত করতে পারে সেইটারও আঞ্জাম কইরা রাখে।
আলেমের ছেলে আলেম হয়াও নাস্তিক হইতে পারে, দুনিয়া এমন ঘটনার সাক্ষি হয় নাই। নুরুলের বাপ আনোয়ার সাহেব মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি মসজিদের ইমামতিও করেন। নুরুলের নাস্তিক হয়া যাওয়ার পর ছি ছি রব উঠছিল। মসজিদ কমিটির কেউ কেউ আপত্তিও তুলছিল নাস্তিকের বাপের পেছনে নামাজ পড়তে রাজি না তারা। কিন্তু সভাপতি বলছিল, ছেলের পাপ তো বাপে বহন করবে না। যার পাপের শাস্তি আল্লা তাকেই দিবেন। একজনের শাস্তি অন্যজনকে দেওয়ার আমরা কে?
মাদ্রাসাতেও ঝামেলা হইছিল। নেত্রেকোনার সেই এনায়েতুল্লাহ হুজুর যে কিনা মক্তবের এক ছাত্রকে বলাৎকার করার জন্য ঢাকার এক মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার হয়া এই মাদ্রাসায় আসছে, সে মিটিংয়ে এই প্রসঙ্গ উঠাইছিল, যে একজন নাস্তিক আর ইসলামের শত্রুর বাপকে মাদ্রাসায় রাখা ঠিক হবে কিনা। আনোয়ার সাহেব সেইদিন বাসায় গিয়া অনেক কান্দিছেন। আল্লার কাছে মোনাজাত ধইরা কাইন্দা কাইন্দা বলছেন, আল্লাহ আর কিছু না একজন লাওয়াততকারীর কাছেও আমাকে ছোট বানাইলা? কী এমন অপরাধ কী গো মাবুদ?
নাস্তিক হওয়ার পর নুরুলের বাপ ভাই আর কথা বলে না নুরুলের সাথে। তার মা আর বোন বলে। মাঝেমধ্যেই ভিডিও কলে কথা হয় তাদের সাথে। মা আফসোস করে, কী এমন অপরাধ আমরা করলাম যে তুই আমাদের এত বড় শাস্তি দিলি বাবা? নুরুল বহুদিন এই প্রশ্ন এড়ায়া গেছে। কিন্তু একদিন এড়ায়া যাইতে পারল না। বইলা ফেলল নিজের মনের দুঃখের কথা। বলল, আচ্ছা মা বলো তো, এই দুনিয়ায় আসার আগে তোমরা কি আমাকে একবারও জিগাইছো, আমি নোংরা আর যন্ত্রণায় ভরা এই দুনিয়ায় আসতে চাই কিনা?
নুরুলের মা বলে, তুই তো তখন পেটের ভিতরে ছিলি, আমরা কেমনে জিগাব? জিগানো সম্ভব? তুই বল? এগুলো কোনো কথা?
নুরুল বলে, আচ্ছা জিগানোর সুযোগ পাও নাই ঠিকাছে। কিন্তু আব্বা যে আমাকে ধইরা কাঁচা কুঞ্চি দিয়া পিটাইতো, ধর্ণার সাথে বাইন্ধা পিটাইতো, শেকল দিয়া বাইন্ধা রাখতো এগুলো না করার সুযোগ ছিল না? নিজের ছেলেকে কেউ এইভাবে মারে মা?
নুরুলের মা চুপ কইরা থাকে। এক মিনিট নীরবতার পর নুরুল আবার শুরু করে। বলো এগুলো না করলে হইতো না? আমি কি এতই খারাপ ছিলাম? সিনেমা দেখা কি এতই খারাপ? ডিম চাইল চুরি করার কারণে কি নিজের ছেলেকে কেউ হাইলা পান্টি দিয়া পিটায়?
এইবার নুরুলের মা বলে, জানোসই তো, তোর বাপের একটু মাথা গরম। বেয়াদবি সহ্য করতে পারত না। তোর তো মুখ খারাপ ছিল। কী না কী বইলা গাইল পারতি। নিজের বাপেক কেউ এইভাবে গাইল পারে?
হ, পারে না। তোমরা তো মনে করো, সন্তান জন্ম দিয়া গোলাম বানায়া ফেলছো। আমাদের কোনো আশা ভরসা নাই। স্বপ্ন নাই। নিজস্ব চাওয়া পাওয়া নাই। তোমরা যা চাইছো, তাই বানাইছো। আমি যে মাদ্রাসায় পড়তে চাই নাই, তার বেলায়? কেন ওনার বন্ধু এনাম হুজুর তো ঠিকই নিজের ছেলেকে স্কুলে পড়াইছে। এনাম হুজুর কি কম পরহেজগার মানুষ? তিনি আল্লার পথে চলেন না? আমার বাপই একমাত্র আল্লার বান্দা?
দুজনের ভেতর নীরবতা নেমে আসে। কল কেটে দেয় নুরুল।
নুরুলের বাপ কড়াভাবে না করছেন, নুরুলের সাথে যেন কোনো কথা না বলেন। কিন্তু নিজেই মাঝেমধ্যে জিগ্যেস করেন, নুরুলের কথা। ফোনে নিয়মিত এমবি ভরে আনেন। মাঝেমধ্যেই বাসায় ভুলে মোবাইল রেখে যান। নুরুলের মায়ের বুঝতে অসুবিধা হয় না, এইটা উনি ইচ্ছা করেই করেন। মাঝেমধ্যে গভীর রাতে তাহাজ্জুদের নামাজে দাঁড়ায়া হাউমাউ কইরা কান্দেন আনোয়ার সাহেব। নুরুলের মায়ের ঘুম ভাইঙা গেলে, কাছে আসেন আর নুরুলের বাপের কান্না থাইমা যায়। তিনি নামাজে মনোযোগ দেন। নুরুলের মা আবার গিয়া শুইয়া পড়েন।
সবই মায়ের কাছে শোনা। নুরুলের দুঃখ হয়।
খোকনদার বিল পরিশোধ কইরা উইঠা পড়ে নুরুল।
৩
মারকুইস স্ট্রিট থেকে উঠে কলেজ স্ট্রিটের উদ্দেশে রওনা দেয়। ভাবে হাঁইটাই যাবে। ভাবা মতো হাঁটা দেয়। আধা ঘণ্টার পথ। ফুটপাথের একটা বইয়ের দোকান থেকে একটা বই খুঁজতেছিল। হাতে নাইড়া চাইড়া দেখতেছিল। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রচনাবলীর ২য় খণ্ড পুরোনো পাওয়া যাবে কিনা খুঁজতেছিল। দুই উপন্যাসই পড়ছে নুরুল। বছর দশেক আগে। দেশ ছাড়ার সময় কিছুই আনতে পারে নাই। উপন্যাস দুইটা আবার পড়তে ইচ্ছা করতেছে। পিডিএফ আছে। কিন্তু পিডিএফ পড়তে ইচ্ছা করে না। কলকাতার পাঠক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে ভালোই পড়ে। বিভিন্ন বন্ধুদের বলতে শুনছে।
দোকানদারের উদ্দেশে নাম বলতে যাবে তার আগেই দোকানদার নুরুলের মুখের দিকে তাকায়া চট কইরা বইরা বসে, “তুমি কি উর্দু বই খুঁজছ?”
নুরুল বিরক্ত হইলো। “না, বাংলার একটা বই খুঁজতেছিলাম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বই পাওয়া যাবে?”
“না বাংলাদেশিদের বই নেই। তুমি কি বাংলাদেশ থেকে এসেছ?”
নুরুল সরাসরি উত্তর দিল না। দোকানদার হাসল। একটু কৌতুকমাখা হাসি।
সে যখন বাইরে বাইর হয়া আসলো, তখনই একটা দল তার সামনে আইসা দাঁড়াল। এদের চেহারা সে চেনে। মাথায় গেরুয়া কাপড় বাঁধা, কপালে তিলক, চোখে রাগী দৃষ্টি।
“এই হুজুর! কী করছ এখানে?”
নুরুল ঠান্ডা স্বরে বলল, “আমি হুজুর নই।”
“ওহ্! তাহলে কী? পাকিস্তানি?”
নুরুল এবার বুঝল, তার কথা কাজে আসবে না। এরাই সেই লোক, যারা কেবল পরিচয়ের ভিত্তিতে বিচার করে, কর্মের ভিত্তিতে না।
তারা একপর্যায়ে ধাক্কা দিয়া ফেলে দিল নুরুলকে। তার গায়ে লাথি পড়ল, মুখে ঘুষি। আশেপাশের লোকজন তাকায়া দেখল, কেউ আগায়া আসলো না। দোকানের দরজাগুলো বন্ধ হয়া গেল।
কিছুক্ষণ পর তারা চইলা গেল। রাস্তায় পইড়া রইল নুরুল, একা।
শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণে তাদের জীবন কতটা সস্তা। গাজার মানুষ মুসলমান বলেই ভারতের অসংখ্য হিন্দু ইসরায়েলে গিয়া বিনা পারিশ্রমিকে যুদ্ধ করতে যাইতে চায়। নেতানিয়াহুর ছবি বুকে নিয়া মিছিল করে। ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুতে খুশি হয়। অথচ এইদেশে আশ্রয় নিছে এই দেশের মানুষ প্রগতিশীল বলে।
৪
৭ অক্টোবর মুফতি নুরুল ইসলামের চিন্তার পৃথিবীটাকে তছনছ কইরা দিছে। ৭ অক্টোবরের আগের নুরুল আর পরের নুরুল একই মানুষ না। দেখলে হয়তো মনে হবে, নুরুল একই মানুষ রয়া গেছে, এখনো কোরানের উপর জুতা রাইখা লাইভ করে, নিয়মিত নবীকে গালি দেয়, নবীর চরিত্র নিয়া ঠাট্টা মশকরা করে। এখন আবার নতুন একটা ডিউটি দাঁড়ায়া গেছে, একটা কিছু হইলেই বাংলাদেশ যে একটা জঙ্গি রাষ্ট্র সেই ব্যাপারে অতিরঞ্জনবাজারের মিডিয়ায় সাক্ষ্য দিতে হয় নুরুলকে। আদতে কাজটা করে আর আনন্দ পায় না। প্রথম যখন করছিল নিজ ইচ্ছায় করছিল। পরে এইটা তার রুটিন ওয়ার্ক হয়া দাঁড়াইছে। ভিসার মেয়াদ বাড়াইতে হইলে এইটা কইরা যাইতেই হবে। এক আপার কাছ থেকে এই শিক্ষা পাইছে নুরুল। সেই আপা গোপনে এই ট্রিক্সটা শিখায়া দিছেন। উনি নিজেও রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। সেইম কেইস। কিন্তু উনি আরও দুনিয়া ঘুইরা আসছেন। সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা। প্রচুর অভিজ্ঞতা। আপা গল্প করছিলেন এইসব নিয়া।
নুরুলের এইসব আর ভাল্লাগে না। একই কাহিনী আর কত? মাঝেমধ্যে ভাবে এইটা কীভাবে একজন সুস্থ স্বাভাবিক জীবন হইতে পারে! নুরুল নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। নিজের বেড়ে ওঠার সাথীদের হারায়া ফেলছে খালি না, শত্রু বানায়া ফেলছে। যারা আজ তাকে সামনে পাইলে মাইরা ফেলতেও দ্বিধা করবে না। কিন্তু নুরুলের হাত পা বাঁধা দৃশ্য অদৃশ্য অনেক শেকলে। নুরুল আর কখনোই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে না, কখনোই হাঁটতে পারবে না নিজের গ্রামের পথ ধরে। এইটা ভাবলেই নুরুলের মন খারাপ হয়া যায়। গ্রামের পথগুলি নুরুলকে ডাকে। নুরুলের সবসময় পথের কথা মনে থাকে। যে পথে একবার গেছে, সেই পথের চিহ্ন ও স্মৃতি নুরুল সহজে ভোলে না। অবসর সময়ে বারবার পেছনে ফেলে আসা হাঁটা পথের ছবি ভাসে নুরুলের মনে।
এর ভেতর ঘইটা গেল ৭ অক্টোবর। যা নুরুলকে আরও নিরুপায় বানায়া ফেলে। নুরুল নাস্তিক হয়া গেছিল সত্যকে অনুসরণ করতে গিয়াই। কিন্তু সত্য যে কত বড় শাস্তি তা ৭ অক্টোবর বুঝায়া দেয় নুরুলকে। এই তারিখটা তাকে শেষ কইরা দিলো। এখন সে এক্সে নিয়মিত ফিলিস্তিনিদের দুঃখ দুর্দশা দেইখা চোখের পানি ফেলে। তারা মুসলমান বলেই নুরুলের এই আবেগ— সেইটা নুরুলের মনে হয় না। কারণ নুরুল নিজেই যে যাপন করতেছে, যে জাহান্নামের ভেতর দিয়া যাইতেছে তা তাকে নিজের পরিচয়ের দিকে তাকাইতে বাধ্য করে।
ফিলিস্তিনিদের কষ্ট দেইখা নুরুল নিজের অসহায়ত্ব ভালো করেই টের পায়। শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণে তাদের জীবন কতটা সস্তা। গাজার মানুষ মুসলমান বলেই ভারতের অসংখ্য হিন্দু ইসরায়েলে গিয়া বিনা পারিশ্রমিকে যুদ্ধ করতে যাইতে চায়। নেতানিয়াহুর ছবি বুকে নিয়া মিছিল করে। ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুতে খুশি হয়। অথচ এইদেশে আশ্রয় নিছে এই দেশের মানুষ প্রগতিশীল বলে। এতদিন বিশ্বাস করত এরা পরধর্মকে সহ্য করতে পারে, পুরাপুরি সেকুলার রাষ্ট্র। কিন্তু ভারতে পাড়া দেওয়ার সাথে সাথে না হইলেও বুঝতে খুব একটা দেরি হয় নাই যে এদেশের সবথেকে অসাম্প্রাদায়িক লোকটাও বাংলাদেশের একটা মৌলবাদীদের থেকে কোনো অংশেই কম না।
যেই পশ্চিমা সভ্যতাকে আদর্শ মাইনা নুরুল নিজ ধর্ম বিসর্জন দিছে, সেই সভ্যতা আজ চোখের সামনে একটা গণহত্যা চালাচ্ছে। তারা অস্ত্র দিচ্ছে, মিডিয়ার সাপোর্ট দিচ্ছে, নেতানিয়াহু আরামছে ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করতেছে। আন্তর্জাতিক আদালত যার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কইরা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করছে, আমেরিকা তাকে নিয়া নিজেদের সংসদে বসায়া ভাষণ দিতে অনুরোধ করে, নেতানিয়াহু ভাষণ দেয়, তারা সবাই উঠে হাততালি দেয়, নিজেরা ধন্য হয়; এবং হোয়াইট হাউজের চাবি ইসলায়েলের কসাইয়ের হাতে তুইলা দেয়।
এই যদি হয় পশ্চিমা সভ্যতার রূপ সেই সভ্যতাকে কীভাবে নুরুল আদর্শ মানছিল?
নুরুল বহুবার ঘর ওয়াপসির দাওয়াত পাইছে। কিন্তু নুরুল ঘর ওয়াপসিতে নিজের মনের সায় পায় নাই। সে ভাইবা কুল পায় না, একটা মানুষ কতটা বোকাচোদা হইলে ঘর ওয়াপসির মাধ্যমে হিন্দু হবে আর গরুর মোত গোবর গায়ে মাখবে? ঘর ওয়াপসি ঘর ওয়াপসি যে করে ওরা, খুব তো বিজ্ঞান বিশ্বাস করে, সত্যিকারের ঘর ওয়াপসি যদি করতে চায়, নিজেরা লেজ লাগায়া হনুমান হয়া যায় না কেন? গুহায় গিয়া বসবাস শুরু করে না কেন? রান্না বান্না কইরা খায় কেন? কাঁচা খাইতে পারে না? কাপড় পরে কেন? ন্যাংটা থাকতে পারে না? যত্তসব ছাগলের দল।
ইসলাম আর মুসলমানের প্রতি নুরুলের অনিঃশেষ ক্ষোভ থাকলেও হিন্দু ধর্মকে আপন ভাবতে পারে না। খালি হিন্দু ধর্ম না অন্য কোনো ধর্মই আর ভালো লাগে না নুরুলের। নুরুল নাস্তিক হইলেও তার বিশ্বাস ইসলামের পর আর কোনো ধর্ম সে মেনে নিতে পারবে না। অন্য ধর্মের থেকে সবদিক দিয়া যুক্তিযুক্ত হওয়ার পরেও যখন ইসলামে বিশ্বাস হারায়া ফেলল তখন অন্য ধর্ম আর কীভাবে ভালো লাগতে পারে? যদিও নানান সময় তাকে খ্রিস্ট ও হিন্দু ধর্মের গুনগান গাইতে হয়। আলোচনায় টিইকা থাকতে হইলে এবং দাদাদের খুশি রাখতে হইলে না কইরা আর উপায় কী?
সারাদিন যেহেতু ধর্ম নিয়াই তার কারবার, ধর্ম থেকে দূরে থাকতে গিয়াও ধর্মের আরও কাছাকাছি থাকা লাগে সর্বক্ষণ। ধর্মভিত্তিক নানান ঘটনা দেখতে দেখতে ইউটিউবে নতুন একটা চ্যানেল খুঁইজা পাইছে নুরুল। টুওয়ার্ডস ইটারনিটি নাম। বাংলাতেও আছে চ্যানেলটা। কিন্তু নুরুল এখন ইংরেজি বুঝতে পারে। উন্নত দেশে এসালাইম পাইতে হইলে ইংরেজি জানতে হবে তো। বুঝতে পারবে এমন ভিডিও দেখতে দেখতে এখন পুরাপুরি বোঝে। কিন্তু বলতে পারে না অতটা। লিখতেও খুব একটা পারে না। গুগল ট্রান্সলেট ব্যবহার করে। কিন্তু গুগলে শান্তি পায় না। চ্যাটজিপিটি আবার বাংলাটা ভালো পারে। মানে মানুষের মত কইরাই লিখতে পারে। অনুবাদের জন্য তাই গুগল ট্রান্সলেট থেকে চ্যাটজিপিটির উপর বেশি ভরসা করে। কয়েকজন বিদেশির সাথে কথা হয়। তাদের সাথে কথা বলতে ইংরেজি ব্যবহার করে। এর বাইরে তেমন দরকার পড়ে নাই এখনো ইংরেজির। নুরুলের বিশ্বাস তারা হেল্প করবে যদি ইংরেজিটা আরও ভালো পারে।
টুওয়ার্ডস ইটারনিটিতে বিদেশিদের ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার বহু ঘটনা তার নিজের বয়ানে শুনছে নুরুল। এই জিনিসটা তাকে আস্তে আস্তে আবার ধর্মে বিশ্বাসী বানায়া ফেলবে কিনা তাই নিয়া টেনশনে আছে। যদি হয়ও, তাও আগের মতো আর ওইরকম প্র্যাকটিসিং মুসলিম হইতে পারবে না। পৃথিবীর কত দেশের কত ধর্মের কত রকমের মানুষ যে ইসলাম গ্রহণ করতেছে, এইটা ভাবতে গিয়া নুরুল পাগল হয়া যায়। শালার কী ভুলটাই না কইরা ফেলছে।
নেদারল্যান্ডসের এক পার্লামেন্ট মেম্বার, নামটা মনে নাই নুরুলের। কঠিন নাম। বেশিরভাগ বিদেশির নাম মনে রাখা যায় না। যাইহোক, একবার ইসলাম যে জঙ্গিদের ধর্ম তা কোরান ও হাদিসের আলোকে প্রমাণ করতে গিয়া দেখে যে আরে এইটাই তো আসল ধর্ম। মানে সত্যি ধর্ম। তাইলে আর কী হইলো? পরে উনি মুসলমান হয়া যান।
আমেরিকার আরেকজন লোক, ভেটেরান। ইরাকের যুদ্ধে বহু মুসলমান খুন করছে। তার ভিডিওটা ইউটিউব সাজেস্টে আসছিল। নিউ ইয়র্ক পোস্টের তৈরি একটা ডকুফিল্ম। যেইটা অস্কারের জন্য মনোনিত হইছিল। টাইটেল মনে হচ্ছে, স্ট্রেঞ্জার এট দা ডোর বা এই টাইপের কিছু। ঘটনা হইলো, সে রিটায়ার করার পরে যে এলাকায় বাসা কেনে সেই এলাকায় তার বাড়ির পাশেই মুসলমানদের একটা মসজিদ আর কমিউনিটি সেন্টার আছে। এর সামনে দিয়া গেলেই তার মেজাজ খারাপ হয়। সে বিশ্বাস করে মুসলমান মানেই টেরোরিস্ট। টেরোরিস্ট না হইলেও পটেনশিয়াল টেরোরিস্ট। যেকোনো সময় টেরোরিস্ট হয়া উঠতে পারে। তো, একদিন স্বাভাবিকভাবেই তার সামনে মুসলমান পড়ে আর তার মেজাজ খারাপ হয়। সে সিদ্ধান্ত নেয় এই শালাদের বোম মাইরা মসজিদ শুদ্ধা উড়ায়া দিবে। তো, তার বোম বানানোর অভিজ্ঞতা ছিল। প্ল্যান মতো একটা বড়সড় বোম বানায়াও ফেলে। মারবে মারবে কইরা মারা হয় না। ভাবে মারব যে আমার তো আদালতে বলতে হবে যে আমি কেন মারছিলাম। বের তো হইতে পারবই। মানে উকিল বন্ধু টন্ধু আছে। তাছাড়া রাষ্ট্রের সাবেক যোদ্ধা। যে কিনা জীবন বাজি রাইখা দেশের হয়া যুদ্ধ করছে। তাকে জামিন তো দিবেই। কিন্তু কনভিন্স তো করতে হবে। এভিডেন্স লাগবে।
এভিডেন্স জোগাড়ের জন্য মসজিদে যায় ক্যামেরা নিয়া। গিয়া ইতস্তত দাঁড়ায়া থাকে। তাকে দেইখা মসজিদের ইমাম সাব আগায়া আসে। তাকে কীভাবে হেল্প করতে পারবে জানতে চায়। কিন্তু সে কথা বাড়ায় না। চুপচাপ দেখতে থাকে কে কী করে।
দেখে কেউ মাটিতে লুটায়া পড়ে। কেউ সুর কইরা কী জানি পড়ে। যে যার মতো চুপচাপ ইবাদত বন্দেগি করতেছে। তো সে তখন কোনো এভিডেন্স না পায়া চইলা যায়। কয়েকদিন পর আবার আসে। আইসা আবারও একই চিত্র দেখে। আবার চইলা যায়। এরপর সে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করে।
প্রথমবার মসজিদে যাওয়ার ঠিক ৮ সপ্তাহ পর আবার সে মসজিদে যায় এবং এইবার সে মুসলমান হয়া বের হয়। এখন সে ওই কমিউনিটির সভাপতি।
ছোটবেলায় অনেক অমুসলিমের ইসলাম গ্রহণের সাক্ষাৎকার পড়ছে। গল্প পড়ছে। কিন্তু নুরুল সেগুলোর সব বিশ্বাস করে নাই। মনে হইছে মৌলবীরা বানায়াও তো লিখতে পারে। কিন্তু এইসব ভিডিওতে ব্যক্তি নিজ মুখে জানায়। তারা যেসব নাম পরিচয় বলে নুরুল সেসব নাম দিয়া গুগল করে। সব তথ্য সঠিক পায়। নুরুলের অবিশ্বাস করার কোনো স্কোপই নাই।
এইসব ভিডিও নুরুলের ভেতরটা ওলট-পালট কইরা দেয়। নুরুল নিজের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করে। মাদ্রাসার ছাত্র থেকে নাস্তিক হওয়া যতটা কঠিন ছিল, এখন সত্য বুঝতে পাইরা আবার মুসলমান হওয়া তার জন্য এভারেস্ট পাহাড়ের থেকেও কঠিন, অসাধ্য। সে যদি সত্যি সত্যি আবার মুসলমান হয়ও, তাতেও তার রেহাই হবে না মনে হয়। এই ট্র্যাপ থেকে কোনোভাবেই আর বের হইতে পারবে না। বের হইতে গেলে তার জীবন দিতে হবে। হয় গোয়েন্দাদের গুপ্ত ঘাতকের হাতে, নয়তো মৌলবাদীদের হাতে।
নুরুলের প্রতিটা পদক্ষেপ তারা গুণে রাখে। নুরুলের ফোনের সবই তারা দেখতে পায়। এমনকি তার থাকার জায়গাটাতে আইসাও মাঝেমধ্যে চেক করে। ডাইরি টাইরি দেখে। নুরুল বোঝে না, এত অবিশ্বাস কেমনে করা সম্ভব। মাসে মাসে বসে ২০টা হাজার টাকা সে পায় ঠিকাছে। কিন্তু ব্যক্তি-স্বাধীনতা নামক যেই হরিণের পিছনে এতদিন দৌড়াইছে, সেইটার কী হইলো? আগে যতটুকু বলতে পারত তার কিছুই এখন পারে না।
জীবন সচল রাখতে নুরুল বাংলাদেশিদের সাথে যোগাযোগ করে। বিশেষ কইরা আপার সাথে। আর মৌলভীবাজারের রাজশেখর কাকার সাথে। সেই কাকা নুরুলকে বিশেষ স্নেহ করতেন। বলতেন তোমাদের মতো তরুণরা আছে বলেই স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করে। আবুল ফজলও তোমার মতো কট্টরপন্থী পরিবারের ছেলে। কিন্তু উনিও আলোকপ্রাপ্ত হইছিলেন।
আলোকপ্রাপ্ত রাজশেখর কাকা এখন মাঝেমধ্যেই নিজ ধর্মের ছোটখাট প্রশংসা করার মতো বিষয় সামনে আনেন আর বলেন, হিন্দু ধর্ম নতুনত্ব গ্রহণ করতে পারে বলেই এর সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করে।
নুরুল আজ আপার বাসায় যাবে কিনা ভাবে। এতসব বাজে ঘটনা একদিনেই কেন ঘটবে তা বুঝতে পারে না। ভাগ্য খারাপ। এছাড়া আর কীই বা হবে। আজকেই সে ভাবল কবে না জানি গায়ে হাত তোলে, সেই দিনটা আজকেই হবে কেন? কো-ইন্সিডেন্স?
ব্যথা করতেছে। কাছের কোনো ফার্মেসীতে যাবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মুখে নোনতা নোনতা লাগে রক্ত। এভয়েড করতে চায় শরীরকে। ভাবতে চায় এই শরীর তার না। এক বন্ধু এইটা তাকে শেখাইছিল। যদি খুব যন্ত্রণা হয়, তখন মনে করবি এই শরীর তোর না। তাইলে দেখবি ব্যথা কমে গেছে। নুরুলের ব্যথা কমে না। সে হাঁটতে থাকে।
বাসা থেকে বের হওয়ার আগে নক দিবে ভাবছিল। কয়েকদিন ধরেই নক দিবে দিবে কইরা দেওয়া হয় নাই। নুরুল ভাবে যাওয়ার আগে নক দিলেই হবে। আবার ভাবে দেই, যদি না থাকে বাসায়, অন্য কোনো প্রোগ্রাম থাকে তাইলে তো বিপদ। নুরুল তাও ফোন দেয় না। এই ভাইবা বইসা থাকে যদি না থাকে তাইলে আর কি অন্য কোথাও যাবে। কলেজ স্ট্রিট থেকে আপার বাসা হাঁটা দূরত্বে ১০ মিনিট।
হাঁটতে হাঁটতে ফোন দেয়। আপা যাইতে বলে। নুরুল ভাবে আজকের অভিজ্ঞতা আপার সাথে শেয়ার কইরা মনের দুঃখ হালকা করবে। আপা কী বলতে পারে? উনি তো খুব প্রতিবাদী মানুষ। করতে পারবে প্রতিবাদ? নুরুল শিওর না। তবে সে নিজের কথা বলতে পারে, এই দুঃখের কথা সে সোশ্যাল মিডিয়ায় বা অন্যকোনো জায়গায় বলতে পারবে না।
যাইতে যাইতে পথে আপাকে নিয়া ভাবে নুরুল। প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে।
প্রথম যেদিন নুরুল ইসলাম আপার সাথে দেখা করে সেইদিন আপা তার মনের ভয়ের কথাটা লুকায় নাই। বইলা ফেলছিল। যেমনটা আপার স্বভাব। বলছিল, বুঝছো মুফতি সাহেব, আমি জানি তুমি মুক্তচিন্তার মানুষ, আমার অনুভূতি হয়তো তোমার খারাপ লাগবে না, লাগতেও পারে, এই জন্যই আগেই সতর্কবার্তাটা দিলাম। তোমাকে প্রথম দেখায় ভয়ই লাগছে আমার, মানে তোমাকে তো আগে ছবিতে দেখেছি। কিন্তু সত্যি সত্যিই যখন তুমি সামনে এসে দাঁড়ালে মনে হলো, তুমি একজন মোল্লাই, যেকোনো মুহূর্তেই হয়তো লুকায়া রাখা চাকুটা বের কইরা আমার কাল্লাটা ফালায়া দিবা। বুঝছো, সারাটা জীবন যাদের ভয়ে নিজ দেশ থেকে দূরে থাকলাম, তাদেরই একজন আমার সামনে দাঁড়ায়া আছে। কিন্তু তুমি তো আলোকিত মানুষ।
নুরুল হাসে। মনে দুঃখ পায়। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না।
আপা নুরুলকে সেক্সের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু নুরুল লজ্জা পায়। মাদ্রাসার ছাত্র। সারা জীবন নারীদের থেকে দূরে থাকছে। সেক্স করা কোনো ঘটনা না তার কাছে। সে যে ভার্জিন তাও না। মাঝেমধ্যেই পতিতালয়ে যায়। কিন্তু এইবার স্বভাব তাকে বাধা দেয়। তাছাড়া একজন বৃদ্ধা মহিলার সাথে সেক্স করার আগ্রহ নুরুলের কীভাবেই বা হবে। সে পতিতালয়ে গিয়া কম বয়সী মেয়েই সবসময় পছন্দ করে। এই রকম বৃদ্ধার সাথে শোওয়ার কথা কল্পনাও করতে রাজি না।
যদিও আপার লেখা সেই বালেগ হওয়ার পর থেকেই পড়ে নুরুল। আপার একটা দারুণ ছবি নুরুলের মনে গাঁথা আছে। কত যুক্তি আর জ্ঞান পাইছে আপার লেখায়। আপা যে এমন মাইন্ডের তা নুরুলের অজানা না। কিন্তু নুরুল প্রস্তুত না আসলে। এই বয়সেও কেউ সেক্স করার জন্য পাগল থাকে! নুরুল ভাবে, মানুষের জীবনের কীইবা জানে সে। তাছাড়া সে মেয়েও না। ওই বয়সও তার হয় নাই।
নুরুলের নানার কথা মনে পড়ল। যে কিনা এলাকার সম্মানিত মানুষ। কিন্তু ৭০ বছর বয়সে নিজের ধর্ম মেয়ের বাড়িতে লুঙ্গি রাইখা আসছিল। এবং এই নিয়া কী গজবা কা বেইজ্জতিই না হইছিল।
ন্যানো সেকেন্ডের ভেতর এইসব মনে পড়ে নুরুলের। আপাকে কী বলবে বুঝতে পারে না। বলেও তা, আসলে আপা কী বলব বুঝতে পারতেছি না। হাসে নুরুল। হ্যাঁও করে না, নাও করে না।
আপা নাছোড়। সেক্স না করলে ভালো লাগে না তার। কত রকম এক্সপেরিমেন্ট যে করলেন জীবনে, কত রকম পুরুষের সাথে যে শুইলেন, তবু তার সাধ মিটল না। একজন হুজুরের সঙ্গে, বাস্তবে যে মূলত নাস্তিক, কিন্তু বেশভূষায় হুজুর তো, দাড়ি টুপি সব আছে, তার সঙ্গে সেক্স করার লোভ সামলাতে পারেন না আপা।
আপা ইয়ার্কি ছুইড়া দিয়া নুরুলের ইমান যাচাই করে, আরে নবীর সুন্নত তো পালন করা হবে। তোমাদের নবীও তো তার থেকে ডাবল বয়সী মহিলার সাথে সেক্স করছেন। তুমি একটা সুন্নতের সোয়াব হাসিল করবা না?
নুরুল ইসলাম হাইসা বাঁচে না, আরে তাই তো। সুন্নত তো পালন করাই যায়।
আপা আশ্বস্ত হয়। যাক, বেটা আসলেই নাস্তিক। কিন্তু আপার মনের খুতখুতানি যায় না, বাস্তবেই কি একজন আলেমের নাস্তিক হওয়া সম্ভব? আপার জেদ চাইপা বসে। নুরুলকে তার পাইড়া ফেলতেই হবে।
কিন্তু নুরুল আমতা আমতা করে। এড়ায়া যাইতে চায়। বলে, আপা আসলে আজ আমার মন ভালো নাই। আরেকদিন করব নি। আজকে অলরেডি ৫বার হ্যান্ডেল মারছি। আর একবার করলে আজ আর বাসায় ফিরতে পারব না।
আপা মুচকি মুচকি হাসেন, হুজুর, তুমি তো মনে হচ্ছে রিয়েল নাস্তিক না। আবার রিয়েল হুজুরও না। নবীর সুন্নত মানলে না হয় বুঝতাম তুমি হুজুর। নাস্তিক হইলেও তো সেক্স করতে পারো।
নিজের মনের কথা বইলা ফেলেন আপা। কিছুটা ক্ষোভ থেকেই। জীবনে হাজার হাজার পুরুষের সঙ্গে শুইছেন, কিন্তু প্রত্যাখানের সংখ্যা খুব বেশি না। হাতে গুইনা ফেলা যাবে। প্রথমবার এক হিন্দু রিকশাওয়ালা প্রত্যাখান করছিল। আপা বিশ্বাসই করতে পারেন নাই। একজন রিকশাওয়ালা কীভাবে মৌলবাদীদের মত অপর নারীকে ভোগ করার সুযোগ পায়াও হাতছাড়া করে!
আপার মনে হয়, রিকশাওয়ালার অশিক্ষাই দায়ী ছিল। মৌলবাদীরাও তাই। অশিক্ষা ছাড়া আর কী এমন জিনিস আছে যা নারী-পুরুষের দেহের ভেতরের জাদু উপভোগ করা থেকে বিরত রাখতে পারে।? পুরাই অশিক্ষিত আর অভাগা। সেইম ঘটনার আপার ক্ষেত্রেও। ভাগ্যে বিশ্বাস না করলেও ভাগ্য সংক্রান্ত শব্দ ব্যবহার করতে দ্বিধা করেন না আপা। বহু আগেই সমাধানে পৌঁছে গেছেন, এইসব শব্দে তার বিশ্বাসের কোনো কিছুই যাবে আসবে না।
আপা অপমানিত বোধ করেন। কিন্তু তা প্রকাশ করেন না। একজন হুজুরের কাছে, যে কিনা আসলে হুজুর না, নাস্তিক না ছাই, তার সঙ্গে শোয়ার প্রস্তাব নাকচ কইরা দিছে, আপা মর্মে মইরা যান। কিন্তু তা আর বুঝতে দেন না।
নুরুল ইসলাম পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বলে, বুঝছেন, আমরা ছোটবেলায় মাস্টারবেট করাকে হ্যান্ডেল মারা বলতাম।
আপা অপমানের হাত থেকে বাঁচার জন্য নুরুল ইসলামের খেলায় শামিল হন, তুমি নাকি মসজিদেও ওইটা, হ্যান্ডেল না কি যেন বললে, হ্যাঁ হ্যান্ডেলই তো, মসজিদে হ্যান্ডেল মারছো? এইটা কি সত্য? মসজিদে হ্যান্ডেল মারার অনুভূতি কেমন?
নুরুল ইসলাম বলে, তেমন কিছু না, স্বাভাবিকই ছিল। আরো অনেকেই করত। বুঝছেন, একবার কী হইছে, মসজিদের কথা মনে পড়ায় নুরুলের অন্য এক ঘটনার কথা মনে পইড়া যায়, বিরাট বড় এক মাদ্রাসার দাওরা হাদিসের সব ছাত্রদের মসজিদ থেকে বের কইরা দিছিল। দাওরা হাদিস তো মনে হয় বুঝবেন না, দাওরা পাস করলেই আলেম হওয়া যায়। তো, তাদের কেন বের কইরা দিছিল জানেন? শুনলে আপনি বিশ্বাস করবেন না।
আপা বলেন, তাই নাকি, বলো দেখি।
নুরুল বলে, মাদ্রাসায় ভবন কম থাকায় তিন তালা মসজিদের ওপরের তলাটা দাওরা হাদিসের শ দুয়েক ছাত্রকে থাকতে দিছিল। ওইখানে ক্লাস হতো। তো, মাদ্রাসায় মোবাইল ব্যবহার করা নিষেধ। ধরতে পারলে বহিষ্কার কইরা দেয়। মোবাইল ব্যবহার করলে নাকি পড়াশোনায় মন বসবে না। কওমি মাদ্রাসা মানে তো জানেন। জনগণের মাদ্রাসা। জনগণের টাকায় চলা মাদ্রাসায় পড়াশোনা না কইরা টাকা সময় নষ্ট করাকে হুজুররা মানতে পারে না। মোবাইল ধরার জন্য মাঝেমধ্যেই ছাত্রদের রুম চেক করে। তো একবার মসজিদেও রেইড দিলো। দাওরার ছাত্রদের প্রায় সবার কাছেই মোবাইল থাকে এইটা ওপেন সিক্রেট। কিন্তু কী মনে কইরা ওইবার মসজিদেও রেইড দিলো। স্বাভাবিকভাবেই সবার মোবাইল ধরা পড়ল। তো, আশ্চর্যের ঘটনা ঘটল যখন হুজুররা মোবাইলগুলো চেক করল। চেক কইরা দেখা গেল, শতাধিক দাওরার ছাত্রের মোবাইলে পর্ণমুভি।
৫
সেদিন কলকাতা বইমেলায় মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাথে দেখা। দেখা বলতে চোখে পড়ল, মনে হইলো মহিউদ্দিন ভাইও দেখছে। প্রথমে ভাবল নুরুল, সামনে পড়লেও দেখা করবে না, কথাও বলবে না। কিন্তু তার উপকারের কথা মনে পড়ল। উপকারীকে কখনো ভোলে না নুরুল। কিন্তু উপকারী যদি সামান্য উপকারের বিনিময়ে নুরুলকে গোলাম মনে করা শুরু করে তখন নুরুল তাকে গোণায় ধরে না।
নুরুল আগায়া গেল মহিউদ্দিনের দিকে। দুজনের কেউ খুশি হইলো সেইটা কারো চেহারা দেইখাই মনে হইলো না। দুজনেই সমচিন্তার মানুষ হিসাবে সম্পর্ক শুরু হইছিল। এখন দুজনের ভাবনা দুইরকম।
উনার সাথে পারসোনাল বিষয় শেয়ার করত নুরুল, এখন আর করে না। এক সময় এই মানুষটাকে সে বিশ্বাস করত। নিজের দ্বিতীয় বইটা তাকেও উৎসর্গ করছিল নুরুল। মাঝেমধ্যে নিজের ভাবনার কথা শেয়ার করত। নুরুলের চিন্তার পরিবর্তন সে টের পাইছে। নুরুলের ভেতর কিছু একটা ঘটতেছে। ফলে দুজনের ভেতর অবধারিত দূরত্ব তৈরি হয়া গেছে।
মহিউদ্দিন ভাই নুরুলকে বললেন, আপনি ইদানিং আবার মৌলবাদী হয়া উঠতেছেন নাকি? আপনি নাস্তিক হয়া গেছিলেন। ফিলিস্তিনিদের নিয়া কথা বলতে গিয়া তো আবার মুসলমান হয়া যাবেন না?
এমনভাবে বললেন যেন মুসলমান হওয়াটা লজ্জাজনক। নুরুল এই বিষয়ে কোনো কথা বলল না। ভয় পায়া গেল। নুরুল যতই সাহসী হোক, তার ভয় সবকিছুতে। সবকিছুকেই তার অবিশ্বাস। যাকে বিশ্বাস করত সেই মানুষটাকে এখন ভয় লাগতেছে। এই মানুষটা আবার তার কথা বলবে না তো গোয়েন্দাদের? ভিসার মেয়াদ বাড়াইতে আবার সমস্যা হবে না তো?
মহিউদ্দিন ভাই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান হইলেও তার ভেতর মুসলমানের কোনো আলামত নাই। এবং লেখালেখির জন্য ভালো পজিশনেই আছে। একটা বড় কোম্পানিতে বেসরকারি চাকরি করে। নবীকে গালি দেওয়া নুরুলের ভিডিও দেইখা সে যোগাযোগ করছিল। এমনকি এসালাইম পাইতেও হেল্প করছে।
পরোপকারী মানুষ। নিজেকে একটু বেশি কুলীন মনে করে। নুরুলের মনে হইছে, মহিউদ্দিন ভাই নিজেকে প্রকৃত সংস্কৃতিমনা মনে করে। এই ধরনের মানুষগুলোর ভাবসাব দেইখা মনে হয়, এরাই কেবল সুশিক্ষিত। বাকিরা ধইঞ্চা। অশিক্ষিত।
মুসলমানের নিজস্ব রাজনীতি থাকতে পারে না। মুসলমানের কোনো সংস্কৃতি নাই।
হ্যাঁ সত্যকে অনুসরণ করতে গিয়া নুরুল নাস্তিক হইছিল, কিন্তু আবার যদি সত্য তার সামনে ভিন্নভাবে ধরা দেয় নুরুল কি তা গ্রহণ করবে না?
৬
আপার বাসার কাছে পৌঁছে মনে হইলো ঢুকবে না বাসায়। ভাবে কল দিয়া না করবে। ফোন বের কইরা কল দিতে গিয়াও দিল না। ভাবল বাসায় গিয়া পরে মেসেজ কইরা বলবে।
নিজের শরীরের দিকে আবারও খেয়াল করে। হাঁটুতে লাগছে, ঠোঁট কেটে গেছিল, এখন রক্ত জমাট বাঁইধা গেছে। হালকা ক্ষত। সবচাইতে বেশি ক্ষত তৈরি হইছে মনে।
নিজের চিন্তার এই জার্নিতে নিজেই অবাক হয় নুরুল। নিজের ধর্ম নিয়া বিতৃষ্ণা আসছে, বিদ্বেষ আসছে, একটা সময় মনে হইছিল সব ধর্মই ভণ্ডামি ছাড়া কিচ্ছু না। কিন্তু আজকের অভিজ্ঞতা তাকে নতুন কইরা ভাবাচ্ছে। এই একদিন যেন হাজার বছরের সমান হয়া গেল।
যাদের কাছে সে পালায়া আসছে, তারা তাদের চাইতে আলাদা তো না-ই, বরং অনেক সময় আরও নির্মম, আরও সাম্প্রদায়িক।
সে নিজের অস্তিত্ব নিয়া ভাবে। কে সে? তার কী পরিচয়?
সে জানে, ধর্মবিশ্বাস নাই তার। কিন্তু বাইরের দুনিয়ার কাছে পরিচয় এত সহজে মুছে ফেলা যায় না।
সে বুঝতে পারে—সে আসলে একটা গোলাম রোবট। চিন্তা করতে পারে, অনুভব করতে পারে, কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। পরিচয়ের শৃঙ্খল তার চারদিকে জড়ায়া আছে।
কলেজ স্ট্রিটের আলো ঝাপসা হয়া আসতেছে।
নুরুল ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে।
[রচনাকাল: ফেব্রুয়ারী, ২০২৫]
হুসাইন হানিফ
জন্ম ও বেড়ে ওঠা বগুড়ায়। গল্প ও প্রবন্ধ লেখেন।
প্রকাশিত গল্পের বই: বহিষ্কার।