হিজল জোবায়েরের কবিতা

আদিম পুস্তকে এইরূপে লেখা হয়েছিল


বজ্র-বৃষ্টির দিনে— বহুপুরাতন জল ভেদ করে তুমি এলে— পত্রমোচীর নিচে পুদিনা ও মাছ— দরবেশ, তোমার বাসিমুখ তুমি শালপাতায় মুছে আসো— তোমার বাসিগন্ধের মুখ। এইবার— ছাই আর পারদ, সমুদ্রগর্ভ থেকে শত বছরের হারানো জাহাজ উঠে আসে কলকব্জাসমেত— ছাইবর্ণ কেমন উপত্যকা

 

জলস্তম্ভ পেরিয়ে ভূমি                                      অবশেষে                                         জলস্তম্ভ পেরিয়ে তুমি

 

স্থলে তুমি, সমুদ্রগর্ভে ছায়া, ঐ কলে-কব্জায় জড়ায়-জাপটায়, আয়তাকার ক্ষেত্র রচনা করে। তোমার আলখাল্লায় লুকানো আদিম পুস্তক তবে বিবেচ্য হোক, তবে হোক সমুদ্রবিস্ফার— অগণন বিস্ফোরণে তোমার পুরুত্বহীন ছায়া পুনরায় কোথায় তলিয়ে গেছে, আজ আর তুমি খুঁজেও পাবে না— পেলেও যদিবা, ছায়া থেকে শরীর গঠনের কোনো কৌশল শেখোনি তুমি। তোমার ছায়াখণ্ড, তমসাসম্বলিত, আলোকের উপস্থিতিহীন, না জানি কোথায় ঘুরে বেড়ায়; অগণন বর্ষণ ও বিস্ফোরণের শেষে প্লাবনে ‘প্লুত তোমার ছায়া।

 

হে মহৎ তান্ত্রিক, তুমি বলো, সমুদ্রের নোনা বাতাসের ভিতর উৎসহীন, অভিভাবকহীন তোমার ছায়াটি কি পচে উঠছে কোথাও, মুহুর্মুহু বর্ষণের নিচে? গন্ধ ছড়াচ্ছে সমুদ্রের ভেজা বাতাসের ভিতর? যদি নাই জানো, যদি নাই— বজ্র-বৃষ্টির দিনে বহুপুরাতন জল ভেদ করে তুমি যাও, তুমি চলে যাও নিমজ্জমান ধাতুখণ্ডের সাথে— তোমার পরিণতি সাংকেতিক, নিয়তিনির্ভর

 

আদিম পুস্তকে এইরূপে লেখা হয়েছিল।।

 


পরবাস


প্রতি পূর্ণিমাতেই চড়ে টাট্টু ঘোড়ায়

আমি দূর বনে যাই, শীতে মশলা বনের—

পাশে পুত্রসমেত আমি ভুট্টা ফলাই,

দেখি শান্ত নদীর জলে মার্কারি রং

মৃদুমন্দ বাতাস, যদি জাগছে শরীর

যদি যৌনকাতর আমি পুত্রসমেত—

ফুলে গর্ভকেশর— ভুলে তাই ছুঁয়ে দেই

যদি বিগড়ানো যায়, যদি বিগড়ে হৃদয়

পিতা পুত্রসমেত আমি মশলা বনের

গাছে ঘষছি শরীর, গায়ে গন্ধ ফুলের;

কাঁপে, ঘর্ষতাপে কাপেঁ— জীর্ণ হৃদয়

কাঁপে আত্মা ও প্রাণ, দূরে উল্কাপতন

 

খেলে শান্ত নদীর জলে

মার্কারি রঙ…

 


উপকথা


বোঁটা-ছিন্ন ফলের মতো সমস্ত দিনের থেকে সূর্যকে ছিঁড়ে ফেলা হলো— নিক্ষেপ করা হলো রাত্রির অন্ধকারে। আমাদের পরিশ্রান্ত শরীর, রাত্রির প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে পড়লো যার যার ঘরে— স্ত্রী আর মায়েদের, ফুপুদের কাছে। বৃষ্টি হবে আজ, মধ্যরাতে বাইরে ফেলে আসা শক্ত লালমাটির উঁচু জমিগুলো, শুকিয়ে আসা ঘাসের শিকড়গুলো ভিজিয়ে চলবে বৃষ্টির অব্যাহত খনন; আমাদের স্বপ্নের ভিতরেও বৃষ্টির ছাঁট পৌঁছে যাবে সময়মতন। একটানা বৃষ্টিতে সঙ্গীহারা মানুষের মতন আর্তনাদ করবে খ্যাপাটে বাতাস

 

এখন অন্ধকারে, আমাদের বাচ্চারা মাতৃভূমি আর বীরদের গল্পে ডুবে আছে, বিস্মৃতিপ্রবণ বুড়োরা তাদের শোনায় যার যার স্মৃতি আর বিস্ময়ের গাথা—

 

সেইসব দিনগুলোর কথা, যখন অচেনা অভিভাবকের মতন সমুদ্রে তারা ভেসে বেড়াতো আর সমুদ্র গর্জাতো, অতিকায় ইঞ্জিন। সেইসব দিনে কী এক আনন্দে প্রায়ই তাদের বুকের ছাতি এতো বিশাল হয়ে ফুলে উঠতো যে, চাইলেই সেটা দিয়ে একটা মাঝারি জাহাজের পাল খাটানো যেতো। সমুদ্রে যেতে যেতে রূপকথার মতন কতো-না গল্প, অথচ সেগুলোতে মানুষের বিশ্বাস কেমন অটুট! সেই যে একটা গল্প— সমুদ্রে নেমে কোন্‌ মহিলা সাবানের ফেনায় তার যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করছিল, তখন হুট করে তা খসে পড়লো, আর একটা তারামাছ হয়ে ভেসে গ্যালো সমুদ্রের গভীরে, একেবারে নাভির দিকে।

 

কিংবা সেই লোকটা, যে বাড়িতে তার স্ত্রীকে মাছ কুটতে দেখে গ্যালো সমুদ্রে গোসল করতে, ডুব দিলো, কিন্তু ভেসে উঠলো এক রূপসী অষ্টাদশীর শরীর নিয়ে। আপনা মাংসে হরিণা বৈরী— রূপ হলো কাল, রূপে পাগল হয়ে উঠিয়ে নিলো এক সওদাগর, রূপসীর সেখানে বারো বছর ঘর হলো, তিন-তিনটা সন্তান, অবশেষে একদিন আবারও সেই সমুদ্রে গোসলে এসে দিলো ডুব, আর ভেসে উঠলো বারো বছর আগের পুরুষ হয়ে— লোকটা বাড়ি ফিরে যেয়ে দেখে, তখনও তার স্ত্রী ঐ মাছ কুটছে, গোসলে যাবার আগে সে যেভাবে দেখে গিয়েছিল— অথচ এর ভিতর কেটে গ্যাছে বারোটা বছর!

 

সময় এভাবে যায়। ক্ষণকালে রুয়ে দেয়া সময়ের রুহ্‌! শোকগাথার হরফে বৃষ্টি অবিরাম। আমাদের মায়েরা সব জেনে-বুঝে তবু তারা তুলছে না উঠানে মেলে রাখা শুকনা কাপড়, মশলার ঝুড়ি। সবাই কেমন কাটিয়ে দিচ্ছে রাত নীরব, নির্বিকার, প্রস্তুতিহীন।

 


মেঘের মেশিন


বৃদ্ধ ষাঁড়ের খুর

তৃণভূমি কতদূর

জাইলেম জাইলেম

তৃণভূমি জাইলেম

 

জিপসাম ফেনা থেকে ভেসে ওঠা মুখ

কহে বাপু, সুরে গাও

ঐ-মুখো ঘুরে গাও

জাইলেম জাইলেম

তৃণভূমি জাইলেম

 

আর কাঁটা ছিল না

তারকাঁটা ছিল না

বিন্যাস ছিল;

সয়াবিন ফুলের বাগান ছিল নিরঙ্কুশ পাতনযন্ত্রে ঘেরা। শস্যের ভিতর ছিল অভিশাপ— অব্যাহত মেশিন প্রবাহের মুখে প্রার্থনার চাদর উড়ালো যারা, সেইসব মানুষেরা প্রার্থনার ভঙ্গি থেকে উঠে আসে বিবেচনাহীন—

 

স্বয়ম্ভূ তারা শৃঙ্খলাহীন

নিরাশ্রিত ঈশ্বরহীন

তাহাদের মর্ম নিরুপণ,

কর্মের মর্ম নিরুপণ

এইসব-সকল-সমূহ গুরুত্বহীন বিবেচনা পর

পরিত্যক্ত তারা

পরিত্যক্ত মানুষেরা তবে রূপক হয়ে ওঠে— শব্দ!

শব্দোত্তর তবে ধ্বনি

তথাগত ধুলায় ছড়ানো দিনে, একটি দোলনকালের ভিতর দুলে ওঠা তারকানিচয়— তরঙ্গে ভাসা স্মৃতি— তথাগত ধুলায় ছড়ানো দিনে আকাশ ফুঁড়ে বেড়ে ওঠে লোহার মিনার— জাহাজের ভার বহে নদী

 

জাইলেম জাইলেম

তৃণভূমি জাইলেম

 

এই উপজীব্য—

গড়ে ওঠে লোকালয়— বাতাসে অর্পিত পাখি, পাখিসব চলৎশক্তিহীন— প্রণালীসমূহ, এইসব প্রণালীতে পুঁতে রাখা চোখ, জলে আর্দ্র— এই উপজীব্য

 

নেপথ্য থেকে উড়ে আসে কফিন

বৃহদন্ত্রময় মৃত এক জন্মপত্রহীন

বিনষ্টিহীন

সস্তা-কফিন

সস্তা-কফিন

তলদেশহীন

মধ্যাহ্ন উগরে আসে নদী— প্র ল ম্বি ত হয়

বাতাসে তখন প্রদাহনাশক

অ্যালোভেরা

উৎকৃষ্ট মধুভরা গাছ

গাছের বাকল

 

এই উপজীব্য—

অতিক্রান্ত জলরাশির ভিতর

শূন্য হয়ে আসে বিগলিত রৌপ্যে ঠাসা হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া

 

তথৈবচ

আজবার গুপ্তহত্যার ছুরি

বাতাসে ছড়ানো আজ লোধ্ররেণুর দিন

আজবার আকাশ ক্রমশ ঢেকে ফ্যালে

বজ্রোৎপাদনশীল মেঘের মেশিন

 

 


ঔম্‌ প্রাঙ্‌মুখ


হুহুম হুহুম না

মধ্যাহ্নের শববাহকেরা শব ফেলে গ্যাছে আধঘাটায়

হুহুম হুহুম না

হঠাৎ বৃষ্টি শ্রাবণ মাসের দিকে

 

একূলে তরঙ্গ বহে অসীমের ধরা প্রেক্ষাপট

ওকূলে বহিয়া চলে নাতিধীর গোষ্ঠশকট

 

হুহুম হুহুম না

জংলা নদীর বিপরীত স্রোতে শার্দূল সাঁতরায়

 

কেঁপে কেঁপে ওঠে এপিলেপটিক

ঘুমের মধ্যে তাড়িখোর মানুষেরা,

শ্লেষ্মায় বাঁচে, ঘুমের মধ্যে কাশি;

বাঁধ ভেঙে যায় বন্যাপ্রবণ নদী—

নদী ঘিরে রাখা বিদ্যুৎ-কাঁটাতারে

বিপরীত স্রোতে গুলবাঘ ফিরে যায়

 

আলো নিভে গ্যাছে, পাহাড়ে এসো না

মাহুত বনের হাতি নিয়ে গ্যাছে মেঘালয় পাড়ি দিয়ে—

আরও দূর দূর অবহ সুদূর পাহাড়িয়া বন্দরে

 

হুহুম হুহুম না

হাহাকার হয়ে ডগিয়ে উঠছে লতা,

তোমার লতানো বাহু বেয়ে যেন রাতে চাঁদ নেমে আসে

হুহুম হুহুম না

তোমার লতানো বাহু বেয়ে যেন সূর্যটা উঠে আসে

 

ঔম্‌ প্রাঙ্‌মুখ

সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু

ঔম্‌ প্রাঙ্‌মুখ

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ

 

সময় আসিয়া অকূলে বহিয়া যায়

আগুন-ডানার পাখি ফল ভেবে সূর্য ঠুকরে খায়

 

ঔম্‌ প্রাঙ্‌মুখ

তেপান্তরের টিলা—

বাতাস ঘিরে পাখির চংক্রমণ

 

অন্ধ-পীরের দরগায় একা গেরুয়া নিশান ওড়ে

 

ঢেউয়ে ভর করে ভেসে যায় নদী

দীর্ঘ শুষ্ক অনাবৃষ্টির দেশে,

ফেলে দিয়ে আসা বস্তার মুখ খুলে যায় অবশেষে

 

বিপরীত স্রোতে মার্জার সাঁতরায়

 


কবি পরিচিতি

কবি হিজল জোবায়েরের জন্ম ৩ মে ১৯৮৭ সালে।

প্রকাশিত বই:

আদিম পুস্তকে এইরূপে লেখা হয়েছিল (২০১৫, চৈতন্য)

ধূলিপবনের দেশ (২০১৮, মেঘ)

জলপাই পাতার নিশান (২০২২, বাতিঘর)

শেয়ার