রিমঝিম আহমেদের কবিতা

কথার জোনাক


বিনা বাতাসে ভেতর থেকে এত এলোমেলো হই!

এত কথার জোনাক! নিজেকে পুড়িয়ে ভস্ম হয়–

শেষ করে আয়ু! আশৈশব ছায়া ফেলেছিল

বুকে প্রগাঢ় জঙ্গল, মত্ত-ফড়িঙ-প্রবণতা

সব জট লাগে আজ। আটকে আছি ফলের খোসায়

বুঝি না ভেতরে কত বীজ পলাশের-শিমুলের

মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, কথা বলছে চিবুক নাচিয়ে

 


একদিন


একদিন        জোনাকপোকার পিছুপিছু

একদিন        পাতার নাচন দেখে দেখে

বাঁকানো       ঠোঁটের উপকূলে ভাঙা চাঁদ

কিছুদিন       আরও নদীর জলের মতো

উত্তাল         জ্বরের তাপ বুকে ধরে রেখে

দগ্ধ            প্রেমের কবিতা উজ্জ্বল উদ্ধারে

নেমে পড়ব   তুমি আমি। পাখিবৃত্তে

কোত্থাও       বন্ধন নেই। নির্বন্ধনও নয়

যেন কিছু      দূরত্বের প্রেম থেকে আলো

আসে, আর   নুয়ে পড়ে ঘাসে। তোমার চিবুকে

পাখিরাও      কী আশ্চর্য! মূর্খ একেবারে

আমাদের     মতোই, ঈদের আনন্দে ঘোরে

 


পিঁপড়েছন্দ


কে যে তার মর্ম বোঝে

কে যে দেয় আগুনে ফুঁক

শরীরে জন্মক্ষত

প’মন্ত বৃষ্টি নামুক

 

ব্যাসার্ধ মাপতে এসে

দৈর্ঘ্যও ছুঁয়েছে যে

তাহাকেও আস্কারা দিই

ছায়া-রোদে অনায়াসে

 

সে যেন লাউয়ের ডগা

বাড়ছেই তরতরিয়ে

দখলের বিদ্যা শিখে

আমাকেও দেয় সরিয়ে

 

তাকেও তো আসতে বলি

ভাঙাচোরা মাটির ঘরে

আমাদের গল্পগুলো

কথা বলে নীচুস্বরে

 

পাহাড়ি পথের বাঁকে

বিষণ্ণ পাতার বাঁশি

কে বাজায়, কে দিচ্ছে ডাক

কে রাক্ষুসে সব্বনাশী

 

নিজেরই রক্তনালি

শুষে হই পরিপুষ্ট

মানতের হিজলফুলে

মালা গেঁথে হই দুষ্ট

 

দুরন্ত পিঁপড়েগুলি

গিলে খায় চোখের মণি

কী নরম অন্ধকারে

খুলে দেয় বিষেরখনি

 

পাথরের ঠোঁট ছোঁয়াতেই

কে যেন উঠল কেঁপে

হৃদয়ের রত্নখনি

গোপনে কে নেয় মেপে!

 

এসবই ভাবের কথা

সবকিছু ভুলিয়ে রাখে

রূপকথা, ডালিমকুমার

সে কেবল গল্পে থাকে।

 


প্রেমহীন প্রেমের কবিতা


দূরে সরে আসি। দূর, সম্পর্কের অধিক সুন্দর

জলের ফোঁটার মতো বেজে যায় চিরচেনা স্বর

 

ডাকছে ধানের মাঠ, বৃষ্টিহীন আকাশটা ছাতা

এমন বিচ্যুতি, যেন, গাছ থেকে ঝরে পড়া পাতা

 

কত দৃশ্য ডুবে যায়! ঠিকানা খুঁজিনি তবু তার…

বিরহ বাতাস বয়। দুটি মন– এক কাঁটাতার

 

দেখা হোক সহজ সন্ধ্যায়– মিলনের সম্ভাবনাহীন

এতটাও সহজতা রপ্ত করা জটিল, ভীষণ!

বেকসুর কুর্চি ফুটে ডুবে যায় দৃশ্যের অধীন

এ কি সমুদ্রের শূন্যতা ছুঁতে জলের অনশন!

 

ঘুম নয়, লেখা থাক, যা-কিছু ঘুমের কাছাকাছি

স্পর্শের অধিক কিছু থাকে যদি সে আশায় বাঁচি

 

দৃশ্যের মৃত্যুর পর আরও দৃশ্য হয়ে ফুল ফোটো

কাছাকাছি দুঃখের মতো তুমি আপন হয়ে ওঠো

আমার রাতের পিঠে তোমারও কি রাত লেগে থাকে?

দুজনের ভিন্ন গাছ, ফল তবু একসাথে পাকে।

 

দূরত্ব বেড়েছে তাই কালো-মেঘে মাখামাখি মুখ

বিরহী কাদার গায়ে লেগে থাকে মাতাল শামুক

প্রেমের বাতাস লেগে কাঠের ডালিমও পেকে যায়

শুধু কেউ রাত জেগে বিরহ বপন করে বুকে

নির্বাণ পেয়েছে ভেবে, নিজের টুকরো নিজে খায়

আহত ঘোড়ার পিঠে রাত লেখে রক্তাক্ত চাবুকে

 

লালসার চিহ্ন জিভে– উদোম দুপুরপোড়া চর

বাতাসে হেলান দেয়, আত্মমুগ্ধ– ধু ধু চরাচর

 


সেজদা


সেজদায় দাঁড়ালে নিবিষ্ট ধ্যান ভেঙে শঙ্খ বেজে ওঠে

সশব্দে হেসে ওঠে ইচ্ছের ঘুঙুর

দরজা খোলার পর অবলিপ্ত ধুলা ঘরে এসে ছড়িয়ে দেয়–

মায়াময় পৃথিবীর সুতা

সমস্ত শরীরে টান লাগে, জট লাগে চেতনায়

ভাষাহীন চিৎকারে শিথিল হয়ে যায় চোখ

দৃশ্যতা নেই।

বিষণ্ণ জলাভূমি একা সারসের ডানায় আঁকছে রাত

নতুন মায়ের মতো জন্ম ও মৃত্যুর গন্ধ উড়িয়ে–

তোমার সিঁথির লোভে অনিশ্চিত চৌকাঠ ডিঙাচ্ছি…

 


কবি পরিচিতি

জন্ম: ৮ জুলাই ১৯৮৫, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম। পেশা: উন্নয়নকর্মী

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:

লিলিথের ডানা [চৈতন্য, ২০১৬] কয়েক লাইন হেঁটে [জেব্রাক্রসিং, ২০১৮] ময়ূরফুলের সন্ধ্যা [বাতিঘর, ২০১৯] সুবেহ তারা [তবুও প্রয়াস,২০১৯] অনন্তকলহ [বাতিঘর, ২০২২] কেন আমি সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিলাম [চন্দ্রবিন্দু, ২০২৩] ভস্মাধার নাকি অগ্নি [মাওলা ব্রাদার্স ২০২৩] পথ একা হাঁটে [পাখিরা, ২০২৪] শ্রীচট্টলেশ্বরী [আদম, ২০২৪] উপন্যাস: বিস্ময়চিহ্নের মতো [বাতিঘর, ২০২০] ইমেইল: rimjhimahmed85@gmail.com

শেয়ার