যে পালাতে চায়, যে হারায় | পূরবী বসু

এক

স্বেচ্ছায় যে জন ঘর ছেড়ে চলে যায়, অথবা হারিয়ে যায়, সে আর কখনো ঘরে ফেরে না।

এমন কথা অনেকের কাছে, বহু জায়গায় শুনেছি। কোন কোন ক্ষেত্রে কথাটার সত্যতা পরীক্ষিত হতেও দেখেছি। ব্যর্থ হতে একেবারে দেখিনি তাও হলফ করে বলতে পারবো না। তবে নিজের সংসারেই তার বাস্তবায়নের কথা ভাবিনি কখনো। অথচ হারিয়ে যাবার কথা ছিল আমারই। গোটা জীবনে কতবার যে এই চিন্তা মাথায় এসেছে! সত্যি সত্যিই তা করার কথা ভেবেছি আমি।  চেষ্টাও করেছিলাম একবার। কিন্তু না, পারিনি, চলতে গিয়ে পথ থেকে ফিরে আসা নয়,  শুরু করার আগে চিন্তার পর্যায়েই থেমে গেছি। অথচ ভাবতে গেলে মানসিকভাবে কতোটাই না এগিয়ে গিয়েছিলাম! কী সাংঘাতিক প্রস্তুত ছিলাম আমি। হঠৎ এক রাতে – বাসস্থান থেকে দূরে— নির্জন পাহাড়-ঘেরা এক শহরতলিতে। সত্যি কথা বলতে কি, সেই রাতে অকস্মাৎ-ই মোটামুটি  স্থির ও দৃঢ় এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম! সারাজীবন ধরে অন্যের কথা ভাবলেও সেই রাতে নিজের দিকে ফিরে তাকিয়েছিলাম। শুধু নিজের কথাই ভেবেছিলাম। সেদিন। একবার।

তবে কার্যত যে আদৌ চলে যায়নি বা হারায়নি, তার তো ফিরে আসার প্রশ্ন-ও আসে না! ফলে যাওয়া যখন হয়নি, হারিয়ে বা চলে যাবার জন্যে আমার পূর্বপ্রস্তুতির কোনো গুরুত্ব বা মূল্যই নেই। এমন অজ্ঞাত, একান্ত গোপনীয় প্রস্থান বা হারিয়ে যাবার ইচ্ছা, কেবল যে আমার জীবনেই প্রথম ঘটেছে, তা নয়। অনেকের জন্যেই হয়তো তা সত্য। এ ব্যাপারে আমি প্রায় নিশ্চিত। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর ধরনটা হয় আলাদা। ফলে, যে হারাবার গল্প পরিবার বন্ধুবান্ধব সকলেই জানে, সেই গল্পই বলি আজ। আমার কথা, হারাতে গিয়েও যে হারাতে পারিনি, সেকথা আপাতত নাই বা বললাম। পরে দেখা যাবে। সময়, স্থান ও সুযোগের মিলন ঘটলে বলেও ফেলতে পারি এক ফাঁকে।

যার কথা বলছিলাম সেই বুদবুদ আসলে মানুষ নয়, যদিও মানবিক গুণ বা স্বভাব অনেকটাই নিজের মধ্যে ধারন করতো সে। সুযোগ পেলেই হলো। নিজের ইচ্ছায় ঘর ছেড়ে নির্ঘাত বেরিয়ে পড়তো। কিন্তু বেরিয়ে গেলেও আমার ধারণা, হারাবার মতলব তার কখনো থাকতো না। খেলাপ্রিয় এই প্রাণীটি আমাদের সঙ্গে এক ধরনের কৌতুকপূর্ণ খেলা করতো, সুযোগ পেলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে। ও চাইতো আমরা তার পিছু পিছু ছুটে গিয়ে বহু কায়দাকসরৎ করে, অনেক দুঃশ্চিন্তা-পরিশ্রম শেষে কোনমতে তাকে ধরে আবার ঘরে ফিরিয়ে আনবো পরম যত্নে – আদর করে। সমস্ত ড্রামা শেষ হলে সে সম্রাজ্ঞীর মতো মাথা উঁচু করে গাড়ির জানালা দিয়ে চারদিকে তাকাতে তাকাতে প্রবল প্রতাপে ঘরে ফিরতো- আমার পুত্রের গাড়িতে চড়ে। এভাবে এক-ই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বহুবার। ফলে চূড়ান্ত ঘটনাটা ঘটার অনেক আগেই যেন আমি তা টের পেয়েছিলাম— চোখের সামনে স্পষ্ট ঘটতে দেখতাম প্রায়-ই। কেননা এই সর্বশেষ নাটকটির শেষ অঙ্কের  মহড়া আমার বাড়িতেই ঘটে চলেছিল অনেক দিন ধরেই।

বলছিলাম, আমাদের কুকুর বুদবুদের কথা। এমনিতে তো তার শরীরে দারুণ মায়া। নিজে অবশ্য আদুরে কিশোরী মেয়ের মতো কথায় কথায় অভিমান করে। ঠিক সময় তাঁর খাবার পরিবেশন না করলে।  তাকে তার মনমতো কিছু করতে না দিলে বা আমরা কেউ তার ইচ্ছেমত কিছু না করলে। দুষ্টুমী করার জন্যে ধমক দিলে, বা ওকে একা ঘরে রেখে কোথাও আমরা গেলে তো কথাই নেই, মুখ ফুলিয়ে খাটের নীচে সোজা চলে যাবে নিঃশব্দে। সেখান থেকে তাকে বের করা এক মস্তবড় হাঙ্গামা। আর খাটের নীচে যদি নাও যায় সামনের দুই বা ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর সম্পূর্ণ মাথাটা রেখে কেমন এক দুঃখী দুঃখী চোখে চুপচাপ বসে থাকবে।

আমি, আমার স্ত্রী বা আমার পুত্র কোথাও গিয়ে কিছু সময়ের ব্যবধানে ফিরে এলে সে যে পরিমান খুশিতে, আনন্দে উত্তেজিত হয়ে পড়ে, লেজ নাড়িয়ে অনবরত দ্রুত ছোটাছুটি শুরু করে, আমাদের হাতেপায়ে চেটেপুটে, উঁ-ঊঁ আওয়াজ তুলে তার মনের ভাব প্রকাশ করে, সেখানে সুযোগ পেলেই সে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাবে, নিজে থেকে ফিরে আসবে না, তার পিছু পিছু পাড়াময় কেউ হেঁটে, কেউ গাড়িতে ছুটে বেরিয়ে অবশেষে তাকে কোনমতে ধরে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে, এটা কোনমতেই আশা করা যায় না। তবু  এরকম-ই হতো। বইতেও পড়েছি, এই জাতীয়, অর্থাৎ জাপানিজ পিউর ব্রীড “শিবা ইনো”, কুকুরের এটা স্বভাব বা জাতিগত বৈশিষ্ট-ও বটে। পশুডাক্তার-ও বোঝান আমাদের,” এরা মূলত স্বাধীনতা প্রিয়। মনিবের প্রতি যথেষ্ট মায়া থাকা সত্বেও এ বন্দীদশা থেকে সবসময় তারা মুক্তি চায়। তারা খোলা আকাশের নীচে বন্ধনহীন ঘুরে বেড়াতে চায়। সাধারণত গৃহপালিত জীব বিশেষ করে কুকুররা এটা করে না। মনিবের প্রতি শুধু আনুগত্য নয়, তাঁর অতি ঘনিষ্ঠতা, নির্ভরশীলতা ও  নিষ্ঠার অনেক গল্প চালু আছে। আমরা নিজেরাও দেখেছি জীবদ্দশায় সেরকম দু-চারটি ঘটনা। আর কিছু করুক না করুক গৃহপালিত কুকুর খোলা দরজা পেলেই পাঁচ বছর পরেও ঘর ছেড়ে ছুটে পালায় এটা বড় শোনা যায় না। কিন্তু আমাদের আদরের বুদবুদ যে প্রতি ভোরে আমার স্ত্রীর ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিত তার শিয়রে এসে বালিশের ওপর বসে কপাল, গাল হাত চেটে আদর করে, সত্যি সত্যি-ই একদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেল, হারিয়ে গেল। গেল তো গেল-ই। কোথাও আর তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।

আমি কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি যেন দিব্য চোখে দেখতে পেতাম এই যে বুদবুদ ঘর ছেড়ে মাঝে-মধ্যে পালিয়ে যায়,  কিছুদিন পর পর-ই এক-ই নাটকের মঞ্চায়ন ঘটায়, আর বাধ্য হয়ে আমরা তিনজন যে যার ভূমিকা পালন করে চলি, ওকে ঘরে ফিরিয়ে আনি বরণ করে, যে নাটকের সমাপ্তি সব সময়েই হয় মিলনাত্মক, এবং  প্রতিবার নাটকের শেষ দৃশ্যে স্পষ্ট দেখি, হারানো কুকুর ফেরত পেয়ে (নিজের একক চেষ্টায় বা পাড়াপ্রতিবেশীর সাহায্যে) তৃপ্ত পুত্র আমার ঘরে ফিরছে তার অতি আদরের বাহনকে ধরে গাড়ির সামনের সিটে তার পাশে বসিয়ে নিয়ে। কিন্তু আমাদের আদুরে নায়িকা বুদবুদ (যার মনুষ্য সমতুল্য বয়স এখন অতি লোভনীয়, সে পূর্ণ যৌবনবতী মানে সবে মধ্য তিরিশের কোঠায়), যদিও তার কুকুর-বয়স সবে সাড়ে পাঁচ, সে কি আর বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে গাড়ির সিটে? পেছনের দু’পায়ের ওপর ভর করে বুদবুদ দিব্যি সিটের ওপর টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আধ খোলা জানালা দিয় মুখ বার করে দিয়ে পৃথিবী দেখতে দেখতে রাজকীয় ভঙ্গিতে ঘরে ফিরছে। ঘর ছেড়ে পালিয়ে এতোগুলো মানুষকে যে ঘর্মাক্ত-ই শুধু করেনি, প্রায় হার্ট অ্যাটাক করে দিচ্ছিল, সে ব্যাপারে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।

যখন আমাদের পুত্রকে বুদবুদসহ গাড়ি করে বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে স্মিতমুখে ফিরে আসতে দেখি,  আমি ও আমার  স্ত্রী প্রতিবার-ই তখন পর্যন্ত আমাদের বাড়ির আশেপাশে বুদবুদের নাম ধরে কাতর স্বরে ডাকতে ডাকতে তাকে খুঁজে বেড়াতে থাকি। আর প্রত্যেকবার আমার মনে হয় একদিন এমন হবে, আমি চোখের সামনে  নিশ্চিত দেখতে পাই, একদিন এমন হবে যখন আমার ছেলেকে দেখবো তার গাড়ি নিয়ে মুখ কালো করে একাই ঘরে ফিরে আসছে। পাশের সিট খালি। সেখানে বসে আধ খোলা জানলায় মুখ বের করে বুদবুদ তাকিয়ে নেই। আমি চোখ বুজলেই স্পষ্ট দেখতে পেতাম, বুদবুদ সারাজীবনের জন্যে হারিয়ে গেছে, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ পদে পদে সে বহু দৃষ্টান্ত রেখেছে যার থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি সে আসলে হারাতে চায় না, মাঝে মাঝে কিছুটা মুক্তির আনন্দ পেতে চায় কেবল। একা একা বন্ধনহীন বাইরের খোলামেলা পৃথিবীটাকে জানতে ও বুঝতে চায় ক্ষণিকের জন্যে।  তার চাইতেও বড়া কথা সে খেলতে চায়।  সে বড় মজা পায় দেখতে যে সে প্রাণপণে ছুটছে আর তার  পেছনে পেছনে আমরা তিনজন সাবালক মানুষ পাগলের মতো দিকবিদিক ভুলে দৌড়ুচ্ছি তাকে ধরতে। এটা দেখে সে খুব মজা পায়, ভীষণ আনন্দ হয় তার। হয়তো খানিকটা আত্মগড়িমাও হয়। তখন পড়ি মরি করে সে আরো জোরে ছোটে। কোথায় চলে যাচ্ছে না ভেবেই ছোটে। সবটাই তার জন্যে খেলা। সে ভালো করেই জানে, যেখানেই যাক না কেন, তাকে আমরা যে করে হোক খুঁজে বের করে ফিরিয়ে আনবোই। সে যেটা বুঝতে পারে না, এমনি করে খেলতে গিয়ে বাড়িঘর, গাছপালা, জঙ্গল, বড় রাস্তা, গাড়ি ইত্যাদির মাঝখানে সে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে, অথবা ছুটে রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ে মারা যেতে পারে।

আর আশ্চর্য, আমি যেমনটি ভেবেছিলাম, ঠিক তেমনি ঘটে গেল এক বিকেলে। মানে, অবশেষে সত্যি সত্যি সেই দিনটি এলো, যেদিন আমার পুত্র বুদবুদের পেছনে পেছনে ছুটে সমস্ত অঞ্চল তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে পায় না।

না পেয়ে সন্ধ্যার পর বিমর্ষ বদনে একাই ঘরে ফিরে আসে। ওর নীল রঙের টোয়োটা ক্যামরি গাড়ির পাশের সিট আজ খালি। সম্রাজ্ঞীর মতো মাথা উঁচু করে দঁড়িয়ে জানালা দিয়ে শহর দেখছে না বুদবুদ। বুদবুদ হারিয়ে গেছে। তাকে আজ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।  কানামাছি কানামাছি খেলতে গিয়ে আজ নিজেই হয়তো কোথায় কানামাছি হয়ে হারিয়ে গেছে।  এই অঞ্চলের ভেতর ও আশেপাশের রাস্তাগুলো বড় বিদ্ঘুটে।  লম্বা লম্বা ও সিধে নয় প্রায় কোনোটি-ই।  প্রতিটি রাস্তা গোল গোল করে বেঁকে গিয়ে অন্য এক রাস্তায় গিয়ে পড়ে একরকম গোলকধাঁধার সৃষ্টি করেছে। এই জটিল বিন্যাসের সড়কগুলো ভালোমতো চেনা না থাকলে কাছাকাছি থাকলেও নিজের ঘরে ফিরে আসাই শক্ত। তার জন্যেই হয়তো  ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বুদবুদ ফিরে আসতে পারছে না। পুত্র আমার সন্ধ্যার পরেও অনেকক্ষণ খুঁজেছে তাকে। কখনো পায়ে হেঁটে- কখনো গাড়ি চড়ে। তারপর অন্ধকার গাঢ় হলে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এসেছে সে। এ দেশে এ অসময়ে কারো বাড়ির সামনে বা পেছনের বাগানে ঢোকা যায় না কুকুরের খোঁজে। এদিকে আমি ও আমার স্ত্রীও বাড়ির দুদিকে দুজন পায়ে হেঁটে গিয়ে সারাটা সময়েই বুদবুদের নাম ধরে ডেকে তাকে খুঁজে বেরিয়েছি। রাতে কিছু না খেয়ে ছেলে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার আগে কেবল বলে, কাল খুব ভোরে উঠে গিয়ে আবার খুঁজবে। পুলিশকে, গৃহপালিত পশুদের শেল্টারগুলোতে খবর দেয়া হয় সেই রাতেই।  পুলিশ আশ্বস্ত করলো, হয়তো কোনো দয়ালু, ভালো মানুষ খোঁজ পেয়ে ফেরত দিয়ে যাবে বা ফোন করবে। গলায় রঙিন কলার-বেল্টের সঙ্গে ছোট্ট একটি ঘুঙ্গুর,  ও কয়েকটি ধাতব চাকতির মতো লকেটে তার নাম, জলাতঙ্ক ও অন্যান্য জরুরি টিকার তারিখ, মালিকের নাম,  ঠিকানা, ফোন নম্বর সব দেওয়া আছে। এছাড়া সে এই দেশের রেজিস্টার্ড কুকুর। তার ঘাড়ের ভেতর চামড়ার নিচে রেডিওএক্টিভিটি দিয়ে খোদাই করে একটা নম্বর লিখে দেয়া আছে যা থেকে তার সকল তথ্যাদি বের করা সম্ভব। কিন্তু কথা হলো, যদি প্রাপক কুকুরটিকে ফেরত দিতে চায় তবেই না সে সব তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করবে!  এমন সুন্দর কুকুর পেলে কেউ কি ফেরত দেবে?  তারপরেও ছবিসহ খবরের কাগজে ও লাইটপোস্টে বিজ্ঞাপণে বিস্তৃত বর্ণনা দিতে কিছুই বাকি থাকে না। বহুদিন পর্যন্ত আমরা আশায় থাকতাম কেউ হয়তো নিয়ে আসবে সঙ্গে করে আমাদের বুদবুদকে। জিজ্ঞেস করবে, “এটা আপনাদের কুকুর?” অথবা সে নিজেই খুঁজে পেতে একদিন ঠিক এই বাড়িতে চলে আসবে। এসব কথা ভেবেই বুঝি, আশায় আন্দোলিত হয়ে সময়ে অসময়ে সামনের সদর দরোজা খুলে আশে পাশে, ঝোপঝাড়ে তাকে খুঁজতো আমার স্ত্রী। বুদবুদের নাম ধরে ডাকতো। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তো তখন।

দুই

বুদবুদ হারিয়ে যাবার পর আমাদের জীবন বেশ কিছুদিনের জন্যে কেমন যেন থমকে গিয়েছিল। সবাই স্থবির হয়ে পড়েছিলাম। এর চাইতে কোন কঠিন অসুখে ভুগে, চিকিৎসাসেবা নেবার পরে যদি বুদবুদ মরে যেতো,  তাহলেও বোধহয় যন্ত্রণাটা কিছুটা কম হতো। বুদবুদ এমন উলোটপালোট করে দেয় আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সবকিছু  যে অনেক দিন পর্যন্ত আমরা পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তায় পারতপক্ষে তার নাম উচ্চারণ করতাম না। বুদবুদের ব্যবহৃত সব জিনিসপত্র আমাদের পুত্র ঘর থেকে সরিয়ে ফেলে।  বিশেষ করে আমার স্ত্রীর মানসিক অবস্থা ভেবে। বুদবুদের জন্যে এই প্রৌঢ়া নারী মাঝে মাঝেই এমন উচ্চস্বরে বিলাপ করে কাঁদতে শুরু করে যে তা দেখে আমি ও পুত্র ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। অবস্থা যত-ই সঙ্গিন বা শোচনীয় হোকনা কেন, আমার স্ত্রীর অনুভূতির প্রকাশ বরাবর-ই থাকতো যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত ও শালীন।  আমার জীবনে আমি আর কখনো তাকে এমন ভেঙে পড়তে  দেখিনি। অসময়ে তার পিতা মারা যাবার পরেও নয়। যে বাঞ্ছিত কন্যাকে এই জীবনে ধারণ করা সম্ভব হয়নি, বুদবুদ একরকম করে সেই খালি জায়গাটাই বোধহয় দখল করে নিয়েছিল তাঁর।

জীবনকে সহনীয় করে তুলতে, বুদবুদের চিহ্ন মুছে ফেলে দিতে, এক এক করে দেয়াল ও অ্যালবাম থেকে বুদবুদের সব ছবি নামিয়ে নেওয়া হয়। সব-ই করে আমাদের পুত্র, যে নিজে দিনের পর দিন ডজন ডজন কুকুরের মৌলিক ও শঙ্কর জাতির চেহারা ও বৈশিষ্ট্য পড়ে ও জেনে এবং শত শত কুকুর দেখেশুনে নিজের হাতে দু’সপ্তাহ বয়সী বুদবুদকে পছন্দ করে কিনে এনে পরমাদরে ঘরে তুলেছিল নেব্রাস্কার একটা নাম করা ফার্ম থেকে। গত সাড়ে পাঁচ বছরে ২০ এপ্রিল বুদবুদের জন্মদিন পালন করতে সে একবার-ও ভোলেনি। ঘরময় ছড়ানো বুদবুদের সকল ছবি সরাবার পর সবশেষে সে ঢোকে আমাদের শোবার ঘরে। সেখানে দেয়ালে আমাদের তিনজনের মাঝে বুদবুদের এনলার্জ করা ভারি  জ্যান্ত একটা  ছবি তখনো টাঙ্গানো। কিন্তু ওটার গায়ে আমার স্ত্রী কাউকে হাত দিতে দেয় না।

“তোমরা কী মনে করেছ বল দেখি? তোমাদের ব্যবহার দেখে মনে হয় ও কোনদিন এখানে ছিল না। যেন জ্যান্ত কোনো প্রাণী নয়, পোস্টারের একটা ছবি কেবল। ওকি একটা কল্পনা? আজ না হয় নেই। কিন্তু ও তো ছিল একদিন! এই বাড়িতেই। না কি?” আমরা চোখ চাওয়াচাওয়ি করি, কিন্তু ছবিখানা নামানো দূরে থাক, স্পর্শ করার সাহস-ও হয় না। ওটা আজো আমাদের শোবার ঘরে দেয়াল জুড়ে শোভা পায়।

এর ভেতর বছর না ঘুরতেই ছেলে কলেজে চলে যায়। আমিও যতোটা সম্ভব প্র্যাক্টিস গুটিয়ে আনি। দুটো কি তিনটা জীবন, একটি সংসার চালাবার জন্যে আর কতো টাকা লাগে! গ্রুপ প্র্যাক্টিসের মজা তো এটাই। অনেক রকম চয়েস থাকে। ফ্লেক্সিবিলিটি থাকে। তবে শহরের প্র্যাক্টিস কমিয়ে দিলেও আগের মতো শনি-রোববারগুলোতে নব্বই মাইল ড্রাইভ করে উত্তরের সেই পাহাড়ি অঞ্চলের ছোট ক্লিনিকটাতে নিয়মিত ঠিকই যাই। যাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচার জন্যে। এই কোলাহলপূর্ণ বড় শহরের নষ্ট বায়ু ছেড়ে নির্মল বাতাস বুক ভরে টেনে নেবার জন্যে। দীর্ঘ জীবন ভর আস্তে আস্তে তলানিতে যত ক্লেদ, গ্লানি, বিতৃষ্ণা, ক্লান্তি, হতাশা জমা হয়েছিল, এখন নীচ থেকে তা ধীরে ধীরে উপরে উঠে এসে জাহাজ থেকে সাগরে পড়া পোড়া তেলের মতো হৃদয়ের ওপরের স্তরে ভাসতে থাকে। আটান্ন বছর বয়সী শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ আমি যখনই রাজধানী ছেড়ে ওই ছোট্ট গ্রামীণ শহরটাতে যাই, প্রতিবারই নতুন করে অনুভব করি, এখনো বেঁচে আছি। জীবনটাতে সুন্দর, হালকা, ফুরফুরে আনন্দ বলে কিছু রয়েছে।  সপ্তাহান্তে দু’দিনের এই নির্জন-বাস, এই নিরিবিলি, নৈঃশব্দ্য, শান্ত পরিবেশ, –  এর চেয়ে শ্রেয়, এর চেয়ে শান্তির বুঝি কিছু নেই। হতে পারে না। এখানে এলেই মনে হয়, জীবন থেকে ভালো লাগার বস্তুর পুরোপুরি নির্বাসন ঘটেনি। আর তাই শনিবারে সূর্য ওঠার আগেই রওনা হয়ে ছুটে আসি এখানে। শুধু সহজ সরল পাহাড়বাসী রোগীদের জন্যেই নয়, একা একা মুক্তমনে ড্রাইভ করতেও ভারি মজা লাগে। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আসার কথা মনে  হয় না আমার। সারাদিন তো ক্লিনিকেই থাকি, সঙ্গে এলে এই দীর্ঘ সময় হোটেলরুমে করার কী-ই বা থাকতো তার! সে নিজেও অবশ্য আসার জন্যে ইচ্ছাপ্রকাশ করেনি কখনো। তাছাড়া আমি মনে করি প্রতিটি মানুষেরই কিছুটা নিজস্ব সময় থাকা দরকার – একা নিজের মতো করে কিছু সময় কাটানো দরকার। এই স্পেসটুকু না থাকলে মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে। নিদারুণ সংসার, পরিচিত ভুবন ফেলে তাই কেউ কেউ পালিয়ে আসে, হোক তা দু’দিন বা দু’ঘণ্টার জন্যে- তিরিশ মিনিটের জন্যে। নিজেকে সতেজ ও সবুজ করে তুলতে এটুকু ছাড় দিতে হবেই নিজেকে, মনে মনে বোঝাই আমি। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এই জায়গাটিতে সপ্তাহের ঐ ছত্রিশ ঘণ্টার প্রতিটি মুহূর্ত আমি টের পেতাম, আমি একেবারে শেষ হয়ে যাইনি। আমি স্পষ্ট বুঝতাম, একটি মারাত্মক একঘেয়ে, নিরানন্দ জীবন টেনে বেড়ানোর কোন অর্থ হয় না।  কারো জন্যেই। আমার আরো অনেক আগেই বেরিয়ে পড়া উচিত ছিল।

এক সন্ধ্যেয় স্ত্রীর রেঁধে দেওয়া খাবারের সঙ্গে ওই ক্লিনিকের রেজিস্টার্ড নার্স মনিকার ঘর থেকে রেঁধে আনা খাবার একত্র করে আমার জন্যে বরাদ্দ করা সপ্তাহান্তের নির্ধারিত হোটেল রুমে বসে দুজনে ডিনার খাচ্ছিলাম। এটিই এখানে বসে প্রথম মনিকার সঙ্গে একত্রে খাওয়া নয়। কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে আমরা খাচ্ছি। কী জানি কী বলে  একচোট হাসালো আমাকে মনিকা। নেপথ্যে মৃদু আওয়াজে জুবিন মেহেতার কন্সার্টের রেকর্ড বাজছে হোটেলের স্টেরিওতে। দূরের কোনো এ, এম রেডিও স্টেশন থেকে নিশ্চয়। খাওয়া শেষে প্লেটগুলো ডিস ওয়াশারে দিয়ে সোফায় এসে বসে মনিকা। সামনের অটোমনে পা দুটো বিছিয়ে। আয়েশ করে। মনিকাকে দেখলে মনে হয় ওর মধ্যে যেন কোন টেনশন নেই, সর্বদা কেমন এক প্রশান্তির ছায়া সমস্ত অবয়ব জুড়ে। বন্ধ টেলিভিশনের সামনে বসে বসে আনমনে বাঁ কপালের ওপরের ছোট চুলগুলো ডানহাতের তর্জনীতে একবার পেঁচাচ্ছে, একবার খুলছে সে। সাইত্রিশ বছরের মনিকার ছিপছিপে অ্যাথলেটিক স্বাস্থ্য ও পূর্ণ যৌবন তার খাটো স্কার্ট আর সিল্কের ব্লাউজে উদ্ভাসিত হলেও বসার ধরনে তা যথেষ্ট অবগুন্ঠিত। মিউজিকের তালে তালে মৃদু পা নাড়াচ্ছে মনিকা। আমার হঠাৎ মনে হলো,  যে জীবন আমি যাপন করছি, তা আমার হবার কথা ছিল না। আমি টের পাই, জীবন অতি সংক্ষিপ্ত ও অনিশ্চিত। সে সন্ধ্যায় বা বিকেলে কোন মদ্যপান করিনি আমরা। আমি সম্পূর্ণ সজাগ, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কিন্তু  অতি আকস্মিকভাবেই আমি স্থির করে ফেলি, পরিপূর্ণ একা একাই  স্থির করি, এই পাহাড়ি ঝর্নাস্নাত ছোট্ট উপশহরেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেবো। এই মাসের শেষ সপ্তাহে যখন আসবো এখানে, আর কোনদিন ঐ মহানগর, পরিচিত বাড়ি, বা গ্রুপ প্র্যাক্টিসে ফিরে যাবো না। শহরের বাড়িঘর, গাড়ি, ব্যাঙ্কে যত টাকা সব ভাগ করে দিয়ে দেবো স্ত্রী-পুত্রকে। আমি জানতাম মনিকা লাফিয়ে উঠতো কথাটা শুনলে। কিন্তু আমার এই পরিকল্পনা আজ কারো কাছে প্রকাশ করার ইছে হলো না। এমনকি মনিকার কাছেও নয়। আমি নিশ্চিত যা করতে যাচ্ছি, সেটা প্রধানত নিজের কথা ভেবেই। সব জেনে বুঝে কেউ যদি পাশাপাশি চলতে চায়, বিশেষ করে মনিকার মতো উচ্ছল এক নারী, বাধা দেই কী করে?  সেই ছোটবেলা থেকে মা-বাবা, ছোট ভাই-বোনদের দায়িত্ব নেওয়া থেকে শুরু করে আজো সংসারের একটানা – একঘেয়ে ঘাণি টেনে বেড়াচ্ছি। অথচ দিনরাত্রি কেবল নিজের অক্ষমতার কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বর্তমান জীবনের ধরন- এখনকার বেঁচে থাকা।

আমি ভেবে দেখি, আমার গোটা জীবনের প্রায় সবটাই উৎসর্গ করে দিয়েছি অন্যদের জন্যেই। আর যে কদিন বাঁচবো, নিজের মত করে বাঁচার ইচ্ছা। মনিকা এই জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হলেও সব নয়। শুধু তার জন্যেই আমি ঘর ছাড়ছি, এটা সত্য নয়।

সিদ্ধান্তটা নিয়ে কিছুটা উৎফুল্ল ও হালকা মনে ঘরে ফিরি পরদিন। গত কিছুকাল ধরে আমার স্ত্রীর সিঁড়ি ভাংতে বা হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। অস্টিও বা রিমোটয়েড আর্থ্রাইটিস, এ বয়সে বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে খুব কমন ভেবে ব্যথার ওষুধ ও অ্যান্টাই ইনফ্লেমমেটরি বড়ি দিচ্ছিলাম। সেই সঙ্গে জয়েন্টের সাস্থ্যরক্ষার জন্যে গ্লুকোসোমাইন, কন্ড্রাইটিস, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি। উপসম না হওয়ায় অরথোপেডিক ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল কিছুদিন আগে। গত দু’ সপ্তাহ ধরে তার যে অগুন্তি পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছিল, একে একে সেসব পরীক্ষার ফল আসতে শুরু করে। আজকের ফলাফল দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই। যা ভাবা গেছিল তার চেয়ে বিস্তর খারাপ ও জটিল অবস্থা।  মাল্টিপল স্কেরোসিস। ধীরে ধীরে আর-ও খারাপ হবে তাঁর অবস্থা। প্রোগেসিভ ডিজেনারেটিভ অসুখ। ভবিষ্যতে ভালো হবার কোন আশা নেই। আর কিছুকাল পরেই হুইল চেয়ার ছাড়া চলাফেরা করা যাবে না নিশ্চিত।

সিদ্ধান্ত নেবার পালা এখন আমার। ভাবার বেশি কিছু ছিল না।  অতঃপর, শহরের গ্রুপ প্র্যাক্টিস নয়, ঝর্নাস্নাত পাহাড়ি শহরই ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই। স্ত্রীর পক্ষে একা বাস করা আর সম্ভব নয়। তার  দেখাশোনার জন্যে সার্বক্ষণিক একজন বিশ্বস্ত লোক দরকার। পুত্র এ বছরই কলেজ শেষ করবে, তাই বলে কলেজ পাশ করে ঘরে বসে মায়ের সেবা করবে না সে, বলাই বাহুল্য। কেউ-ই করে না। অন্তত এই সংস্কৃতিতে। আমার স্ত্রী অবশ্য বার বার-ই লং টার্ম কেয়ারের জন্যে নার্সিং হোমে চলে যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। তার অসুস্থতার জন্যে আমি সুস্থ মানুষ কেন এমন কঠিন জীবনযাপন করবো? এর ঠিক উত্তর আমিও জানি না। তবে ঐ ঝর্নাতলার ক্লিনিকে বা ঐ পাহাড়তলীর শহরে আর কখন-ই আমি ফিরে যাইনি। মনিকার সঙ্গেও যোগাযোগ করিনি। সে ফোন করলে ঠান্ডা গলায় জবাব দিয়ে ফোন রেখে দিয়েছি। সপ্তাহ ও সপ্তাহান্ত উভয়-ই কাটে এখন এই বাড়িতেই, মাঝে-মধ্যে বাইরের দুএকটি রোগী দেখা ছাড়া। গ্রুপ প্র্যাক্টিস-ও একরকম ছেড়েই দিয়েছি, নামটা  যদিও রয়েছে সেখানে। ফলে মাঝে-মধ্যে দু’একটা কেইস নিই। এভাবেই কেটে গেছে গত পাঁচ বছর।

তিন

ফিস থেকে মোবাইল ফোনে খবর পেয়ে আর জরুরীর মাত্রাটা বেশি দেখে দেরি করি না। প্রথমে গাড়ি নিয়ে যাবার কথাই ভেবেছিলাম। পরে জিপিএসের ম্যাপ ও দূরত্ব দেখে বুঝলাম জায়গাটা আমার বাড়ির একেবারে কাছে। আধ মাইলের-ও কম দূরে। ফলে বিকেলের হাঁটা ও রোগী দেখা দুটোই একসঙ্গে হবে ভেবে ছোট্ট ডাক্তারী ব্যাগটা হাতে নিয়ে হেঁটেই রওনা হলাম। এমনিতেই তো উল্টোযাত্রা। হাউজ কল প্রায় কেউ করে না আজকাল। সে প্রথা প্রায় উঠেই গেছে। রোগী দেখতে ডাক্তাররা আর আগের মতো বাড়ি বাড়ি ছোটে না। দরিদ্র দেশের গ্রামাঞ্চলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আজো তা চালু থাকলেও এখানে প্রায় নেই। রোগীর পক্ষে চলাফেরা করা একান্ত অসম্ভব হলে বড়জোর নার্স প্র্যাক্টিশনার  কিংবা ডাক্তারের সহকারী আসলে আসতেও পারেন। তার চেয়ে অনেক বেশি চালু, তেমন গুরুতর কিছু হলে সরাসরি ৯১১-তে কল করে অ্যাম্বুলেন্সে ইমারজেন্সিতে চলে যাওয়া।

কিছুক্ষণ আগে অফিস থেকে আসা টেক্সট মেসেজের সারাংশে বুঝি,  রোগীর অবস্থা তেমন গুরুতর নয় – নতুন বা আকস্মিক কোন উপসর্গ-ও নয়।  কিন্তু মুশকিল হলো, সে হাসপাতালে কিছুতেই যেতে চায় না। ভয়, তাকে সারারাত ধরে রাখবে হাসপাতালে। ঘরের বাইরে রাত কাটাতে সে  চায় না কোনমতেই। অথচ ঘরে তাঁর দেখাশোনার জন্যে কেউ নেই। সে একা।

আঁকাবাঁকা, গোলাকার, ধাঁধাঁর মতো রাস্তায় একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে, একবার হারিয়ে, পুনয়ায় ঠিক পথ বের করে অবশেষে নির্দিষ্ট বাড়িতে এসে পৌঁছি। ছোট্ট দোতলা বাড়ি। সামনের দরজায় এই দিনের বেলাতেও  টিমটিমে একটা হলুদ আলো জ্বলছে। লনের ঘাস বেশ বড় হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ঘন আগাছা ঝাড়ে অবহেলিত ফুলের উঁকিঝুকি, প্রধানত ড্যান্ডেলায়নের হলুদ ফুল। সামনের দরোজায় বেল বাজালে ভেতর থেকে খড়খড়ে গলায় ভেসে আসে দুটি শব্দ, “দরজা খোলা।“

বুঝি, আমার অপেক্ষাতেই বসেছিল সে। ঘরে ঢুকে শেষ বিকেলের স্বল্প আলোতে বাইরের ঘরের মাঝখানে পাতা একটি ডাবল বেডে এক বৃদ্ধকে একটি ধবধবে সাদা চাদর গায়ে শুয়ে থাকতে দেখি। বৃদ্ধের সারা মুখ জুড়ে অন্তত দু’দিনের খোঁচা খোঁচা বাসি দাড়ি। পাকা সাদা চুল উসকোখুসকো। তাঁর শিয়রের কাছে বসে আছে একটি কুকুর। বালিশের ওপর বসে সামনের এক পা পরম আদরে বুড়োর কপাল স্পর্শ করে আছে। কুকুরটির দিকে তাকিয়ে আমি হঠাৎ ভীষণ চমকে যাই। তারপর গায়ে চিমটি কেটে নিজেকে স্থির করে নেবার চেষ্টা করি।  মনে হয় একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে জ্বর ছাড়লো। আমার মনে হলো সেই সর্বজনবিদিত সত্যের কথা। এই জাতের মানে জাপানিজ শিবা- ইনো জাতের সব কুকুরের-ই মুখের আকৃতি ও চোখের গড়ন একইরকম। লম্বাটে মুখ ও বাদামী-সাদায় (ক্কচিৎ সাদা-কালোয়) শিবা-ইনোরা প্রায় প্রত্যেকে দেখতে প্রায় এক-ই রকম, আইডেন্টিক্যাল টুইনের মতো। হঠাৎ দেখলে তাদের  খেঁকশিয়াল বলে ভুল হয়।

কে জানে দূর অতীতের কোন এক সময় খেঁকশিয়ালের সঙ্গে কোন জাপানিজ কুকুরের সখ্যতায় শিবা-ইনোর জন্ম হয়েছিল কিনা। আমার পুত্র এই জাতের কুকুরের ওপর ছবিসহ বেশ কয়েকটি বই, ক্যালেন্ডার ও ডায়েরি কিনেছিল যা থেকে এই সত্য আবিষ্কার করেছিলাম।

বৃদ্ধের কুকুর কিন্তু আমাকে দেখামাত্র বিছানা ও বালিশ ছেড়ে দৌড়ে ছুটে আসে আমার কাছে। কুঁই কুঁই শব্দ করতে করতে আমার পা,  হাত চাটতে শুরু করে পাগলের মতো। বৃদ্ধ প্রবল হাঁপানির টানের মধ্যেও অতি কষ্টে মাঝে মাঝে দম নিয়ে বলে, “তোমাকে দেখছি সে খুব পছন্দ করেছে। সাধারণত কোনো অপরিচিত মানুষ দেখলে ভীষণ রেগেমেগে উত্তেজিত হয়ে প্রাণপণে চেঁচায়।“

আমার সমস্ত বুক জুড়ে তখন তোলপাড়। কোনমতে বলি, “শিবা-ইনো। এরা সত্যি অসাধারণ। বড় মায়া ওদের।“

“তোমার কুকুর-ও বুঝি শিবা-ইনো”?

আমি ততক্ষণে দেখতে অবিকল বুদবুদের মতো, আরেকটু ক্ষীণকায়, আরেকটু বয়সের ভারে নাজুক বৃদ্ধের কুকুরটিকে দুহাতে ধরে কোলে তুলে নিই। তা করার আগে অবশ্য-ই কুকুরের মালিকের অনুমতি নিয়ে নিই।  তাকে ছোঁবার অনুমতি। কুকুরটির গায়ের লোম, শরীরের গন্ধ, ওর দেহের উষ্ণতা আমাকে বিমোহিত করে। বৃদ্ধের প্রশ্নের উত্তরে বলি, “আমার একটি শিবা-ইনো কুকুর ছিল।“

“আমি দুঃখিত। না বুঝে তোমাকে কষ্ট দিয়ে দিলাম বলে। এটা সত্যি খুব পরিতাপের বিষয় যে এমন “অ্যাডোরেবল” প্রাণী! কিন্তু ওরা বেশিদিন বাঁচে না।“

আমি দ্রুত প্রতিবাদ করে উঠি। “সে হারিয়ে গেছে।“

আমি বৃদ্ধের কথা বা ধারণা দৃঢ়ভাবে সংশোধন করে দেই। না, সে যা ভাবছে তা ঠিক নয়। আমাদের শিবা-ইনো মারা যায়নি।

ততক্ষণে শান্তভাবে আমার কোলে বসা কুকুরটিকে ভালো করে দেখি। আশ্চর্য সাদৃশ্য!  কিন্তু আরো ভালো করে দেখতে গিয়ে একটা বিশেষ জিনিস চোখে পড়লে আমি হিমশীতল হয়ে একেবারে স্থির ও অবশ  হয়ে যাই। কুকুরটির বাঁ চোখের ঠিক নীচে একটি ছোট্ট কালো বৃত্ত দেখে আমার আর সংশয় থাকে না। সাদা-বাদামী কুকুরের গায়ে এই অনন্য একটিমাত্র কালো স্পট বুদবুদকে আর সব শিবা-ইনো থেকে আলাদা করতো। খবরের কাগজের হারানোর বিজ্ঞপ্তিতেও তার মুখমণ্ডলের এই বিশেষ বৈশিষ্টের উল্লেখ ছিল। আমি আরো শক্ত করে বুকের সাথে জাপটে ধরি কুকুরটিকে, ওর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, বুকের ঘড়ঘড় আওয়াজ স্পষ্ট টের পাই। সেও তখন তার চরম আদর দেখাতে আমার গাল, কপাল, গলা চেটে দিতে শুরু করে।

আমি তাড়াতাড়ি কুকুরটিকে বিছানায় রেখে রোগী দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বৃদ্ধের পুরনো হাঁপানীর জন্যে তেমন কিছু করার ছিল না। ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আনার ব্যবস্থা ও বিছানা, জামাকাপড় ধুলামুক্ত করে রাখতে হবে। এছাড়া এই ধরনের ঋতুভিত্তিক এলার্জিতে কী-ইবা করার আছে? অবস্থা এতোটা সংকটাপন্ন নয় যে এড্রিনালিন ইঞ্জেকশন দিতে হবে। আমি তার বুক, পিঠ ভালো করে স্টেথস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। তারপর ব্লাড প্রেসার, শরীরের তাপমাত্রা, হৃদপিণ্ডের গতি মেপে তাকে ঘরের ভেতর সার্বক্ষণিকভাবে, অন্তত রাতের বেলায়,  একটি হিউমিডিফাইয়ার চালিয়ে রাখতে বললাম। আর ২৪ ঘণ্টায় তিন থেকে চারবার ইনহেলার নিতে বললাম। কুকুরটি তখনো আমার পাশে বসে ফ্যল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। আর এক মাস পরে বর্তমানে ব্যবহৃত ইনহেলারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে লক্ষ্য করে নতুন ইনহেলারের জন্যে একটা প্রেস্ক্রিপশন লিখে দিলাম।

“তোমার কুকুরের নাম কী ছিল”? বৃদ্ধ আবার প্রশ্ন করে।

আমি একটু ভাবি।  “ছিল” শব্দটা মোটেও পছন্দ করি না। বলি, “ওকে অতীতকালের প্রাণী হিসেবে আমরা এখনো দেখি না।  তোমার ঐ past tense-টা কানে বড্ড লাগছে আমার।  যাই হোক, ওর নাম বুদবুদ’।  পরে আবার অনুবাদ করে বলি, “Bubbles.”

তারপর নিজের কাছে নিজেই বলছি এমনি স্বরে নিচু গলায় বলি, “বুদবুদ। বুদবুদ।“

আমার মুখে ঐ বিশেষ শব্দটা দু’বার উচ্চারণ করতে শুনে খাট থেকে এক লাফে আবার আমার কোলে চলে আসে কুকুরটি। বিক্ষুব্ধ- বিস্মিত বৃদ্ধ খাটের ওপর শোয়া থেকে উঠে বসে। আর তার কুকুর পরম আদরে তার মাথাটি গুঁজে দেয় তখন আমার বুকে। আমি বৃদ্ধের চোখেমুখে অস্বস্তির ও অস্থিরতার  চিহ্ন দেখি। নাকি ওটা আতঙ্ক? সে অনবরত কাশতে শুরু করে। কাশতে কাশতেই সে তার কুকুরকে ডাকে, “ টিলা, টিলা, এদিকে আয়। “

আমার গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা কুকুর একবার বৃদ্ধের মুখের  দিকে, একবার আমার মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু নড়ে না।

আমি আস্তে ওকে বৃদ্ধের মাথার কছে নামিয়ে দেই।

“দরজাটার দিকে একটু লক্ষ্য করবেন? আমি যাচ্ছি। টিলা আবার না পালায়।“

“না পালাবে না। তুমি দরজা হাট করে খুলে রেখে যাও। ও তবু যাবে না। আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না টিলা”। একটু চুপ করে থেকে বৃদ্ধ বলে, “ঘরে যা গরম! তুমি সত্যি সত্যি-ই দরজাটা খুলে রেখেই যাও। আমি পরে বন্ধ করে দেব। এ পাড়া বেশ সেইফ। তেমন ভয় নেই। তাছাড়া আছেই বা কী ঘরে যে চোর আসবে?”

আমি হিসেব করে দেখলাম, বুদবুদের মানুষ সমতুল্য বয়স এখন প্রায় পঁচাত্তর-আশি।  ওর-ও যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আমি বৃদ্ধের ঘরের সামনের দরজার দুটি পাট-ই টান টান খোলা রেখে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে আসি। বারান্দা থেকে ঘরের ভেতর একবার ফিরে তাকাই। স্বল্প আলোকে দেখি পা থেকে গলা পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা বৃদ্ধ  জোরে জোরে হাঁপানির দম নিচ্ছে। হাপড়ের মতো  বড় বড় নিঃশ্বাসের সঙ্গে বুকের পুরো খাঁচাটা প্রবল বেগে ওঠানামা করছে। আর শিয়রের কাছে বালিশের ওপর চুপ করে বসে আছে কুকুরটি।

সে এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। তাকে কোনকিছু দিয়ে কারো সাথে বেঁধে রাখা হয়নি। ঘরের  দরজাও বন্ধ নয়। তা সত্ত্বেও, খোলা দরজা পেয়েও, ঘর ছেড়ে পালাবার ব্যাপারে আজ কোনো আগ্রহ দেখা যায় না শিবা-ইনোর। এমনকি বহুদিন পরে বহু প্রত্যাশিত অথচ দুর্লভ এই সাক্ষাৎ লাভের পরেও নয়।

সন্ধ্যা নেমে আসছে। আমি ধীরে ধীরে ফুটপাথ ধরে আমার একমাত্র গন্তব্যের দিকে পা বাড়াই।


পূরবী বসু

পূরবী বসু বিজ্ঞানী, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। তাঁর গল্প, প্রবন্ধাবলি ও বিবিধ রচনা নারী-ভাবনা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনায় ঋদ্ধ। মুন্সীগঞ্জের সন্তান তিনি। শহরের এক জনপ্রিয় চিকিৎসকের কন্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ করেছেন। ফার্মেসিতে অনার্সসহ স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা। তারপর বিদেশ যাত্রা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। মেডিক্যাল কলেজ অভ পেনসিলভ্যানিয়া ও ইউনিভার্সিটি অভ মিসৌরি থেকে লাভ করেছেন। যথাক্রমে প্রাণ-রসায়নে এম.এস. ও পুষ্টিবিজ্ঞানে পিএইচ-ডি । বিজ্ঞানচর্চা তার পেশা। নিউইয়র্কের বিশ্ববিখ্যাত মেমােরিয়াল স্লোন কেটারিং ক্যান্সার সেন্টার গবেষণা ও কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনায় কেটেছে বেশ কিছুকাল । অজস্র গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে সারা বিশ্বের নানা নামী জার্নালে। দীর্ঘ বিদেশবাসের পর দেশে ফিরে আসেন এক খ্যাতনামা ঔষধ প্রস্তুত প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে। দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক-এ স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালকও ছিলেন পরবর্তীকালে । গত কয়েক বছরে তার নারী সম্পর্কিত রচনা নিয়ে কয়েকটি মননশীল গ্রন্থ বেরিয়েছে, যার মধ্যে নারী, সৃষ্টি ও বিজ্ঞান, ‘নােবেল বিজয়ী নারী’, ‘সাহিত্যে নােবেল বিজয়ী নারী’, ‘প্রাচ্যে পুরাতন নারী’, ‘আমার এ দেহখানি’ ও নারী, মাতৃত্ব ও সৃজনশীলতা উল্লেখযােগ্য।। তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্যে ২০০৫-এ তিনি অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১৪-এ কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

শেয়ার