শহরের কোথাও ভালো রান্না হচ্ছে না
আমাদের হেঁশেলের পায়ায় চাকা লাগিয়ে দিয়েছি
সে ঘুরে বেড়ায় গলিতে গলিতে
আর অদ্ভুত এক ঘ্রাণে
চাঙ্গা হয়ে ওঠে
শহরের মেজাজ
কয়েন
কে যেন লক্ষ লক্ষ কয়েন ছিটাচ্ছে হাইওয়ের উপর
কালো মোজাইকের ফ্লোরে
মেঘোত্তমার নাচ
তার ঘাঘরার ভিতর
উপচে উঠছে
তরঙ্গের রাগ
বাজছে সন্তুর
পত্র-পল্লবের পাশে
শেমিজের ফুলগুলি
ঢেঁকিঘরজুড়ে হাসি ছড়িয়ে পড়েছে, আতপ চালের ঘ্রাণে মগ্ন নিশিগঞ্জ,
পাড়ে পাড়ে নাচছে কোমর
কেউ বসে থাকে আকুতি জাপটে ধরে—মনের ছাপচিত্রে
পাল্টে যায় হারিকেনের আলো
শেমিজের ফুলগুলি ফুটতে শুরু করেছে— প্রচ্ছদতট থেকে শোনা যায়
মোহনদীর ধ্বনি
খাঁচায় চরকাটা হাঁস, একটু একটু করে শরীর বাঁকিয়ে দিচ্ছে
সংঘাতের দিকে
ঝোপের নিবিড়তা ধরে আসক্তির স্রোত
ঋতুরহস্যের ধারে
ঋতুরহস্যের ড্রাম ফাটতেছে কোথাও:
জলে ফুটতেছে বুদ্বুদ।
মেঘের সাথে রঙের দেখা
তটরেখা ধরে ফুল হলুদ হলুদ!
রেণু উড়তেছে হাওয়ায়
যে জুনিপোকারা ওড়ে মাঠে, ঘুরে ঘুরে
রাতের গূঢ় শরীরে বুনে দেয় আলো
রাতকালো নাকে যেন
জ্বলে তারা-নথ।
বাঁকে পথ চমকাল
মৃদু পায়ে হাঁটা—যে রমণীর যাওয়ায়,
তার শাড়ি জুড়ে আঁকা বনে বাওয়া লতা
শাদা শাদা ফুল
মাথা তুলে তুলে চায় ঘন সান্দ্রতায়
বর্তুল বর্তুল সে চাহনি
উঁচা-নিচা টিলা বেয়ে ম-ম করা বন
ঝিঁঝি গুঞ্জরন
অবনতপর ঘর
গুলগুলি বেয়ে চুয়ে পড়ে রোদ
সে কোনো সুবোধ সুকুমার মেয়ে,
খসা ঘোমটায় ঘরনি
ঘেমে ঘেমে ঝাড় দেয় তুলার তোশক
পুরান আলমারি,
চিনা ক্রোকারিজ ধুয়ে সাফ করে রাখে তাকে।
দাগ পড়ে যাওয়া ফ্রিজ
মোছে কত বাহারি আসবাব
কলাকৈবল্যের হাব
এ ভরা সংসার;
কুড়িয়ে কুড়িয়ে নিই
রূপ-রঙ-শোক।
শস্যের ডগায় নাচে ছায়াশিহরিত গেঁয়ো গান;
মৃদু মৃদু কম্পমান দুপুর হাওয়ায়
হাজারে হাজারে ঝরে
বর্ণাঢ্য শিমুল—শুধু ফুল আর ফুল
মেয়েদের কাপড়ের থানে
সুচারু গৃহসজ্জায়
রান্ধনে, গায়নে
কেউ রেখে যায় বাঁশি—গুনগুন সুর
স্মরণের বহু দূরে বাজে দুপুর-নূপুর।
সবুজ বরই পাতা ছুঁয়ে
গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে হাওয়া
যেন প্রান্ত ধরে
ঘোরানো পথের ’পরে নিকেল গলিত
তেরচা হয়ে থাকা আলো,
ঝিম মেরে থাকা আলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়
আনগ্ন শরীর;
সেই দেহমন্দিরার গানে
বাজছে ডালের নড়ায়
ফিনফিন ধ্বনি,
যেন মহাপথ ছিঁড়ে ছুটে আসা দূর
ছোট ছোট শ্বাসে ঘুম যায়
এত হালকা আওয়াজ
মৃদু রিনিঝিনি
সাজসজ্জাহীন সরণি;
ঘুমঘোরে ছাওয়া
বাজে কার দোরগোড়ায়
সংহত সিম্ফনি!
শুনি সন্ধ্যায় কাঁদতেছে পোকারা
ঘন কোনো সুরে
শিশুদের পড়াপড়ি হাওয়া বয়ে আনে
রাতের বাথানে।
ফোটে কখনো সুগন্ধ ফুল কোনো মর্মের সুদূরে
ঘরের আড়ার পাশে হেলে থাকে আনত ডালিয়া
ছাইপাঁশ আঁচড়ায় মা-হারা যে কুকুর
তার ফোঁপা স্বর হানে
মর্ম ছেদ করে কলিজা মথিয়া।
এ সবই শুনি বসে একা ঘাটলায়
সে সান্দ্র সন্ধ্যায়;
আকাশে দেখি নাই তারারা
হয়তো ছুটিতে গেছে আজ
নাকি ভাজে খই
মেঘের ওপাশে হাওয়া-মই বেয়ে
মনে হয় গেছে তারা
নতুন আসমানে
তাই আজ ছাইরঙা রাতের সাজগোজ
আমাকে ডেকেছে যেন কোনো মহাভোজ
দুঃখ ও বিরহের বিবাহে।
ফাঁপরে পড়া লোকের মতো মুখ ভার
সব অতিথির;
যেন এ তিথির সাথে জুতসই মিলে যায় আবহে।
ঝনৎ ঝনৎ বাজে কোনো বুনো রেলগাড়ি
বগি ছাড়া হয়ে
পুরানো ইঞ্জিন সারাইয়ের এ দোকানে
কানে মাকড়ি ছাড়া মেয়ে যথা হীন লাগে—
নিঝুম নিরল রাতে
মনে হয় বাড়ি
থম মেরে আছে
মৃত তারাদের কাছে
জীবন বসিয়া যায় কোনো এক ফুঁয়ে।
জলাজঙ্গলের কোণে থেমে গেছে ক্রমশিথিল পা
পিচ্ছিল কূলের কাছে যেন কেউ দেবে যায় ধীরে—
এই গূঢ় গহ্বরে ফোটে শাদা ফুল;
কার রত্নখনি থেকে জাগে
ঘন রূপবিভা-ঘ্রাণ!
হুইসেল বাজাবার আগে যাত্রীরা গোছায়
নিজ বাক্সপেটরা
ঠিক করে রাখে স্থান
সেভাবে রাত্রিরা পুঁতে রাখছে ধ্বনিপুঞ্জের ভাঁজে
মিহিমিহি সুর
কুঞ্জে কুঞ্জে যেন কোনো গোপন সিরিঞ্জে
পশে দেয় ঝিরিঝিরি গান;
এ ভরা ভোরের রূপ এসেছে গাভির
বাঁট বেয়ে,
এসেছে ফুলের ঘ্রাণে নেয়ে
বনবীথিকার নিচে
আশ্চর্য সূর্যোদয়ের পিছে
কেউ যেন পিচকারিতে ছিটিয়ে দিয়েছে
কাঁচি হলুদের রঙ;
হাওয়ায় হাওয়ায়
খালের পাড়ে সকালের আড়ং।
সে হরিদ্রা বর্ণে ভিজে লোকে হাটে যায়,
তারা গল্পে মাতে
বহু অনিশ্চয়তায় যাতে
মরিতে না হয়
যাতে এ চর্মশরীর বহু দুঃখসহ
হয়ে উঠতে পারে।
রোদে চা ডুবিয়ে খেয়ে
কাতারে কাতারে তারা নেমে পড়ে
পাথারে পাথারে;
সে গ্রীষ্মে পোড়া মাটির সাথে গড়ে
গাঢ় বসতি ও প্রীতি।
দুপুর-রোদে তাপায় স্মৃতি তারা বটবৃক্ষতলে
ঘষা কাঁসার থালায় খাওনের ছলে
বলে বহু যথাকথা,
বলে বহু বাক্সময় বচন।
নারীরা যতনে রাখে সেই সব পড়ে পাওয়া ধন
লতাপাতাজলে গাঁথা
যত উপকথা,
কুহু ও কথনে ভরা
জীবন সংহিতা
সেই স্রোত মনোহরা;
কর্ম ও কুশলে গড়া সেই শান্ত তীর
গভীর! গভীর!
বাসন ধোয়ার ধ্বনি ভেসে আসে রোদে;
যেন বাতাসের অনুরোধে
মেঘেদের শব্দে কাঁপে
কাচের পিরিচ।
নুয়ে পড়া আলো বাগানের নিচে প্রবাহিত খালে
যেকোনো আকালে
হাওয়াধ্বনিরোদ সঞ্জীবনী
সুধা।
এখানে পুরোধা ঘ্রাণ
নানা আকারের পুষ্পরেণু
রাঙিয়ে রেখেছে মাঠ গৃহিণীর কোল ছুঁয়ে আসা
নাচ প্রতিভার লাল ধেনু।
ওপারে পরম জমি, মাঝখানে খাল,
আয়ুর নরম ব্রিজ
লোকে পার হয় দুলে নিজ নিজ সীমা;
যেন কোনো নৌযান ভাসা
নিখিলের বিলে,
গানের রাগিণী ফোটে
এ দরাজ দিলে
ধ্বনিপথ ফুঁড়ে আসে অনন্তের দূর
পিপাসা মেটার ছলে লোকে পান করে
সরোদ নিঃসৃত সুর।
আভা
মৃত ফুলের ঝাড় থেকে খসে পড়ছে রোদ
এক অনুক্ত দুপুর
মেঘে নিপাট হয়ে আছে;
আমি তার সঙ্গী হই
এক হতশ্রী গাছের মতো বিগত গানগুলি
গেয়ে চলেছি
ডুবে থাকা বিল কিছু ধ্বনির যোগান দিয়ে যায়,
যখন মন্দ্র মুহূর্ত
ছিন্ন কোনো ঋতু ফুরিয়ে এসেছে এখানে,
যেন খসা ফল
স্রোতে বহুদূর ভেসে গেল;
তার আভাটুকু লেগে আছে এই এখানে
পাতায়, ডালে, স্মরণঘরের গোলায়।
কবি পরিচিতি
![]()
জন্ম : ২৭ আগস্ট, ১৯৮৫ খ্রি.
ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর
পড়াশোনা :
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পেশা:
প্রভাষক
বাংলা বিভাগ, সরকারি মুজিব কলেজ , নোয়াখালী
প্রকাশিত বই:
১। মেঘ ও ভবঘুরে খরগোশ [কবিতা, কা বুকস, ঢাকা, ২০১৫]
২। তামার তোরঙ্গ [কবিতা, জেব্রাক্রসিং প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৮]
৩। জড়োয়া [কবিতা, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ভারত, ২০১৯]
৪। শেমিজের ফুলগুলি [কবিতা, প্রিন্ট পোয়েট্রি, ঢাকা, ২০২০]
৫। ঋতুরহস্যের ধারে [কবিতা,ঐতিহ্য, ঢাকা, ২০২১]
পুরস্কার:
হিমেল বরকত কবিতা পুরস্কার ২০২০ [ শেমিজের ফুলগুলি কাব্যের জন্য]